সহজিয়া কড়চা-নির্বাচিত সরকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কয়েক মাসে ভারত থেকে বহু বড় বড় ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশ সফর করেন। ভারতের প্রত্যক্ষ সামরিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ হওয়ায় ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন। তাঁরা দেখছিলেন, নতুন রাষ্ট্র কোন পথে চলে।
অনভিজ্ঞতা ও আবেগের বশে বাম দিকে বেশি ঝুঁকতে গিয়ে হোঁচট না খায়। ভারত একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় সেখানকার নেতারা মনে করছিলেন, বাংলাদেশ যতই সমাজতন্ত্রের কথা বলুক, শেষ পর্যন্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের পথেই থাকবে।
১৯৭২-৭৩-এর দিকে ভারতের বহু বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা বেঁচে ছিলেন এবং সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতে। তত্ত্বগত ও বাস্তব রাজনীতি—দুই দিকেই তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল। অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে বাংলার মুজাফ্ফর আহমদ, উত্তর ভারতের পি সি জোশি, মুম্বাইয়ের এস এ ডাঙ্গে, পাঞ্জাবের গোলাম হোসেন, তামিলনাড়ুর এস চেত্তিয়ার, কেরালার ই এস এস নাম্বুদিরিপাদ, শওকত উসমানী প্রমুখ সাধারণ মানুষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। এস এ ডাঙ্গে, ড. জি অধিকারী প্রমুখ রাজনৈতিক লেখালেখি ও সম্পাদনার কাজে দক্ষতার পরিচয় দেন। সেকালের অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতার রাজনৈতিক জীবনের শুরু গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে। বহুদিন তাঁরা কংগ্রেসে কাজ করেছেন। ডাঙ্গের একটি বই গান্ধী ভার্সাস লেনিন সেকালে খুব নাম করেছিল। তিনি সম্পাদনা করেছেন সোশ্যালিস্ট পত্রিকা। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে ডাঙ্গে ছিলেন একটি স্তম্ভ।
স্বাধীনতার কয়েক মাস পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি অথবা ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আমন্ত্রণে কমরেড ডাঙ্গে ঢাকায় আসেন। পল্টন ময়দানের এক সম্মেলনে তিনি ভাষণও দেন। সিপিবির নেতা কমরেড মণি সিংহ সম্ভবত কিছুটা আবেগের বশেই বলেছিলেন: বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর ১৬তম সমাজতান্ত্রিক দেশ।
কমরেড ডাঙ্গের কানে গিয়ে কথাটা লাগে। তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, আপনাদের উচিত হবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। টেকসই গণতন্ত্র যদি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা হলে বহু সামাজিক অসাম্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে আসবে। তিনি অবশ্য কথাটি হুকুমের ভঙ্গিতে নয়, বন্ধুসুলভ পরামর্শ হিসেবে বলেছিলেন। প্রাজ্ঞ নেতা খুব ভালোই জানতেন, বাংলাদেশের নেতারা তাঁদের পশুটির লেজ আগে কাটবেন না গলা আগে কাটবেন—তা স্রেফ তাঁদের ব্যাপার। তা নিয়ে তাঁর নাক গলানো তাঁরা পছন্দ করবেন না।
হোটেল পূর্বাণীতে অবস্থানকালে কমরেড ডাঙ্গের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বাঘা বাঘা নেতা ও তাঁদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান যুবনেতাদের কেউ যে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তা মনে পড়ে না। আমাদের মতো বাম বলয়ের ছেলে-ছোকরাগোছের মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি সোজা দিল্লিতে রওনা হন। তাঁর থাকা-খাওয়ার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে আমাদের অগ্রজপ্রতিম বন্ধু দুই বছর আগে, নিজের ঘরে বিস্ফোরণ দুর্ঘটনায় নিহত নুরুল ইসলাম বিশেষ দৃষ্টি রাখেন। তবে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল।
বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল সমাজতন্ত্রের নামে যা করে থাকে, তা অন্য জিনিস। গণতান্ত্রিক দলের পক্ষে সদিচ্ছা থাকলে শুধু গণতন্ত্রটাই ঠিকঠাক মতো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সে কাজটিও ঠিকমতো হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ডিগ্রি নেওয়া নেতারাও মনে করেন, বহু টাকা খরচ করে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করাই গণতন্ত্র। এবং বিজয়ী দলই যা খুশি বলার এবং যা খুশি করার অধিকারী। সরকারের বাইরের দলের নেতারা মনে করেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। কোনো কায়দায় ভবিষ্যতে ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো ছাড়া তাঁদের আর কোনো কাজ নেই। একেবারে কাজ নেই—তা বলা যায় না। নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা করা তাঁদের অবশ্যকরণীয়।
গণতন্ত্র যে শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন নয়, গণতন্ত্র একটি মহান রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা, তা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নেতারা মনে করেন বলে মনে হয় না। গণতন্ত্র সেই ধরনের রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা, যার শিক্ষা হলো: প্রত্যেকের মতামতের প্রতি প্রত্যেকের শ্রদ্ধা প্রদর্শন। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে আঙ্গুরপোতা বা উখিয়ার একজন মানুষও যদি একটি মতামত দেন, তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশের অধিকার নেই গোটা দেশের ১৪,৯৯,৯৯,৯৯৯ মানুষের। এবং তাঁকে তাঁর মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তবে তাঁর সঙ্গে গোটা দেশের মানুষ ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারে।
কোনো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-নেতাদের এক রকমের দায়িত্ব। কিন্তু পরবর্তী কালের প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতাদের দায়দায়িত্ব বিরাট। আধুনিক গণতন্ত্রের পথপ্রদর্শক যুক্তরাষ্ট্রের নেতা ওয়াশিংটন-জেফারসনরা এক রকম ভূমিকা পালন করে ইতিহাসে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন। তাঁদের পরবর্তী নেতারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আরও বহু দূর।
প্রাজ্ঞ নেতারা জাতির মধ্যে একটি চেতনা ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করেন। যেমন করেছিলেন কুড়ি শতকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট। তাঁর শাসনকালকে বলা হয় ‘প্রগতিশীল যুগ’ বা ‘প্রগ্রেসিভ এরা’। তিনি গোটা জাতিকে আশাবাদী করে তুলেছিলেন। তাঁর সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে অতিদ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ হতে থাকে। তাতে রাষ্ট্রে নতুন এক শ্রেণী তৈরি হয় এবং তাদের দ্বারা গড়ে ওঠে নতুন সমাজব্যবস্থা। ফলে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও দেখা দেয়। নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং নতুন সমস্যাকে বলিষ্ঠভাবে মোকাবিলা করতে রুজভেল্টের নেতৃত্বে জাতীয় উদ্যোগের সৃষ্টি করা হয়। সে জন্য নতুন রাজনৈতিক মূল্যবোধও তৈরি করা হয়। সেই মূল্যবোধগুলোর উপাদান জোগাড় করা হয়েছে খ্রিষ্টধর্ম থেকে, বহুকালের সামাজিক সংস্কার থেকে এবং বড় বড় চিন্তাশীল মানুষের রচনা থেকে। আমরা গত চার দশকে সে ধরনের রাজনৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করতে পারিনি। যদিও বাঙালি জাতিরও ধর্ম রয়েছে, সামাজিক মূল্যবোধ রয়েছে এবং মহান মানুষদের অমূল্য চিন্তারাশি রয়েছে।
জাতীয় নেতাদের এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কথাবার্তা হবে ব্যক্তিগত স্বার্থনিরপেক্ষ ও অতি ভারী। গত জোট সরকার দেশে একটি সংসার সাজিয়েছিল, যে সংসারের সঙ্গে গণতান্ত্রিক চেতনা ও নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। একজন বিচারপতিকে প্রধান করে অসংখ্য কমিশনার নিয়োগ দিয়ে ওই সরকার একটি নির্বাচন কমিশনও সাজিয়েছিল। সেই নির্বাচন কমিশনের অবস্থা ছিল বাংলা নাটকের প্রথম যুগের ‘নাটুকে রামনারায়ণ’ বা রামনারায়ণ তর্করত্নের কুলীনকুল-সর্বস্ব (১৮৫৪) নাটকটির মতো। বাংলার দর্শক তা উপভোগ করেছিল। ৬০ বছর বয়স্ক কুলীন বৃদ্ধ এবং তার চার পত্নীর কাহিনি কুলীনকুল-সর্বস্ব। ওই নাটকের কাহিনি জমাট বেঁধেছিল কুলধর্ম রক্ষাকে কেন্দ্র করে। আমাদের জোট সরকারও তাদের নিজস্ব ধরনের গণতন্ত্রের কুলধর্ম রক্ষা করতে কোমরে বেল্ট পরা বৃদ্ধ বিচারপতি ও তাঁর চার-পাঁচজন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে এক নাটক খাড়া করে। ওই নাটকের কুশীলবদের অভিনয় দেখে দেশের মানুষ (বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক বাদে) দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে। সাধারণ মানুষ যখন বলতে লাগল: আমরা ‘আজিজ-কুল-সর্বস্ব’ খুব দেখেছি, আর না, তাঁকে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বলুন। তখনই কুমিল্লায় এক জনসভায় বেগম জিয়া বললেন: এই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আজিজের অধীনেই নির্বাচন হবে।
এই এক কথাতেই দেশের ভোটাররা (আসল ভোটাররা) বুঝে গেল—কম্ম কাবার। আমরা ভোট দিই বা না দিই, আজিজ সাহেবের প্রার্থীর বিজয় অবধারিত। বিশ্বের কোনো শক্তির সাধ্য নেই আজিজ সাহেবের দলের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয় রোধ করা।
একটি পর্যায়ে গিয়ে জনগণ দেখল, সিভিল সোসাইটির নেতাদের মতো গোলটেবিল করে কোনো কাজ হবে না, মালকোচা মেরে তাদের নিজেদেরই পুরানা পল্টন আর স্টেডিয়ামের আশপাশে নামতে হবে। তারা রাস্তায় নামল, কিন্তু যারা নামল, তাদের সবাই ঘরে ফিরে এল না। অনেকেরই ঠাঁই হলো স্থায়ীভাবে আজিমপুর বা জুরাইনের মাটিতে। বাংলার মাটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেকেই চিরকালের জন্য মাটিতে মিশে গেল।
বাংলার মাটিতে গণতন্ত্র এল। তবে তা বাংলার ঘরে ঘরে না গিয়ে শেরেবাংলা নগরের ধূসর বাড়িটির কড়িকাঠে গিয়ে মাথা কুটতে লাগল। গণতন্ত্র একটুখানি আদর ও পরিচর্যা চায়। সেই ভালোবাসাটুকু বাংলার নেতাদের কাছ থেকে পেল না। পদদলিত হতে থাকল গণতান্ত্রিক চেতনা।
সরকারি দলের মুখপাত্রদের কাজ দলের মুখ উজ্জ্বল করা—দলের মুখে এবং সরকারের মুখে চুনকালি মাখানো নয়। যদিও আমাদের সমাজে কিছু লোক আছে, যারা চুনকালিও উপভোগ করে। তবে সাধারণ মানুষ চুনকালির নোংরা পছন্দ করে না।
দাঁত-মুখ খিচিয়ে অতি সাবলীলভাবে অট্টহাসি-সহযোগে কথা বলার জন্য বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রসিদ্ধ। তাঁর কথার গুরুত্ব কেউ দেয় না, উপভোগ করে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকেরা। কিন্তু সরকারি দলের বড় নেতার কথা উপভোগের বিষয় নয়—উপলব্ধি ও ভাবার জিনিস। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভদ্র-নম্র মানুষ। তাঁর কথার মূল্য আলাদা। তিনি ১৮ অক্টোবর বললেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন জরুরি সরকারের সময়ে ডিজিএফআইয়ের এজেন্ট ছিলেন।
সুখ-শান্তিতে থাকার জন্য আমাদের মতো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মানুষকে অনেক কিছুরই এজেন্ট হতে হয়। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব অনেকে তা টেরও পায়। তবে চুপ করে থাকে, জেনেও না জানার ভান করে। তা ছাড়া এসব জিনিস প্রমাণ করা কঠিন। দালাল কেউ হতেই পারেন এবং সে খবর কেউ জানতেও পারেন। বলার কী দরকার। আমাদের ছোট সমাজ। নিরানব্বই ভাগ মানুষের হাঁড়ির খবর সবাই জানে। প্রশ্ন তা নয়, প্রশ্ন অন্যখানে।
ডিজিএফআই জিনিসটি বিরোধী দলের অঙ্গসংগঠন নয়, সরকারেরই একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। সেখানে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের নিয়োগ দেয় সরকার। যখন যাঁদের প্রয়োজন, তখন তাঁদের সেখান থেকে বদলি করে। অন্য কেউ নিয়োগ পান। খন্দকার মাহবুব উচ্চশিক্ষা পরিদপ্তরের এজেন্ট নন, মহিলাবিষয়ক দপ্তরের এজেন্ট নন, আবহাওয়া বিভাগের এজেন্ট নন, পাট মন্ত্রণালয়ের কোনো পরিদপ্তরেরও এজেন্ট নন। ওসবের এজেন্ট হলে দোষের কিছু নেই। দোষ ডিজিএফআইয়ের এজেন্ট হলে। ওই বিভাগটি সরকার তা হলে রেখেছে কেন? গোয়েন্দা বিভাগের কাজ ভিন্ন ধরনের। রাষ্ট্রের স্বার্থেই তারা কাজ করে। অনুমান করি, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মন্ত্রী কারও সম্পর্কে বলবেন না যে অমুকে সিআইএ ও এফবিআইয়ের এজেন্ট। ভারতের কোনো মন্ত্রী কি বলবেন, অমুক আইনজীবী ‘র’-এর এজেন্ট। পাকিস্তানে আইএসআই প্রবল পরাক্রান্ত। সুতরাং, সেখানকার বিরাট মাথাঅলা নেতারা কার সম্বন্ধে কী বলেন, তা অনুমান করার সাধ্য কারও নেই।
গণতান্ত্রিক সমাজে কথা বলার অধিকার আছে সবারই, কিন্তু সেই কথা সভ্যতা-ভব্যতা ও সৌজন্যের সীমা অতিক্রম করবে না। বাংলাদেশের বড় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকেরা সাধারণত অসাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেন, যেমন করেছিলেন খন্দকার মোশতাক বা লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমান। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন: ‘খোন্দকার দেলোয়ারের চেহারা আর উদ্ভট কথাবার্তা শুনে মনে হয়, উনি ফেনসিডিলখোর। ফেনসিডিলই ওনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।’ [যুগান্তর ও অন্যান্য কাগজ] দেশের জনগণই খালেদা জিয়াকে দেশছাড়া করবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
বেগম জিয়ার দেশছাড়া হওয়ার চেয়ে বাড়িছাড়া হওয়া যে বেশি ক্ষতিকর, তা এখন বুঝতে কারও অসুবিধা নেই। সুতরাং তাঁর দলের নেতাদের উদ্বেগের কারণ যে নেত্রীর বাড়ি, তাতে কারও সন্দেহ নেই। নাটক বাঙালি জাতি কম দেখেনি, ভবিষ্যতে আরও দেখবে। মইনুল সড়কের বাড়ির সামনে যেদিন মালবাহী ট্রাক, ভ্যান বা ঠেলাগাড়ি দেখা যাবে, সেদিন নির্মল আনন্দে হার্টফেল করার মতো মানুষ বাংলার মাটিতে অগণিত। বেগম জিয়ার সোফা-আলমারি-খাট-পালঙ্ক-ড্রেসিং টেবিল যখন ট্রাকে উঠবে—সেই দৃশ্য টিভি চ্যানেলে দেখে কেউ বুক চাপড়াবে, কেউ বগল বাজাবে। এটা বাঙালির স্বভাব।
খোন্দকার দেলোয়ার সাহেবকে ষাটের দশক থেকে দেখছি—প্রধানত দূর থেকে। আমি তাঁকে দেখেছি মতিয়া আপা, মেনন ভাইদের পক্ষে আদালতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে যেতে। তাঁর চেহারা নিয়ে হ্যান্ডসাম হানিফ সাহেব যা-ই বলুন, আমি তাঁকে দেখেছি একজন সুদর্শন মানুষ হিসেবেই। মানুষের রূপ-যৌবন ও পেশিতে তাকদ্ চিরকাল থাকে না। খোন্দকার সাহেবকে তীব্র সমালোচনা করে আমি লিখেছি এই স্তম্ভে যখন তিনি সংসদের ক্যানটিন থেকে প্রাপ্যের অতিরিক্ত চাল-ডাল-গরম মসলা বাড়িতে নিয়েছেন। আমার সেই লেখা যুগ্ম সম্পাদকের দলের ক্যাডাররা ফটোকপি করে বিতরণ করেছে আমার সামনে।
ফেনসিডিল যখন আজকের মতো খ্যাতি অর্জন করেনি, তখন এই দাওয়াই কাশি হলে আমিও প্রচুর খেয়েছি। এখন খেলে আমার লেখা যারা পছন্দ করে না, তারা বলবে: লোকটা স্রেফ ফেনসিডিলখোর। তা না হলে এসব ছাইপাঁশ লেখে কী করে। টেলিভিশনে আমাকে দেখে তাদের পক্ষে বলা স্বাভাবিক: লোকটার চেহারা দেখে মনে হয় ফেনসিডিলখোর। বিশাল দল আওয়ামী লীগে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নেতা অগণিত। তাঁদের কারও উচিত কানে কানে যুগ্ম সম্পাদককে বলা: চিরদিন সবার সমান নাহি যায়।
২৪ অক্টোবর সকালে গাড়িতে রেডিওর খবরে শুনলাম, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বলছেন: খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি বরাদ্দ বাতিল করায় তিনি প্রতিহিংসার বশে রূপগঞ্জে সেনাক্যাম্পে হামলা করিয়েছেন। খালেদা জিয়ার নির্দেশেই হামলা ও বিক্ষোভ হয়েছে। তা যদি তিনি করিয়ে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে জনগণের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসী, তাদের খেয়াল রাখা দরকার রূপগঞ্জের লোকেরাও ভোটার। আমরা অতীতে দেখেছি, কোনো নেতার একটিমাত্র বাক্যের কারণে কোনো দলের লাখ লাখ ভোটার অন্য দলের মার্কায় চুটিয়ে সিল মেরেছে।
গত কয়েক দশকে আমাদের সমাজে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে ফেনসিডিল না খেয়েও বহু মানুষ ফেনসিডিলখোরের ভাষায় কথা বলে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে জনগণ ফেনসিডিলখোর নয়। তারা ভাতখোর। তাদের বিচার-বিবেচনা আছে। সত্য ও মিথ্যা বিভাজন করার ক্ষমতাও তাদের বিলকুল আছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়াটা একটা উপায় মাত্র—প্রধান বিষয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, যার অন্যতম উপায় হলো অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। সেই ‘অপর’ যদি চরম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও হন, তবুও। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনা সমুন্নত রাখাটা গণতান্ত্রিক সরকারের এক নম্বর কর্তব্য। সেই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে বড় বড় নদীর ওপর দোতলা ব্রিজ বানালেও দেশ ও জাতির কোনো উপকারই হবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
১৯৭২-৭৩-এর দিকে ভারতের বহু বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা বেঁচে ছিলেন এবং সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতে। তত্ত্বগত ও বাস্তব রাজনীতি—দুই দিকেই তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল। অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে বাংলার মুজাফ্ফর আহমদ, উত্তর ভারতের পি সি জোশি, মুম্বাইয়ের এস এ ডাঙ্গে, পাঞ্জাবের গোলাম হোসেন, তামিলনাড়ুর এস চেত্তিয়ার, কেরালার ই এস এস নাম্বুদিরিপাদ, শওকত উসমানী প্রমুখ সাধারণ মানুষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। এস এ ডাঙ্গে, ড. জি অধিকারী প্রমুখ রাজনৈতিক লেখালেখি ও সম্পাদনার কাজে দক্ষতার পরিচয় দেন। সেকালের অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতার রাজনৈতিক জীবনের শুরু গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে। বহুদিন তাঁরা কংগ্রেসে কাজ করেছেন। ডাঙ্গের একটি বই গান্ধী ভার্সাস লেনিন সেকালে খুব নাম করেছিল। তিনি সম্পাদনা করেছেন সোশ্যালিস্ট পত্রিকা। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে ডাঙ্গে ছিলেন একটি স্তম্ভ।
স্বাধীনতার কয়েক মাস পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি অথবা ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আমন্ত্রণে কমরেড ডাঙ্গে ঢাকায় আসেন। পল্টন ময়দানের এক সম্মেলনে তিনি ভাষণও দেন। সিপিবির নেতা কমরেড মণি সিংহ সম্ভবত কিছুটা আবেগের বশেই বলেছিলেন: বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর ১৬তম সমাজতান্ত্রিক দেশ।
কমরেড ডাঙ্গের কানে গিয়ে কথাটা লাগে। তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, আপনাদের উচিত হবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। টেকসই গণতন্ত্র যদি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা হলে বহু সামাজিক অসাম্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে আসবে। তিনি অবশ্য কথাটি হুকুমের ভঙ্গিতে নয়, বন্ধুসুলভ পরামর্শ হিসেবে বলেছিলেন। প্রাজ্ঞ নেতা খুব ভালোই জানতেন, বাংলাদেশের নেতারা তাঁদের পশুটির লেজ আগে কাটবেন না গলা আগে কাটবেন—তা স্রেফ তাঁদের ব্যাপার। তা নিয়ে তাঁর নাক গলানো তাঁরা পছন্দ করবেন না।
হোটেল পূর্বাণীতে অবস্থানকালে কমরেড ডাঙ্গের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বাঘা বাঘা নেতা ও তাঁদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান যুবনেতাদের কেউ যে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তা মনে পড়ে না। আমাদের মতো বাম বলয়ের ছেলে-ছোকরাগোছের মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি সোজা দিল্লিতে রওনা হন। তাঁর থাকা-খাওয়ার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে আমাদের অগ্রজপ্রতিম বন্ধু দুই বছর আগে, নিজের ঘরে বিস্ফোরণ দুর্ঘটনায় নিহত নুরুল ইসলাম বিশেষ দৃষ্টি রাখেন। তবে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল।
বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল সমাজতন্ত্রের নামে যা করে থাকে, তা অন্য জিনিস। গণতান্ত্রিক দলের পক্ষে সদিচ্ছা থাকলে শুধু গণতন্ত্রটাই ঠিকঠাক মতো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সে কাজটিও ঠিকমতো হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ডিগ্রি নেওয়া নেতারাও মনে করেন, বহু টাকা খরচ করে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করাই গণতন্ত্র। এবং বিজয়ী দলই যা খুশি বলার এবং যা খুশি করার অধিকারী। সরকারের বাইরের দলের নেতারা মনে করেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। কোনো কায়দায় ভবিষ্যতে ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো ছাড়া তাঁদের আর কোনো কাজ নেই। একেবারে কাজ নেই—তা বলা যায় না। নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা করা তাঁদের অবশ্যকরণীয়।
গণতন্ত্র যে শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন নয়, গণতন্ত্র একটি মহান রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা, তা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নেতারা মনে করেন বলে মনে হয় না। গণতন্ত্র সেই ধরনের রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা, যার শিক্ষা হলো: প্রত্যেকের মতামতের প্রতি প্রত্যেকের শ্রদ্ধা প্রদর্শন। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে আঙ্গুরপোতা বা উখিয়ার একজন মানুষও যদি একটি মতামত দেন, তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশের অধিকার নেই গোটা দেশের ১৪,৯৯,৯৯,৯৯৯ মানুষের। এবং তাঁকে তাঁর মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তবে তাঁর সঙ্গে গোটা দেশের মানুষ ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারে।
কোনো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-নেতাদের এক রকমের দায়িত্ব। কিন্তু পরবর্তী কালের প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতাদের দায়দায়িত্ব বিরাট। আধুনিক গণতন্ত্রের পথপ্রদর্শক যুক্তরাষ্ট্রের নেতা ওয়াশিংটন-জেফারসনরা এক রকম ভূমিকা পালন করে ইতিহাসে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন। তাঁদের পরবর্তী নেতারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আরও বহু দূর।
প্রাজ্ঞ নেতারা জাতির মধ্যে একটি চেতনা ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করেন। যেমন করেছিলেন কুড়ি শতকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট। তাঁর শাসনকালকে বলা হয় ‘প্রগতিশীল যুগ’ বা ‘প্রগ্রেসিভ এরা’। তিনি গোটা জাতিকে আশাবাদী করে তুলেছিলেন। তাঁর সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে অতিদ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ হতে থাকে। তাতে রাষ্ট্রে নতুন এক শ্রেণী তৈরি হয় এবং তাদের দ্বারা গড়ে ওঠে নতুন সমাজব্যবস্থা। ফলে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও দেখা দেয়। নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং নতুন সমস্যাকে বলিষ্ঠভাবে মোকাবিলা করতে রুজভেল্টের নেতৃত্বে জাতীয় উদ্যোগের সৃষ্টি করা হয়। সে জন্য নতুন রাজনৈতিক মূল্যবোধও তৈরি করা হয়। সেই মূল্যবোধগুলোর উপাদান জোগাড় করা হয়েছে খ্রিষ্টধর্ম থেকে, বহুকালের সামাজিক সংস্কার থেকে এবং বড় বড় চিন্তাশীল মানুষের রচনা থেকে। আমরা গত চার দশকে সে ধরনের রাজনৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করতে পারিনি। যদিও বাঙালি জাতিরও ধর্ম রয়েছে, সামাজিক মূল্যবোধ রয়েছে এবং মহান মানুষদের অমূল্য চিন্তারাশি রয়েছে।
জাতীয় নেতাদের এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কথাবার্তা হবে ব্যক্তিগত স্বার্থনিরপেক্ষ ও অতি ভারী। গত জোট সরকার দেশে একটি সংসার সাজিয়েছিল, যে সংসারের সঙ্গে গণতান্ত্রিক চেতনা ও নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। একজন বিচারপতিকে প্রধান করে অসংখ্য কমিশনার নিয়োগ দিয়ে ওই সরকার একটি নির্বাচন কমিশনও সাজিয়েছিল। সেই নির্বাচন কমিশনের অবস্থা ছিল বাংলা নাটকের প্রথম যুগের ‘নাটুকে রামনারায়ণ’ বা রামনারায়ণ তর্করত্নের কুলীনকুল-সর্বস্ব (১৮৫৪) নাটকটির মতো। বাংলার দর্শক তা উপভোগ করেছিল। ৬০ বছর বয়স্ক কুলীন বৃদ্ধ এবং তার চার পত্নীর কাহিনি কুলীনকুল-সর্বস্ব। ওই নাটকের কাহিনি জমাট বেঁধেছিল কুলধর্ম রক্ষাকে কেন্দ্র করে। আমাদের জোট সরকারও তাদের নিজস্ব ধরনের গণতন্ত্রের কুলধর্ম রক্ষা করতে কোমরে বেল্ট পরা বৃদ্ধ বিচারপতি ও তাঁর চার-পাঁচজন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে এক নাটক খাড়া করে। ওই নাটকের কুশীলবদের অভিনয় দেখে দেশের মানুষ (বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক বাদে) দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে। সাধারণ মানুষ যখন বলতে লাগল: আমরা ‘আজিজ-কুল-সর্বস্ব’ খুব দেখেছি, আর না, তাঁকে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বলুন। তখনই কুমিল্লায় এক জনসভায় বেগম জিয়া বললেন: এই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আজিজের অধীনেই নির্বাচন হবে।
এই এক কথাতেই দেশের ভোটাররা (আসল ভোটাররা) বুঝে গেল—কম্ম কাবার। আমরা ভোট দিই বা না দিই, আজিজ সাহেবের প্রার্থীর বিজয় অবধারিত। বিশ্বের কোনো শক্তির সাধ্য নেই আজিজ সাহেবের দলের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয় রোধ করা।
একটি পর্যায়ে গিয়ে জনগণ দেখল, সিভিল সোসাইটির নেতাদের মতো গোলটেবিল করে কোনো কাজ হবে না, মালকোচা মেরে তাদের নিজেদেরই পুরানা পল্টন আর স্টেডিয়ামের আশপাশে নামতে হবে। তারা রাস্তায় নামল, কিন্তু যারা নামল, তাদের সবাই ঘরে ফিরে এল না। অনেকেরই ঠাঁই হলো স্থায়ীভাবে আজিমপুর বা জুরাইনের মাটিতে। বাংলার মাটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেকেই চিরকালের জন্য মাটিতে মিশে গেল।
বাংলার মাটিতে গণতন্ত্র এল। তবে তা বাংলার ঘরে ঘরে না গিয়ে শেরেবাংলা নগরের ধূসর বাড়িটির কড়িকাঠে গিয়ে মাথা কুটতে লাগল। গণতন্ত্র একটুখানি আদর ও পরিচর্যা চায়। সেই ভালোবাসাটুকু বাংলার নেতাদের কাছ থেকে পেল না। পদদলিত হতে থাকল গণতান্ত্রিক চেতনা।
সরকারি দলের মুখপাত্রদের কাজ দলের মুখ উজ্জ্বল করা—দলের মুখে এবং সরকারের মুখে চুনকালি মাখানো নয়। যদিও আমাদের সমাজে কিছু লোক আছে, যারা চুনকালিও উপভোগ করে। তবে সাধারণ মানুষ চুনকালির নোংরা পছন্দ করে না।
দাঁত-মুখ খিচিয়ে অতি সাবলীলভাবে অট্টহাসি-সহযোগে কথা বলার জন্য বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রসিদ্ধ। তাঁর কথার গুরুত্ব কেউ দেয় না, উপভোগ করে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকেরা। কিন্তু সরকারি দলের বড় নেতার কথা উপভোগের বিষয় নয়—উপলব্ধি ও ভাবার জিনিস। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভদ্র-নম্র মানুষ। তাঁর কথার মূল্য আলাদা। তিনি ১৮ অক্টোবর বললেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন জরুরি সরকারের সময়ে ডিজিএফআইয়ের এজেন্ট ছিলেন।
সুখ-শান্তিতে থাকার জন্য আমাদের মতো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মানুষকে অনেক কিছুরই এজেন্ট হতে হয়। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব অনেকে তা টেরও পায়। তবে চুপ করে থাকে, জেনেও না জানার ভান করে। তা ছাড়া এসব জিনিস প্রমাণ করা কঠিন। দালাল কেউ হতেই পারেন এবং সে খবর কেউ জানতেও পারেন। বলার কী দরকার। আমাদের ছোট সমাজ। নিরানব্বই ভাগ মানুষের হাঁড়ির খবর সবাই জানে। প্রশ্ন তা নয়, প্রশ্ন অন্যখানে।
ডিজিএফআই জিনিসটি বিরোধী দলের অঙ্গসংগঠন নয়, সরকারেরই একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। সেখানে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের নিয়োগ দেয় সরকার। যখন যাঁদের প্রয়োজন, তখন তাঁদের সেখান থেকে বদলি করে। অন্য কেউ নিয়োগ পান। খন্দকার মাহবুব উচ্চশিক্ষা পরিদপ্তরের এজেন্ট নন, মহিলাবিষয়ক দপ্তরের এজেন্ট নন, আবহাওয়া বিভাগের এজেন্ট নন, পাট মন্ত্রণালয়ের কোনো পরিদপ্তরেরও এজেন্ট নন। ওসবের এজেন্ট হলে দোষের কিছু নেই। দোষ ডিজিএফআইয়ের এজেন্ট হলে। ওই বিভাগটি সরকার তা হলে রেখেছে কেন? গোয়েন্দা বিভাগের কাজ ভিন্ন ধরনের। রাষ্ট্রের স্বার্থেই তারা কাজ করে। অনুমান করি, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মন্ত্রী কারও সম্পর্কে বলবেন না যে অমুকে সিআইএ ও এফবিআইয়ের এজেন্ট। ভারতের কোনো মন্ত্রী কি বলবেন, অমুক আইনজীবী ‘র’-এর এজেন্ট। পাকিস্তানে আইএসআই প্রবল পরাক্রান্ত। সুতরাং, সেখানকার বিরাট মাথাঅলা নেতারা কার সম্বন্ধে কী বলেন, তা অনুমান করার সাধ্য কারও নেই।
গণতান্ত্রিক সমাজে কথা বলার অধিকার আছে সবারই, কিন্তু সেই কথা সভ্যতা-ভব্যতা ও সৌজন্যের সীমা অতিক্রম করবে না। বাংলাদেশের বড় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকেরা সাধারণত অসাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেন, যেমন করেছিলেন খন্দকার মোশতাক বা লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমান। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন: ‘খোন্দকার দেলোয়ারের চেহারা আর উদ্ভট কথাবার্তা শুনে মনে হয়, উনি ফেনসিডিলখোর। ফেনসিডিলই ওনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।’ [যুগান্তর ও অন্যান্য কাগজ] দেশের জনগণই খালেদা জিয়াকে দেশছাড়া করবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
বেগম জিয়ার দেশছাড়া হওয়ার চেয়ে বাড়িছাড়া হওয়া যে বেশি ক্ষতিকর, তা এখন বুঝতে কারও অসুবিধা নেই। সুতরাং তাঁর দলের নেতাদের উদ্বেগের কারণ যে নেত্রীর বাড়ি, তাতে কারও সন্দেহ নেই। নাটক বাঙালি জাতি কম দেখেনি, ভবিষ্যতে আরও দেখবে। মইনুল সড়কের বাড়ির সামনে যেদিন মালবাহী ট্রাক, ভ্যান বা ঠেলাগাড়ি দেখা যাবে, সেদিন নির্মল আনন্দে হার্টফেল করার মতো মানুষ বাংলার মাটিতে অগণিত। বেগম জিয়ার সোফা-আলমারি-খাট-পালঙ্ক-ড্রেসিং টেবিল যখন ট্রাকে উঠবে—সেই দৃশ্য টিভি চ্যানেলে দেখে কেউ বুক চাপড়াবে, কেউ বগল বাজাবে। এটা বাঙালির স্বভাব।
খোন্দকার দেলোয়ার সাহেবকে ষাটের দশক থেকে দেখছি—প্রধানত দূর থেকে। আমি তাঁকে দেখেছি মতিয়া আপা, মেনন ভাইদের পক্ষে আদালতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে যেতে। তাঁর চেহারা নিয়ে হ্যান্ডসাম হানিফ সাহেব যা-ই বলুন, আমি তাঁকে দেখেছি একজন সুদর্শন মানুষ হিসেবেই। মানুষের রূপ-যৌবন ও পেশিতে তাকদ্ চিরকাল থাকে না। খোন্দকার সাহেবকে তীব্র সমালোচনা করে আমি লিখেছি এই স্তম্ভে যখন তিনি সংসদের ক্যানটিন থেকে প্রাপ্যের অতিরিক্ত চাল-ডাল-গরম মসলা বাড়িতে নিয়েছেন। আমার সেই লেখা যুগ্ম সম্পাদকের দলের ক্যাডাররা ফটোকপি করে বিতরণ করেছে আমার সামনে।
ফেনসিডিল যখন আজকের মতো খ্যাতি অর্জন করেনি, তখন এই দাওয়াই কাশি হলে আমিও প্রচুর খেয়েছি। এখন খেলে আমার লেখা যারা পছন্দ করে না, তারা বলবে: লোকটা স্রেফ ফেনসিডিলখোর। তা না হলে এসব ছাইপাঁশ লেখে কী করে। টেলিভিশনে আমাকে দেখে তাদের পক্ষে বলা স্বাভাবিক: লোকটার চেহারা দেখে মনে হয় ফেনসিডিলখোর। বিশাল দল আওয়ামী লীগে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নেতা অগণিত। তাঁদের কারও উচিত কানে কানে যুগ্ম সম্পাদককে বলা: চিরদিন সবার সমান নাহি যায়।
২৪ অক্টোবর সকালে গাড়িতে রেডিওর খবরে শুনলাম, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বলছেন: খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি বরাদ্দ বাতিল করায় তিনি প্রতিহিংসার বশে রূপগঞ্জে সেনাক্যাম্পে হামলা করিয়েছেন। খালেদা জিয়ার নির্দেশেই হামলা ও বিক্ষোভ হয়েছে। তা যদি তিনি করিয়ে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে জনগণের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসী, তাদের খেয়াল রাখা দরকার রূপগঞ্জের লোকেরাও ভোটার। আমরা অতীতে দেখেছি, কোনো নেতার একটিমাত্র বাক্যের কারণে কোনো দলের লাখ লাখ ভোটার অন্য দলের মার্কায় চুটিয়ে সিল মেরেছে।
গত কয়েক দশকে আমাদের সমাজে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে ফেনসিডিল না খেয়েও বহু মানুষ ফেনসিডিলখোরের ভাষায় কথা বলে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে জনগণ ফেনসিডিলখোর নয়। তারা ভাতখোর। তাদের বিচার-বিবেচনা আছে। সত্য ও মিথ্যা বিভাজন করার ক্ষমতাও তাদের বিলকুল আছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়াটা একটা উপায় মাত্র—প্রধান বিষয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, যার অন্যতম উপায় হলো অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। সেই ‘অপর’ যদি চরম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও হন, তবুও। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনা সমুন্নত রাখাটা গণতান্ত্রিক সরকারের এক নম্বর কর্তব্য। সেই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে বড় বড় নদীর ওপর দোতলা ব্রিজ বানালেও দেশ ও জাতির কোনো উপকারই হবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments