কণ্ঠস্বর-দায়িত্বশীল রাজনীতি চাই by রাহাত খান
বিএনপির রাজনীতি যদি আগের মতোই থাকে, জামায়াতকে যদি তারা ত্যাগ করতে না পারে, সংসদে ও রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ বেছে নিয়ে যদি তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দেয়, তাহলে জনগণের কাছে বিএনপি আমলের সেই নৃশংস চেহারাটাই ভেসে উঠবে। দেশের তরুণ সমাজ তাদের ক্ষমা করবে না।
আবার বলি, আগের হত্যা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দলীয়করণের রাজনীতি ত্যাগ করে এবং দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেই শুধু বিএনপি রাজনীতিতে লাভবান হতে পারে, অন্য কোনো উপায়ে নয়
কিছুদিন থেকে বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া প্রায় বিশ্বাস করা যায় না, এমন একটা নম্র, বিদ্বেষহীন ভাষায় কথা বলছেন জনগণের উদ্দেশে। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে হামলা-মামলা করে বিরোধী দল দমনের চেষ্টা করবেন না। সমাজে ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অপরাজনীতিকে 'আল-বিদা' জানিয়ে দেশে উন্নয়ন ও সমাজ জাগৃতির রাজনীতি জারি রাখবেন। রাজনীতিতে বাহুবল, গ্রেনেড-শক্তি আর বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার নাম যে রাজনীতি নয়, সেটা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়ে সাম্প্রতিক এক এনজিও প্রতিষ্ঠানের সভায় রাজনীতিতে মেধাবী ও সৎ লোকদের যোগ দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তার রাজনীতির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের বদল ঘটিয়ে খালেদা জিয়া বোধ করি এই প্রথম প্রকৃত রাজনীতির ভাষায় কথা বললেন। খালেদা জিয়ার পূর্বেকার রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকার হঠাৎ এই পরিবর্তন দেখে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ একটু বিস্মিত যে হয়নি, তা নয়। এ তো হঠাৎ রঙ ও রূপ বদলে ফেলা এক ব্যক্তি! এক নেতা। কেউ কেউ এমন সংশয়ও মনের ভেতর পোষণ করেন যে, এই হঠাৎ রাজনৈতিক চেহারা বদলে ফেলা আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার একটা কৌশল নয় তো?
তবে আমার মতো অনেকে মনে করেন, রাজনীতিতে দায়িত্বশীল হওয়ার এই অঙ্গীকার যদি খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কৌশল হয়ে থাকে, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তার এবং তার বিশাল রাজনৈতিক দলটির যদি এই উপলব্ধি ঘটে থাকে যে, ক্ষমতায় বা দেশ শাসনের দায়িত্বে যেতে হলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, নেপথ্যের শক্তি, হুমকি-ধমকি ইত্যাদি রাজনীতির পরিবর্তিত বাস্তবতায় কোনো সাহায্যে আসবে না, সেটা বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যত বেশি উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল।
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ শাসনের দায়িত্বে যেতে হলে যে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের জন্য প্রয়োজন জনগণের শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি ও সমর্থন। বস্তুত দেশের রাজনৈতিক দলগুলো থেকে সেটাই কাম্য। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণ এক পক্ষকে ভোট-সমর্থন দিয়ে জয়ী করে, পাশাপাশি বিরোধী দলকেও এই ক্ষমতা দেয় যে, তারা রাজনীতিতে জনগণের স্বার্থে একটি প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করবেন, একটি প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে কাজ করবেন, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অন্যায় আচরণ ও রাজনৈতিক নীতিভ্রষ্টতার (যদি সে রকম ঘটতে দেখা যায়) বিরুদ্ধে।
ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়কে গণতান্ত্রিক নিয়মনীতি মেনে নিয়ে অবশ্যই যা কিছু করার তা করতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পথে। বিদ্বেষ, অসত্য ভাষণ, হুঙ্কার, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের লালন করা এবং তাদের দিয়ে দেশে অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিতি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করা ইত্যাদি আর যাই হোক নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা নয়। জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী_ কোনো দলকেই রাজনীতিতে অস্থিতি ও অস্থিরতা সৃষ্টির ম্যান্ডেট দেয় না। ম্যান্ডেট দেয় না সুশাসনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটিয়ে দেশের উন্নয়ন ধারাকে ব্যাহত করার কিংবা বিঘি্নত করার।
যা-ই হোক, সাম্প্রতিক রাজনীতিতে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার কিছুটা পরিবর্তিত অবস্থানের কথা বলছিলাম। এই পরিবর্তন বিএনপির রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তারা যদি সংসদে যান, সরকারের অন্যায় বা ভুল-ত্রুটি, দুর্নীতি সংসদের মাধ্যমে জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারেন, সেটা হবে বিএনপি রাজনীতির জন্যই অত্যন্ত কল্যাণকর। দেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী, উভয় দলই যদি দম্ভ, জেদ ও আক্রোশের পথে রাজনীতিকে না নিয়ে গিয়ে রাজনীতিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তবে সেটা হবে দেশ, জনগণ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অত্যন্ত মঙ্গলজনক। এ ব্যাপারে অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব একটু বেশি। বিরোধী দলও দেশ শাসনের সহযোগী শক্তি। এই কথাটা মনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের উচিত বিরোধী দলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা, সংসদে বিরোধী দলকে প্রয়োজনে একটু বেশি কথা বলার সুযোগ দেওয়া। সংসদের ভেতরে ও বাইরে খোঁচা মারা রাজনীতির ইতি টানা। খালেদা জিয়াকে সাম্প্রতিক সময়ে অপেক্ষাকৃত নম্র, অর্থপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল কণ্ঠে কথা বলার জন্য সাধুবাদ জানাই। আশা করি, বিএনপির রাজনীতির হঠাৎ এই পরিবর্তিত অবস্থান ক্ষণস্থায়ী হবে না!
অবশ্য ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় খালেদা জিয়ার যে বক্তব্যটি ছাপা হয়েছে তা মোটেও স্বস্তিকর নয়। খালদা জিয়া তার বক্তব্যে বলেছেন, এখনও নাকি তিনি সংসদে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন না। ভাবছেন রাজপথের কথা। ধারণা করা যায়, আগামী ১২ মার্চ 'ঢাকা চলো, ঢাকা চলো' নামে একটি 'বিপ্লবাত্মক' রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থির করে রেখেছে খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং জামায়াতসহ জোটের অন্য কয়েকটি ক্ষুদ্র দল। রাজপথের কথা বিশেষভাবে সে জন্যই বলা। বিএনপি এবং তাদের জোটসঙ্গী রাজনৈতিক দলগুলো ১২ মার্চের কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে একটা কোনো অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়, নাকি শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের রাজনৈতিক শক্তির প্রদর্শনী করতে চায় সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।
তবে বিএনপি রাজনীতি তো বহুকালের চেনা একটা ব্যাপার। বিএনপি কিংবা বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গেলে দেশের সব সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ দলীয়করণ ঘটে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সব সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং প্রায় একটা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। বিএনপি-জামায়াতের সযত্নে লালন করা জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা লুকানো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে হত্যা, বোমাবাজি ও গ্রেনেড হামলার 'ঐতিহ্য' সগৌরবে ফিরিয়ে আনে।
এসব তো বাংলার মানুষের অজানা কোনো বিষয় নয়। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে স্লোগান তোলে : দেশে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। অথচ পশ্চাৎপদ কিংবা উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়নের যা প্রধান শর্ত তা তারা কখনোই প্রতিপালন করে না। উন্নয়নের প্রধান শর্ত বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। আরেক শর্ত দেশে প্রবর্তন করা আইনের শাসন। বাহুবলে ক্ষমতা দখলকারী বিএনপি দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক। তিনি তো তার সাড়ে ছয় বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের পাকিস্তানিকরণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী প্রায় ধ্বংসের পথে চলে যাওয়া শক্তির পুনরুজ্জীবন এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পুনর্বাসনেই মেয়াদকালের বেশি সময় সচেষ্ট ছিলেন। এমনকি জেনারেল এরশাদ-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলের দুই টার্মেও ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি এক কিলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করেনি। অথচ নির্বাচনের আগে জনগণকে এবং দাতাগোষ্ঠীকে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার আপন স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনার অর্থনীতির সমূহ উন্নয়নের কত রকমের গালভরা প্রতিশ্রুতিই না তারা দেয়। ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিএনপিকে দেখা যায়, যে মেকুর ছিল সেই মেকুরই থেকে গেছে।
১২ মার্চের রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা ভেবে আপাতত বিএনপি 'রাজপথে'র কথাই ভাবছে। পাশাপাশি তারা এ কথাও তো বলতে পারতেন, রাজপথ ও সংসদ দুইয়ের কথাই তারা ভাবছেন! সেটাই তো দায়িত্বশীল বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে দেশের আপামর জনগণের প্রত্যাশা! বিএনপি ক্ষমতায় না গেলে 'সংসদে'র রাস্তা যেন ভুলে যায়। সংসদের কথা তাদের মনে পড়ে শুধু সংসদীয় কার্যদিবসের ৯০ দিন পার হওয়ার একদিন আগে। বেতন, ভাতা ও রাষ্ট্রের দেওয়া অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কারণে তারা একদিন সংসদে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে যথাবিহিত সংসদে যাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ বর্জনের এই কাজটা যে দলই করুক, এটা যে চরম স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচায়ক এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি, জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়া একটি ক্ষমতাসীন সরকারকে তাদের মেয়াদ পূর্তির আগেই পতন ঘটাবার 'ধৃষ্টতাপূর্ণ' চিন্তা বাদ দিয়ে বিএনপির উচিত রাজপথে থাকার পাশাপাশি সংসদে যোগ দেওয়া এবং দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা।
গত তিন বছরে সরকার পরিচালনা ও দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার চেয়ে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের সাফল্যের পাল্লা অনেক ভারী। বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক জোটের লোকজন সে কথা জানে না, আমার মতো অনেকেই সেটা বিশ্বাস করে না। জনগণের গরিষ্ঠ অংশ সেটা জানে। এও ভাবে, বিশ্বাস করে যে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি-জামায়াত আবার সেই দলীয়করণের ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ হয়ে যাবে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীন কোনো ব্যক্তি বিচারে দণ্ড পেলে বিএনপি সেই ব্যক্তিদের অপরাধ ক্ষমা করে তাদের সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হবে, আবার দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের গাড্ডায় পড়বে। কথাগুলো বলছি কারণ, বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াতের দুই আমলে ঠিক এ রকমটাই ঘটেছে। আর নির্বাচনে জিতলে, বিএনপি-জামায়াতের যে 'ঐতিহ্য' হিন্দু ও আওয়ামী লীগের লোকদের হত্যা করা, হিন্দু নারীদের গনিমতের মাল মনে করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের স্টাইলে ধর্ষণ করা, হিন্দুদের বাড়ি ও সম্পত্তি দখল করা_ সেই 'ঐতিহ্যে'র পুনরাবৃত্তি ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কে না জানে জামায়াতের অর্থ ও কূটবুদ্ধি বিএনপিকে এখন চালায়। কে না জানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী হত্যা ও ঘৃণার রাজনীতিতে বিশ্বাসী একটি ফ্যাসিস্ট দল, যারা বাংলাদেশকে আবার দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত!
বিএনপির রাজনীতি যদি আগের মতোই থাকে, জামায়াতকে যদি তারা ত্যাগ করতে না পারে, সংসদে ও রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ বেছে নিয়ে যদি তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দেয়, তাহলে জনগণের কাছে বিএনপি আমলের সেই নৃশংস চেহারাটাই ভেসে উঠবে। দেশের তরুণ সমাজ তাদের ক্ষমা করবে না। আবার বলি, আগের হত্যা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দলীয়করণের রাজনীতি ত্যাগ করে এবং দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেই শুধু বিএনপি রাজনীতিতে লাভবান হতে পারে, অন্য কোনো উপায়ে নয়। দেশ ও জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশের জনগণ বিএনপিকে সেই দায়িত্বশীল ভূমিকায়ই ন্যস্ত দেখতে চায়।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
কিছুদিন থেকে বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া প্রায় বিশ্বাস করা যায় না, এমন একটা নম্র, বিদ্বেষহীন ভাষায় কথা বলছেন জনগণের উদ্দেশে। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে হামলা-মামলা করে বিরোধী দল দমনের চেষ্টা করবেন না। সমাজে ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অপরাজনীতিকে 'আল-বিদা' জানিয়ে দেশে উন্নয়ন ও সমাজ জাগৃতির রাজনীতি জারি রাখবেন। রাজনীতিতে বাহুবল, গ্রেনেড-শক্তি আর বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার নাম যে রাজনীতি নয়, সেটা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়ে সাম্প্রতিক এক এনজিও প্রতিষ্ঠানের সভায় রাজনীতিতে মেধাবী ও সৎ লোকদের যোগ দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তার রাজনীতির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের বদল ঘটিয়ে খালেদা জিয়া বোধ করি এই প্রথম প্রকৃত রাজনীতির ভাষায় কথা বললেন। খালেদা জিয়ার পূর্বেকার রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকার হঠাৎ এই পরিবর্তন দেখে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ একটু বিস্মিত যে হয়নি, তা নয়। এ তো হঠাৎ রঙ ও রূপ বদলে ফেলা এক ব্যক্তি! এক নেতা। কেউ কেউ এমন সংশয়ও মনের ভেতর পোষণ করেন যে, এই হঠাৎ রাজনৈতিক চেহারা বদলে ফেলা আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার একটা কৌশল নয় তো?
তবে আমার মতো অনেকে মনে করেন, রাজনীতিতে দায়িত্বশীল হওয়ার এই অঙ্গীকার যদি খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কৌশল হয়ে থাকে, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তার এবং তার বিশাল রাজনৈতিক দলটির যদি এই উপলব্ধি ঘটে থাকে যে, ক্ষমতায় বা দেশ শাসনের দায়িত্বে যেতে হলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, নেপথ্যের শক্তি, হুমকি-ধমকি ইত্যাদি রাজনীতির পরিবর্তিত বাস্তবতায় কোনো সাহায্যে আসবে না, সেটা বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যত বেশি উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল।
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ শাসনের দায়িত্বে যেতে হলে যে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের জন্য প্রয়োজন জনগণের শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি ও সমর্থন। বস্তুত দেশের রাজনৈতিক দলগুলো থেকে সেটাই কাম্য। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণ এক পক্ষকে ভোট-সমর্থন দিয়ে জয়ী করে, পাশাপাশি বিরোধী দলকেও এই ক্ষমতা দেয় যে, তারা রাজনীতিতে জনগণের স্বার্থে একটি প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করবেন, একটি প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে কাজ করবেন, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অন্যায় আচরণ ও রাজনৈতিক নীতিভ্রষ্টতার (যদি সে রকম ঘটতে দেখা যায়) বিরুদ্ধে।
ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়কে গণতান্ত্রিক নিয়মনীতি মেনে নিয়ে অবশ্যই যা কিছু করার তা করতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পথে। বিদ্বেষ, অসত্য ভাষণ, হুঙ্কার, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের লালন করা এবং তাদের দিয়ে দেশে অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিতি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করা ইত্যাদি আর যাই হোক নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা নয়। জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী_ কোনো দলকেই রাজনীতিতে অস্থিতি ও অস্থিরতা সৃষ্টির ম্যান্ডেট দেয় না। ম্যান্ডেট দেয় না সুশাসনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটিয়ে দেশের উন্নয়ন ধারাকে ব্যাহত করার কিংবা বিঘি্নত করার।
যা-ই হোক, সাম্প্রতিক রাজনীতিতে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার কিছুটা পরিবর্তিত অবস্থানের কথা বলছিলাম। এই পরিবর্তন বিএনপির রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তারা যদি সংসদে যান, সরকারের অন্যায় বা ভুল-ত্রুটি, দুর্নীতি সংসদের মাধ্যমে জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারেন, সেটা হবে বিএনপি রাজনীতির জন্যই অত্যন্ত কল্যাণকর। দেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী, উভয় দলই যদি দম্ভ, জেদ ও আক্রোশের পথে রাজনীতিকে না নিয়ে গিয়ে রাজনীতিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তবে সেটা হবে দেশ, জনগণ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অত্যন্ত মঙ্গলজনক। এ ব্যাপারে অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব একটু বেশি। বিরোধী দলও দেশ শাসনের সহযোগী শক্তি। এই কথাটা মনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের উচিত বিরোধী দলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা, সংসদে বিরোধী দলকে প্রয়োজনে একটু বেশি কথা বলার সুযোগ দেওয়া। সংসদের ভেতরে ও বাইরে খোঁচা মারা রাজনীতির ইতি টানা। খালেদা জিয়াকে সাম্প্রতিক সময়ে অপেক্ষাকৃত নম্র, অর্থপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল কণ্ঠে কথা বলার জন্য সাধুবাদ জানাই। আশা করি, বিএনপির রাজনীতির হঠাৎ এই পরিবর্তিত অবস্থান ক্ষণস্থায়ী হবে না!
অবশ্য ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় খালেদা জিয়ার যে বক্তব্যটি ছাপা হয়েছে তা মোটেও স্বস্তিকর নয়। খালদা জিয়া তার বক্তব্যে বলেছেন, এখনও নাকি তিনি সংসদে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন না। ভাবছেন রাজপথের কথা। ধারণা করা যায়, আগামী ১২ মার্চ 'ঢাকা চলো, ঢাকা চলো' নামে একটি 'বিপ্লবাত্মক' রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থির করে রেখেছে খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং জামায়াতসহ জোটের অন্য কয়েকটি ক্ষুদ্র দল। রাজপথের কথা বিশেষভাবে সে জন্যই বলা। বিএনপি এবং তাদের জোটসঙ্গী রাজনৈতিক দলগুলো ১২ মার্চের কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে একটা কোনো অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়, নাকি শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের রাজনৈতিক শক্তির প্রদর্শনী করতে চায় সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।
তবে বিএনপি রাজনীতি তো বহুকালের চেনা একটা ব্যাপার। বিএনপি কিংবা বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গেলে দেশের সব সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ দলীয়করণ ঘটে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সব সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং প্রায় একটা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। বিএনপি-জামায়াতের সযত্নে লালন করা জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা লুকানো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে হত্যা, বোমাবাজি ও গ্রেনেড হামলার 'ঐতিহ্য' সগৌরবে ফিরিয়ে আনে।
এসব তো বাংলার মানুষের অজানা কোনো বিষয় নয়। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে স্লোগান তোলে : দেশে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। অথচ পশ্চাৎপদ কিংবা উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়নের যা প্রধান শর্ত তা তারা কখনোই প্রতিপালন করে না। উন্নয়নের প্রধান শর্ত বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। আরেক শর্ত দেশে প্রবর্তন করা আইনের শাসন। বাহুবলে ক্ষমতা দখলকারী বিএনপি দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক। তিনি তো তার সাড়ে ছয় বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের পাকিস্তানিকরণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী প্রায় ধ্বংসের পথে চলে যাওয়া শক্তির পুনরুজ্জীবন এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পুনর্বাসনেই মেয়াদকালের বেশি সময় সচেষ্ট ছিলেন। এমনকি জেনারেল এরশাদ-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলের দুই টার্মেও ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি এক কিলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করেনি। অথচ নির্বাচনের আগে জনগণকে এবং দাতাগোষ্ঠীকে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার আপন স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনার অর্থনীতির সমূহ উন্নয়নের কত রকমের গালভরা প্রতিশ্রুতিই না তারা দেয়। ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিএনপিকে দেখা যায়, যে মেকুর ছিল সেই মেকুরই থেকে গেছে।
১২ মার্চের রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা ভেবে আপাতত বিএনপি 'রাজপথে'র কথাই ভাবছে। পাশাপাশি তারা এ কথাও তো বলতে পারতেন, রাজপথ ও সংসদ দুইয়ের কথাই তারা ভাবছেন! সেটাই তো দায়িত্বশীল বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে দেশের আপামর জনগণের প্রত্যাশা! বিএনপি ক্ষমতায় না গেলে 'সংসদে'র রাস্তা যেন ভুলে যায়। সংসদের কথা তাদের মনে পড়ে শুধু সংসদীয় কার্যদিবসের ৯০ দিন পার হওয়ার একদিন আগে। বেতন, ভাতা ও রাষ্ট্রের দেওয়া অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কারণে তারা একদিন সংসদে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে যথাবিহিত সংসদে যাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ বর্জনের এই কাজটা যে দলই করুক, এটা যে চরম স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচায়ক এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি, জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়া একটি ক্ষমতাসীন সরকারকে তাদের মেয়াদ পূর্তির আগেই পতন ঘটাবার 'ধৃষ্টতাপূর্ণ' চিন্তা বাদ দিয়ে বিএনপির উচিত রাজপথে থাকার পাশাপাশি সংসদে যোগ দেওয়া এবং দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা।
গত তিন বছরে সরকার পরিচালনা ও দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার চেয়ে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের সাফল্যের পাল্লা অনেক ভারী। বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক জোটের লোকজন সে কথা জানে না, আমার মতো অনেকেই সেটা বিশ্বাস করে না। জনগণের গরিষ্ঠ অংশ সেটা জানে। এও ভাবে, বিশ্বাস করে যে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি-জামায়াত আবার সেই দলীয়করণের ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ হয়ে যাবে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীন কোনো ব্যক্তি বিচারে দণ্ড পেলে বিএনপি সেই ব্যক্তিদের অপরাধ ক্ষমা করে তাদের সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হবে, আবার দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের গাড্ডায় পড়বে। কথাগুলো বলছি কারণ, বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াতের দুই আমলে ঠিক এ রকমটাই ঘটেছে। আর নির্বাচনে জিতলে, বিএনপি-জামায়াতের যে 'ঐতিহ্য' হিন্দু ও আওয়ামী লীগের লোকদের হত্যা করা, হিন্দু নারীদের গনিমতের মাল মনে করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের স্টাইলে ধর্ষণ করা, হিন্দুদের বাড়ি ও সম্পত্তি দখল করা_ সেই 'ঐতিহ্যে'র পুনরাবৃত্তি ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কে না জানে জামায়াতের অর্থ ও কূটবুদ্ধি বিএনপিকে এখন চালায়। কে না জানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী হত্যা ও ঘৃণার রাজনীতিতে বিশ্বাসী একটি ফ্যাসিস্ট দল, যারা বাংলাদেশকে আবার দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত!
বিএনপির রাজনীতি যদি আগের মতোই থাকে, জামায়াতকে যদি তারা ত্যাগ করতে না পারে, সংসদে ও রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ বেছে নিয়ে যদি তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দেয়, তাহলে জনগণের কাছে বিএনপি আমলের সেই নৃশংস চেহারাটাই ভেসে উঠবে। দেশের তরুণ সমাজ তাদের ক্ষমা করবে না। আবার বলি, আগের হত্যা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দলীয়করণের রাজনীতি ত্যাগ করে এবং দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেই শুধু বিএনপি রাজনীতিতে লাভবান হতে পারে, অন্য কোনো উপায়ে নয়। দেশ ও জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশের জনগণ বিএনপিকে সেই দায়িত্বশীল ভূমিকায়ই ন্যস্ত দেখতে চায়।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments