টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ‘প্রথম আলো’র উদ্যোগে ‘টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।


আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আমাদের দেশে ভূমি কম, মানুষ বেশি। তার ওপর সামনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ। অনেক দিন থেকেই আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা জটিলতার মধ্যে ছিল। কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। শহরের আশপাশের জলাভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে। যদিও কিছু আইন আছে, তবে সেই আইনের বাস্তবায়ন দুর্বল। এই জায়গাটা আমরা আলোচনা করতে চাই। এমনভাবে ভূমি ব্যবস্থাপনা করতে হবে, যেন সেটা টেকসই হয়। জলবায়ুর পরিবর্তন বিবেচনায় রেখে এবং আগামী বেশ কিছু সময় সামনে রেখে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কী কী ব্যবস্থা বা কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে আমাদের যা ভূমি আছে তার সদ্ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়টি এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ বিষয়ে বলার জন্য আমি অনুরোধ করছি এম আসাদুজ্জামানকে।

এম আসাদুজ্জামান
ভূমি ব্যবস্থাপনাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে একটি হলো ভূমির ক্ষয়। অনেক কারণে ভূমির ক্ষয় হয়ে থাকে। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কিছু তাৎক্ষণিক, কিছু সুদূরপ্রসারী। এ বিষয়ে আমরা কতটুকু করতে পেরেছি বা পারিনি, সেটি একটি বিষয়। না পারার মধ্যে রয়েছে নীতিগত, ব্যবস্থাপনাগত, প্রয়োগ ও অন্যান্য সমস্যা। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা যে জরুরি, সে দিকটি উপলব্ধি করতে পারা। জাতিগোষ্ঠী, ব্যক্তিপর্যায়ে এই উপলব্ধি আছে কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
ভূমিক্ষয়ের অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো নদীভাঙন (রিভার অ্যারোসন)। প্রায় এক হাজার ২০০ কিলোমিটার নদীতীর ভেঙে গেছে। গঙ্গা নদীর প্রবাহ কমার কারণে বিভিন্নভাবে ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে লবণাক্ততা তৈরি হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে। দেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ জমি শুষ্কতায় আক্রান্ত (ড্রাউট)। কৃষিক্ষেত্রে নিয়মনীতির বাইরে সার ও ওষুধ ব্যবহারের কারণে ভূমি উৎপাদনের উৎকর্ষ হারাচ্ছে এবং ক্ষয় হচ্ছে। জলাবদ্ধতার (ওয়াটার লগিং) জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমির ক্ষয় হচ্ছে। প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন হেক্টর জমি জলাবদ্ধতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষ ও প্রকৃতির দ্বারা বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য আমাদের ভূমির ক্ষয় হচ্ছে। আমাদের দেশে নদী-খাল, জমি জোরজবরদস্তি করে দখল করে অন্য কাজে ব্যবহার করার জন্যও ভূমির ক্ষয় হচ্ছে। এসব হওয়ার একটি বড় কারণ হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ। আমাদের ভবিষ্যৎ আরও অধিক শঙ্কাপূর্ণ।
ভবিষ্যতে নদীভাঙন, লবণাক্ততা ও মরুময়তা অনেক বেশি হবে। পানি না থাকলে বিভিন্নভাবে জমির ক্ষয় হতে থাকে। অপরিকল্পিত গ্রামীণ অবকাঠামো ও নগরায়ণ ভূমিক্ষয়ের আরও একটি কারণ। শহরের জমির ব্যাপক চাহিদা এবং মূল্যবৃদ্ধির জন্য ক্ষমতাশালী লোকজন বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে এগুলো দখল করছে। ভূমিক্ষয়ের জন্য প্রতিবছর আমরা কমপক্ষে ১ শতাংশ জিডিপি হারাই। জীবিকা ও অর্থ উপার্জনের দিকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা খাসজমির অপব্যবহার হয়।
ব্যবস্থা কী নেওয়া হয়েছে? হয়তো ভূমি-জোন করা হয়েছে। তা কতটুকু, সঠিক আমি জানি না। টেকসই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু কাজ করা হয়েছে; কিন্তু সেটা কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, তা একটি প্রশ্ন। বিভিন্ন মূল্যায়নে দেখা গেছে, সমন্বিত কোনো উদ্যোগ না থাকায় ভালো ফল পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিপর্যায়ে জমি ক্ষয় হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে। এটি তারা নিজেরা যেমন বুঝতে পারে না, তেমনি ক্ষয়রোধের কোনো উদ্যোগও নেই। জমির খড়কুটা, আবর্জনা ফেলে দেওয়ায় একজন বিদেশি কৃষিবিজ্ঞানী মন্তব্য করলেন, আমরা চাষ বুঝি না। কারণ, খড়কুটা-আবর্জনা জমির একটি ভালো খাদ্য, সেটি ফেলে চাষি জমিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কোনো ধ্যান-ধারণা আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। টেকসই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কাজ যতটুকু হয়েছে, সেখানে উৎপাদনের দিকটি বেশি বিবেচনায় আনা হয়েছে। জমির বহুবিধ ব্যবহারের দিকটি সেভাবে বিবেচনায় আনা হয়নি। টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে আমরা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাব।

আব্দুল কাইয়ুুম
এম আসাদুজ্জামানের কাছ থেকে আমরা ভূমিক্ষয়ের অনেকগুলো বিষয় জানতে পারলাম। এখন টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বলবেন আইনুন নিশাত।

আইনুন নিশাত
আজকের আলোচনার শিরোনামে টেকসই, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশ প্রেক্ষিত নামে তিনটি বিষয় রয়েছে। যথাযথ সময়ে এই আলোচনা হচ্ছে। আমি অনেক দিন ধরেই পরিবেশ, প্রকৃতি, ভূমি, জলাভূমি ইত্যাদি বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলে আসছি। কয়েক দিন আগে সংবিধানের যে সংশোধনী হয়েছে, সেখানে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সংশোধনীর আগে আমাদের জমি ছিল ভিটেবাড়ি, কৃষিজমি, বনভূমি এবং অবশিষ্ট ছিল সব পতিত জমি। জলাভূমি বলে কোনো জমি ছিল না। সংশোধনী সংবিধানের ১৮-এর ‘ক’ ধারার শিরোনাম হচ্ছে: পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন।
১৮-এর ‘ক’ ধারার বর্ণনা হলো: রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে। প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে। সংসদে যখন বিষয়টি আলোচনা হয়, তখন সাবের হোসেন চৌধুরী নদ-নদীকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছিলেন। সেটি যদিও হয়নি, কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে নদ-নদীকে বোঝায়।
এখন এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট যে নীতিমালা রয়েছে, সেগুলো পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে। কারণ, সংবিধান এই কাজগুলো করার দায়িত্ব দিয়েছে। এটা করতে হলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। কেন করতে হবে? প্রথমত, ভূমি মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে খাসজমিগুলো বরাদ্দ করে। কিন্তু আমাদের যেটা করতে হবে, ভূমি, মাটি, পানি, কৃষি, বন, মৎস্য, নগরায়ণ, প্রাণিসম্পদ, শিল্পায়ন, যোগাযোগ—সব একসঙ্গে দেখতে হবে। কারণ মানুষ বাড়ছে, নগরায়ণ বাড়ছে, কৃষি জনসংখ্যাকে ধরে রাখতে না পারার জন্য শিল্পায়ন বাড়ছে।
জমি সীমিত। গ্রামীণ জনপদও ঘনবসতিপূর্ণ হচ্ছে। এতে যত চাপ পড়ছে কৃষির ওপর। কৃষি বলতে শস্য উৎপাদনকে বোঝানো হয়ে থাকে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের দিকে খুব একটা নজর দেওয়া হচ্ছে না। পঞ্চাশের দশক এবং আজকের বাংলাদেশের অবস্থা এক নয়। সবকিছু বদলে গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে যত কঠিনই হোক না কেন, সবকিছুর ওপর ভূমি মন্ত্রণালয়কে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। জলাভূমি, খাসজমি ইজারার ব্যাপারে নতুন ব্যবস্থাপনা আনতে হবে। চরের জমি উৎপাদনশীল করতে হবে। নদীকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে যেগুলো শুকিয়ে যায়, সেগুলোকে নদী বলা যাবে না। জমি যাঁরা জবরদখল করেন, তাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তি থাকে। তাঁদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
সংবিধানে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। এখন এ বিষয়ে শুনব পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব মেছবাহ উল আলমের কাছ থেকে।

মেছবাহ উল আলম
আমরা সবাই জানি, এই ছোট দেশের এক ইঞ্চি জমিও বাড়ছে না; কিন্তু প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। সংবিধানে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় আলোচনা থেকে কাজের গুরুত্ব অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এদিক থেকে আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে এমন একটি উর্বর জমি আমরা পেয়েছি। পৃথিবীতে খুব কম দেশই আছে, যেখানে তিনটি ফসল হয়। ব্যাপক জনগোষ্ঠীর চাপে আমরা এই উর্বর ভূমিকে নষ্ট করে ফেলছি। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যেখানে টনকে টন অ্যাসিডিটি সরিয়ে জমি চাষের উপযোগী করতে হয়। শুধু যে নদীভাঙনের জন্য ক্ষয় হচ্ছে তা নয়, বিভিন্নভাবে মাটির মান নষ্ট হচ্ছে, মাটির জীবনীশক্তি নষ্ট হচ্ছে। আমি প্রতিনিয়ত দেখি, বন থেকে যে পাতা পড়ে, তা সরিয়ে ফেলা হয়। অথচ এটি মাটির প্রাণশক্তি রক্ষা করে। তারপর আমরা দেখি, জ্বালানির জন্য, শিল্পায়নের জন্য নানাবিধ কারণে গাছ কাটা হচ্ছে। আবার জমির বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবহারের পরিবর্তে অতিরিক্ত ব্যবহার করা হচ্ছে।
মনুষ্যসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক—উভয় সমস্যা আমাদের পরিবেশ ও জমিকে আক্রান্ত করেছে। বৃষ্টি-অনাবৃষ্টি অনেক কারণে জমির ক্ষতি হচ্ছে। পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণের ফলে পাহাড় ও জমির বিপর্যয় ঘটছে। সুন্দরবনের আশপাশের মানুষের জীবিকা হচ্ছে বনকেন্দ্রিক। মধুপুরে যারা থাকে তারা বলে, ‘আমরা গাছ না কেটে করব কী?’ এসব রক্ষা করার জন্য আমাদের যে আইনকানুন আছে, তার বাস্তব প্রয়োগ হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং ভঙ্গকারী উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে। মধুপুর অঞ্চলে যারা বাস করে, আমরা তাদের অন্য কার্যক্রমের আওতায় এনেছি। ফলে তারা এখন জীবিকার জন্য বন ধ্বংস করে না। বন রক্ষার জন্য ৪৭৫ জনের একটি কমিটি করা হয়েছে। মধুপুরের আশপাশের ইটের ভাটাগুলোতে এখন কোনো গাছ পোড়ানো হয় না। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই গাছ কাটার জন্য তাদের ব্যবহার করত।
বাঘ থাকার জন্য সুন্দরবন রক্ষা হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে জলযান চালানো হচ্ছে, কাছাকাছি শিল্পায়ন হচ্ছে, যে কারণে অন্যভাবে সুন্দরবনের ক্ষতি হচ্ছে। শুধু আইন থাকলেই হবে না, রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত সচেতনতা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা কাজ শুরু করেছি। টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা বলতে এমন একটি ব্যবস্থাপনাকে বোঝায়, যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জমিটি ব্যবহার করে সুফল পেতে পারে। দুভাবে টেকসই ব্যবস্থাপনা কাজ করতে পারে—এক. জমি ব্যবহারকারীদের সচেতনতা। দুই. আইনের মাধ্যমে বাধ্য করা। এটা উভয়ের দায়িত্ববোধের ব্যাপার। এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাধারণ ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জরিপ, স্পার্সো, ভৌগোলিক জরিপ, স্থানিক মানচিত্র, ভূতাত্ত্বিক অবস্থান এবং এর বিশ্লেষণ, আর্থসামাজিক, প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি বিষয়ের প্রভাব আমাদের বোঝা দরকার। ভূমি আইনের মধ্যে জটিলতা পরিহার করে সবার জন্য একটি যুগোপযোগী আইন করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
এখন এ বিষয়ের ওপর আলোচনা করবেন নুরুল ইসলাম নাজেম।

নুরুল ইসলাম নাজেম
এসএলএম প্রকল্পের আওতায় আমরা ভূমি জরিপ নিয়ে কাজ করেছি। সেই ধারাবাহিকতায় আমি আলোচনা করতে চাই। আমাদের ভূগোল বিভাগ থেকে ৫০ বছর যাবৎ ভূমি জরিপের কাজ হয়ে আসছে। এই জরিপের তথ্য আমাদের কাছে আছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের জমি চার ভাগে ভাগ করতে চাই—মানববসতি, কৃষি, বন, জলাশয়। কোনো সন্দেহ নেই, বন ও জলাশয়কে আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। জমিকে কৃষি জোনে ভাগ করতে হবে। কৃষি জোনের মধ্যে একমাত্র কৃষি ছাড়া অন্য কোনো কিছু করা যাবে না। সবশেষে থাকে মানববসতি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, যোগাযোগ অন্যান্য অবকাঠামোসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড মানববসতিতে করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিবছর এ চারটি জোন বিভিন্নভাবে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে উপজেলা থেকে শুরু করে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে, যাতে নির্দিষ্ট খাতের বাইরে কেউ জমি ব্যবহার করতে না পারে।
এ বিষয়ে আমাদের একটি জরিপ আছে; যার ফল খুবই আশঙ্কাজনক। ২০০৩ সালে পলাশ উপজেলায় যথাক্রমে মানববসতি ছিল ২৫ শতাংশ, কৃষিজমি ছিল ৬৬ শতাংশ। উপজেলার একটি পৌরসভায় দালান-বসতি ছিল ২১ শতাংশ, জলাশয় ৬ শতাংশ। ২০১০ সালে মানববসতি হয়েছে ৪৬ শতাংশ, কৃষিজমি কমে এসেছে ৪০ শতাংশে, দালান-বসতি হয়েছে ৬৩ শতাংশ, জলাশয় বেড়ে হয়েছে ৮ শতাংশ। পলাশ উপজেলাকে দেশের মানদণ্ড ধরা যাবে না। কারণ, এটি একটি অতি শিল্পায়িত এলাকা। সারা দেশে আমাদের কোনো জরিপ নেই। বাংলাদেশের ৪ ভাগের ১ ভাগ জমি ইতিমধ্যে মানববসতিতে ব্যবহার হয়েছে। অবশিষ্ট ৩ ভাগের মধ্যে রয়েছে কৃষি, বন ও জলাভূমি। এর মধ্যে একটি বড় অংশ রাস্তাঘাটের জন্য ব্যবহার হয়েছে। মৌজা ম্যাপের ওপর ভিত্তি করে কৃষিজমিকে কৃষি অঞ্চলে ভাগ করতে হবে।
আমাদের দেশে উপকূলীয় এলাকা আছে, কিন্তু মৌজা ম্যাপের ওপর না হওয়ায় এর প্রয়োগ সম্ভব হবে না। এ চারটি জোনকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবহার না করলে জমি কোনোভাবেই রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ৬৩ শতাংশ জমি এখন কৃষির আওতায় আছে। এই পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে কৃষিজমি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন এর মান কমে যাচ্ছে, তেমনি দিন দিন কৃষিজমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। সারা দেশকে পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণের আওতায় আনতে হবে। সব কটি গ্রাম হবে শহরের মতো, তবে গ্রামীণ শহর হবে ফাঁকা ফাঁকা, সুন্দর। মাঠপর্যায় থেকে আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে। ১৯৭৬ সালে এই পরিকল্পনা ছিল।
বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে। এখন সরকারকে যা করতে হবে তা হলো, সারা দেশের জমি চার ভাগে ভাগ করে অপরিকল্পিতভাবে জমি ব্যবহারের চিন্তাকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে। চীনে সব জমি সরকারের। সরকার সব জমিকে জোনিং করে ফেলেছে। তাই যে কেউ সরকারের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারে না।

আব্দুল কাইয়ুম
জমিকে মানববসতি, কৃষি, বন, জলাশয়—এই চার ভাগের আওতায় এনে সুপরিকল্পিত ব্যবহারের বিষয়ে বললেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম নাজেম। এবার শুনব নিলুফা ইসলামের কাছ থেকে।

নিলুফা ইসলাম
ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমরা খুব পিছিয়ে আছি। যেখানে অবস্থান করছি, সেটা মোটেই ভালো অবস্থান নয়। ২০১২ সালে এসে সমস্যাগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। সমস্যা থেকে ভবিষ্যতের করণীয় নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভূমি, মানববসতি, কৃষি, পানি, বন, মৎস্য, জলাশয় ইত্যাদির ক্ষেত্রে কোনো নীতি ছিল না। যখন যেখানে সমস্যা হয়েছে, তখন সে ক্ষেত্রে নীতি করা হয়েছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, এত নীতি থাকার পরও ২০১২ সালে এসে কেন বলছি যে আমাদের সমস্যা আছে। তাহলে আসলে সমস্যাটি কোথায়? সমস্যা হচ্ছে প্রথমত, এই নীতির সঠিক প্রয়োগ নেই। দ্বিতীয়ত, জাতিগোষ্ঠী, ব্যক্তিপর্যায়ে নীতি পৌঁছানো হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এই নীতি সঠিকভাবে না জানবে, ততক্ষণ এ থেকে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। ২০ বছর আগে ঢাকা শহরে যেখানে জলাভূমি ছিল ২১ শতংশ, এখন তা ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। শুধু টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা নয়; ভূমি, কৃষি, পানি, বন, মৎস্য, জলাশয়—সবকিছু যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়ে একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে যত দিন যাবে, ততই এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দেবে। ভূমি, কৃষি, বন, মৎস্য, জলাশয়, মানববসতি এসব কিছুর জন্য পানি দরকার। এর যেকোনো একটি নীতির ক্ষেত্রে পানি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততার গুরুত্ব এখানে অনেক বেশি।

আব্দুল কাইয়ুম
আমরা নিলুফা ইসলামের কথা শুনলাম। এবার বলবেন আবু মোস্তফা কামালউদ্দিন।

আবু মোস্তফা কামালউদ্দিন
কেউ কেউ বলে থাকেন, জমি রক্ষা করা যাবে না। এটি হয়তো রূপক অর্থে বলেন। জমি আসলে স্থির। জমি যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে। তবে অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে করতে একসময় জমি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। শিল্পের ফলে যে দূষণ সৃষ্টি হয়, সেটা জমির উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে বন উজাড়ের ফলে ভূমির ক্ষয় হয়। এই মাটির দ্বারা আবার জলাশয় ভরাট হতে থাকে। ফলে বন এবং জলাশয় উভয়ই তার উৎপাদনক্ষমতা হারাচ্ছে। বন উজাড়, নদীভাঙন, ভূমিক্ষয়, দূষণ, জলাশয় ভরাট, জমিতে অধিক আইল—এসব জমির জন্য ক্ষতিকর। অর্থাৎ, জমি যা আছে, সেটা ঠিক থাকবে। কিন্তু মানুষের অপব্যবহারের ফলে এবং প্রাকৃতিক কারণে জমি নষ্ট হচ্ছে। শুধু ভূমি মন্ত্রণালয় কিছু করলে সেটি টিকবে না। টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য ভূমি, কৃষি, শিল্প, পানি, পরিবেশসহ সব মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো জরিপ করে কাজ করে। ফলে জটিলতা আরও বাড়তে থাকে। মৌলিকভাবে একটি মৌজা-ম্যাপ থাকবে, যার ভিত্তিতে সবাই কাজ করবে। এখন যে ডিজিটালাইজড মৌজা-ম্যাপ আছে, সেটি ওয়েবসাইটে দিয়ে দিতে হবে এবং ভূমির ওপর যেকোনো ধরনের কাজ মৌজা-ম্যাপের ওপর ভিত্তি করে করতে হবে। আমাদের জায়গা কম, মানুষ বেশি। তাই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত কিছু স্থান রাখতে হবে। এটা একসঙ্গে অনেক মানুষকে অধিক সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবে।
আমাদের কৃষি জিডিপি দেয় ২০ শতাংশ, কিন্তু কর্মসংস্থান দেয় ৫০ শতাংশ। খাদ্যনিরাপত্তা দেয় প্রায় ১০০ শতাংশ। একটি কথা মনে রাখতে হবে, ২০০৭ সালে টাকা দিয়েও কোথাও থেকে খাদ্য আনতে পারিনি।

আব্দুল কাইয়ুম
শিরিন কামাল সাঈদকে অনুরোধ করছি তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করার জন্য।

শিরিন কামাল সাঈদ
আলোচনায় সমস্যার কথা অনেক এসেছে। আমি সমাধানের দিকটি আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত, নিয়মনীতি যেগুলো আছে, সেগুলোর ঠিক ঠিক প্রয়োগ করতে হবে। ভূমিসংক্রান্ত আইনকানুনগুলো আরও আধুনিকীকরণ করতে হবে। এই নিয়মনীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত, তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে ভূমির অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়। এটি বন্ধ করতে হলে ভূমিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং মন্ত্রণালয়; বিশেষ করে ভূমি, কৃষি, পানি, বন পরিবেশসহ সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মেগা সিটিতে পরিণত হবে। সে ক্ষেত্রে ভূমি জোনিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। খাসজমিগুলো অধিকাংশই প্রভাবশালীরা দখল করেছে বা লিজ নিয়েছে। ফলে প্রকৃত দরিদ্ররা এ থেকে কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। পাহাড় কাটা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
এখন বলবেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন
ভূমি হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ। একে শুধু অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে দেখলে হবে না। ভূমি থেকে আমরা বহুমাত্রিক সেবা পাই। অন্য কিছু থেকে এই সেবা পাওয়া সম্ভব নয়। মানববসতি থেকে শুরু করে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষি—সবকিছু আমাদের করতে হবে। তবে সেটা টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার মধ্য থেকে করতে হবে। আজকে আমরা যেভাবে ভূমির অপব্যবহার করছি, ভূমিকে নষ্ট করছি, আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে অবশ্যই এগুলো বন্ধ করতে হবে আমাদের। এখনো আমরা এর শিকার হচ্ছি।
আমরা একটি ছোট আয়তনের দেশে বাস করি। কিছু কিছু বিষয় আমাদের জন্য খুবই আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে ঢাকা, গাজীপুর তারও উত্তরে—এককথায় ঢাকাকে কেন্দ্র করে এর চারদিকে এবং একইভাবে চট্টগ্রামেও কৃষিজমি, জলাভূমি দখল করে যেভাবে মানববসতি, নগরায়ণ, শিল্পায়ন হচ্ছে; সেটি অচিরেই আমাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। কোনো সভ্য দেশে এমন হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ইটের ভাটার কারণে মারাত্মকভাবে ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ইটের ভাটার আধুনিকীকরণের ব্যবস্থা সরকারের আছে। এই প্রথম বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই আমাদের আর পেছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই। এখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে। ভূমি জোনিংসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা আছে। এই প্রস্তাবনা আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
এবার বলবেন কামরুল ইসলাম চৌধুরী।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী
টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। আমি সে বিষয়ে কিছু বলব। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও প্রতিনিয়ত ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বিশ্বব্যাপী প্রয়োজন দেখা দিয়েছে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার। ১৯৯২ সালে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ধরিত্রী সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে মরুময়তা, জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন সনদ নামে তিনটি সনদ স্বাক্ষরিত হয়। এবং একুশ শতকের এজেন্ডায় টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। পৃথিবীব্যাপী দিন দিন জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নের স্থায়িত্ব।
এ জন্য বিশ্ব পরিমণ্ডলে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন দেখা দেয়। ধরিত্রী সম্মেলনের এবার ২০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ উপলক্ষে ২০ থেকে ২২ জুন ব্রাজিলের রিও নগরে ধরিত্রী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এখানে ১৯৯২ সালের স্বাক্ষরিত সনদ এবং ২০২১ সালের এজেন্ডা নিয়ে পর্যালোচনা হবে। আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় উভয় পরিসরে এই আলোচনা হবে। সংবিধান সংশোধন হওয়ার আগে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবে দুটি কর্মশালা করেছিলাম। ড. রেজাউল করিম আজ নেই। তিনি এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এবং আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই সংবিধানে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানের ধারাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রিও নগরের ধরিত্রী সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যাবেন। তিনি যেন সেখানে বলতে পারেন টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশে কাজ হচ্ছে।
আমার শেষ কথা, আন্তমন্ত্রণালয় এবং তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনা করে এই বিষয়ের ওপর একটি আইন করতে হবে। এই সংসদে তা পাস করাতে হবে। আমরা ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা একান্ত প্রয়োজন। এ কাজটি আমাদের সঠিকভাবে করতে হবে। এটি যদি আমরা করতে পারি, তাহলে সংবিধান প্রদত্ত দায় থেকে মুক্তি পাব।

আব্দুল কাইয়ুম
টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক বিষয় উঠে এসেছে। আমার কাছে মনে হয়, অধিক জনসংখ্যার চাপ যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে যেকোনো ভালো উদ্যোগ টেকসই করা কঠিন হয়ে যাবে। এখন আমরা শুনব ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে।

মোস্তাফিজুর রহমান
১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশ আমাদের। এখানে অনেক সমস্যা বিদ্যমান। আমাদের ভূমির পরিমাণ কম। বিভিন্ন কারণে ভূমি দিন দিন কমে আসছে। যদিও উপকূলীয় অঞ্চলে আমরা কিছু কিছু ভূমি ফিরে পাচ্ছি। আমাদের দেশ থেকে যখন ইট রপ্তানি হচ্ছিল, তখন আমি এ বিষয়ে কথা বলেছি। অনেকে আমার কথা পছন্দ করেনি। তারা ভেবেছে, ইট রপ্তানি করে যদি আমরা টাকা পাই, তাহলে সমস্যা কোথায়। তাদের মাথায় শুধু কারেন্সি। একটি ইটভাটার জন্য কমপক্ষে পাঁচ একর জমি লাগে এবং পাঁচ ফুট পরিমাণ ওপরের মাটি কেটে ফেলতে হয়। একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় আর আগের অবস্থায় ওই জমি ফিরিয়ে আনতে পারে না। ধরে নিই, বাংলাদেশে এক লাখ ইটের ভাটা আছে। এই এক লাখ ইটের ভাটার জন্য পাঁচ লাখ একর জমি নষ্ট হচ্ছে। যাঁরা ইট তৈরি করেন, তাঁদের বিকল্প দিতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে আমরা কীভাবে ইট বিদেশে রপ্তানি করি?
জমির প্রয়োজন আমাদের অনেক। এর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। শুধু আন্তমন্ত্রণালয়ে মিটিং করে এটা হবে না। এ ব্যাপারে সবাইকে জোরেশোরে কাজ করতে হবে। আগামী ২০ বছর যাঁরা দেশ চালাবেন, তাঁদের সবাইকে একত্র হয়ে একটা সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। সুশীল সমাজের সঙ্গে বসতে হবে। আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যেভাবে কথা বলা হচ্ছে, সে তুলনায় এ ব্যাপারে কোনো কথাই হচ্ছে না। অথচ এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভাবা উচিত ছিল। কৃষকেরা মাটির নিচ থেকে পানি তুলছেন। তাঁরা নিজেরাও জানেন না, এই পানি একসময় শেষ হয়ে যাবে। ফসলের আপনি যত বৈচিত্র্য আনেন না কেন, পানি না থাকলে কোনো কিছু করা সম্ভব হবে না। শুধু যে জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, কৃষকেরাও বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিতে নিতে রুগ্ণ হয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে করি, আগামী ২০ বছর যেসব দল দেশ পরিচালনা করবে, তাদের সবাইকে মিলে এখনই একটা শক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ২০ বছর পর সব দল মিলে যদি টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার কথা ভাবে, তখন সেটি আর কোনো কাজে আসবে না। যেমন অনেকে বলে থাকেন, ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো আরও বড় হওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু এখন ইচ্ছা করলেও সব জায়গায় রাস্তা বড় করা সম্ভব নয়।
কোনো নীতি ছাড়া আমরা অপরিকল্পিত নগরায়ণ করে ফেলেছি। প্রথমে আমি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে ছিলাম। ওই সময় অনেকে নিয়ম ভঙ্গ করার চেষ্টা করেছেন। শিল্পায়নের জন্য অনৈতিকভাবে পরিবেশের ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন। ২০০ বছর আগের একজন মানুষ আজকের এই উন্নয়ন দেখে হয়তো হূৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাবেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উন্নয়ন টেকসই নয়।
আমার কথা হলো, টেকসই যদি না হয়, তাহলে এক অর্থে এটা কোনো উন্নয়নই নয়। এখন মাথাপিছু জমির পরিমাণ ১৭ শতক। দিন দিন প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষ যদি ৩০ কোটি হয়, আমাদের যদি সমন্বিত টেকসই পরিকল্পনা থাকে—এ ক্ষেত্রে আমরা না খেয়ে মারা যাব না। রাজনীতিবিদদের একসঙ্গে বসিয়ে এখনই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বিতভাবে নকশা করতে হবে। আমাদের দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষের দশ-পাঁচটা বাড়ি না হলে হচ্ছে না। গ্রামে, থানা শহরে, জেলা শহরে, গুলশানে, বনানীতে, পূর্বাচলে, এখানে-সেখানে—প্রতিটি জায়গায় তাদের একটা করে বাড়ি দরকার। এত বাড়ির দরকার কী? গ্রামের বাড়িকে পাঁচ তলা করেন। আপনার ভাইও থাকবে, আপনিও থাকবেন।
অনেকে মনে করেন, তাঁদের সময় চলে গেলেই হলো। পরে কী হবে, সেটা তাঁদের দেখার দরকার নেই। এটা এমন একটা সময়, যে সময় বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছু জানা যায়। জানার পর কীভাবে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এত বড় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে যাই। আমি মনে করি, শুধু ভূমি নয়, ভূমি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সব দলকে মিলে একটি সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা একটি নীতি অনুসরণ করতে পারে। আগে পৃথিবীতে ধনতন্ত্র ছিল, বুর্জোয়াতন্ত্র ছিল, সাম্যবাদ ছিল। এখন বিশ্বব্যাপী বাজার অর্থনীতি। ব্যবস্থাপনার দিক থেকে যারা দক্ষ, তারা এগিয়ে যাবে। আর শুধু আইন করলেই হবে না। আমাদের দেশের মানুষ মনে করে, তার জমিতে পুকুর কাটতে পারে, বাগান করতে পারে, যেকোনোভাবেই ব্যবহার করতে পারে। বাধা দিতে গেলে জনে জনে মামলা করবে। তখন এনবিআরের মতো হবে। হাজার হাজার মামলা হাইকোর্টে যাবে। হাইকোর্ট থামিয়ে দেবেন। কিন্তু সব দল মিলে যদি আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে সবাই সেটা মেনে চলতে বাধ্য হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন
মোস্তাফিজুর রহমান
ভূমি প্রতিমন্ত্রী
মেছবাহ উল আলম
সচিব, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়
এম আসাদুজ্জামান
গবেষণা পরিচালক, বিআইডিএস
আইনুন নিশাত
উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
নুরুল ইসলাম নাজেম
অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন
যুগ্ম সচিব, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়
কামরুল ইসলাম চৌধুরী
চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ পরিবেশসাংবাদিক ফোরাম
নিলুফা ইসলাম
পরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়
শিরিন কামাল সাঈদ
পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ
আবু মোস্তফা কামালউদ্দিন
পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ
ইউএনডিপি
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.