জাবিতে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন-অপরাধীকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় নয় by রেহনুমা আহমেদ
জাহাঙ্গীরনগরের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের গুরুত্ব এখানে যে এটি তুলে ধরে সরকারি দল কী ভাবে নিজ স্বার্থে জঘন্যতম অপরাধকে, অভিযুক্ত অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয়। একই সঙ্গে তুলে ধরে কী ভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব_ ১৯৯৮ ও তার পরবর্তী আন্দোলনগুলো তার পথ বাতলে দেয়।
সে অর্থে এ আন্দোলন যুগান্তকারী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৮ সালের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের দাবির নিষ্পত্তি একবারে হয়নি। তার কারণ হচ্ছে, অভিযুক্ত জসিমউদ্দিন মানিকসহ তার সহযোগীরা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ছাত্র সংগঠনের নেতা ও ক্যাডার ছিল। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক ছিল। যার অর্থ হচ্ছে, অপরাধী যদি 'নিজ' দলের হয় তাহলে তার অপরাধকে ধামাচাপা দিতে হবে, তাকে পার পাইয়ে দিতে হবে। কি ধর্ষক, কি খুনি তাতে কিছু যায় আসে না (এক্ষেত্রে খোদ রাষ্ট্রপতির ভূমিকা, এই ক'দিন আগে, বিশেষভাবে স্মরণীয়)। এ কারণেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুষ্ঠিত তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বারবার বিঘি্নত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সম্মিলিত আন্দোলনের শক্তিমত্তার কারণে সাধারণ মানুষের সমর্থনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেষমেশ 'সেঞ্চুরিয়ান' মানিককে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদের লঘু শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ১৯৯৯-এ আবারও ফুঁসে ওঠে এবং ২০০১-এ খণ্ডকালীন বহিষ্কার শেষে নিপীড়করা ক্যাম্পাসে ফিরে আসে। এর দায়ভার তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকার-সমর্থক শিক্ষককুলের। তৎকালীন সরকারি দলের। তৎকালীন সরকারের। তাদের মদদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীদের।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ_ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক দলীয়করণ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল, শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়মুক্ত করা হবে। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তার উল্টোটা ঘটতে দেখছি এবং তা একেবারে দলীয় স্বার্থের কারণে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগ, যুবলীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাঠ-ঘাট-হাট-বাজার দখলের অভিযোগ ওঠে। মেয়েদের, বিশেষ করে স্কুলছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ ওঠে। ধর্ষণেরও অভিযোগ ওঠে। তাদের রক্ষা করতে গিয়ে এক ছাত্রীর নানা মৃত্যুবরণ করেন। একজন স্কুলশিক্ষককেও মেরে ফেলা হয়। মিডিয়া রিপোর্টে প্রকাশ, বহুক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। দিতে সক্ষমও হন। পটুয়াখালীর পাখিমারার ঘটনা। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ছাত্রলীগ সদস্যরা গণধর্ষণ করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা জরিমানার ব্যবস্থা করে ১৬ ধর্ষক ও সহযোগীকে ধর্ষণের অপরাধ থেকে দায়মুক্ত করে।
সরকার অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশয় দেয় বলেই মেয়েরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। মেয়েরা এখনও আত্মহত্যা করেই চলছে। অপরাধীরা শুধু পার পেয়ে যাচ্ছে বলে নয়, উল্টো তারা নিপীড়িতের বাড়িতে এসে চোটপাট করে, করতে পারে বলে এগুলো ঘটছে। এটি ভয়াবহ। এতে কি প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, কিংবা নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর টনক নড়েছে? তাদের কার্যক্রম কোনোভাবেই তা বলে না। বরং আমরা উল্টোটাই ঘটতে দেখেছি। যৌন হয়রানি বিষয়ে হাইকোর্টের রুলিংয়ের প্রতি সরকারকে অবমাননা প্রদর্শন করতে দেখেছি। রুলিং মতে, যৌন হয়রানি যে ঘোরতর একটি অপরাধ, এটি সরকারের সারাদেশে প্রচার করার কথা ছিল। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, কর্মস্থলে হয়রানিবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করার কথা ছিল। সরকার এখনও সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং যৌন নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে লঘু করার উদ্দেশ্যে গত বছর এপ্রিল মাসে শুরু হয় 'ইভ টিজিং' নামক ক্যাম্পেইন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোভার স্কাউটদের আয়োজিত এ ক্যাম্পেইনে নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য। সরকার-সমর্থক নারী সংগঠনও এ ক্যাম্পেইনে অংশ নেয়, তার বিস্তৃতি ঘটায়। অ্যাক্টিভিস্ট আইনজীবীরা আবারও হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। এ বছর জানুয়ারি মাসে 'ইভ টিজিং' নামক প্রত্যয়কে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেন।
সরকার, শাসক দল, তাদের বুদ্ধিজীবী বাহিনী যদি নিপীড়ক-ধর্ষকদের পক্ষ গ্রহণ করে, যদি বারংবার তাই ঘটে, যদি এটি দৃশ্যমানভাবে ঘটে, তাহলে যৌন নিপীড়নের ঘটনা তো কমার কথা না, বাড়ারই কথা।
যতদিন পর্যন্ত না সরকারের পালাবদলের সঙ্গে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'দখলের' সংস্কৃতি আমরা বন্ধ করতে পারব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক দলীয়করণ বন্ধ করতে পারব, ততদিন পর্যন্ত এ অবস্থা চলবে। এ কারণে কি সরকারি দল, কি বিরোধী দল, উভয় পক্ষেরই সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে আমাদের সবার সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এমন প্রতিরোধের সাম্প্রতিক নজির স্থাপন করেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী-অভিভাবক-শিক্ষকরা, সম্মিলিতভাবে। ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষক পরিমল এবং তার প্রশ্রয়দাতা অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম ও বসুন্ধরা ইউনিটের প্রধান লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলনে নামে। নামতে বাধ্য হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগরের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের গুরুত্ব এখানে যে এটি তুলে ধরে সরকারি দল কী ভাবে নিজ স্বার্থে জঘন্যতম অপরাধকে, অভিযুক্ত অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয়। একই সঙ্গে তুলে ধরে কী ভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব_ ১৯৯৮ ও তার পরবর্তী আন্দোলনগুলো তার পথ বাতলে দেয়। সে অর্থে এ আন্দোলন যুগান্তকারী।
দেশের কথা, নারীশিক্ষার কথা বিবেচনা করলে_ যা সরকার করছে না বলে সুস্পষ্ট_ প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, সরকার কেন যারা মেয়েদের রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করে, যারা ধর্ষণ করে, তাদের প্রশ্রয় দেবে? এ অবস্থা চলতে থাকলে মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। অষ্টম শ্রেণীর জেনি আক্তারের ক্ষেত্রে তো তাই ঘটল। বামনা উপজেলার আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হায়দার হেমায়েত মৃধার ছেলে জিশান হায়দার ওকে উত্ত্যক্ত করত। তাই জেনির বাবা-মা দু'মাস আগে ওর মাদ্রাসা যাওয়া বন্ধ করে দেন। দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাতে জেনি রেহাই পায়নি। বিয়ের খবর শুনে জিশান তাকে ধর্ষণ করে। গলাটিপে হত্যা করে। সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা। দিনাজপুরের ১৪ বছর বয়সী ইয়াসমিনের ধর্ষণ ও হত্যার ব্যাপারে যাদের আন্দোলনে নামতে দেখেছিলাম, কই এখন তো তাদের সরব হতে দেখি না। আপনারা তো মিডিয়ায় আছেন, জিজ্ঞেস করে দেখেন না, শুনি তারা কী বলেন। জানতে খুবই আগ্রহী।
রেহনুমা আহমেদ : লেখক, কলাম লেখক ও প্রাক্তন শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৮ সালের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের দাবির নিষ্পত্তি একবারে হয়নি। তার কারণ হচ্ছে, অভিযুক্ত জসিমউদ্দিন মানিকসহ তার সহযোগীরা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ছাত্র সংগঠনের নেতা ও ক্যাডার ছিল। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক ছিল। যার অর্থ হচ্ছে, অপরাধী যদি 'নিজ' দলের হয় তাহলে তার অপরাধকে ধামাচাপা দিতে হবে, তাকে পার পাইয়ে দিতে হবে। কি ধর্ষক, কি খুনি তাতে কিছু যায় আসে না (এক্ষেত্রে খোদ রাষ্ট্রপতির ভূমিকা, এই ক'দিন আগে, বিশেষভাবে স্মরণীয়)। এ কারণেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুষ্ঠিত তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বারবার বিঘি্নত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সম্মিলিত আন্দোলনের শক্তিমত্তার কারণে সাধারণ মানুষের সমর্থনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেষমেশ 'সেঞ্চুরিয়ান' মানিককে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদের লঘু শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ১৯৯৯-এ আবারও ফুঁসে ওঠে এবং ২০০১-এ খণ্ডকালীন বহিষ্কার শেষে নিপীড়করা ক্যাম্পাসে ফিরে আসে। এর দায়ভার তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকার-সমর্থক শিক্ষককুলের। তৎকালীন সরকারি দলের। তৎকালীন সরকারের। তাদের মদদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীদের।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ_ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক দলীয়করণ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল, শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়মুক্ত করা হবে। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তার উল্টোটা ঘটতে দেখছি এবং তা একেবারে দলীয় স্বার্থের কারণে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগ, যুবলীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাঠ-ঘাট-হাট-বাজার দখলের অভিযোগ ওঠে। মেয়েদের, বিশেষ করে স্কুলছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ ওঠে। ধর্ষণেরও অভিযোগ ওঠে। তাদের রক্ষা করতে গিয়ে এক ছাত্রীর নানা মৃত্যুবরণ করেন। একজন স্কুলশিক্ষককেও মেরে ফেলা হয়। মিডিয়া রিপোর্টে প্রকাশ, বহুক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। দিতে সক্ষমও হন। পটুয়াখালীর পাখিমারার ঘটনা। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ছাত্রলীগ সদস্যরা গণধর্ষণ করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা জরিমানার ব্যবস্থা করে ১৬ ধর্ষক ও সহযোগীকে ধর্ষণের অপরাধ থেকে দায়মুক্ত করে।
সরকার অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশয় দেয় বলেই মেয়েরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। মেয়েরা এখনও আত্মহত্যা করেই চলছে। অপরাধীরা শুধু পার পেয়ে যাচ্ছে বলে নয়, উল্টো তারা নিপীড়িতের বাড়িতে এসে চোটপাট করে, করতে পারে বলে এগুলো ঘটছে। এটি ভয়াবহ। এতে কি প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, কিংবা নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর টনক নড়েছে? তাদের কার্যক্রম কোনোভাবেই তা বলে না। বরং আমরা উল্টোটাই ঘটতে দেখেছি। যৌন হয়রানি বিষয়ে হাইকোর্টের রুলিংয়ের প্রতি সরকারকে অবমাননা প্রদর্শন করতে দেখেছি। রুলিং মতে, যৌন হয়রানি যে ঘোরতর একটি অপরাধ, এটি সরকারের সারাদেশে প্রচার করার কথা ছিল। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, কর্মস্থলে হয়রানিবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করার কথা ছিল। সরকার এখনও সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং যৌন নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে লঘু করার উদ্দেশ্যে গত বছর এপ্রিল মাসে শুরু হয় 'ইভ টিজিং' নামক ক্যাম্পেইন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোভার স্কাউটদের আয়োজিত এ ক্যাম্পেইনে নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য। সরকার-সমর্থক নারী সংগঠনও এ ক্যাম্পেইনে অংশ নেয়, তার বিস্তৃতি ঘটায়। অ্যাক্টিভিস্ট আইনজীবীরা আবারও হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। এ বছর জানুয়ারি মাসে 'ইভ টিজিং' নামক প্রত্যয়কে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেন।
সরকার, শাসক দল, তাদের বুদ্ধিজীবী বাহিনী যদি নিপীড়ক-ধর্ষকদের পক্ষ গ্রহণ করে, যদি বারংবার তাই ঘটে, যদি এটি দৃশ্যমানভাবে ঘটে, তাহলে যৌন নিপীড়নের ঘটনা তো কমার কথা না, বাড়ারই কথা।
যতদিন পর্যন্ত না সরকারের পালাবদলের সঙ্গে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'দখলের' সংস্কৃতি আমরা বন্ধ করতে পারব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক দলীয়করণ বন্ধ করতে পারব, ততদিন পর্যন্ত এ অবস্থা চলবে। এ কারণে কি সরকারি দল, কি বিরোধী দল, উভয় পক্ষেরই সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে আমাদের সবার সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এমন প্রতিরোধের সাম্প্রতিক নজির স্থাপন করেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী-অভিভাবক-শিক্ষকরা, সম্মিলিতভাবে। ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষক পরিমল এবং তার প্রশ্রয়দাতা অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম ও বসুন্ধরা ইউনিটের প্রধান লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলনে নামে। নামতে বাধ্য হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগরের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের গুরুত্ব এখানে যে এটি তুলে ধরে সরকারি দল কী ভাবে নিজ স্বার্থে জঘন্যতম অপরাধকে, অভিযুক্ত অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয়। একই সঙ্গে তুলে ধরে কী ভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব_ ১৯৯৮ ও তার পরবর্তী আন্দোলনগুলো তার পথ বাতলে দেয়। সে অর্থে এ আন্দোলন যুগান্তকারী।
দেশের কথা, নারীশিক্ষার কথা বিবেচনা করলে_ যা সরকার করছে না বলে সুস্পষ্ট_ প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, সরকার কেন যারা মেয়েদের রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করে, যারা ধর্ষণ করে, তাদের প্রশ্রয় দেবে? এ অবস্থা চলতে থাকলে মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। অষ্টম শ্রেণীর জেনি আক্তারের ক্ষেত্রে তো তাই ঘটল। বামনা উপজেলার আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হায়দার হেমায়েত মৃধার ছেলে জিশান হায়দার ওকে উত্ত্যক্ত করত। তাই জেনির বাবা-মা দু'মাস আগে ওর মাদ্রাসা যাওয়া বন্ধ করে দেন। দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাতে জেনি রেহাই পায়নি। বিয়ের খবর শুনে জিশান তাকে ধর্ষণ করে। গলাটিপে হত্যা করে। সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা। দিনাজপুরের ১৪ বছর বয়সী ইয়াসমিনের ধর্ষণ ও হত্যার ব্যাপারে যাদের আন্দোলনে নামতে দেখেছিলাম, কই এখন তো তাদের সরব হতে দেখি না। আপনারা তো মিডিয়ায় আছেন, জিজ্ঞেস করে দেখেন না, শুনি তারা কী বলেন। জানতে খুবই আগ্রহী।
রেহনুমা আহমেদ : লেখক, কলাম লেখক ও প্রাক্তন শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments