সবচেয়ে ভালোবাসো মাতৃভাষাকে by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল, যেসব মানুষ বাংলাদেশের যে এলাকার, সে এলাকার কথা বলতেই তাদের সবচেয়ে আরাম। তাই যদি হয়, নিজের জায়গার ভাষা বলতেই মানুষ যদি সবচেয়ে সুখী হয়, তবে পৃথিবীর মধ্যে যত ভাষা আছে, তার মধ্যে জাপানিরা কোন ভাষাটা বললে সবচেয়ে খুশি হবে? আরবি,
ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ না জাপানি? (ছেলেমেয়েরা : জাপানি)। চীনারা কোন ভাষা বলতে পারলে সবচেয়ে আরাম পাবে? (ছাত্রছাত্রীরা : চীনা ভাষা)। ইংরেজরা? (ছাত্রছাত্রীরা : ইংরেজি ভাষা)। তাই যদি হয়, তবে আমাদের বাঙালিদের কোন ভাষা বলতে সবচেয়ে শান্তি? (ছাত্রছাত্রীরা : বাংলা ভাষা।) তোমরা কি সিন্ডারেলার গল্পটা জানো? (ছাত্রছাত্রীরা : জানি)। সিন্ডারেলার কাচের জুতো কি দেশের অন্য কোনো মেয়ের পায়ে লেগেছিল, না কেবল সিন্ডারেলার পায়েই লেগেছিল? (ছাত্রছাত্রীরা : শুধু সিন্ডারেলার পায়েই লেগেছিল।) অন্যের জামা, অন্যের জুতো দেখতে যত সুন্দরই হোক, তুমি সেগুলো পরলে কি তোমার খুব আরাম লাগবে? (ছাত্রছাত্রীরা : না।) সব সময় যেন কেমন খচখচ করবে, তাই না? বলো তো কার জামা-জুতো পরলে তোমার শরীরে সবচেয়ে মানানসই হবে, তোমাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখাবে, তোমার সবচেয়ে আরাম লাগবে? (ছাত্রছাত্রীরা : আমার জুতো-জামা পরলে।) পৃথিবীর সব মানুষেরই তো একজন করে মা আছে, তাই না। এই যে এখানে তোমরা প্রায় ৪০০-৫০০ ছেলেমেয়ে বসে আছ, তোমাদের প্রায় সবারই তো মা আছে তাই না? (ছাত্রছাত্রীরা : আছে)। বলতো, এই মায়েদের মধ্যে কার মা তোমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়, সবচেয়ে বেশি আপন? (ছাত্রছাত্রীরা : আমার মা।) এবার বলতো অনেক ভাষাই তো আছে পৃথিবীতে, অনেক সুন্দর সুন্দর ভাষা, কিন্তু কোন ভাষাটি তোমার সবচেয়ে প্রাণের ভাষা? কোন ভাষা বললে তোমার বুকের ভেতরটা সবচেয়ে বেশি জুড়িয়ে যায়, খুশি হয়? শরীরে-মনে অসীম আরাম পাও? তোমার মাতৃভাষা- বাংলা, তাই না? (ছাত্রছাত্রীরা : হ্যাঁ)।
৪
এখন এসো তোমাদের বোঝাতে চেষ্টা করি, কেন মাতৃভাষা বললে আমাদের এত আনন্দ লাগে। কেন অমন করে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। এর এক নম্বর কারণ, এ ভাষা আমাদের চেষ্টা করে শিখতে হয় না। নিজের অজান্তে একলা একলাই আমরা শিখে ফেলি। রাতের শেফালির মতো এ আমাদের জীবনের ভেতর আমাদের অগোচরে ফুটে ওঠে, সুরভি ছড়ায়। তুমি যখন ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান ভাষা শেখ তখন এদের প্রত্যেকটা শব্দ তোমাকে মুখস্থ করতে হয়। ব্যাকরণের প্রতিটা নিয়ম আত্মস্থ করতে হয়। এ বড়ই পরিশ্রম আর কষ্টের কাজ। আমাদের ভেতরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। তাই আলোর মতো, হাওয়ার মতো আমাদের ভেতর এরা খেলা করে না। জোর করে আমাদের জীবনের ভেতর ঠুকে ঠুকে ঢোকাতে হয়। এসব কষ্ট করে শেখা ভাষাগুলো সবার জন্যই এক ধরনের কৃত্রিম ভাষা। তাই এরা ত্বকের মতো আমাদের নিজেদের জিনিস নয়, চাপিয়ে দেওয়া পোশাকের মতো শরীরের ওপর সেঁটে থাকা জিনিস। মুখস্থ করতে করতে এগুলো এক সময় আমাদের অভ্যাসের ব্যাপার হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন সারাক্ষণ খচখচ করে। চর্চা কমে গেলে এগুলোকে অনেক সময় ভুলেও যাই। কিন্তু নিজের ভাষাকে পাই আমরা অনায়াসে, আনন্দের মধ্য দিয়ে, আলোর মতো সহজে। তাই এ ভাষার মধ্যে আমাদের মনের স্বতঃস্ফূর্ত দীপ্তি এমন হীরের কুচির মতো আলো ছড়ায়। চাঁদের যেমন জোছনা, সূর্যের যেমন আলো, ফুলের যেমন সুবাস, মানুষের জীবনে মাতৃভাষা ঠিক তেমনি। মানুষের জীবনের যত আনন্দ, যত স্বপ্ন, যত স্মৃতি, যত কথা, অনুভূতি আর দীপ্তি- সব থাকে মাতৃভাষার মধ্যে। এ জন্য কেউ যদি পৃথিবীতে বড় হতে চায়, মাতৃভাষা ছাড়া তার কোনো পথ নেই। তুমি যদি রাজনীতিবিদ হতে চাও, তবে মাতৃভাষা তোমাকে ভালো করে জানতেই হবে। না হলে জনগণকে তুমি জাগিয়ে তুলবে কী করে? বক্তৃতা করার মন-ভোলানো ভঙ্গি তোমাকে তো জানতেই হবে, সেই সঙ্গে জানতে হবে জনগণের ভাষা। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা আর স্বপ্নের কথাগুলো সুন্দর ভাষায় জাতির সামনে তোমাকে তুলে ধরতে হবে। দেখ না আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়াকে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁরা কতটা সফল, তা বলতে পারব না; কিন্তু তাঁদের বাংলা ভাষাটা ভালো। তাই না? খারাপ করে কথা বললে তাঁরা কি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারতেন? লোকে বলত, বাংলাই বলতে পারে না, ভালো করে দেশ চালাবে কী করে? তুমি যদি নায়ক হতে চাও, গায়ক হতে চাও, অভিনেতা হতে চাও তোমাকে কি ভালো বাংলা জানতে হবে না? তুমি যত বড় জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত বা চিন্তাবিদই হও না কেন তোমার চিন্তাগুলো তো তোমার জাতিকে বোঝাতে হবে। মাতৃভাষা ভালোভাবে না জানলে তা বোঝাবে কী করে? তুমি যদি লেখক, ভাস্কর, কবি বা চিত্রশিল্পী হতে চাও, মানুষের ভাষা কি তোমাকে বুঝতে হবে না? বাঙালিরা কিভাবে কথা কয়, কাঁদে, হাসে, রাগ করে, কী ভাষায় কিভাবে মনের কথাগুলো প্রকাশ করে, এ তোমাকে তো জানতে হবে। বড় গায়ক হতে চাও অথচ উচ্চারণ কর খারাপ, হতে পারবে দেশের সেরা গায়ক? নাটক হয়েছো নায়ক কিন্তু তোমার উচ্চারণ গুণ্ডাদের মতো। নায়িকা কি তোমাকে ভালোবাসবে?
(চলবে)
৪
এখন এসো তোমাদের বোঝাতে চেষ্টা করি, কেন মাতৃভাষা বললে আমাদের এত আনন্দ লাগে। কেন অমন করে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। এর এক নম্বর কারণ, এ ভাষা আমাদের চেষ্টা করে শিখতে হয় না। নিজের অজান্তে একলা একলাই আমরা শিখে ফেলি। রাতের শেফালির মতো এ আমাদের জীবনের ভেতর আমাদের অগোচরে ফুটে ওঠে, সুরভি ছড়ায়। তুমি যখন ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান ভাষা শেখ তখন এদের প্রত্যেকটা শব্দ তোমাকে মুখস্থ করতে হয়। ব্যাকরণের প্রতিটা নিয়ম আত্মস্থ করতে হয়। এ বড়ই পরিশ্রম আর কষ্টের কাজ। আমাদের ভেতরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। তাই আলোর মতো, হাওয়ার মতো আমাদের ভেতর এরা খেলা করে না। জোর করে আমাদের জীবনের ভেতর ঠুকে ঠুকে ঢোকাতে হয়। এসব কষ্ট করে শেখা ভাষাগুলো সবার জন্যই এক ধরনের কৃত্রিম ভাষা। তাই এরা ত্বকের মতো আমাদের নিজেদের জিনিস নয়, চাপিয়ে দেওয়া পোশাকের মতো শরীরের ওপর সেঁটে থাকা জিনিস। মুখস্থ করতে করতে এগুলো এক সময় আমাদের অভ্যাসের ব্যাপার হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন সারাক্ষণ খচখচ করে। চর্চা কমে গেলে এগুলোকে অনেক সময় ভুলেও যাই। কিন্তু নিজের ভাষাকে পাই আমরা অনায়াসে, আনন্দের মধ্য দিয়ে, আলোর মতো সহজে। তাই এ ভাষার মধ্যে আমাদের মনের স্বতঃস্ফূর্ত দীপ্তি এমন হীরের কুচির মতো আলো ছড়ায়। চাঁদের যেমন জোছনা, সূর্যের যেমন আলো, ফুলের যেমন সুবাস, মানুষের জীবনে মাতৃভাষা ঠিক তেমনি। মানুষের জীবনের যত আনন্দ, যত স্বপ্ন, যত স্মৃতি, যত কথা, অনুভূতি আর দীপ্তি- সব থাকে মাতৃভাষার মধ্যে। এ জন্য কেউ যদি পৃথিবীতে বড় হতে চায়, মাতৃভাষা ছাড়া তার কোনো পথ নেই। তুমি যদি রাজনীতিবিদ হতে চাও, তবে মাতৃভাষা তোমাকে ভালো করে জানতেই হবে। না হলে জনগণকে তুমি জাগিয়ে তুলবে কী করে? বক্তৃতা করার মন-ভোলানো ভঙ্গি তোমাকে তো জানতেই হবে, সেই সঙ্গে জানতে হবে জনগণের ভাষা। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা আর স্বপ্নের কথাগুলো সুন্দর ভাষায় জাতির সামনে তোমাকে তুলে ধরতে হবে। দেখ না আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়াকে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁরা কতটা সফল, তা বলতে পারব না; কিন্তু তাঁদের বাংলা ভাষাটা ভালো। তাই না? খারাপ করে কথা বললে তাঁরা কি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারতেন? লোকে বলত, বাংলাই বলতে পারে না, ভালো করে দেশ চালাবে কী করে? তুমি যদি নায়ক হতে চাও, গায়ক হতে চাও, অভিনেতা হতে চাও তোমাকে কি ভালো বাংলা জানতে হবে না? তুমি যত বড় জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত বা চিন্তাবিদই হও না কেন তোমার চিন্তাগুলো তো তোমার জাতিকে বোঝাতে হবে। মাতৃভাষা ভালোভাবে না জানলে তা বোঝাবে কী করে? তুমি যদি লেখক, ভাস্কর, কবি বা চিত্রশিল্পী হতে চাও, মানুষের ভাষা কি তোমাকে বুঝতে হবে না? বাঙালিরা কিভাবে কথা কয়, কাঁদে, হাসে, রাগ করে, কী ভাষায় কিভাবে মনের কথাগুলো প্রকাশ করে, এ তোমাকে তো জানতে হবে। বড় গায়ক হতে চাও অথচ উচ্চারণ কর খারাপ, হতে পারবে দেশের সেরা গায়ক? নাটক হয়েছো নায়ক কিন্তু তোমার উচ্চারণ গুণ্ডাদের মতো। নায়িকা কি তোমাকে ভালোবাসবে?
(চলবে)
No comments