চরাচর-সাঁওতাল বিদ্রোহ by সাজ্জাদ কবীর
সব বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় নিপীড়ন থেকে। শাসকের হাত যখন হয়ে ওঠে দস্যুর থাবা তখন শোষিতের আর কিছুই করার থাকে না। সহ্য করতে করতে একসময় বিস্ফোরণ ঘটে। আজ থেকে প্রায় দেড় শ বছর আগেও ঘটেছিল এমনি এক ঘটনা। নিরীহ সাঁওতালরা ছিল খুবই সহজ-সরল।
গায়ে খেটে ক্ষেতে ফসল ফলাত, জঙ্গলে শিকার করত। সামান্য প্রাপ্তিতেই তাদের আনন্দের সীমা ছিল না। কিন্তু শোষকের কালো থাবা তাদের গ্রাস করল। সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেলে তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিল।
সাঁওতাল পরগনার মানুষ এখানে এসে বসবাস শুরু করেছে বহুদূর থেকে। ভাগলপুর থেকে শুরু করে উড়িষ্যার বৈতরণী নদীর পাড় থেকে এসেছিল তারা। তখন তাদের জনসংখ্যা প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখ। নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই তাদের আনাগোনা। তেমন একটা বাইরে তারা যেত না। নিজেদের জমি আর জঙ্গল নিয়েই তারা সন্তুষ্ট ছিল।
দেশে তখন ইংরেজ শাসন চলছে। ইংরেজরা আসলে সাঁওতালদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানতই না। তারা এসব অঞ্চলে সরকারি কর্মচারী পাঠিয়ে খাজনা আদায় করেই কর্তব্য শেষ করত। তাদের বিদ্রোহ প্রথমে কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয়নি। তিতুমীরের মতো এ যুদ্ধও ছিল ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। সংগত কারণেই ধনিক শ্রেণীর সঙ্গে সরকারের সখ্য থাকে। সেই সূত্র ধরেই একসময় সরকারও এতে জড়িয়ে পড়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহ এভাবেই ক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়ে। ফসল কাটা হয়ে গেলে সাঁওতালরা এগুলো বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে যেত। তারা অশিক্ষিত ছিল; কিন্তু তাদের মধ্যে সততা ছিল শতভাগ। তাদের ফসল বিক্রির মূল্য কী হতে পারে তা তাদের বোধগম্য ছিল না। এই ফসল কিনতে সেসব বাজারে হাজির হতো হিন্দু মহাজনরা। এসব ব্যবসায়ী কেউ কেউ সুবিধার জন্য বাজারের কাছে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এসব মহাজন ছিল অসাধু এবং ধূর্ত। ফসল কেনার সময় তারা নানাভাবে সাঁওতালদের ঠকাত। ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের কাছ থেকে লবণ, তেল, কাপড়, বারুদ এসবের বিপরীতে নিত ফসল। নেওয়ার সময় তারা একধরনের মাপ ব্যবহার করত। আবার দেওয়ার সময় তাদের মাপের পাত্র ছিল আলাদা। ফলে কেনার সময় এবং বেচার সময় দুবারই তারা সাঁওতালদের ঠকাত।
কোনো কারণবশত যদি একটি সাঁওতাল পরিবারের খাবার না থাকে, তাহলে সে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিত। মহাজন তাকে সারা বছর বেঁচে থাকার মতো শস্য দিয়ে যেত। আর কাটা সব ফসল মহাজনকে দিয়েও তার দেনা শোধ হতো না। তাদের প্রতিবাদের কোনো জায়গা ছিল না। ইংরেজ সরকার বলতে তখন ইস্ট-ইন্ডিয়া কম্পানি, যারা তাদের আয়ের ব্যাপারেই তখন ব্যস্ত থাকত। গরিব প্রজার সমস্যা সমাধানের সময় তাদের হাতে ছিল না। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যদি কোনো সাঁওতাল কাজ করতে না চাইত, তাহলে তার খাওয়া বন্ধ করে দিত। যখন পরগনাজুড়ে অসন্তোষ ঠিক তখন আবির্ভাব হয় দুই ভাই সিধো আর কানহুর। তারা প্রথমে দরখাস্ত পাঠাল কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের দুর্দশার কথা জানিয়ে। কিন্তু তার কোনো উত্তর তারা পেল না। এরপর তারা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে গেল। তারা তাদের দুর্দশার প্রতিকার চাইল। আর এও জানাল, যদি তা না হয় তাহলে নিজেরাই এর প্রতিকার করবে। সাঁওতালদের সম্পর্কে সরকার তেমন কোনো তথ্যই রাখত না। ফলে তাদের কোনো কথার গুরুত্ব দিল না। আর এভাবেই দেশের সবচেয়ে শান্ত অঞ্চলটা হয়ে উঠল সংঘাতময়।
সাঁওতালরা হাতে তুলে নিল তীর-ধনুক। তারা একতাবদ্ধ হলো কলকাতা যাওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে তারা তাদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকার চাইবে। দলে দলে তারা বেরিয়ে পড়ল কলকাতার উদ্দেশে। শুধু নেতাদের দেহরক্ষীই ছিল ৩০ হাজারের মতো। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন শুরু হয় এই অভিযান। হাজার হাজার সশস্ত্র মানুষের এই জোয়ার জনপদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল। যত দিন তাদের কাছে নিজেদের খাবার ছিল তত দিন পর্যন্ত তারা শান্তভাবেই এগিয়ে চলে। কিন্তু যখন খাবার ফুরিয়ে গেল তখনই শুরু হলো লুটপাট। অবশ্য তখন পর্যন্ত তারা কোনো মানুষ হত্যা করেনি।
জুলাইয়ের ৭ তারিখে সশস্ত্র দল ঢুকে পড়ে একটা থানা এলাকায়। মহান এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় দুই ভাই সিধো আর কানহু। তাদের সঙ্গে আরো দুই ভাই ছিল_চাঁদ আর ভৈরব। সব সাঁওতাল অঞ্চল জেগে ওঠে। তারা তীর-ধনুক, তলোয়ার আর দেশি বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। কার্ল মার্কস তাঁর 'নোটস অব ইন্ডিয়া'তে সাঁওতালদের এই বিদ্রোহকে বলেছেন গেরিলা যুদ্ধ। প্রথম দিকে অবশ্য এটা গেরিলা যুদ্ধ ছিল না। তারা তখন জানিয়ে-শুনিয়ে পরোয়ানা পাঠিয়ে অভিযানে বের হয়। পরে অবশ্য ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে তারা গেরিলা যুদ্ধই করেছিল। সাঁওতালরা এই যুদ্ধে জিততে পারেনি ঠিকই; কিন্তু তারা মাথা নত করেনি। ইংরেজ সরকার বর্বরোচিতভাবে তাদের প্রতিহত করেছিল। তাদের বুলেটের সামনে সামান্য তীর-ধনুক নিয়ে সাঁওতালরা বীরের মতো লড়ে গেছে। তারা জিততে না পারলেও রেখে গেছে ন্যায়সংগত একটি বিদ্রোহের প্রতীক।
সাজ্জাদ কবীর
সাঁওতাল পরগনার মানুষ এখানে এসে বসবাস শুরু করেছে বহুদূর থেকে। ভাগলপুর থেকে শুরু করে উড়িষ্যার বৈতরণী নদীর পাড় থেকে এসেছিল তারা। তখন তাদের জনসংখ্যা প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখ। নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই তাদের আনাগোনা। তেমন একটা বাইরে তারা যেত না। নিজেদের জমি আর জঙ্গল নিয়েই তারা সন্তুষ্ট ছিল।
দেশে তখন ইংরেজ শাসন চলছে। ইংরেজরা আসলে সাঁওতালদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানতই না। তারা এসব অঞ্চলে সরকারি কর্মচারী পাঠিয়ে খাজনা আদায় করেই কর্তব্য শেষ করত। তাদের বিদ্রোহ প্রথমে কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয়নি। তিতুমীরের মতো এ যুদ্ধও ছিল ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। সংগত কারণেই ধনিক শ্রেণীর সঙ্গে সরকারের সখ্য থাকে। সেই সূত্র ধরেই একসময় সরকারও এতে জড়িয়ে পড়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহ এভাবেই ক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়ে। ফসল কাটা হয়ে গেলে সাঁওতালরা এগুলো বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে যেত। তারা অশিক্ষিত ছিল; কিন্তু তাদের মধ্যে সততা ছিল শতভাগ। তাদের ফসল বিক্রির মূল্য কী হতে পারে তা তাদের বোধগম্য ছিল না। এই ফসল কিনতে সেসব বাজারে হাজির হতো হিন্দু মহাজনরা। এসব ব্যবসায়ী কেউ কেউ সুবিধার জন্য বাজারের কাছে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এসব মহাজন ছিল অসাধু এবং ধূর্ত। ফসল কেনার সময় তারা নানাভাবে সাঁওতালদের ঠকাত। ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের কাছ থেকে লবণ, তেল, কাপড়, বারুদ এসবের বিপরীতে নিত ফসল। নেওয়ার সময় তারা একধরনের মাপ ব্যবহার করত। আবার দেওয়ার সময় তাদের মাপের পাত্র ছিল আলাদা। ফলে কেনার সময় এবং বেচার সময় দুবারই তারা সাঁওতালদের ঠকাত।
কোনো কারণবশত যদি একটি সাঁওতাল পরিবারের খাবার না থাকে, তাহলে সে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিত। মহাজন তাকে সারা বছর বেঁচে থাকার মতো শস্য দিয়ে যেত। আর কাটা সব ফসল মহাজনকে দিয়েও তার দেনা শোধ হতো না। তাদের প্রতিবাদের কোনো জায়গা ছিল না। ইংরেজ সরকার বলতে তখন ইস্ট-ইন্ডিয়া কম্পানি, যারা তাদের আয়ের ব্যাপারেই তখন ব্যস্ত থাকত। গরিব প্রজার সমস্যা সমাধানের সময় তাদের হাতে ছিল না। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যদি কোনো সাঁওতাল কাজ করতে না চাইত, তাহলে তার খাওয়া বন্ধ করে দিত। যখন পরগনাজুড়ে অসন্তোষ ঠিক তখন আবির্ভাব হয় দুই ভাই সিধো আর কানহুর। তারা প্রথমে দরখাস্ত পাঠাল কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের দুর্দশার কথা জানিয়ে। কিন্তু তার কোনো উত্তর তারা পেল না। এরপর তারা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে গেল। তারা তাদের দুর্দশার প্রতিকার চাইল। আর এও জানাল, যদি তা না হয় তাহলে নিজেরাই এর প্রতিকার করবে। সাঁওতালদের সম্পর্কে সরকার তেমন কোনো তথ্যই রাখত না। ফলে তাদের কোনো কথার গুরুত্ব দিল না। আর এভাবেই দেশের সবচেয়ে শান্ত অঞ্চলটা হয়ে উঠল সংঘাতময়।
সাঁওতালরা হাতে তুলে নিল তীর-ধনুক। তারা একতাবদ্ধ হলো কলকাতা যাওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে তারা তাদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকার চাইবে। দলে দলে তারা বেরিয়ে পড়ল কলকাতার উদ্দেশে। শুধু নেতাদের দেহরক্ষীই ছিল ৩০ হাজারের মতো। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন শুরু হয় এই অভিযান। হাজার হাজার সশস্ত্র মানুষের এই জোয়ার জনপদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল। যত দিন তাদের কাছে নিজেদের খাবার ছিল তত দিন পর্যন্ত তারা শান্তভাবেই এগিয়ে চলে। কিন্তু যখন খাবার ফুরিয়ে গেল তখনই শুরু হলো লুটপাট। অবশ্য তখন পর্যন্ত তারা কোনো মানুষ হত্যা করেনি।
জুলাইয়ের ৭ তারিখে সশস্ত্র দল ঢুকে পড়ে একটা থানা এলাকায়। মহান এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় দুই ভাই সিধো আর কানহু। তাদের সঙ্গে আরো দুই ভাই ছিল_চাঁদ আর ভৈরব। সব সাঁওতাল অঞ্চল জেগে ওঠে। তারা তীর-ধনুক, তলোয়ার আর দেশি বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। কার্ল মার্কস তাঁর 'নোটস অব ইন্ডিয়া'তে সাঁওতালদের এই বিদ্রোহকে বলেছেন গেরিলা যুদ্ধ। প্রথম দিকে অবশ্য এটা গেরিলা যুদ্ধ ছিল না। তারা তখন জানিয়ে-শুনিয়ে পরোয়ানা পাঠিয়ে অভিযানে বের হয়। পরে অবশ্য ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে তারা গেরিলা যুদ্ধই করেছিল। সাঁওতালরা এই যুদ্ধে জিততে পারেনি ঠিকই; কিন্তু তারা মাথা নত করেনি। ইংরেজ সরকার বর্বরোচিতভাবে তাদের প্রতিহত করেছিল। তাদের বুলেটের সামনে সামান্য তীর-ধনুক নিয়ে সাঁওতালরা বীরের মতো লড়ে গেছে। তারা জিততে না পারলেও রেখে গেছে ন্যায়সংগত একটি বিদ্রোহের প্রতীক।
সাজ্জাদ কবীর
No comments