সাহসী আরিফার সাহস ফুরায় না by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

রাজশাহীতে নিরাপত্তা নিবাসে ভালো আছে আরিফা। কোনো ভয় নেই, এই মুহূর্তে মাদক ব্যবসায়ীর হত্যার হুমকি নেই, কিন্তু ‘পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না’ এ কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলে সে। অনেকক্ষণ কথা বলতে পারে না। ওড়নায় চোখ মুছতে থাকে।


নিরাপত্তার অভাবে নিজ গ্রাম তানোরের নোনাপুকুর থেকে কিশোরী আরিফাকে ১১ জুন রাজশাহীতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা নিবাসে আনা হয়েছে।
নোনাপুকুর গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। আরিফা তানোরের কোয়েল উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। গ্রামের এই অবস্থা দেখে সে তার সহপাঠী ও স্থানীয় ১৫ জন কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে একটি মাদকবিরোধী গণগবেষণা দল গঠন করে। তাদের নিরবচ্ছিন্ন নজরদারিতে নোনাপুকুর গ্রামের মাদক ব্যবসা ব্যাহত হয়। এতে মাদক ব্যবসায়ীরা তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয়। মেয়েকে তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামানোর দায়ে আমিনুল ইসলাম নামের একজন মাদক ব্যবসায়ী আরিফার বাবা ও ভাইকে মারধর করে। তাঁদের ফসলের ক্ষতি করে। তার পরও আরিফার দল থেমে থাকেনি।
এক বছর আগের ঘটনা। আরিফার মাদকবিরোধী অভিযানে ক্ষিপ্ত হয়ে আমিনুল ইসলাম তাঁর ওপর হামলা চালান। আহত হয়ে আরিফাকে ১২ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। এ ঘটনায় মামলা হলে আমিনুল গ্রেপ্তার হন। তারপর জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি আবার মাদকের ব্যবসা শুরু করেন। আবার আরিফার দলের নজরদারি শুরু করে আমিনুল নানাভাবে অত্যাচার করতে থাকেন তাকে। এমনকি হত্যার হুমকি দেন। আরিফা তানোর থানায় অভিযোগ করেন। পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নিলে আরিফার বাবা-মা মেয়ের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ২ জুন তাকে তানোর পৌর এলাকায় কুঠিপাড়া মহল্লায় তার খালার বাড়িতে রেখে আসেন। এসব শুনে পাঁচন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মমিনুল হক দায়িত্ব নিয়ে আরিফাকে খালার বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন। স্থানীয় সালিসে আমিনুলকে সাবধান করা হলেও কাজ হয় না। সে আবার আরিফাকে শাসায়। আমিনুলের হুমকিতে আরিফা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) পরামর্শে থানায় যায়। কিন্তু পুলিশ আগের অভিযোগটিই সাধারণ ডায়েরি হিসেবে গ্রহণ করে প্রসিকিউশন দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে অনুমতি চেয়ে পঠিয়েছে। তার বেশি আপাতত পুলিশ কিছু করতে পারবে না বলে জানায়। আশ্রয়হীন আরিফা দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে কোথায় যাবে, কে তার নিরাপত্তা দেবে! খবর পেয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী দিল সেতারা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে নিরাপত্তা নিবাসে রেখেছেন। এরপর ১৪ জুন আরিফার নিরাপত্তা ও আমিনুলকে গ্রেপ্তারের দাবিতে স্থানীয় ১০টি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তানোরে মানববন্ধন করেছে। তার পরও আমিনুল বহালতবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আরিফা নিরাপত্তা নিবাসে।
১৭ জুন দুপুরে রাজশাহীতে নিরাপত্তা নিবাসে গিয়ে আরিফাকে দেখে অবাক হতে হয়। আরিফা একটুও ভেঙে পড়েনি। মাদকবিরোধী আন্দোলন থেকে সরে আসবে কি না জানতে চাইলে সে মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়প্রত্যয়ের কথা জানায়। আরিফার কথা, ‘তার একটা জীবনের বিনিময়ে যদি গ্রাম মাদকমুক্ত হয়, তাও ভালো। কিন্তু আজকে সে আন্দোলন ছেড়ে দেবে, কালকে ওই ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে তার ভাইটিই যদি নেশায় জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার পরিবারের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। সে তা হতে দেবে না।’
নিরাপত্তা নিবাসের সহকারী পরিচালক শবনাম শিরিন বলেন, ‘মেয়েটি এখানে আসার একদিন পরেই আবার গ্রামে যেতে চাইছিল।’ তাঁরা তাকে ছেড়ে দেওয়ার সাহস করেননি। তিনি বলেন, তিনি আরিফাকে বুঝিয়েছেন, আগে তো জীবন, তারপরে স্কুল, পড়োশোনা এবং তারও পরে মাদকবিরোধী আন্দোলন।

No comments

Powered by Blogger.