এইচএসসি-মানের প্রশ্ন নিয়ে কিছু উল্টো প্রশ্ন by মোহীত উল আলম
এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল আগের যেকোনোবারের চেয়ে ভালো হয়েছে। আগের যেকোনোবারের অপেক্ষায় জিপিএ-৫ও বেশি এসেছে। প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। বলা হচ্ছে, যেহেতু সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর জন্য আসন আছে সর্বসাকল্যে ২০ হাজার, সেহেতু সেখানে জিপিএ-৫
পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্ধেকের জন্য কোনো আসন থাকবে না। সড়ক যানজটের সমস্যার মতো উচ্চশিক্ষার কাঠামোগত জট একটি সমস্যা হিসেবে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীসহ ভবিষ্যতের যেকোনো শিক্ষামন্ত্রীর জন্য শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে রইল।
ভৌতবিষয়ক সমস্যা ছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ফলাফল নিয়ে আরও একটি সমস্যা জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে সংকটে ফেলেছে। এত জিপিএ-৫ যারা পাচ্ছে, তাদের মেধার মানটা কেমন বা এত বেশি শিক্ষার্থী যে পাস করছে, তাদের যোগ্যতা কেমন?
পৃথিবীতে যত রকম জটিল প্রশ্ন আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আপেক্ষিক হচ্ছে মানের প্রশ্নটি। ‘নিজ দেশে এরেন্ডা বৃক্ষ’ প্রবচনটিতে যত ঠাট্টাই থাকুক না কেন, বাস্তবে মান বিচারের ক্ষেত্রে আসলে এটির দার্শনিক চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার উপায় নেই।
কিন্তু মানের প্রশ্নটি কেন একটি দুর্জ্ঞেয় প্রশ্ন এবং কেন সহজে এর চেহারা নির্ণয় করা যায় না, সেটা বিশ্লেষণ করার প্রয়াসে বর্তমান আলোচনাটি এগোচ্ছে। মান বিচারের ক্ষেত্রে আমরা তিনটি মানদণ্ড ভুলভাবে প্রয়োগ করি। এক. মান যে স্থান-কাল-পাত্রবিরহিত কোনো ধারণা নয়, সেটা আমরা মানতে চাই না। দুই. মান বিচারের ক্ষেত্রে আমরা অতীতকে বর্তমানের চেয়ে সেরা মনে করি, যেটার কোনো গাণিতিক পরিসংখ্যান নেই। তিন. মান বিচারের ক্ষেত্রে আমরা ইংরেজি জানা না-জানাকে বিষয় জানার সঙ্গে তুল্যমূল্য করে ফেলি।
প্রথমে স্থান-কাল-পাত্রের কথা ব্যাখ্যা করি। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এ বছরও মানের দিক থেকে আমেরিকার এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এর শিক্ষার্থীদের উচ্চমান যদি সারা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রক্ষা করতে হয়, তখন দেখা যাবে যে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওই মানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি হয়তো দেখা গেল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগও পেল না, তাই বলে প্রথমোক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির ভালো ছাত্রটিকে কি মানসম্পন্ন মনে করা হবে না? মানের সমতাকরণ প্রয়োগ করতে গেলে একটা অবাস্তব অবস্থার সৃষ্টি হবে। তাই প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আওতায় ভালো মান, মধ্যম মান ও নিম্নমানের শিক্ষার্থী থাকবে—সেটিই বাস্তব, হোক না সেটি ‘নাই দেশে এরেন্ডা বৃক্ষ’।
ঠিক সে রকম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এখন শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ বেশি পেলে তাদের মান কী রকম, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি, কিন্তু প্রশ্ন তোলার যৌক্তিক ভিত্তি কোথায়? তথ্য নিয়ে দেখা যাবে, এখনকার শিক্ষার্থীদের জগৎ জ্ঞান নির্মাণ ও তথ্য আহরণের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি উপকরণসমৃদ্ধ। সিদ্ধান্ত তাই হওয়া উচিত যে মানেরও উন্নতি হচ্ছে।
সদ্য পাস করা শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে সংশয় প্রকাশেও দেখা যায় একটি প্রচলিত গৎ। ২০ বছর আগের পত্রিকা খুলে দেখা যায়, তখনো সদ্য পাস করা শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলেছি।
তাই লক্ষ করলে দেখা যায়, মানের প্রশ্নটি যখন তোলা হয়, তখন মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা অতীতাশ্রয়ী বা প্রবীণাশ্রয়ী থাকি। ধরে নিই যে অতীতে লেখাপড়ার মান সব সময় ভালো ছিল এবং যত দিন এগোচ্ছে, তত মান নিচে নামছে। মান নির্ধারণকারী তীরটা সব সময় বর্তমান থেকে অতীতের দিকে সফলতার বার্তা নিয়ে যাচ্ছে। মানের চিন্তার পথ তাই ওয়ানওয়ে ট্রাফিকের মতো। অতীতমুখী।
আর ‘অতীতের মান ভালো ছিল’-এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে আরেকটি মাত্রা: পূর্বপুরুষকে গৌরবান্বিত আলোকে দেখার যে মনস্তত্ত্ব আমাদের মধ্যে কাজ করে, সেটা। পিতামহের কাশিটাও যেমন সুমধুর শোনায়, তেমনি তাঁর সামান্য জ্ঞানকেও বিরাট জ্ঞান মনে হয়। আমাদের যেমন আমাদের শিক্ষক প্রজন্মকে জ্ঞানের আধার বলে মনে হয়, তেমনি আমাদের প্রজন্মকে আমাদের ছাত্রছাত্রীর প্রজন্মের কাছে বিরাট জ্ঞানী প্রজন্ম মনে হতে পারে।
কয়েক দিন আগে আসাদুজ্জামান নূর পরিচালিত ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ অনুষ্ঠানে হটসিটে বসা একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হলো যে দূরের গ্রহ-নক্ষত্র দেখার জন্য যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়, সেটির নাম কী। সিনেমাস্কোপ? মাইক্রোস্কোপ? টেলিস্কোপ? নাকি বায়োস্কোপ? মেয়েটি পারল না। তার পিসেমশাইয়ের সাহায্য নিলে তিনিও পারলেন না। খুব অবাক করা ব্যাপার যে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের একজন ছাত্রী কেন এই প্রশ্নের উত্তর নিজে থেকে দিতে পারল না! পরের দিন ক্লাসে আমার ছাত্রছাত্রীদের এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাতে তারা সবাই সহাস্যে সঠিক উত্তর দিলেও দুজন ছাত্রছাত্রী ঠিকই উত্তর দিতে পারল না। মধ্য ষাটের দশকে আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন সম্ভবত আমিও খুব পরিষ্কার ছিলাম না দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও অণুবীক্ষণ যন্ত্রের পার্থক্য নিয়ে। তবে এই ছাত্রীর ব্যাপারে অভিযোগ থাকতে পারে যে সে তো কম্পিউটার যুগের ছাত্রী; কলেজ অঙ্গনে প্রবেশ করেছে এবং সে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হট সিটে বসার সুযোগও পেয়েছে।
তার পরও টেলিস্কোপ যন্ত্রটি যে দূরের গ্রহ-নক্ষত্র দৃষ্টিগোচরিত হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়—কেউ যদি এই প্রশ্নের উত্তর হট সিটে বসে দিতে না পারে, তাহলে তার মেধার মান নিচে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ সে নার্ভাস ছিল এবং তাকে চারটি উত্তরের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হয়েছে। বাছাই করতে গেলেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। যেমন কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে ঘরে বাইরে উপন্যাসটি কার লেখা, সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কিন্তু একই প্রশ্ন যদি ঘুরিয়ে করা হয় যে নিম্নোক্ত চারটি উপন্যাসের মধ্যে কোনটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের: সূর্য দীঘল বাড়ি, বারো ঘর এক উঠোন, ঘরে বাইরে, নাকি ঘর-মন-জানলা? তখন ভুল উত্তর দেওয়ার লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবে।
যা হোক, মেধার মান বিচারের ভিত্তি সাধারণ জ্ঞান নয়, এটা আমরা মোটামুটি স্বীকার করি। মেধার মান বিচারের উপাদানগুলো হলো সৃজনশীল চিন্তাশক্তি, বোধশক্তি ও ভাষাশক্তি (বলার ও লেখার)। এই বিচারেও বর্তমান প্রজন্মের মেধার মান যাচাই করার ক্ষেত্রে আমরা আগের ব্যাখ্যাত অতীতাশ্রয়ী তো হই-ই, সঙ্গে আরেকটা সূত্র যোগ হয়, সেটি হচ্ছে ইংরেজি জানা এবং না জানা।
ঔপনিবেশিক মানসিকতায় লালিত আমাদের আধুনিক শিক্ষা-চেতনা। যে ইংরেজি জানে, সে বেশি শিক্ষিত এবং জ্ঞানী, এটি আমাদের সমাজে মেধা বিচারের প্রচলিত ধারা। এবার ফলাফল ভালো হওয়ার পেছনে একটি কারণ ছিল যে ইংরেজি প্রশ্নটি সহজ করা হয়েছিল এবং সম্ভবত ইংরেজিতে গ্রেস নম্বরের ব্যবস্থা ছিল। শুধু ইংরেজিতে পাস না করার কারণে স্নাতক পর্যায়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হতো না বলে একপর্যায়ে স্নাতক পর্ব থেকে ইংরেজি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ইংরেজি জানা না-জানার সঙ্গে মেধার উঠতি-পড়তির সংযোগস্থলটি নির্ধারণ করা জটিল। যেমন অঙ্ক বুঝতে গেলে একজন শিক্ষার্থীকে যথেষ্ট মাথা খাটাতে হয়, তেমনি ইংরেজিতে সঠিক বাক্য নির্মাণ করা শিখতেও একজন শিক্ষার্থীকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। অঙ্কে যেমন দক্ষতা অর্জন করতে হয়, তেমনি ইংরেজি বিদেশি ভাষা বিধায় কোথায় ‘ইজ’ হবে আর কোথায় ‘আর’ হবে—এগুলোও যথেষ্ট পরিশ্রম করে আয়ত্ত করতে হয়। পরিশ্রম ও আয়াসলব্ধ পরিশীলন বলে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে মেধার চর্চাও বাড়ে বলে প্রচলিত অর্থে ইংরেজি জানাকে মেধার উন্নতির চিহ্ন হিসেবে দেখা হয়।
সঙ্গে সঙ্গে এই চিন্তার সীমাবদ্ধতাটাও বুঝতে হবে। ইংরেজি ভাষাকে রপ্ত করার প্রয়োজনটা যেন কোনোক্রমে শিক্ষার্থীর ক্রম-বোধশক্তি অর্জনের সৃজনশীল প্রক্রিয়াকে আক্রমণ করে সেটাকে খাটো বা অনুপযুক্ত করে না তোলে। বোধশক্তি বা বোঝার ক্ষমতা সব সময় ভাষাশক্তির সঙ্গে সমান্তরালভাবে উন্নতি লাভ করে না। একজন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হয়তো শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট-এর বিখ্যাত ‘টু বি অর নট টু বি’ স্বগতোক্তিটি পুরো হূদয়ঙ্গম করতে পারল, কিন্তু এটা হতে পারে যে ভাষার দক্ষতার অভাবে সেটা সে পুরো গুছিয়ে লিখতে পারল না বা যথেষ্ট ভুল বাক্যে লিখল। এখানে পরীক্ষক তার বোধশক্তির জন্য তাকে সন্তোষজনক নম্বর দিতে পারেন। এই আপসটি করতে হয়, কারণ ভাষার দক্ষতার ব্যাপারটি ভাষা সম্পাদনার ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত, বিষয় বোঝার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় নয়। অন্তত ছাত্রাবস্থায় নয়। তাই একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হয়তো ঢ্যাঁড়সের জন্মবৃত্তান্ত পুরোটা বুঝল কিংবা বুঝল ফটোসিন্থেসিস, কিন্তু কেবল ভাষাজ্ঞানের অভাবে (বিশেষ করে ইংরেজি জ্ঞানের অভাবে) তার নম্বর কমে যেতে পারে না। সাধারণত দেখা যায়, ভাষাশক্তিকে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রকাশক্ষমতায় নিয়ে যেতে পারে না। এ জন্য এই পর্যায়ে মুখস্থ করার প্রাবল্য লক্ষ করা যায়। স্নাতক পর্যায়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাষাশক্তির ওপর ক্রমশ দখল বাড়তে থাকে। এ জন্য উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজিকে খানিকটা সহজ করে দিয়ে পাসের হার বাড়ানোর নীতি বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঠিকই আছে। কারণ, নানা কারণে আমাদের দেশে সুষ্ঠুভাবে ইংরেজি শেখার পরিবেশ বজায় নেই। তাই এই ভাষার দক্ষতা অর্জনকে জীবন-মরণ হিসেবে দেখে ইংরেজিতে দুর্বল কিন্তু অন্যথায় বোধশক্তিসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থামিয়ে দেওয়া সমীচীন নয়।
দ্বিতীয়ত, ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে ঔপনিবেশিক সম্পর্ক জড়িয়ে থাকায় আমরা সম্ভবত অতীতে ভুলভাবে মান নির্ধারণ করেছি। যেমন আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের (১৯৪৭-এর এদিক-ওদিক) লোকদের মধ্যে যাঁরা রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের ইংরেজি জানার বহর ছিল বিস্তৃত, কিন্তু সেই ইংরেজি জানার জোরটা ছিল ইংরেজি ব্যাকরণের নিয়ম জানার ওপর; ইংরেজি ভাষাকে সাহিত্যের, বিজ্ঞানের ও রাজনীতির ভাষা হিসেবে দেখার মধ্যে নয়। সে সময় চাকরির দরখাস্তের জন্য ইংরেজি জ্ঞান ছিল সর্বজনীন, কিন্তু এর বাইরে ইংরেজি সীমাবদ্ধ ছিল মুখস্থ করা আইনি ভাষায়। আমলাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু প্রবচননির্ভর বক্তৃতা সাজিয়ে বলার দক্ষতাও ছিল সেই সময়ে ইংরেজি জানার মাধ্যম মেধা প্রকাশ করার পন্থা, তার চিন্তাশক্তি যত দুর্বলই হোক না কেন।
ওপরের কথাগুলোর আলোকে মনে হয়, ‘মান নেমে গেছে’ কথাটা যথেষ্ট মানসম্পন্ন কথা নয়।
মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
ভৌতবিষয়ক সমস্যা ছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ফলাফল নিয়ে আরও একটি সমস্যা জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে সংকটে ফেলেছে। এত জিপিএ-৫ যারা পাচ্ছে, তাদের মেধার মানটা কেমন বা এত বেশি শিক্ষার্থী যে পাস করছে, তাদের যোগ্যতা কেমন?
পৃথিবীতে যত রকম জটিল প্রশ্ন আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আপেক্ষিক হচ্ছে মানের প্রশ্নটি। ‘নিজ দেশে এরেন্ডা বৃক্ষ’ প্রবচনটিতে যত ঠাট্টাই থাকুক না কেন, বাস্তবে মান বিচারের ক্ষেত্রে আসলে এটির দার্শনিক চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার উপায় নেই।
কিন্তু মানের প্রশ্নটি কেন একটি দুর্জ্ঞেয় প্রশ্ন এবং কেন সহজে এর চেহারা নির্ণয় করা যায় না, সেটা বিশ্লেষণ করার প্রয়াসে বর্তমান আলোচনাটি এগোচ্ছে। মান বিচারের ক্ষেত্রে আমরা তিনটি মানদণ্ড ভুলভাবে প্রয়োগ করি। এক. মান যে স্থান-কাল-পাত্রবিরহিত কোনো ধারণা নয়, সেটা আমরা মানতে চাই না। দুই. মান বিচারের ক্ষেত্রে আমরা অতীতকে বর্তমানের চেয়ে সেরা মনে করি, যেটার কোনো গাণিতিক পরিসংখ্যান নেই। তিন. মান বিচারের ক্ষেত্রে আমরা ইংরেজি জানা না-জানাকে বিষয় জানার সঙ্গে তুল্যমূল্য করে ফেলি।
প্রথমে স্থান-কাল-পাত্রের কথা ব্যাখ্যা করি। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এ বছরও মানের দিক থেকে আমেরিকার এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এর শিক্ষার্থীদের উচ্চমান যদি সারা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রক্ষা করতে হয়, তখন দেখা যাবে যে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওই মানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি হয়তো দেখা গেল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগও পেল না, তাই বলে প্রথমোক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির ভালো ছাত্রটিকে কি মানসম্পন্ন মনে করা হবে না? মানের সমতাকরণ প্রয়োগ করতে গেলে একটা অবাস্তব অবস্থার সৃষ্টি হবে। তাই প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আওতায় ভালো মান, মধ্যম মান ও নিম্নমানের শিক্ষার্থী থাকবে—সেটিই বাস্তব, হোক না সেটি ‘নাই দেশে এরেন্ডা বৃক্ষ’।
ঠিক সে রকম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এখন শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ বেশি পেলে তাদের মান কী রকম, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি, কিন্তু প্রশ্ন তোলার যৌক্তিক ভিত্তি কোথায়? তথ্য নিয়ে দেখা যাবে, এখনকার শিক্ষার্থীদের জগৎ জ্ঞান নির্মাণ ও তথ্য আহরণের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি উপকরণসমৃদ্ধ। সিদ্ধান্ত তাই হওয়া উচিত যে মানেরও উন্নতি হচ্ছে।
সদ্য পাস করা শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে সংশয় প্রকাশেও দেখা যায় একটি প্রচলিত গৎ। ২০ বছর আগের পত্রিকা খুলে দেখা যায়, তখনো সদ্য পাস করা শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলেছি।
তাই লক্ষ করলে দেখা যায়, মানের প্রশ্নটি যখন তোলা হয়, তখন মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা অতীতাশ্রয়ী বা প্রবীণাশ্রয়ী থাকি। ধরে নিই যে অতীতে লেখাপড়ার মান সব সময় ভালো ছিল এবং যত দিন এগোচ্ছে, তত মান নিচে নামছে। মান নির্ধারণকারী তীরটা সব সময় বর্তমান থেকে অতীতের দিকে সফলতার বার্তা নিয়ে যাচ্ছে। মানের চিন্তার পথ তাই ওয়ানওয়ে ট্রাফিকের মতো। অতীতমুখী।
আর ‘অতীতের মান ভালো ছিল’-এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে আরেকটি মাত্রা: পূর্বপুরুষকে গৌরবান্বিত আলোকে দেখার যে মনস্তত্ত্ব আমাদের মধ্যে কাজ করে, সেটা। পিতামহের কাশিটাও যেমন সুমধুর শোনায়, তেমনি তাঁর সামান্য জ্ঞানকেও বিরাট জ্ঞান মনে হয়। আমাদের যেমন আমাদের শিক্ষক প্রজন্মকে জ্ঞানের আধার বলে মনে হয়, তেমনি আমাদের প্রজন্মকে আমাদের ছাত্রছাত্রীর প্রজন্মের কাছে বিরাট জ্ঞানী প্রজন্ম মনে হতে পারে।
কয়েক দিন আগে আসাদুজ্জামান নূর পরিচালিত ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ অনুষ্ঠানে হটসিটে বসা একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হলো যে দূরের গ্রহ-নক্ষত্র দেখার জন্য যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়, সেটির নাম কী। সিনেমাস্কোপ? মাইক্রোস্কোপ? টেলিস্কোপ? নাকি বায়োস্কোপ? মেয়েটি পারল না। তার পিসেমশাইয়ের সাহায্য নিলে তিনিও পারলেন না। খুব অবাক করা ব্যাপার যে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের একজন ছাত্রী কেন এই প্রশ্নের উত্তর নিজে থেকে দিতে পারল না! পরের দিন ক্লাসে আমার ছাত্রছাত্রীদের এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাতে তারা সবাই সহাস্যে সঠিক উত্তর দিলেও দুজন ছাত্রছাত্রী ঠিকই উত্তর দিতে পারল না। মধ্য ষাটের দশকে আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন সম্ভবত আমিও খুব পরিষ্কার ছিলাম না দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও অণুবীক্ষণ যন্ত্রের পার্থক্য নিয়ে। তবে এই ছাত্রীর ব্যাপারে অভিযোগ থাকতে পারে যে সে তো কম্পিউটার যুগের ছাত্রী; কলেজ অঙ্গনে প্রবেশ করেছে এবং সে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হট সিটে বসার সুযোগও পেয়েছে।
তার পরও টেলিস্কোপ যন্ত্রটি যে দূরের গ্রহ-নক্ষত্র দৃষ্টিগোচরিত হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়—কেউ যদি এই প্রশ্নের উত্তর হট সিটে বসে দিতে না পারে, তাহলে তার মেধার মান নিচে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ সে নার্ভাস ছিল এবং তাকে চারটি উত্তরের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হয়েছে। বাছাই করতে গেলেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। যেমন কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে ঘরে বাইরে উপন্যাসটি কার লেখা, সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কিন্তু একই প্রশ্ন যদি ঘুরিয়ে করা হয় যে নিম্নোক্ত চারটি উপন্যাসের মধ্যে কোনটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের: সূর্য দীঘল বাড়ি, বারো ঘর এক উঠোন, ঘরে বাইরে, নাকি ঘর-মন-জানলা? তখন ভুল উত্তর দেওয়ার লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবে।
যা হোক, মেধার মান বিচারের ভিত্তি সাধারণ জ্ঞান নয়, এটা আমরা মোটামুটি স্বীকার করি। মেধার মান বিচারের উপাদানগুলো হলো সৃজনশীল চিন্তাশক্তি, বোধশক্তি ও ভাষাশক্তি (বলার ও লেখার)। এই বিচারেও বর্তমান প্রজন্মের মেধার মান যাচাই করার ক্ষেত্রে আমরা আগের ব্যাখ্যাত অতীতাশ্রয়ী তো হই-ই, সঙ্গে আরেকটা সূত্র যোগ হয়, সেটি হচ্ছে ইংরেজি জানা এবং না জানা।
ঔপনিবেশিক মানসিকতায় লালিত আমাদের আধুনিক শিক্ষা-চেতনা। যে ইংরেজি জানে, সে বেশি শিক্ষিত এবং জ্ঞানী, এটি আমাদের সমাজে মেধা বিচারের প্রচলিত ধারা। এবার ফলাফল ভালো হওয়ার পেছনে একটি কারণ ছিল যে ইংরেজি প্রশ্নটি সহজ করা হয়েছিল এবং সম্ভবত ইংরেজিতে গ্রেস নম্বরের ব্যবস্থা ছিল। শুধু ইংরেজিতে পাস না করার কারণে স্নাতক পর্যায়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হতো না বলে একপর্যায়ে স্নাতক পর্ব থেকে ইংরেজি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ইংরেজি জানা না-জানার সঙ্গে মেধার উঠতি-পড়তির সংযোগস্থলটি নির্ধারণ করা জটিল। যেমন অঙ্ক বুঝতে গেলে একজন শিক্ষার্থীকে যথেষ্ট মাথা খাটাতে হয়, তেমনি ইংরেজিতে সঠিক বাক্য নির্মাণ করা শিখতেও একজন শিক্ষার্থীকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। অঙ্কে যেমন দক্ষতা অর্জন করতে হয়, তেমনি ইংরেজি বিদেশি ভাষা বিধায় কোথায় ‘ইজ’ হবে আর কোথায় ‘আর’ হবে—এগুলোও যথেষ্ট পরিশ্রম করে আয়ত্ত করতে হয়। পরিশ্রম ও আয়াসলব্ধ পরিশীলন বলে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে মেধার চর্চাও বাড়ে বলে প্রচলিত অর্থে ইংরেজি জানাকে মেধার উন্নতির চিহ্ন হিসেবে দেখা হয়।
সঙ্গে সঙ্গে এই চিন্তার সীমাবদ্ধতাটাও বুঝতে হবে। ইংরেজি ভাষাকে রপ্ত করার প্রয়োজনটা যেন কোনোক্রমে শিক্ষার্থীর ক্রম-বোধশক্তি অর্জনের সৃজনশীল প্রক্রিয়াকে আক্রমণ করে সেটাকে খাটো বা অনুপযুক্ত করে না তোলে। বোধশক্তি বা বোঝার ক্ষমতা সব সময় ভাষাশক্তির সঙ্গে সমান্তরালভাবে উন্নতি লাভ করে না। একজন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হয়তো শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট-এর বিখ্যাত ‘টু বি অর নট টু বি’ স্বগতোক্তিটি পুরো হূদয়ঙ্গম করতে পারল, কিন্তু এটা হতে পারে যে ভাষার দক্ষতার অভাবে সেটা সে পুরো গুছিয়ে লিখতে পারল না বা যথেষ্ট ভুল বাক্যে লিখল। এখানে পরীক্ষক তার বোধশক্তির জন্য তাকে সন্তোষজনক নম্বর দিতে পারেন। এই আপসটি করতে হয়, কারণ ভাষার দক্ষতার ব্যাপারটি ভাষা সম্পাদনার ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত, বিষয় বোঝার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় নয়। অন্তত ছাত্রাবস্থায় নয়। তাই একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হয়তো ঢ্যাঁড়সের জন্মবৃত্তান্ত পুরোটা বুঝল কিংবা বুঝল ফটোসিন্থেসিস, কিন্তু কেবল ভাষাজ্ঞানের অভাবে (বিশেষ করে ইংরেজি জ্ঞানের অভাবে) তার নম্বর কমে যেতে পারে না। সাধারণত দেখা যায়, ভাষাশক্তিকে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রকাশক্ষমতায় নিয়ে যেতে পারে না। এ জন্য এই পর্যায়ে মুখস্থ করার প্রাবল্য লক্ষ করা যায়। স্নাতক পর্যায়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাষাশক্তির ওপর ক্রমশ দখল বাড়তে থাকে। এ জন্য উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজিকে খানিকটা সহজ করে দিয়ে পাসের হার বাড়ানোর নীতি বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঠিকই আছে। কারণ, নানা কারণে আমাদের দেশে সুষ্ঠুভাবে ইংরেজি শেখার পরিবেশ বজায় নেই। তাই এই ভাষার দক্ষতা অর্জনকে জীবন-মরণ হিসেবে দেখে ইংরেজিতে দুর্বল কিন্তু অন্যথায় বোধশক্তিসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থামিয়ে দেওয়া সমীচীন নয়।
দ্বিতীয়ত, ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে ঔপনিবেশিক সম্পর্ক জড়িয়ে থাকায় আমরা সম্ভবত অতীতে ভুলভাবে মান নির্ধারণ করেছি। যেমন আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের (১৯৪৭-এর এদিক-ওদিক) লোকদের মধ্যে যাঁরা রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের ইংরেজি জানার বহর ছিল বিস্তৃত, কিন্তু সেই ইংরেজি জানার জোরটা ছিল ইংরেজি ব্যাকরণের নিয়ম জানার ওপর; ইংরেজি ভাষাকে সাহিত্যের, বিজ্ঞানের ও রাজনীতির ভাষা হিসেবে দেখার মধ্যে নয়। সে সময় চাকরির দরখাস্তের জন্য ইংরেজি জ্ঞান ছিল সর্বজনীন, কিন্তু এর বাইরে ইংরেজি সীমাবদ্ধ ছিল মুখস্থ করা আইনি ভাষায়। আমলাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু প্রবচননির্ভর বক্তৃতা সাজিয়ে বলার দক্ষতাও ছিল সেই সময়ে ইংরেজি জানার মাধ্যম মেধা প্রকাশ করার পন্থা, তার চিন্তাশক্তি যত দুর্বলই হোক না কেন।
ওপরের কথাগুলোর আলোকে মনে হয়, ‘মান নেমে গেছে’ কথাটা যথেষ্ট মানসম্পন্ন কথা নয়।
মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
No comments