রাজনীতি-আইনের নয়, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির শাসন by এ কে এম জাকারিয়া

তারেক রহমান দেশের বাইরে আছেন। তাঁর অবস্থান গোপনীয় কোনো বিষয় নয়। বিএনপির প্রধান বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি লন্ডন গিয়ে ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখাও করে এসেছেন। তবে আইনের চোখে তিনি পলাতক। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আদালত পলাতক যে ১২ আসামিকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি


দিতে বলেছেন, সেখানে তারেক রহমানের নামও থাকবে। আদালত যখন নির্দেশ দিয়েছেন তখন বিজ্ঞপ্তি নিশ্চয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হবে। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি পড়ে তারেক রহমান আদালতে হাজির হবেন তো?
এই প্রশ্নের জবাব পেতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি বের হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে ধারণা করার কিছু বিষয় তো থাকে। এর আগে খালেদা জিয়ার আরেক ছেলে আরাফাত রহমানের বিরুদ্ধে টেলিযোগাযোগ খাতে সিমেন্সকে কাজ পাইয়ে দিতে ঘুষ নেওয়ার মামলার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে তিনি আদালতে হাজির হননি। প্যারোলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাঁর অনুপস্থিতিতেই সেই বিচার হয়েছে। বিদেশে অবৈধ অর্থ লেনদেনের কারণে ওই মামলায় আরাফাত রহমান কোকোর জেলও হয়েছে। তিনি এখনো দেশের বাইরে, এমনকি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন না বলেও তাঁর আইনজীবীদের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। এই যখন আমাদের অভিজ্ঞতা, তখন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে তারেক রহমান আদালতে হাজির হবেন, সে আশা খুবই হালকা।
তারেক রহমান প্রসঙ্গ থাক, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি। অনুপস্থিতিতে বিচার হয়ে আরাফাত রহমানের ছয় বছরের সশ্রম জেল হয়েছে, সঙ্গে ১৯ কোটি টাকা জরিমানাও। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমরা কি ধরে নিতে পারি যে বিচারের রায় তিনি মেনে নিয়েছেন? কোনোভাবেই না। তবে? আপিল তিনি ভবিষ্যতে কোনো একসময়ে করতে পারেন, সেটা এই সরকারের আমলে নয়। আরাফাত রহমানের আইনজীবীরা মনে করেন এই সরকারের আমলে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন না। তাঁর ‘ন্যায়বিচার’ নিশ্চিত করতে হলে তবে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে, বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে হবে!
আরাফাত রহমান ভাগ্যবান, তিনি জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছেলে। জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া একটি দল আছে, এখন খালেদা জিয়া এর প্রধান। দলটি আগে ক্ষমতায় ছিল, এখন প্রধান বিরোধী দল, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ক্ষমতায় যাবে। নিজের পিতা-মাতার দল ক্ষমতায় গেলে ন্যায়বিচার পাবেন—এমন আশায় তিনি বুক বাঁধতেই পারেন। কিন্তু আমাদের মতো যাদের পিতা কোনো দল রেখে যাননি, মা সেই দলের প্রধান হতে পারেননি, আর দলই যেহেতু নেই তাই ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগও নেই, তারা যদি কোনো কারণে অপরাধ করে বসি, বা ‘মিথ্যা’ মামলায় ফেঁসে যাই, তবে কী হবে? ‘ন্যায়বিচার’ পাওয়ার আশায় আমরা কোন সরকারের জন্য অপেক্ষা করব?
আমরা সাধারণ জনগণ যার ওপর ভরসা করে বাঁচি, তার নাম ‘আইনের শাসন’। এখন আরাফাত রহমানের জেল হয়েছে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা চলছে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। বিএনপির কাছে এটা ‘জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র’। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াল কী? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে যদি দেশের বিচারব্যবস্থার বিচারের মধ্য দিয়ে ‘জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র’ করা যায় আর বিএনপি ক্ষমতায় এলে যদি জিয়া পরিবারকে ‘রক্ষা’ করার আশা করা যায়, তবে দেশে আইনের শাসন বলে কিছু থাকল কোথায়! শাসন তো তাহলে হয় আওয়ামী লীগের, নয় বিএনপির।
প্রাচীন কালে যা ছিল ‘আইনের দ্বারা শাসন’ (rule by law), আধুনিক কালে তা হয়েছে আইনের শাসন (rule of law)। এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটি কী? চীনের ইউনিভার্সিটি অব পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড লয়ের অধ্যাপক লি সুগুয়াং এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তফাতটি তাঁর মতে ‘আইনের শাসনের অধীনে আইন হচ্ছে সবার ওপরে এবং তা ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর দাওয়াই হিসেবে কাজ করতে পারে। আর আইনের দ্বারা শাসনে আইন সরকারের একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়।’ আইনের ‘দ্বারা’ শাসনের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই শাসনের অধীনে যাঁরা দেশ পরিচালনা করতেন, তাঁরা আইন থেকে ছাড় পেতেন। মানে শাসকদের ওপর আইন কাজ করত না। এখন আরাফাত রহমান যদি মনে করেন যে বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন না, তবে এটা ধরে নিতে হয় যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে ‘ন্যায়বিচার’ পাওয়ার যে আশা করা হচ্ছে, তা কি আসলে শাসক হিসেবে ছাড় পাওয়ার আশা নয়? আমাদের দেশে তবে কোন শাসন চলছে? ‘আইনের শাসন’ না আইনের ‘দ্বারা’ শাসন?
আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পণ করে আইনি লড়াই চালানো উচিত। আইনের শাসনে বিশ্বাসী হলে তাঁরা তা করবেন’ (প্রথম আলো ১৯ জুলাই)। আইন প্রতিমন্ত্রী আইনের শাসনের কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁরা যদি ‘আইনের দ্বারা শাসনে’ বিশ্বাসী হয়ে থাকেন তবে আইনের শাসনের প্রতি আস্থা থাকে কীভাবে? তাঁরা আদালতে আত্মসমর্পণ না করে অপেক্ষা করবেন নিজ দলের ক্ষমতায় আসার জন্য! নিজ দলের ক্ষমতায় আসা মানেই তো আইনের ওপরে চলে যাওয়া। আইন প্রতিমন্ত্রীর ডাকে তাঁরা সাড়া দেবেন কেন?
আইন প্রতিমন্ত্রী তো ‘আইনের শাসনের’ দোহাই দিয়ে তারেক ও আরাফাতকে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন, কিন্তু আইনের শাসনের প্রতি বর্তমান সরকারের বিশ্বাস কতটুকু জোরালো? আমরা তো দেখলাম ‘আইনের শাসনের’ প্রতি আস্থার চেয়ে বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগও অপেক্ষায় ছিল কীভাবে ক্ষমতায় এসে দলের লোকজনকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া যাবে সেই আশায়। আইনের শাসন বড় হলে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ নাম দিয়ে প্রায় সাত হাজার মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়ার দরকার পড়ত কি? এ ধরনের মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করার জন্য গঠিত জাতীয় কমিটির প্রধান হিসেবে এই কাজটি করে যাচ্ছেন আইন প্রতিমন্ত্রী। খুন ও ডাকাতির মতো মামলাও জায়গা পেয়েছে এই প্রত্যাহারের সুপারিশের তালিকায়। আর দুর্নীতির মামলা তো আছেই। এই হাজার সাতেক ‘রাজনৈতিক’ মামলার মধ্যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মামলা রয়েছে মাত্র দুটি। আইনের শাসন নয়, ‘আইনের দ্বারা’ শাসনে বিশ্বাস করলেই সরকারের পক্ষে এটা করা সম্ভব।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তারেক ও আরাফাত রহমানদের ওপর আইন কাজ করতে পারেনি। আর এখন আইন কাজ করছে না বিপ্লবদের জন্য, তুলে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার মামলা। ক্ষমতার বদল হলে খেলাটা শুধু উল্টে যাবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনায় বলেছেন, দলীয় বিবেচনায় সরকার সাত হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহার করে ‘এক লাখের ওপর ধর্ষক ও ডাকাতকে’ মুক্তি দিয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। তবে যে কথা তিনি বলেননি তা হচ্ছে, সে সময় আবার তারেক ও আরাফাত রহমানেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন, ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ মামলার নামে তখন তাদের মামলাগুলোও উঠে যাবে। দেশে তো তবে আইনের শাসন নয়, ধারাবাহিকভাবে চলছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসন, যার হাতিয়ার হচ্ছে আইন। চলছে সেই পুরোনো ‘আইনের দ্বারা’ শাসন।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.