জাতীয় কলঙ্কমোচনে চাই পুনর্বিচার-জেলহত্যা দিবস
শোকাবহ জেলহত্যা দিবসের পঁয়ত্রিশ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে অশুভ রাজনৈতিক শক্তির চক্রান্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, জেলের ভেতরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনা ছিল তারই ধারাবাহিকতা।
এই ঘটনাবলি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা থমকে দিয়েছিল, বিচ্যুত করেছিল রাষ্ট্রের গতিকে। আমরা জাতীয় চার নেতা যথাক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথম অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানের স্মৃতির প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
স্বাধীনতাসংগ্রামের চার অগ্রনায়কের হত্যাকাণ্ড ছিল বিরাট ট্র্যাজেডি, কিন্তু ঘটনার ৩৫ বছর পরও ন্যায়বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় তা পরিহাসে পর্যবসিত হয়েছে। খুনিদের দীর্ঘকাল বিচারের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ আলামতও পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হয়েছে। অতীতের এসব মারাত্মক দায়িত্বহীনতার প্রতিকারের কর্তব্য এখনো আদালত ও সরকারের কাঁধে। আমরা আশা করব, অবিলম্বে জেলহত্যার পুনর্বিচারের মাধ্যমে জাতির কলঙ্ক মোচন হবে।
২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারার অপরাধে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে আদালতের ভাষায়, ‘নৃশংস, পৈশাচিক ও বর্বরোচিতভাবে গুলি করে হত্যা’র দায়ে মৃত্যুদণ্ড এবং ৩০২/১০৯ ধারার অপরাধে ফারুক-রশিদসহ ১৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন, যাঁরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলারও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এ ছাড়া ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত মেজর মো. খায়রুজ্জামানসহ চার রাজনীতিক তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়েদুর রহমান ও নুরুল ইসলাম মঞ্জুর অভিযোগ ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত’ না হওয়ায় খালাস পান। খায়রুজ্জামান ছাড়া অভিযুক্ত বাকি আসামিরা মারা গেছেন। এই বিচার তখনো জনগণ গ্রহণ করেনি, এখনো করে না।
জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যরা এ রায় মেনে নেননি। এই প্রহসনের বিচারের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল না করার বিষয়টিও বিস্ময়কর। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেই কাঙ্ক্ষিত আপিলটি করা হয়। মামলাটি এখন শুনানির অপেক্ষায়। অপেক্ষা যাতে দীর্ঘসূত্রতায় না গড়ায়, তা দেখার দায়িত্ব সরকার ও অ্যাটর্নি জেনারেলের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও ‘জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচার’-এর কথা বলা হয়েছে।
পুনর্বিচার অচিরেই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হোক। জাতীয় চার নেতার স্মৃতি ও গৌরবদীপ্ত অর্জনের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করানোয় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হোক। স্বাধীনতার মহান কারিগরদের জীবন, কর্ম ও মৃত্যুর ঋণ তখনই শোধ হবে, যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যার পথ এবং খুনিদের রক্ষার সংস্কৃতি চিরতরে বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা সেসব পদক্ষেপের প্রত্যাশী।
No comments