ব্রাজিল টু বাংলাদেশ

পেলের দেশের ফুটবলার। শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু আসলে এঁরা কেমন? ভিনদেশে কেমনই বা আছেন? বাংলাদেশে ক্লাব ফুটবলে এখন খেলা তিন ব্রাজিলিয়ানকে নিয়ে লিখেছেন মাসুদ আলম ‘বাংলাদেশ...বাংলাদেশ...কোথায় এই দেশটা? গুগলে সার্চ দিয়ে কিছু তথ্য পেলাম। তার আগে পর্যন্ত একটা কৌতূহল ছিল বাংলাদেশ নিয়ে।’


রাফায়েল ডি আন্দ্রের কৌতূহল খানিক মিটেছে ঢাকায় আসার পর। বাংলাদেশের জল-হাওয়ার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় সারা। তবে এখানে নিজেকে আবিষ্কার করলেন একটু অন্যভাবে। ‘রাস্তায় হাঁটলে অনেকেই বিস্মিত চোখে আমাদের দেখে। যেন ভিন গ্রহের মানুষ আমরা। আসলে আমরা লম্বা তো, তাই... (হাসি)।’
নিজের বিছানায় পাতা ল্যাপটপে পর্তুগিজ ভাষায় লিখছেন রাফায়েল। ল্যাপটপে সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজি ভাষান্তর। ব্রাজিলিয়ানের সঙ্গে কথা বলার সহজ এক মাধ্যম!
‘আমরা’ বলতে রাফায়েল বুঝিয়েছেন আরেকজনকে—উইলিংটন ডি লিমা। দুজনই মুুক্তিযোদ্ধার হয়ে খেলছেন বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলে। ধানমন্ডিতে দলটির আবাসিক ক্যাম্পে দুজন থাকেন একই কক্ষে, পাশাপাশি বিছানায়। রাফায়েল টুকটাক ইংরেজি বুঝলেও লিমা খুবই কম। তবে ‘ল্যাপটপ-সাহায্য’ থাকলে আর সমস্যা কী!
দুজনে মিল অনেক। প্রথম দর্শনেই চোখে পড়ে উচ্চতা। ২২ বছরের স্টপার রাফায়েল ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। কাকাকাছি উচ্চতা মিডফিল্ডার লিমারও, বয়সও প্রায় ২১। এঁদের এক অতি আপনজন আছেন এ দেশে—২৭ বছরের এভারটন সুজা সান্তোস। বাংলাদেশে খেলা আরেক ফুটবলার, লিমা-রাফায়েলের সিনিয়র। তিনজনেরই শরীরে ব্রাজিলিয়ান রক্ত। তা এঁরা কেমন ফুটবলার?
এভারটনের ক্ষেত্রে উত্তরটা গত বছর ছিল এক রকম, এখন আরেক রকম। গত মৌসুমে ব্রাদার্সে এসেই চোখ কেড়েছেন। কিন্তু এবার শেখ জামালের হয়ে এত দিন কাটছিল বেঞ্চে। গত ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ হয়েছে অবশেষে। তবে দল হেরেছে। সতীর্থরা জানাচ্ছেন, এত দিন এভারটনের বেঞ্চে কাটানোর কারণে খেলায় মন নেই। সারা রাত ফেসবুকে কাটান। ঢাকায় মডেল, টিভি অভিনেত্রীর সঙ্গে ঘোরেন। বুঝুন অবস্থা!
অনেকের চোখে ‘জোকার’, গ্যালারি শো ভালোই জানেন। চুলে নেইমার কাট দিয়ে নিজেকে দাবি করছেন নেইমারের বন্ধু বলে! অথচ হালের সেই ‘নেইমার’কে না খেলানো নিয়ে কত নাটক শেখ জামালে! দলটির বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে দামি এই এভারটনই (সাড়ে চার হাজার ডলার মাসিক বেতন)। তাঁকে খেলানোর জন্য তাই ক্লাব সভাপতি চাপ দিয়েছিলেন কোচ সাইফুল বারীর ওপর। শেষ পর্যন্ত সাইফুল চাকরিও হারিয়েছেন! নতুন কোচ আবু ইউসুফ প্রথম ম্যাচটায় এভারটনকে খেলালেও চেনা তো যায়ইনি, উল্টো দল হেরেছে। দলের অনেকেই বলছেন, এভারটনকে না খেলালেই জিতত শেখ জামাল!
রাফায়েল-লিমার শুরুটাও ভালোই। মুক্তিযোদ্ধার কোচ শফিকুল ইসলাম দুজনকেই দিচ্ছেন দরাজ সার্টিফিকেট, ‘দুজনই ভালো খেলোয়াড়। ব্রাজিলিয়ান ছোঁয়া আছে। তবে লিমাকে আমার একটু বেশিই পছন্দ।’
বাংলাদেশে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার বিষয়ক আলোচনায় এখনো হাসাহাসি হয় ২০০১-০২ মৌসুমে বঙ্গবন্ধু কাপে খেলে যাওয়া ব্রাজিলের দলটি নিয়ে। ‘আদতে ফুটবলারই নয়, কোথা থেকে ধরে এনে তাদের নামিয়ে দিয়েছিল আয়োজক বাফুফে’, এখনো অনেকে এই কথা বলেন। দলটি বুট, জার্সি নাকি ঢাকায় এসে কিনেছিল! তারপর কোচ হয়ে এলেন ডিডো, যিনি বাফুফেকে ভালোই নাচিয়ে ছেড়েছেন কিছুদিন। যদিও পূর্বসূরিদের মতো তাঁর বিদায়ও ছিল তিক্ততায় ভরা।
এই ব্রাজিলিয়ানদের বিদায় কেমন হবে কে জানে! তবে তাঁদের বাংলাদেশে আসাটা ঘটনাক্রমেই। এজেন্ট সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করতে না পারায় কাতারগামী এভারটন তাঁর নৌকাটা দুবাই হয়ে ভিড়িয়ে দেন ঢাকায়। রাফায়েল-লিমাকে পাঠিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সম্প্রতি সমঝোতা স্মারক সই করা ব্রাজিলের এক প্রাদেশিক ক্লাব। রাফায়েল-লিমা ঢাকায় যে মাসিক পারিশ্রমিক পাচ্ছেন, এর ৩০ শতাংশ দিতে হচ্ছে ওই ক্লাবকে।
এই ব্রাজিলিয়ানরা এসেছেন অসচ্ছল পরিবার থেকে। এভারটন জানাচ্ছেন, ‘সাও পাওলোর সান্তোসের জুনিয়র দলে খেলে আমি বাড়ি-গাড়ি করেছিলাম। কিন্তু পারিবারিক প্রয়োজনে এখন সবই শেষ। বাবা কৃষিকাজ করেন। তাঁকে আর্থিক সাহায্য করাই এখন আমার লক্ষ্য।’
রাফায়েলের কথা, ‘আমার বাবা শ্রমিক। চাল-ডালের বস্তা ট্রাকে তোলেন। ২০ বছর থেকে এটা করছেন। মা রেস্টুরেন্টে রান্নার কাজ করেন।’ লিমা বলছেন, ‘মা একটি বিপণি বিতানের পরিচ্ছন্নতা কর্মী। বাবা ৩২ বছর ধরে পৌরসভার ড্রাইভার। বাবা-মা তো আছেনই, একমাত্র বোনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার টাকাও পাঠাচ্ছি।’
‘ঢাকায় ভালো খেলতে চাই’ বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেখায় তিনজনকেই। এই প্রতিবেদককে লিমার অনুরোধ, ‘প্রথম দুটি লিগ ম্যাচে গোল আছে আমার। অনুগ্রহ করে ম্যাচ দুটির ভিডিও জোগাড় করে দিতে পারবে?’ এই ভিডিও দেখিয়েই অন্যত্র সুযোগ খুঁজবেন, যেভাবে বাংলাদেশে আসা অন্য বিদেশিরা খোঁজেন।
রাফায়েল-লিমার ঢাকায় ঘরবন্দী জীবন। বসুন্ধরা সিটি আর পিৎজা হাট যা একটু চেনা হয়েছে এভারটনের সৌজন্যে। ‘এভারটন থাকায় একটু ভরসা পাচ্ছি’—দুজনের কণ্ঠে একই সুর। তিনজনই ঢাকায় ঝাল রান্না খেতে পারেন না। কফির জন্য বিখ্যাত দেশের ফুটবলাররা পছন্দ করেন এখানকার চা। বাংলা-ইংরেজি মিশেলে রাফায়েল-লিমার উচ্চারণ, ‘চা ইজ ভেরি গুউদ...।’
রাফায়েল-লিমার প্রথম দেখা গত বছর। লিমার রাজ্য মোটো গ্রাসোর এমএস সাদ ক্লাবে গত বছর দুজন অনুশীলন করতেন। সেখানেই বন্ধুত্ব। স্বদেশি ইন্টার মিলান ডিফেন্ডার লুসিওর ভক্ত রাফয়েল, লিমার প্রিয় খেলোয়াড় জিনেদিন জিদান। রাফায়েল জানালেন, ‘রাজ্যের হয়ে রোনালদিনহোর ফ্ল্যামেঙ্গোর বিপক্ষে একটা প্রদর্শনী ম্যাচে খেলেছি।’ লিমার সুখস্মৃতি, ‘একবার নেইমারের সান্তোসের বিপক্ষে প্রদর্শনী ম্যাচে রাজ্য দলে ছিলাম।’
বাংলাদেশের ফুটবল প্রসঙ্গে রাফায়েল বললেন, ‘আমরা খেলি ছোট পাসে। বাংলাদেশে লম্বা পাস বেশি।’ এভারটনের কথা, ‘এ দেশে বল ধরো আর লম্বা খেল। টেকনিক্যাল দিকটা উপেক্ষিত।’
এসব নিয়ে অবশ্য ভাবার সময় নেই এই ব্রাজিলিয়ানদের। ফুটবল খেলে বাবা-মাকে একটু উন্নত জীবন দেওয়ার স্বপ্ন এঁকে চলেছেন তিনজন। বাংলাদেশ যেন তাঁদের জীবন ট্রেনেরই এক স্টেশন!

No comments

Powered by Blogger.