ভাগ্যবদলের প্রবাসজীবন by মিঠুন চৌধুরী
মো. নুরুল আজিম (৬৬)। টানা ১৯ বছর পাটকলে চাকরি করেও সংসারে সচ্ছলতা আনতে পারেননি। ১৯৯৩ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে যান। সর্বস্ব বাজি ধরে আট সন্তানের জনক নুরুল আজিম ওমানে পাড়ি জমান। ফিরলেন ২০০২ সালে। তত দিনে তাঁর তিন ছেলেও প্রবাসী হয়েছেন।
নির্মাণাধীন পাঁচ তলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন নিজের ‘ভাগ্যবদলে’র গল্প। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী সরফভাটা ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের ঘরে ঘরে দেখা মিলবে নুরুল আজিমদের।
জানা যায়, ৫০ হাজার অধিবাসীর এ ইউনিয়নের প্রায় ছয় হাজারের বেশি বাসিন্দাই এখন প্রবাসী। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় বিদেশ যাত্রা। প্রবাসীদের কল্যাণে এখন পাল্টে গেছে এলাকার চিত্র। পাড়ায় পাড়ায় নির্মিত হয়েছে পাকা বাড়ি। এসেছে সচ্ছলতা, বেড়েছে শিক্ষার হার। এমনকি হারিয়ে যেতে বসেছে এ জনপদের প্রাচীন পেশাগুলোও।
প্রবাসী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা জানান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, কুয়েতসহ মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের বসবাস। প্রধানত জীবিকার তাগিদেই আত্মীয় ও পরিচিতদের সহায়তায় ভিনদেশে পাড়ি জমানো শুরু হয়। তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এ প্রবণতার কারণে স্থানীয় তরুণেরাও এখন বিদেশমুখী। এখানকার গ্রামগুলোতে এমন পরিবারের দেখাও মিলবে যাদের সব পুরুষ সদস্যই প্রবাসী।
দুঃখ জয়ের গল্প: ১৯৭৪ সালে নুরুল আজিম রাঙ্গুনিয়ার কর্ণফুলী জুট মিলে মেকানিক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু চাকরির আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। তাই সিদ্ধান্ত নেন বিদেশ যাওয়ার। ১৯৯৩ সালের ৬ জুন স্বেচ্ছায় অবসরে গেলে এক লাখ ১৭ হাজার টাকা পান। ঋণ শোধের পর তাঁর হাতে ছিল ৯৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করে এক বন্ধুর সহায়তায় পাড়ি জমান ওমানের মাস্কাট শহরে। সেখানে কাজ নেন একটি দোকানের ব্যবস্থাপকের।
নুরুল আজিম বলেন, ‘এরপর আর কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। ভালো উপার্জন হয়েছে। পাঁচ ছেলের তিনজনই বিদেশ গেছে আমার আয়ে। দেশে থাকা অবস্থায় অনেক সংগ্রাম করেছি। ভাগ্য বদলাতে পারিনি। বিদেশে গিয়েই জীবনসংগ্রামে জয়ী হয়েছি।’ নিজের বাড়ির কাছেই মধ্যম সরফভাটায় পাঁচ গণ্ডা জমি কিনেছিলেন নুরুল আজিম। এখন সেখানে নির্মিত হচ্ছে পাঁচতলা বাড়ি।
পশ্চিম সরফভাটার কাজী মো. হোসেনের সন্তানেরাও জীবনসংগ্রামে জয়ী। এ পরিবারের চার ছেলের সবাই এখন প্রবাসী। তাঁদের মা ফরিদা বেগম (৬০) জানালেন সংগ্রামের গল্প। তিনি বলেন, ‘২৫ বছর আগে ওদের বাবা মারা যায়। এর পরের আট বছর অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। সম্বল বলতে অল্প একটু জমি। তখনই আমার ভাই নিজের টাকায় আবুধাবি নিয়ে যায় বড় ছেলে কাজী মো. শহীদুল্লাহকে।’
এরপর পাল্টে যাওয়া শুরু। তিন ভাইকেও একে একে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিয়ে গেছেন শহীদুল্লাহ। সন্তানদের উপার্জনে জমি কিনেছেন ফরিদা বেগম। সেই জমিতে উঠেছে দালান।
কেউ কেউ প্রবাসী হয়েছিলেন অন্য কারণে। পূর্ব মধ্যম সরফভাটা হাজী নাজির উজ্জামান সওদাগর বাড়ির বাসিন্দা নুরুল আবছার (৪৯) দেশ ছেড়েছিলেন ১৯৯৭ সালে। এর আট বছর আগে নিজের ছোট ভাই দোলোয়ার হোসেনকে (৪৭) পৈত্রিক জমি বিক্রি করে পাঠিয়েছিলেন কাতার। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন নুরুল আবছার। তাই পরিবারের সদস্যদের চাপে তিনিও প্রবাসী হন।
নুরুল আবছার বলেন, বিদেশে চলে যাওয়াতেই এখনো ভালোভাবে বেঁচে আছি। তা না হলে হয়তো প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হতাম।
পথ দেখালেন নুরুল ইসলাম : ইউনিয়নের বয়োজ্যেষ্ঠ অধিবাসীরা জানান, ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে প্রথম কাতার গিয়েছিলেন ছৈদরখিল গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম। সেই শুরু। আত্মীয় ও বন্ধুদের সহায়তায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাওয়া শুরু করেন এলাকার বাসিন্দারা। এখন মূলত পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমেই বিদেশে যান সরফভাটার অধিবাসীরা।
নুরুল আবছার জানান, ছোট ভাই, তিন ভাতিজাসহ আমাদের পাড়ার মোট ২৪ জন পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ইউনিয়নে এমন পাড়ার দেখা মিলবে অহরহ। মধ্যম সরফভাটা কাজী মো. তকি মিয়াজির বাড়িতে প্রবাসীর সংখ্যা ১৮।
এ বাড়ির বাসিন্দা ও সরফভাটা সমিতি চট্টগ্রামের আহ্বায়ক কাজী এ এম এম মমতাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার অনেকে মানুষ প্রবাসী হওয়ায় পাল্টে গেছে জীবনযাত্রা। ঘরে ঘরে স্বচ্ছলতা এসেছে। লেখাপড়ায় আগ্রহ বেড়েছে। পাল্টেছে পুরোনো পেশাও। অতীতে এখানকার অধিবাসীদের মূল পেশা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আনা কাঠ-বাঁশ বেচাকেনা, নৌকা চালনা, কৃষি ও স্বল্প পুঁজির ব্যবসা। অতীতের মতো এখনো কৃষিকাজ হয় তবে অন্য পেশাজীবীদের সংখ্যা খুবই কম।
সরফভাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম মুজিবুল ইসলাম সরফী বলেন, প্রবাসীদের কল্যাণে এলাকার অর্থনীতির চিত্র পাল্টে গেছে। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় দুইশ বাসিন্দা নতুন পাসপোর্ট তৈরি করেন। তাঁদের অনেকে বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে যান।
চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জহিরুল আলম মজুমদার জানান, ২০১০ ও ২০১১ সালের দেশের সবকয়টি জেলার মধ্যে জনশক্তি রপ্তানিতে চট্টগ্রাম জেলা শীর্ষে। নিবন্ধন করতে আসা বিদেশগামীদের মধ্যে রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা ও পাশের কয়েকটি ইউনিয়নের বাসন্দািদের সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ির কয়েকটি ইউনিয়নের প্রচুর সংখ্যক অধিবাসী প্রবাসে কর্মরত।
জানা যায়, ৫০ হাজার অধিবাসীর এ ইউনিয়নের প্রায় ছয় হাজারের বেশি বাসিন্দাই এখন প্রবাসী। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় বিদেশ যাত্রা। প্রবাসীদের কল্যাণে এখন পাল্টে গেছে এলাকার চিত্র। পাড়ায় পাড়ায় নির্মিত হয়েছে পাকা বাড়ি। এসেছে সচ্ছলতা, বেড়েছে শিক্ষার হার। এমনকি হারিয়ে যেতে বসেছে এ জনপদের প্রাচীন পেশাগুলোও।
প্রবাসী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা জানান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, কুয়েতসহ মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের বসবাস। প্রধানত জীবিকার তাগিদেই আত্মীয় ও পরিচিতদের সহায়তায় ভিনদেশে পাড়ি জমানো শুরু হয়। তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এ প্রবণতার কারণে স্থানীয় তরুণেরাও এখন বিদেশমুখী। এখানকার গ্রামগুলোতে এমন পরিবারের দেখাও মিলবে যাদের সব পুরুষ সদস্যই প্রবাসী।
দুঃখ জয়ের গল্প: ১৯৭৪ সালে নুরুল আজিম রাঙ্গুনিয়ার কর্ণফুলী জুট মিলে মেকানিক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু চাকরির আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। তাই সিদ্ধান্ত নেন বিদেশ যাওয়ার। ১৯৯৩ সালের ৬ জুন স্বেচ্ছায় অবসরে গেলে এক লাখ ১৭ হাজার টাকা পান। ঋণ শোধের পর তাঁর হাতে ছিল ৯৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করে এক বন্ধুর সহায়তায় পাড়ি জমান ওমানের মাস্কাট শহরে। সেখানে কাজ নেন একটি দোকানের ব্যবস্থাপকের।
নুরুল আজিম বলেন, ‘এরপর আর কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। ভালো উপার্জন হয়েছে। পাঁচ ছেলের তিনজনই বিদেশ গেছে আমার আয়ে। দেশে থাকা অবস্থায় অনেক সংগ্রাম করেছি। ভাগ্য বদলাতে পারিনি। বিদেশে গিয়েই জীবনসংগ্রামে জয়ী হয়েছি।’ নিজের বাড়ির কাছেই মধ্যম সরফভাটায় পাঁচ গণ্ডা জমি কিনেছিলেন নুরুল আজিম। এখন সেখানে নির্মিত হচ্ছে পাঁচতলা বাড়ি।
পশ্চিম সরফভাটার কাজী মো. হোসেনের সন্তানেরাও জীবনসংগ্রামে জয়ী। এ পরিবারের চার ছেলের সবাই এখন প্রবাসী। তাঁদের মা ফরিদা বেগম (৬০) জানালেন সংগ্রামের গল্প। তিনি বলেন, ‘২৫ বছর আগে ওদের বাবা মারা যায়। এর পরের আট বছর অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। সম্বল বলতে অল্প একটু জমি। তখনই আমার ভাই নিজের টাকায় আবুধাবি নিয়ে যায় বড় ছেলে কাজী মো. শহীদুল্লাহকে।’
এরপর পাল্টে যাওয়া শুরু। তিন ভাইকেও একে একে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিয়ে গেছেন শহীদুল্লাহ। সন্তানদের উপার্জনে জমি কিনেছেন ফরিদা বেগম। সেই জমিতে উঠেছে দালান।
কেউ কেউ প্রবাসী হয়েছিলেন অন্য কারণে। পূর্ব মধ্যম সরফভাটা হাজী নাজির উজ্জামান সওদাগর বাড়ির বাসিন্দা নুরুল আবছার (৪৯) দেশ ছেড়েছিলেন ১৯৯৭ সালে। এর আট বছর আগে নিজের ছোট ভাই দোলোয়ার হোসেনকে (৪৭) পৈত্রিক জমি বিক্রি করে পাঠিয়েছিলেন কাতার। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন নুরুল আবছার। তাই পরিবারের সদস্যদের চাপে তিনিও প্রবাসী হন।
নুরুল আবছার বলেন, বিদেশে চলে যাওয়াতেই এখনো ভালোভাবে বেঁচে আছি। তা না হলে হয়তো প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হতাম।
পথ দেখালেন নুরুল ইসলাম : ইউনিয়নের বয়োজ্যেষ্ঠ অধিবাসীরা জানান, ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে প্রথম কাতার গিয়েছিলেন ছৈদরখিল গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম। সেই শুরু। আত্মীয় ও বন্ধুদের সহায়তায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাওয়া শুরু করেন এলাকার বাসিন্দারা। এখন মূলত পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমেই বিদেশে যান সরফভাটার অধিবাসীরা।
নুরুল আবছার জানান, ছোট ভাই, তিন ভাতিজাসহ আমাদের পাড়ার মোট ২৪ জন পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ইউনিয়নে এমন পাড়ার দেখা মিলবে অহরহ। মধ্যম সরফভাটা কাজী মো. তকি মিয়াজির বাড়িতে প্রবাসীর সংখ্যা ১৮।
এ বাড়ির বাসিন্দা ও সরফভাটা সমিতি চট্টগ্রামের আহ্বায়ক কাজী এ এম এম মমতাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার অনেকে মানুষ প্রবাসী হওয়ায় পাল্টে গেছে জীবনযাত্রা। ঘরে ঘরে স্বচ্ছলতা এসেছে। লেখাপড়ায় আগ্রহ বেড়েছে। পাল্টেছে পুরোনো পেশাও। অতীতে এখানকার অধিবাসীদের মূল পেশা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আনা কাঠ-বাঁশ বেচাকেনা, নৌকা চালনা, কৃষি ও স্বল্প পুঁজির ব্যবসা। অতীতের মতো এখনো কৃষিকাজ হয় তবে অন্য পেশাজীবীদের সংখ্যা খুবই কম।
সরফভাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম মুজিবুল ইসলাম সরফী বলেন, প্রবাসীদের কল্যাণে এলাকার অর্থনীতির চিত্র পাল্টে গেছে। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় দুইশ বাসিন্দা নতুন পাসপোর্ট তৈরি করেন। তাঁদের অনেকে বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে যান।
চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জহিরুল আলম মজুমদার জানান, ২০১০ ও ২০১১ সালের দেশের সবকয়টি জেলার মধ্যে জনশক্তি রপ্তানিতে চট্টগ্রাম জেলা শীর্ষে। নিবন্ধন করতে আসা বিদেশগামীদের মধ্যে রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা ও পাশের কয়েকটি ইউনিয়নের বাসন্দািদের সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ির কয়েকটি ইউনিয়নের প্রচুর সংখ্যক অধিবাসী প্রবাসে কর্মরত।
No comments