মিডিয়া ভাবনা-পাঠকের কাছেই সংবাদপত্রের জবাবদিহি by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
২১ অক্টোবর প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা’ বিষয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনার সূত্র ধরে সংবাদপত্রে ব্যাপকভাবে লেখালেখি এবং বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনার আয়োজন করা উচিত।
বিশেষ করে দেশের যত টিভি চ্যানেল, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাব, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ ও নাগরিক সমাজ এই আলোচনার সূত্র ধরে আলোচনাকে এগিয়ে নিতে পারে। এ দায়িত্ব একা প্রথম আলোর নয়।
প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকটি আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, এ বৈঠকে তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, বিভিন্ন টিভি ও রেডিও চ্যানেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কলামিস্ট ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। ঢাকার কোনো গোলটেবিল আলোচনায় জাতীয় দৈনিকের এত সম্পাদককে অংশ নিতে আমি এর আগে দেখিনি। অংশগ্রহণকারীদের ওপরই গোলটেবিল আলোচনার গুরুত্ব ও সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে।
এই আলোচনায় বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়েছে। আমি এ নিবন্ধে শুধু কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
১. ঢাকার কোনো কোনো দৈনিক সংবাদপত্রে মাঝেমধ্যে প্রতিবেদনের বস্তুনিষ্ঠতা দেখা যায় না। তথ্য ও পরিসংখ্যানের সূত্র থাকে না। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে, সেই পক্ষের কোনো বক্তব্য থাকে না। অনেক প্রতিবেদক নিজের মন্তব্য ও মতামতের মিশেল দিয়ে প্রতিবেদন লেখেন। শুধু লোকমুখে শোনা তথ্যের ভিত্তিতে অনেক প্রতিবেদন ছাপা হয়। ক্রসড চেক করার প্রয়োজনীয়তা অনেকে অনুভব করেন না। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট দেখারও প্রয়োজন বোধ করেন না। এঁরা হচ্ছেন সত্যিকার অর্থে ‘স্বাধীন সাংবাদিক’। এসব পত্রিকার সম্পাদকও ‘স্বাধীন’। এ ধরনের ‘স্বাধীনতা’ থেকে সংবাদপত্রকে রক্ষা করতে হবে।
২. অনেকের ধারণা, যাঁরা কলাম লেখেন, তাঁরা আরও স্বাধীন। তাঁরা যা খুশি, তা লিখতে পারেন। এ ধারণা ঠিক নয়। এ ব্যাপারেও সম্পাদককে সচেতন হতে হবে। কলাম লেখক শুধু তাঁর মতামতের ব্যাপারে স্বাধীন, তথ্যের ব্যাপারে নন। কলাম লেখককে তথ্য, পরিসংখ্যান বা উদ্ধৃতি ব্যবহারে সূত্র উল্লেখ করতে হবে। তখন পাঠক বুঝতে পারবেন, তথ্যটা কতটা নির্ভরযোগ্য।
কোনো কোনো কলাম লেখক প্রায়ই ‘আমরা’ লেখেন। এই ‘আমরা’ কারা? কলাম তো ব্যক্তির চিন্তা ও বিশ্লেষণ। তাহলে ‘আমরা’ কারা? ‘আমরা’ ব্যবহূত হয় শুধু ‘সম্পাদকীয়তে’। এখানে ‘আমরা’ মানে ওই পত্রিকার নীতি বা অবস্থান। পত্রিকার সম্পাদক যখন স্বনামে কলাম লেখেন, তখন তিনি ‘আমরা’ ব্যবহার করতে পারেন। কারণ, তিনি পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব করছেন।
৩. সরকারি দল, মন্ত্রী ও এমপিরা সব সময় স্বাধীন সংবাদপত্রকে ভয় পান। কারণ, তাঁরা ক্ষমতায়। তাঁদের নানা কাজ করতে হয়। কাজ করলে ভুল হতেই পারে। একই সঙ্গে তাঁদের মধ্যে অনেকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে যুক্ত হয়ে পড়েন। ওটাও একটা ভয়। সরকারের ব্যর্থ ও দুর্নীতিবাজ এমপি-মন্ত্রীরা স্বাধীন সংবাদপত্রকে তাই ভয় পান। তাই তাঁরা নানা অপবাদ দেন। দক্ষ, সৎ এমপি-মন্ত্রীরা কিন্তু সংবাদপত্রকে ভয় পান না। দুর্নীতিবাজদের এই চাপের মুখে সংবাদপত্রকে তার দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকতে হবে।
আজকাল ভাড়াটে লোক দিয়ে নানা মানববন্ধন আয়োজন করা হচ্ছে। এসব দুর্নীতিবাজ জানে না, ভিন্ন ব্যানার নিয়েও মানববন্ধন করা যায়। সবার রুচিতে সব কাজ করা সম্ভব হয় না। মানববন্ধন দিয়ে স্বাধীন সংবাদপত্রকে বাধা দেওয়া সম্ভব হবে না।
৪. কালো টাকার মালিকদেরও একটা চাপ এসেছে স্বাধীন সংবাদপত্রের ওপর। আজকাল অনেকের কাছেই কালো টাকার পাহাড়। তাঁরা দৈনিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ইত্যাদিতে মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁরা অনেক সাংবাদিককে দলে ভেড়াচ্ছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না। স্বাধীন সংবাদপত্রগুলো তাঁদের স্বরূপ উন্মোচনে এখন অনেক তৎপর। আদর্শ, নৈতিকতা ও পেশাদারির কাছে কালো টাকা কখনো জয়লাভ করেনি।
৫. দুর্নীতিবাজ এমপি, মন্ত্রী ও কালো টাকার মালিকেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছেন স্বাধীন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে। কারণ, তাঁরা কালো টাকা দিয়ে পুলিশ থেকে শুরু করে অনেক কিছু কিনতে পেরেছেন। দেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কেও এখন জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, ‘উচ্চ আদালতে হাওয়া বুঝে রায় দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘দেশে এখন বিএনপি কোর্ট বা আওয়ামী কোর্ট সৃষ্টি হয়েছে।’ (সূত্র: সংবাদপত্র)। কালো টাকার এ চক্রটি শুধু স্বাধীন গণমাধ্যমকে এখনো কিনতে পারেনি। তাই তারা নির্বিবাদে তাদের অপকর্ম চালাতে পারছে না। কালো টাকার এই চাপ থেকেও স্বাধীন সংবাদপত্রকে বেঁচে থাকতে হবে শুধু পাঠকের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কারণে।
৬. মিডিয়া নিয়ে একটা সমস্যা হলো, মিডিয়ার হাতে কলম বা ক্যামেরা থাকায় সে স্বাধীন। কলম বা ক্যামেরা দিয়ে কাউকে সে ওপরে ওঠাচ্ছে, কাউকে নিচে নামাচ্ছে। কাউকে অকারণে প্রশংসা করছে, কাউকে নিন্দায় ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। এটা কিন্তু মিডিয়ার দায়িত্ব নয়। মিডিয়া কখনো তার কলম বা ক্যামেরার অপব্যবহার করার কথা নয়। মিডিয়ার প্রধান শর্ত হলো, সে সত্য ছাড়া আর কোনো কিছুকে স্থান দেবে না। কিন্তু বাস্তবে অনেক মিডিয়ায় তা পাওয়া যায় না। অসত্য তথ্য ও মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে অনেক মিডিয়াই প্রতিবেদন প্রকাশ বা প্রচার করছে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
মিডিয়ার একটা ক্ষুদ্র অংশ এ রকম কলুষিত হওয়ার প্রধান কারণ হলো, আমাদের দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সব ক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, কালো টাকার দাপট, কিছু সাংবাদিকের অর্থের প্রতি লোভ, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন, সম্পাদক ও সাংবাদিকের যোগ্যতার অভাব ইত্যাদি। কয়েকজন সাংবাদিক বা কয়েকটি সংবাদপত্রের এই কলুষিত ভূমিকা মেনে নেওয়া যায় না। তাঁদের জন্য সমগ্র পেশার বদনাম হচ্ছে। কাজেই তাঁদের এই অনৈতিক লেখালেখির জন্য পাঠক যেন ‘প্রেস কাউন্সিলে’ গিয়ে সুবিচার পেতে পারেন, সে জন্য প্রেস কাউন্সিলকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রমাণহীন অভিযোগ বা ভুল তথ্য প্রমাণিত হলে তা প্রকাশের জন্য সম্পাদক ও সাংবাদিককে অর্থদণ্ডসহ নানা রকম দণ্ডের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দণ্ডের খবরটি সংবাদপত্রে ছবিসহ ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সাংবাদিকের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড এক বা দুই বছরের জন্য স্থগিত, তিনবার স্থগিত হলে আজীবনের জন্য বাতিল ইত্যাদি দণ্ডের ব্যবস্থা থাকতে হবে। শুধু ‘মৃদু ভর্ৎসনা’ করলে কোনো ফল হবে না। এ রকম অপসাংবাদিকতা চলতেই থাকবে।
৭. বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের জার্নাল নিরীক্ষা আদর্শ সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠায় একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন—প্রতি সংখ্যায় প্রধান প্রধান দৈনিকের পক্ষপাতদুষ্ট, অপর পক্ষের বক্তব্য ছাড়া, সূত্র ছাড়া, সাংবাদিকের মতামত-মন্তব্যসহ যেসব ‘রিপোর্ট’ ছাপা হয়েছে, তার তালিকা ও সম্পাদকের মতামত প্রকাশ করা যায়। এভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহারকারীদের স্বরূপ উন্মোচন করা উচিত। নিরীক্ষাকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রতিবেদনও প্রকাশ করা যেতে পারে। এভাবে সংবাদপত্রের দূষিত চক্রটিকে পাঠকসমাজ চিনতে পারবে। তবে অবশ্যই এর পাশাপাশি অনুসন্ধানী ও মানসম্পন্ন প্রতিবেদন ও প্রতিবেদককে প্রেস ইনস্টিটিউট নানাভাবে পুরস্কৃত করতে পারে। নবীন সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার ছাত্ররা ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ দুই ধরনের প্রতিবেদন থেকেই নির্দেশনা লাভ করতে পারবেন।
৮. প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে আরেকটি কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। তা হলো, ‘সংবাদপত্রের প্রধান দায়বদ্ধতা পাঠকের প্রতি’। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, পাঠকই সংবাদপত্রের প্রধান বিচারক। তথ্য মন্ত্রণালয়, প্রেস কাউন্সিল বা প্রেস ইনস্টিটিউট কেউ নয়। পাঠকের কাছে প্রতিদিন সংবাদপত্রকে পরীক্ষা দিতে হয়। বাজারে নিত্যনতুন পত্রিকা আসছে। পাঠক এতটুকু অতৃপ্ত হলেই অন্য পত্রিকা কিনবেন। পাঠককে তৃপ্তি দেওয়ার জন্য প্রতিটি সংবাদপত্র সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। কাজেই কোনো পত্রিকা গণতন্ত্রবিরোধী হলে, কোনো বিশেষ ‘নেত্রী’বিরোধী হলে গণতন্ত্রমনা পাঠক বা ওই নেত্রীর অনুরাগীরা ওই সংবাদপত্র আর পড়বেন না। কাজেই মানববন্ধন করে এই দাবি জানানোর প্রয়োজন হবে না। পাঠকই গণতন্ত্রবিরোধী পত্রিকাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন। যদি দেখা যায়, অভিযুক্ত পত্রিকার সার্কুলেশন দিন দিন বাড়ছে, তাহলে বুঝতে হবে, মানববন্ধনের অভিযোগে পাঠক সাড়া দেননি। পাঠক কিন্তু নিজের টাকা দিয়ে প্রতিদিন পত্রিকা কেনেন। রাজনীতিতে ‘ভাড়াটে লোক’ থাকতে পারে (বা আছেও), কিন্তু ‘ভাড়াটে পাঠক’ বলে কিছু নেই।
৯. পত্রিকার সার্কুলেশন বা প্রকৃত পাঠকসংখ্যা জানার কোনো বিশ্বাসযোগ্য উপায় আমাদের দেশে নেই। পত্রিকার দাবিই সবাইকে মেনে নিতে হচ্ছে। এটা সব সময় ঠিক নয়। তা ছাড়া পত্রিকার মুদ্রণ কপি আর পাঠকসংখ্যা কিন্তু এক নয়। শুনেছি, আজকাল নতুন পত্রিকাগুলো ঢাকাসহ সারা দেশের অভিজাত আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক হাউসে ফ্রি বিলি করছে (আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই)। এ ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই পত্রিকার সার্কুলেশন সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেওয়ার একটা মেকানিজম বের করা দরকার। এ ব্যাপারে তথ্যমন্ত্রী কি কিছু করবেন? হলুদ সাংবাদিকতা বা অতি সস্তা পত্রিকাগুলোকে একই মানদণ্ডে আনা ঠিক হবে না। হলুদ ও সস্তা পত্রিকার পৃথক একটা মানদণ্ড থাকতে হবে।
পাঠককে ঠকিয়ে বা বিভ্রান্ত করে আজ পর্যন্ত কোনো পত্রিকা বড় হতে পারেনি। কাজেই পাঠকের কাছে জবাবদিহি বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
১০. সংবাদপত্রের ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিতভাবে করণীয় কিছু নেই। নিউজপ্রিন্টের শুল্ক প্রত্যাহার, সরকারি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়ানো, কিছু নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয় তথ্য মন্ত্রণালয় দেখতে পারে। প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ইনস্টিটিউট, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠান সাংবাদিক ও টিভির কর্মীদের পেশাগত চাহিদা পূরণ করতে পারছে কি না, তার ওপর নজরদারি করা তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটা বড় দায়িত্ব। এ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি মিডিয়া-জগতে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে, এ ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ। নিজেদের দায়িত্ব তথ্য মন্ত্রণালয় যদি ঠিকমতো করতে না পারে, তাহলে ‘বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা’ বা অন্যান্য বিষয়ে সাংবাদিকদের উপদেশ দেওয়া তথ্যমন্ত্রীর মানায় না।
আজ এ পর্যন্ত। প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকের সূত্র ধরে আরও এক কিস্তি লেখার ইচ্ছে রইল।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।
প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকটি আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, এ বৈঠকে তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, বিভিন্ন টিভি ও রেডিও চ্যানেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কলামিস্ট ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। ঢাকার কোনো গোলটেবিল আলোচনায় জাতীয় দৈনিকের এত সম্পাদককে অংশ নিতে আমি এর আগে দেখিনি। অংশগ্রহণকারীদের ওপরই গোলটেবিল আলোচনার গুরুত্ব ও সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে।
এই আলোচনায় বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়েছে। আমি এ নিবন্ধে শুধু কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
১. ঢাকার কোনো কোনো দৈনিক সংবাদপত্রে মাঝেমধ্যে প্রতিবেদনের বস্তুনিষ্ঠতা দেখা যায় না। তথ্য ও পরিসংখ্যানের সূত্র থাকে না। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে, সেই পক্ষের কোনো বক্তব্য থাকে না। অনেক প্রতিবেদক নিজের মন্তব্য ও মতামতের মিশেল দিয়ে প্রতিবেদন লেখেন। শুধু লোকমুখে শোনা তথ্যের ভিত্তিতে অনেক প্রতিবেদন ছাপা হয়। ক্রসড চেক করার প্রয়োজনীয়তা অনেকে অনুভব করেন না। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট দেখারও প্রয়োজন বোধ করেন না। এঁরা হচ্ছেন সত্যিকার অর্থে ‘স্বাধীন সাংবাদিক’। এসব পত্রিকার সম্পাদকও ‘স্বাধীন’। এ ধরনের ‘স্বাধীনতা’ থেকে সংবাদপত্রকে রক্ষা করতে হবে।
২. অনেকের ধারণা, যাঁরা কলাম লেখেন, তাঁরা আরও স্বাধীন। তাঁরা যা খুশি, তা লিখতে পারেন। এ ধারণা ঠিক নয়। এ ব্যাপারেও সম্পাদককে সচেতন হতে হবে। কলাম লেখক শুধু তাঁর মতামতের ব্যাপারে স্বাধীন, তথ্যের ব্যাপারে নন। কলাম লেখককে তথ্য, পরিসংখ্যান বা উদ্ধৃতি ব্যবহারে সূত্র উল্লেখ করতে হবে। তখন পাঠক বুঝতে পারবেন, তথ্যটা কতটা নির্ভরযোগ্য।
কোনো কোনো কলাম লেখক প্রায়ই ‘আমরা’ লেখেন। এই ‘আমরা’ কারা? কলাম তো ব্যক্তির চিন্তা ও বিশ্লেষণ। তাহলে ‘আমরা’ কারা? ‘আমরা’ ব্যবহূত হয় শুধু ‘সম্পাদকীয়তে’। এখানে ‘আমরা’ মানে ওই পত্রিকার নীতি বা অবস্থান। পত্রিকার সম্পাদক যখন স্বনামে কলাম লেখেন, তখন তিনি ‘আমরা’ ব্যবহার করতে পারেন। কারণ, তিনি পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব করছেন।
৩. সরকারি দল, মন্ত্রী ও এমপিরা সব সময় স্বাধীন সংবাদপত্রকে ভয় পান। কারণ, তাঁরা ক্ষমতায়। তাঁদের নানা কাজ করতে হয়। কাজ করলে ভুল হতেই পারে। একই সঙ্গে তাঁদের মধ্যে অনেকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে যুক্ত হয়ে পড়েন। ওটাও একটা ভয়। সরকারের ব্যর্থ ও দুর্নীতিবাজ এমপি-মন্ত্রীরা স্বাধীন সংবাদপত্রকে তাই ভয় পান। তাই তাঁরা নানা অপবাদ দেন। দক্ষ, সৎ এমপি-মন্ত্রীরা কিন্তু সংবাদপত্রকে ভয় পান না। দুর্নীতিবাজদের এই চাপের মুখে সংবাদপত্রকে তার দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকতে হবে।
আজকাল ভাড়াটে লোক দিয়ে নানা মানববন্ধন আয়োজন করা হচ্ছে। এসব দুর্নীতিবাজ জানে না, ভিন্ন ব্যানার নিয়েও মানববন্ধন করা যায়। সবার রুচিতে সব কাজ করা সম্ভব হয় না। মানববন্ধন দিয়ে স্বাধীন সংবাদপত্রকে বাধা দেওয়া সম্ভব হবে না।
৪. কালো টাকার মালিকদেরও একটা চাপ এসেছে স্বাধীন সংবাদপত্রের ওপর। আজকাল অনেকের কাছেই কালো টাকার পাহাড়। তাঁরা দৈনিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ইত্যাদিতে মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁরা অনেক সাংবাদিককে দলে ভেড়াচ্ছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না। স্বাধীন সংবাদপত্রগুলো তাঁদের স্বরূপ উন্মোচনে এখন অনেক তৎপর। আদর্শ, নৈতিকতা ও পেশাদারির কাছে কালো টাকা কখনো জয়লাভ করেনি।
৫. দুর্নীতিবাজ এমপি, মন্ত্রী ও কালো টাকার মালিকেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছেন স্বাধীন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে। কারণ, তাঁরা কালো টাকা দিয়ে পুলিশ থেকে শুরু করে অনেক কিছু কিনতে পেরেছেন। দেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কেও এখন জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, ‘উচ্চ আদালতে হাওয়া বুঝে রায় দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘দেশে এখন বিএনপি কোর্ট বা আওয়ামী কোর্ট সৃষ্টি হয়েছে।’ (সূত্র: সংবাদপত্র)। কালো টাকার এ চক্রটি শুধু স্বাধীন গণমাধ্যমকে এখনো কিনতে পারেনি। তাই তারা নির্বিবাদে তাদের অপকর্ম চালাতে পারছে না। কালো টাকার এই চাপ থেকেও স্বাধীন সংবাদপত্রকে বেঁচে থাকতে হবে শুধু পাঠকের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কারণে।
৬. মিডিয়া নিয়ে একটা সমস্যা হলো, মিডিয়ার হাতে কলম বা ক্যামেরা থাকায় সে স্বাধীন। কলম বা ক্যামেরা দিয়ে কাউকে সে ওপরে ওঠাচ্ছে, কাউকে নিচে নামাচ্ছে। কাউকে অকারণে প্রশংসা করছে, কাউকে নিন্দায় ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। এটা কিন্তু মিডিয়ার দায়িত্ব নয়। মিডিয়া কখনো তার কলম বা ক্যামেরার অপব্যবহার করার কথা নয়। মিডিয়ার প্রধান শর্ত হলো, সে সত্য ছাড়া আর কোনো কিছুকে স্থান দেবে না। কিন্তু বাস্তবে অনেক মিডিয়ায় তা পাওয়া যায় না। অসত্য তথ্য ও মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে অনেক মিডিয়াই প্রতিবেদন প্রকাশ বা প্রচার করছে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
মিডিয়ার একটা ক্ষুদ্র অংশ এ রকম কলুষিত হওয়ার প্রধান কারণ হলো, আমাদের দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সব ক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, কালো টাকার দাপট, কিছু সাংবাদিকের অর্থের প্রতি লোভ, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন, সম্পাদক ও সাংবাদিকের যোগ্যতার অভাব ইত্যাদি। কয়েকজন সাংবাদিক বা কয়েকটি সংবাদপত্রের এই কলুষিত ভূমিকা মেনে নেওয়া যায় না। তাঁদের জন্য সমগ্র পেশার বদনাম হচ্ছে। কাজেই তাঁদের এই অনৈতিক লেখালেখির জন্য পাঠক যেন ‘প্রেস কাউন্সিলে’ গিয়ে সুবিচার পেতে পারেন, সে জন্য প্রেস কাউন্সিলকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রমাণহীন অভিযোগ বা ভুল তথ্য প্রমাণিত হলে তা প্রকাশের জন্য সম্পাদক ও সাংবাদিককে অর্থদণ্ডসহ নানা রকম দণ্ডের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দণ্ডের খবরটি সংবাদপত্রে ছবিসহ ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সাংবাদিকের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড এক বা দুই বছরের জন্য স্থগিত, তিনবার স্থগিত হলে আজীবনের জন্য বাতিল ইত্যাদি দণ্ডের ব্যবস্থা থাকতে হবে। শুধু ‘মৃদু ভর্ৎসনা’ করলে কোনো ফল হবে না। এ রকম অপসাংবাদিকতা চলতেই থাকবে।
৭. বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের জার্নাল নিরীক্ষা আদর্শ সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠায় একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন—প্রতি সংখ্যায় প্রধান প্রধান দৈনিকের পক্ষপাতদুষ্ট, অপর পক্ষের বক্তব্য ছাড়া, সূত্র ছাড়া, সাংবাদিকের মতামত-মন্তব্যসহ যেসব ‘রিপোর্ট’ ছাপা হয়েছে, তার তালিকা ও সম্পাদকের মতামত প্রকাশ করা যায়। এভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহারকারীদের স্বরূপ উন্মোচন করা উচিত। নিরীক্ষাকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রতিবেদনও প্রকাশ করা যেতে পারে। এভাবে সংবাদপত্রের দূষিত চক্রটিকে পাঠকসমাজ চিনতে পারবে। তবে অবশ্যই এর পাশাপাশি অনুসন্ধানী ও মানসম্পন্ন প্রতিবেদন ও প্রতিবেদককে প্রেস ইনস্টিটিউট নানাভাবে পুরস্কৃত করতে পারে। নবীন সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার ছাত্ররা ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ দুই ধরনের প্রতিবেদন থেকেই নির্দেশনা লাভ করতে পারবেন।
৮. প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে আরেকটি কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। তা হলো, ‘সংবাদপত্রের প্রধান দায়বদ্ধতা পাঠকের প্রতি’। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, পাঠকই সংবাদপত্রের প্রধান বিচারক। তথ্য মন্ত্রণালয়, প্রেস কাউন্সিল বা প্রেস ইনস্টিটিউট কেউ নয়। পাঠকের কাছে প্রতিদিন সংবাদপত্রকে পরীক্ষা দিতে হয়। বাজারে নিত্যনতুন পত্রিকা আসছে। পাঠক এতটুকু অতৃপ্ত হলেই অন্য পত্রিকা কিনবেন। পাঠককে তৃপ্তি দেওয়ার জন্য প্রতিটি সংবাদপত্র সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। কাজেই কোনো পত্রিকা গণতন্ত্রবিরোধী হলে, কোনো বিশেষ ‘নেত্রী’বিরোধী হলে গণতন্ত্রমনা পাঠক বা ওই নেত্রীর অনুরাগীরা ওই সংবাদপত্র আর পড়বেন না। কাজেই মানববন্ধন করে এই দাবি জানানোর প্রয়োজন হবে না। পাঠকই গণতন্ত্রবিরোধী পত্রিকাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন। যদি দেখা যায়, অভিযুক্ত পত্রিকার সার্কুলেশন দিন দিন বাড়ছে, তাহলে বুঝতে হবে, মানববন্ধনের অভিযোগে পাঠক সাড়া দেননি। পাঠক কিন্তু নিজের টাকা দিয়ে প্রতিদিন পত্রিকা কেনেন। রাজনীতিতে ‘ভাড়াটে লোক’ থাকতে পারে (বা আছেও), কিন্তু ‘ভাড়াটে পাঠক’ বলে কিছু নেই।
৯. পত্রিকার সার্কুলেশন বা প্রকৃত পাঠকসংখ্যা জানার কোনো বিশ্বাসযোগ্য উপায় আমাদের দেশে নেই। পত্রিকার দাবিই সবাইকে মেনে নিতে হচ্ছে। এটা সব সময় ঠিক নয়। তা ছাড়া পত্রিকার মুদ্রণ কপি আর পাঠকসংখ্যা কিন্তু এক নয়। শুনেছি, আজকাল নতুন পত্রিকাগুলো ঢাকাসহ সারা দেশের অভিজাত আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক হাউসে ফ্রি বিলি করছে (আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই)। এ ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই পত্রিকার সার্কুলেশন সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেওয়ার একটা মেকানিজম বের করা দরকার। এ ব্যাপারে তথ্যমন্ত্রী কি কিছু করবেন? হলুদ সাংবাদিকতা বা অতি সস্তা পত্রিকাগুলোকে একই মানদণ্ডে আনা ঠিক হবে না। হলুদ ও সস্তা পত্রিকার পৃথক একটা মানদণ্ড থাকতে হবে।
পাঠককে ঠকিয়ে বা বিভ্রান্ত করে আজ পর্যন্ত কোনো পত্রিকা বড় হতে পারেনি। কাজেই পাঠকের কাছে জবাবদিহি বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
১০. সংবাদপত্রের ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিতভাবে করণীয় কিছু নেই। নিউজপ্রিন্টের শুল্ক প্রত্যাহার, সরকারি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়ানো, কিছু নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয় তথ্য মন্ত্রণালয় দেখতে পারে। প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ইনস্টিটিউট, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠান সাংবাদিক ও টিভির কর্মীদের পেশাগত চাহিদা পূরণ করতে পারছে কি না, তার ওপর নজরদারি করা তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটা বড় দায়িত্ব। এ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি মিডিয়া-জগতে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে, এ ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ। নিজেদের দায়িত্ব তথ্য মন্ত্রণালয় যদি ঠিকমতো করতে না পারে, তাহলে ‘বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা’ বা অন্যান্য বিষয়ে সাংবাদিকদের উপদেশ দেওয়া তথ্যমন্ত্রীর মানায় না।
আজ এ পর্যন্ত। প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকের সূত্র ধরে আরও এক কিস্তি লেখার ইচ্ছে রইল।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।
No comments