চরাচর-ঘড়িয়াল নেই! by আলম শাইন
প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে ট্রিয়াসিক যুগে 'অর্কোসোউরিয়ান ডাইনোসর' নামে যে সরীসৃপ পৃথিবীতে বাস করত সেখান থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ঘড়িয়ালের আবির্ভাব ঘটে। অবিকল কুমিরের মতো দেখতে মনে হলেও ঘড়িয়াল একেবারে নিরীহ সরীসৃপ।
একসময় এদের বাস ছিল ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, পাকিস্তানের সিন্ধু, মিয়ানমারের কলাদান নদী এবং বাংলাদেশের পদ্মা-যমুনার সঙ্গমস্থলের উচ্চ অববাহিকায়। বর্তমানে ঘড়িয়াল এ দেশে দেখা যায় না বললেই চলে। একদল বন্য প্রাণী গবেষক ১৯৯০ সালের দিকে সর্বশেষ পদ্মার উচ্চ অববাহিকায় একটি মাত্র ঘড়িয়ালের সাক্ষাৎ পেয়েছে। গবেষকদল সেদিন ঘড়িয়ালের ডিম সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। পরে ডিম ফোটাতে পেরেছে কি না তা জানা যায়নি। একই সালে একই স্থানে জেলেদের জালে চারটি ঘড়িয়ালের বাচ্চা ধরা পড়েছে। তারপর থেকে এ প্রাণীটি বাংলাদেশের নদ-নদীতে আর দেখা যায়নি। ঘড়িয়াল দেখতে হুবহু কুমিরের মতো। পার্থক্য শুধু চোয়ালটি। কুমিরের চোয়াল ভোঁতা খাটো অন্যদিকে ঘড়িয়ালের চোয়াল লম্বাটে শুঁড়ের মতো। শুঁড়ের অংশের ওপরের দিকে ৫০টি এবং নিচে ৪৮টি ছোট ধারালো দাঁত রয়েছে। লম্বায় এগুলো শুঁড়সহ ২০ ফুটের কাছাকাছি। মা ঘড়িয়াল নদীর বালিয়াড়িতে ডিম পেড়ে বালি দিয়ে ঢেকে রাখে। কচ্ছপ-কুমিরের মতোই ডিম ফোটায় এগুলো। সদ্যজাত বাচ্চারা শুঁড়সহ ২২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। আমাদের দেশের বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় সর্বপ্রথম ঘড়িয়ালের নাম এসেছে। শুধু এ দেশেই নয়, ভারতেও এগুলোর অবস্থান সংকটাপন্ন। ১৯৭৫ সালে ভারতের প্রাণিবিজ্ঞানী ডা. এইচ আর -এর নেতৃত্বে একদল উৎসাহী তরুণ 'ঘড়িয়াল বাঁচাও' প্রকল্পের কাজে নামেন। তাঁরা কৃত্রিম উপায়ে ৪৫টি ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা নদীতে ছাড়েন। তার পরও আশানুরূপ সাড়া পাননি তাঁরা। কারণ দুদেশেই ঘড়িয়ালের ওপর খৰ নেমে আসে কিছু পিশাচ মানুষের। ওরা নানাভাবে ঘড়িয়াল শিকার করে ডিম ছিনিয়ে নিয়ে ওদের বংশবিস্তার রোধ করে দিয়েছে। চোরাই শিকারিদের কাছে ঘড়িয়াল অত্যন্ত লোভনীয় শিকার। শিকার করতে পারলে চড়াদাম পায় ওরা। সাধারণত ঘড়িয়ালের চামড়া দিয়ে লেডিস ব্যাগ, মানিব্যাগ, জুতা তৈরি হয়। আর এদের তেল ও চর্বি ওষুধ শিল্পে ব্যবহার করা হয়। ঘড়িয়াল দ্রুত বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার আরেকটি কারণও আছে। কারণটি হচ্ছে জেলেদের জালে ধরা পড়া। জেলেরা বাগে পেলেই ঘড়িয়ালদের নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। ওদের ধারণা এরা কুমিরজাতীয় প্রাণী এবং মানুষখেকো। আসলে যে ঘড়িয়ালরা মানুষখেকো হওয়া তো দূরের কথা, এগুলো মানুষের ধারেকাছেও পারতপক্ষে ঘেঁষে না। এর কারণ ঘড়িয়াল শুধু মাছ, সাপ, ব্যাঙ ছাড়া অন্যকিছু খায় না। (কালেভদ্রে জলজ পাখি খায়) অর্থাৎ মৎস্যভূক প্রাণী এগুলো। এভাবে ভুল বোঝাবুঝির কারণে অনেক ঘড়িয়ালকে জেলেদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে। যার ফলে আজ আমাদের অপরিসীম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ আমরা চেষ্টা করেও সে ক্ষতিপূরণ করতে পারছি না। তাই অনুরোধ করে বলছি, আসুন আমরা যেকোনো বন্য ও জলজ প্রাণীকে বাঁচার সুযোগ করে দিই।
আলম শাইন
আলম শাইন
No comments