'কালো আর ধলো বাহিরে কেবল...' নয় by লুৎফর রহমান রনো

অনেকদিন আগে (বছর দুই হবে হয়তো) পত্রিকায় একটি খবর পড়েছিলাম, 'কালো মেয়ে বলে তালাক'। তাতে বিস্মিত হইনি। কারণ কোনো কারণে বর বিয়ের আগে বউকে দেখেনি, কিন্তু শুনেছে গৌর বর্ণ। যখন দেখেছে কালো, তালাক দিয়েছে। এক মতে ভালোই। খামোখা নির্যাতন না করে ঝামেলা চুকিয়ে দিয়েছে।


তালাকপরবর্তী সময় মেয়ের জীবন অপমানে আর হীনম্মন্যতায় পুড়ে কয়লা যে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবুও ভালো, যে স্বামী কালো রং পছন্দ করে না, এমন হীনম্মন্য লোকের ঘর করার চেয়ে। কারণ মেয়েটির রং কোনোকালে সাদাও হবে না, আর দাম্পত্যজীবনের আগুন থেকে মুক্তিও পাবে না। কিন্তু রং ফর্সা করা যায় না জেনেও বাজারে রং ফর্সা করার অজস্র ক্রিম-মলম বিক্রি হয়_মেয়েরাই কেনে, আর মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা আয় করে। কম্পানিগুলোর পুঁজি আমাদের হীনম্মন্যতা, মনের দৈন্য, রুচির বিকৃতি ও সুন্দরের মিথ্যা-ভ্রান্ত ধারণা। কী অদ্ভুত!
সাদা রঙের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত করে গেছে সাদা রঙের শাসকরা। শাসিত জাতি, প্রজারা দেখে আসছে শতবর্ষ ধরে তাদের সম্মানিত, পূজনীয় রাজা-রানির চামড়া সাদা। সাদা জাত রাজার জাত। রাজার জাত, রং-ঢং ভাষা-ভঙ্গি সবই অভিজাত, সম্মানীয় ও সুন্দর। এর বিপরীত সবই অসুন্দর। ঔপনিবেশিক সাদা শাসকরা আমাদের রংটাকে বা নেটিভদের নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে হীন, নীচ, অশুভ ও অসুন্দর রূপে। যেমন মন্দ মানুষকে তারা তালিকাভুক্ত করত 'ব্ল্যাকলিস্ট' বলে, কালো তালিকা বলে। এরূপ কালো টাকা, কালোবাজার, কালাপানি, কালো দিন_অর্থাৎ জগতের সব মন্দ, অসুন্দর ও অশুভকে সাদারা নেটিভদের রং দিয়ে শনাক্ত করত।
সব সময়ের শাসকদের পাশে শাসিত জাতের কিছু নোংরা, ভাঁড়, সুযোগসন্ধানী, আত্মপ্রতিষ্ঠালোভী, তোষামোদকারী ব্যক্তির ভিড় থাকে। তাদের প্রভুর কর্ম-ধর্ম-স্বভাব-সংস্কৃতি_সব কিছুই মান্য করা, ওসব রপ্ত করা তাদের আরাধনা। তারপর স্বজাতির সামনে তারাই দ্বিতীয় শ্রেণীর সাদা সাহেবের ভূমিকায় নিয়োজিত হয়ে গর্ববোধ করত। সেই থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে, সাদাশাসিত উপনিবেশগুলোতে, সাদাপ্রীতি, সাদাভক্তি বা সাদা রংই সুন্দর বা ইংরেজি ভাষাই মর্যাদার, ইংরেজিই শিক্ষার পরিমাপক_কেন না তা প্রভুদের ভাষা তাই_এসব শুরু হয়। শুধু তাই নয়, হীনম্মন্য জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও সেসব জেঁকে বসে। আমাদের বুদ্ধিজীবী, লেখক, কথাসাহিত্যিক, কবিরা পর্যন্ত সাদার কীর্তন করেছেন তাঁদের রচনায়। উপন্যাস বা সিনেমার নায়ক-নায়িকা তাই সাদা-সুন্দর হয়। শিক্ষিত দেখাতে হলে মেধা-চিন্তা-মননশীলতার প্রদর্শন নয়, ইংরেজি সংলাপ ভরে দিতে হয়। এভাবেই আমাদের নিজস্ব বোধ, চিন্তা, সৌন্দর্য ভাবনা_সবই হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্য রুচির-রঙের ধাঁচে-ছাঁচে। আমরা কালো বা বাদামি জাতি, আমাদের সৌন্দর্য আমাদের রঙে, ঢঙে, সংস্কৃতিতে রয়েছে এবং তা তুলনাহীন। কিন্তু আমাদের স্বজাতির শাসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, ঔপন্যাসিক, কবি বা যাঁদের অনুসরণ করবে জাতি, তারাও চিন্তা-চেতনায় সেই 'সাদা-বৃত্ত' ভেঙে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেননি বলে দুর্ভাগ্য দীর্ঘতর হচ্ছে। শিক্ষার মান ইংরেজি শব্দের ভাণ্ডার দিয়ে মাপা হচ্ছে। মানুষের সৌন্দর্য গাত্র রঙের মাপে মাপা হচ্ছে। ইংরেজি না জানা শিক্ষিতরা, কালো বর্ণের সুন্দরী মেয়েরা সমাজের বিচারে আজ তাই 'প্রভু'-প্রদর্শিত 'কালো তালিকাভুক্ত' অনেকটাই, বলা যায়। যে হাই-হ্যালো বলে চটুল কথা ও চাহনিতে, মেকি হাসিতে বন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে শিখল না, সে নেটিভ-টাইপ রয়ে গেল_গ্রামই। আহ্, যে চুলের ছাঁট আর মিথ্যে ডাট্, চুড়ি পরা ইত্যাদি জানল না, সে তো অনাধুনিক।য
যাক এসব। সবচেয়ে মারাত্মক হলো, ইংরেজের পা-চাটা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিটা এখন আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। সুযোগসন্ধানীরা দশজনের ক্ষতি করে শুধু নিজের তরক্কির জন্য কি সহজেই নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছে! অফিস-আদালতসহ রাজনীতির সব স্তরে ও চাকরি-বাকরির সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে তাই-ই হচ্ছে, অযোগ্য, মেধাহীনদের চাটুকারবৃত্তি আজ মেধাবিকাশের বাধা হয়ে উঠেছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় উন্নতি, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক মান ক্রমশ নিচের দিকে যাচ্ছে।
বিয়ের বাজারে কালো মেয়েরা যেমন কোণঠাসা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির বাজারে সৎ-মেধাসম্পন্ন মানুষেরও সেই একই অবস্থা। মেধার সঙ্গে মর্যাদার সম্পর্ক থাকে। মর্যাদাবোধ যার রয়েছে, তার উন্নতির আশা শুধু নয়, চাকরি বা বাণিজ্য বা ভালোবাসা_সব কিছু টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আমরা তো এমন সমাজেই বেঁচে আছি। তাই কবির কথা আজ আর সত্য নয়। 'কালো আর ধলো বাহিরে কেবল/ভেতরে সবার সমান রাঙা' নয়; মানুষের ভেতরটাই সাদা ও কালোতে পৃথক। গায়ের রং ও ভেতরের রক্ত বড় কথা নয়, অমানুষ, স্বার্থপর লোকের রক্ত লাল হলেও ওদের চিন্তা-চেতনা-মন_সব কিছুই কদাকার, কালো।
কিভাবে অসুন্দরের কবলে সুন্দর ও সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে চলছে তার একটি উদাহরণ : আমরা দেখতে পাই সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিদের ঘিরে থাকে কিছু কালো-কদাকার (অন্তঃকরণ) লোক। যারা নিজের বাসনা-বিলাস চরিতার্থ করতে অজস্র মানুষের বিনাশ করতেও দ্বিধা করে না। এতে নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনাশও ত্বরান্বিত হয়। সাদা শাসকদের কী বলে অভিশাপ দিই যারা মানুষকে বিভক্ত করেছে বর্ণে, ধর্মে, কেন্দ্রে-প্রান্তে। আর আমরা এমনই অপদার্থ যে সুন্দরের ধারণাটাও সাদা রঙের মধ্যে মুড়ে ফেলেছি। অথচ বিচিত্র পৃথিবীর সমূহ সৌন্দর্য তো হাজারো রঙের চ্ছটায় সুষমামণ্ডিত। অতএব, অন্তরে যে সাদা-সৎ-সুন্দর, সেই তো সুন্দর। বাইরের বর্ণ তো মেকি-মায়া। আজকাল কৃত্রিম কালার করাও যায়। ভেতর যার কালো তাকে অসুন্দর, আর অন্তঃকরণ যার সাদা বা সরল-সুন্দর, তাকেই সুন্দর বলা হোক। সুন্দরের ধারণা লাভে, শুভ-র সূত্র নিরূপণে আমরা বরাবর ভুল করে আসছি বলেই আজ অসুন্দরের দখলে চলে যাচ্ছে একে একে সব কিছু।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.