সমকালীন প্রসঙ্গ-বাংলাদেশে অপরাধের জগৎ যেভাবে চলছে by বদরুদ্দীন উমর
পুলিশের অপরাধমূলক বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের এই মুহূর্তের এক দৃষ্টান্ত হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ডাকাত বলে গ্রেফতার করে, তাকে নিজেদের হেফাজতে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা। আবদুল কাদেরকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিরপরাধ জেনেও পুলিশ যে এখনও তার বিরুদ্ধে মামলা তুলে না নিয়ে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করছে এটা
স্বাভাবিক অবস্থায় সম্ভব নয়। এটা সম্ভব হচ্ছে বর্তমানে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় দেশজুড়ে এক অস্বাভাবিক অপরাধের পরিবেশ গড়ে ওঠার কারণে। একের পর এক সরকার যদি নানা ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতায় নিজেরা জড়িত না থাকত এবং অপরাধ দমনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করত, তাহলে এই পরিস্থিতি দেশে এভাবে সৃষ্টি হতো না
বাংলাদেশে অপরাধের ব্যাপকতা, বৈচিত্র্য ও মাত্রা এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যার সঙ্গে ভয়াবহ নৈরাজ্যিক পরস্থিতির পার্থক্য নেই। এই অপরাধের জগতেই এখন বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের বসবাস। এদিক দিয়ে গ্রাম ও শহরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর সব থেকে বিপজ্জনক দিক হলো, এসব অপরাধের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই। উপরন্তু এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যেখানে স্থানীয় জনগণ ঘটতে থাকা নির্যাতনের দৃশ্য নির্বিকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। সালিশের নামে রংপুরের বদরগঞ্জে গৃহবধূ নির্যাতনের এ ধরনের এক দৃশ্য 'সকালের খবর'-এর শেষ পৃষ্ঠায় আজ ছাপা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, গৃহবধূটিকে চিৎ করে ফেলে জন দুই লোক লাঠিপেটা করছে এবং স্থানীয় লোকজন চেয়ারে বসে ও চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে থেকে এই দৃশ্য উপভোগ করছে! বিগত ৭ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে 'সালিশে প্রকাশ্যে দুই গৃহবধূকে লাঠিপেটা' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে এর বিরুদ্ধে রুল জারি করে এই ঘটনার বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এ ধরনের ঘটনা গ্রামে নতুন বা ব্যতিক্রম নয়। নিয়মিতভাবেই এটা গ্রামাঞ্চলে বেশ কিছুদিন থেকে ঘটে চলেছে। এর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ, হাইকোর্টের রুলিং ইত্যাদি হলেও এ ধরনের নারী নির্যাতন বন্ধের কোনো লক্ষণ এখনও পর্যন্ত নেই। বদরগঞ্জে সদ্য সংঘটিত ঘটনাটিই এর প্রমাণ।
গ্রামে যেমন আছে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা, তেমনি আছে অন্য ধরনের ঘটনা যা দেখা গেছে মাত্র কয়েকদিন আগে। ঢাকার গাবতলী-আমীনবাজার এলাকায় রাতে ডাকাত সন্দেহে ছয়জন ছাত্রকে গ্রামবাসী পিটিয়ে হত্যা করেছে। তাদের আটক করে, জিজ্ঞাসাবাদ করে, তাদের পরিচয় জানার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। ডাকাত ধরার নাম করে তারা নিজেদের খুনের স্পৃহা চরিতার্থ করতে গিয়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। একদিকে গৃহবধূ নির্যাতন ও সেই নির্যাতনের দৃশ্য দাঁড়িয়ে, বসে দেখা ও উপভোগ করা এবং অন্যদিকে এভাবে ছয়জন ছাত্রের পরিচয় জানার কোনো চেষ্টা না করে দল বেঁধে গ্রামবাসী কর্তৃক তাদের পিটিয়ে হত্যা করার মধ্যে অপরাধ প্রবণতার চারিত্রিক মিল অবশ্যই আছে।
আজকের দৈনিক সমকালেই মেঘনার জেলেদের ওপর একটি রিপোর্ট প্রথম পৃষ্ঠাতেই বের হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, নদীতে এখন প্রচুর মাছ ধরা পড়লেও জলদস্যু নিজাম ও তার গ্রুপের সদস্যদের চাঁদা পরিশোধ করতে না পারায় নদীতে মাছ ধরতে যেতে পারছেন না শত শত জেলে। নিজাম ডাকাত বড় নৌকাপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ও ছোট নৌকাপ্রতি ৩০-৪০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। এই চাঁদা পরিশোধ করে জেলেদের 'নিজাম ডাকাত টোকেন' সংগ্রহ না করলে নদীতে গিয়ে তাদের মাছ ধরার উপায় নেই। নদীতে টহল পুলিশের কোনো কথা এ রিপোর্টে না থাকলেও জলদস্যুরা যে পুলিশের কাছ থেকে টাকা খেয়েই অবাধে তাদের দস্যুবৃত্তি করে থাকে এতে সন্দেহ নেই!
প্রতিদিনই নানা ধরনের অপরাধ দেশজুড়ে এমনভাবে ঘটছে যাতে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। এ অবস্থা রীতিমতো আতঙ্কজনক। কিন্তু এর থেকেও আতঙ্কজনক ব্যাপার এই যে, এই পরিস্থিতি দ্রুতগতিতে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হচ্ছে। বাংলাদেশে এটা কেন ঘটছে এর কারণ অনুসন্ধান করলে সহজেই বোঝা যাবে, সরকার ও বিভিন্ন রাষ্ট্রযন্ত্রের অপরাধমূলক তৎপরতাই মূলত এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং এর অবনতি ঘটিয়ে চলেছে। বেপরোয়া ঘুষ, চুরি, দুর্নীতি থেকে নিয়ে খুন-জখম পর্যন্ত সবকিছুই এই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। মন্ত্রী, এমপি প্রমুখের দুর্নীতির ওপর রিপোর্ট নিয়মিতই প্রকাশিত হয়। আমলারাও এই দুর্নীতির বড় অংশীদার। দু'একদিন আগে জাতীয় সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, হুইপ, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য প্রমুখের আপ্যায়ন বাবদ বছরে কোটি কোটি টাকা খরচের একটা হিসাব বের হয়েছে। এতে দেখা যায়, তারা কে কত খরচ করবেন তার ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফুর্তির বশবর্তী হয়ে তারা যতই লাখ লাখ টাকা খরচ করুন তার কোনো বিরোধিতা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নেই। অন্য ধরনের দুর্নীতির কথা বাদ দিয়েও উচ্চতম পর্যায়ের এই আপ্যায়ন খরচও যে এক অবাধ দুর্নীতির ব্যাপার এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। এসবের সঙ্গে দেশে ক্রমবর্ধমান অপরাধের যোগ সম্পর্ক আছে। কিন্তু শারীরিক নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির সঙ্গে যার যোগ সব থেকে বেশি তা হলো, পুলিশি নির্যাতন এবং পুলিশের নিজেরই অপরাধমূলক তৎপরতা। এই পুলিশের সঙ্গে সম্পর্কিত আছে র্যাবসহ বিভিন্ন ধরনের বাহিনী। পুলিশ যেখানে নাগরিকদের রক্ষকের ভূমিকা বাদ দিয়ে নিজেই তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে, সেখানে সমাজে অপরাধের বিস্তার যে অবাধে ঘটতে থাকবে এটা স্বাভাবিক।
পুলিশের অপরাধমূলক তৎপরতার সব থেকে বিপজ্জনক দিক হলো, প্রায়ই প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে ব্যর্থ হয়ে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দিয়ে নিরপরাধ লোককে অপরাধী সাজানোর জন্য নানা ক্রিমিনাল পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ। এটা কিছুদিন আগে লিমনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। আসল অপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে তার মতো একজন নিরীহ ও নিরপরাধ ছাত্রকে গুলি করে তার পা নষ্ট করে দেওয়ার মতো অপরাধ যেখানে র্যাব নিজেই করে, সেখানে তার দ্বারা যে সাধারণ চোর, ডাকাত ও গুণ্ডারা উৎসাহিত হয়ে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে র্যাব-পুলিশের সহায়তায় আইনকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরাও খুন-জখম করবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। লিমনের ব্যাপার নিয়ে দেশব্যাপী এত বিক্ষোভ ও লেখালেখি সত্ত্বেও র্যাব যে এখনও পর্যন্ত তাদের অপরাধমূলক অবস্থান থেকে একটুকুও নড়েনি, এটা অপরাধের জগৎ ভালোভাবেই লক্ষ্য করে। এর মধ্যেই তারা নিজেদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পায়। এ জন্য বাংলাদেশে এখন অপরাধের যত ঘটনা ঘটছে সেগুলো যে শুধু র্যাব-পুলিশের নিজেদের অপরাধমূলক তৎপরতা থেকে উৎসাহ লাভ করেই ঘটছে তাই নয়। এসব ঘটনার অধিকাংশই ঘটছে তাদের সঙ্গে সাধারণ অপরাধীদের যোগসাজশের মাধ্যমে অথবা অপরাধী পাকড়াও করার ক্ষেত্রে তাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য। এ সম্পর্কিত রিপোর্ট এখন সংবাদপত্রের পাতায় নিয়মিত ব্যাপার।
পুলিশ যে তাদের অপরাধমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভকে মোটেই পরোয়া করে না, এর প্রধান কারণ পুলিশের অপরাধের জন্য তাদের দ্রুত শাস্তি তো দূরের কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো শাস্তির ব্যবস্থা সরকারিভাবে করা হয় না। পুলিশ যেভাবে অপরাধীদের নিজেদের নাকের ডগায় অপরাধ চালিয়ে যেতে অনেক ক্ষেত্রেই সহায়তা করে, তেমনি সরকার আবার পুলিশের অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা তো দূরের কথা, তাদের শাস্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টাই করে থাকে। সরকার ও সরকারি লোকজন নিজেরা যেসব অপরাধ করে তার জন্য পুলিশের সাহায্য তাদের প্রয়োজন হয়। কাজেই পুলিশকে অপরাধের শাস্তি থেকে রক্ষা করা হয়ে দাঁড়ায় সরকারের দায়িত্ব!
পুলিশের অপরাধমূলক বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের এই মুহূর্তের এক দৃষ্টান্ত হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ডাকাত বলে গ্রেফতার করে, তাকে নিজেদের হেফাজতে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা। আবদুল কাদেরকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিরপরাধ জেনেও পুলিশ যে এখনও তার বিরুদ্ধে মামলা তুলে না নিয়ে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করছে এটা স্বাভাবিক অবস্থায় সম্ভব নয়। এটা সম্ভব হচ্ছে বর্তমানে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় দেশজুড়ে এক অস্বাভাবিক অপরাধের পরিবেশ গড়ে ওঠার কারণে। একের পর এক সরকার যদি নানা ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতায় নিজেরা জড়িত না থাকত এবং অপরাধ দমনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করত, তাহলে এই পরিস্থিতি দেশে এভাবে সৃষ্টি হতো না। অপরাধের জগৎ দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকা এবং চারদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা দাঁড়াত না। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি, গৃহবধূ নির্যাতন, ক্রমবর্ধমান হারে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ১০-২০ জনের মৃত্যু, নদীতে জলদস্যুদের অবাধ অপরাধ, লিমন ও কাদেরের মতো ছাত্রের ওপর র্যাব-পুলিশের নির্যাতন একই অপরাধের সূত্রে গ্রথিত আছে। এবং এসব অপরাধের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র আছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার ও রাষ্ট্রের অপরাধ দমন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তো বটেই, উপরন্তু তাদের নিজেদেরই নানা ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতার।
১.৮.২০১১
বাংলাদেশে অপরাধের ব্যাপকতা, বৈচিত্র্য ও মাত্রা এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যার সঙ্গে ভয়াবহ নৈরাজ্যিক পরস্থিতির পার্থক্য নেই। এই অপরাধের জগতেই এখন বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের বসবাস। এদিক দিয়ে গ্রাম ও শহরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর সব থেকে বিপজ্জনক দিক হলো, এসব অপরাধের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই। উপরন্তু এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যেখানে স্থানীয় জনগণ ঘটতে থাকা নির্যাতনের দৃশ্য নির্বিকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। সালিশের নামে রংপুরের বদরগঞ্জে গৃহবধূ নির্যাতনের এ ধরনের এক দৃশ্য 'সকালের খবর'-এর শেষ পৃষ্ঠায় আজ ছাপা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, গৃহবধূটিকে চিৎ করে ফেলে জন দুই লোক লাঠিপেটা করছে এবং স্থানীয় লোকজন চেয়ারে বসে ও চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে থেকে এই দৃশ্য উপভোগ করছে! বিগত ৭ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে 'সালিশে প্রকাশ্যে দুই গৃহবধূকে লাঠিপেটা' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে এর বিরুদ্ধে রুল জারি করে এই ঘটনার বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এ ধরনের ঘটনা গ্রামে নতুন বা ব্যতিক্রম নয়। নিয়মিতভাবেই এটা গ্রামাঞ্চলে বেশ কিছুদিন থেকে ঘটে চলেছে। এর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ, হাইকোর্টের রুলিং ইত্যাদি হলেও এ ধরনের নারী নির্যাতন বন্ধের কোনো লক্ষণ এখনও পর্যন্ত নেই। বদরগঞ্জে সদ্য সংঘটিত ঘটনাটিই এর প্রমাণ।
গ্রামে যেমন আছে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা, তেমনি আছে অন্য ধরনের ঘটনা যা দেখা গেছে মাত্র কয়েকদিন আগে। ঢাকার গাবতলী-আমীনবাজার এলাকায় রাতে ডাকাত সন্দেহে ছয়জন ছাত্রকে গ্রামবাসী পিটিয়ে হত্যা করেছে। তাদের আটক করে, জিজ্ঞাসাবাদ করে, তাদের পরিচয় জানার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। ডাকাত ধরার নাম করে তারা নিজেদের খুনের স্পৃহা চরিতার্থ করতে গিয়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। একদিকে গৃহবধূ নির্যাতন ও সেই নির্যাতনের দৃশ্য দাঁড়িয়ে, বসে দেখা ও উপভোগ করা এবং অন্যদিকে এভাবে ছয়জন ছাত্রের পরিচয় জানার কোনো চেষ্টা না করে দল বেঁধে গ্রামবাসী কর্তৃক তাদের পিটিয়ে হত্যা করার মধ্যে অপরাধ প্রবণতার চারিত্রিক মিল অবশ্যই আছে।
আজকের দৈনিক সমকালেই মেঘনার জেলেদের ওপর একটি রিপোর্ট প্রথম পৃষ্ঠাতেই বের হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, নদীতে এখন প্রচুর মাছ ধরা পড়লেও জলদস্যু নিজাম ও তার গ্রুপের সদস্যদের চাঁদা পরিশোধ করতে না পারায় নদীতে মাছ ধরতে যেতে পারছেন না শত শত জেলে। নিজাম ডাকাত বড় নৌকাপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ও ছোট নৌকাপ্রতি ৩০-৪০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। এই চাঁদা পরিশোধ করে জেলেদের 'নিজাম ডাকাত টোকেন' সংগ্রহ না করলে নদীতে গিয়ে তাদের মাছ ধরার উপায় নেই। নদীতে টহল পুলিশের কোনো কথা এ রিপোর্টে না থাকলেও জলদস্যুরা যে পুলিশের কাছ থেকে টাকা খেয়েই অবাধে তাদের দস্যুবৃত্তি করে থাকে এতে সন্দেহ নেই!
প্রতিদিনই নানা ধরনের অপরাধ দেশজুড়ে এমনভাবে ঘটছে যাতে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। এ অবস্থা রীতিমতো আতঙ্কজনক। কিন্তু এর থেকেও আতঙ্কজনক ব্যাপার এই যে, এই পরিস্থিতি দ্রুতগতিতে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হচ্ছে। বাংলাদেশে এটা কেন ঘটছে এর কারণ অনুসন্ধান করলে সহজেই বোঝা যাবে, সরকার ও বিভিন্ন রাষ্ট্রযন্ত্রের অপরাধমূলক তৎপরতাই মূলত এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং এর অবনতি ঘটিয়ে চলেছে। বেপরোয়া ঘুষ, চুরি, দুর্নীতি থেকে নিয়ে খুন-জখম পর্যন্ত সবকিছুই এই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। মন্ত্রী, এমপি প্রমুখের দুর্নীতির ওপর রিপোর্ট নিয়মিতই প্রকাশিত হয়। আমলারাও এই দুর্নীতির বড় অংশীদার। দু'একদিন আগে জাতীয় সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, হুইপ, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য প্রমুখের আপ্যায়ন বাবদ বছরে কোটি কোটি টাকা খরচের একটা হিসাব বের হয়েছে। এতে দেখা যায়, তারা কে কত খরচ করবেন তার ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফুর্তির বশবর্তী হয়ে তারা যতই লাখ লাখ টাকা খরচ করুন তার কোনো বিরোধিতা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নেই। অন্য ধরনের দুর্নীতির কথা বাদ দিয়েও উচ্চতম পর্যায়ের এই আপ্যায়ন খরচও যে এক অবাধ দুর্নীতির ব্যাপার এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। এসবের সঙ্গে দেশে ক্রমবর্ধমান অপরাধের যোগ সম্পর্ক আছে। কিন্তু শারীরিক নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির সঙ্গে যার যোগ সব থেকে বেশি তা হলো, পুলিশি নির্যাতন এবং পুলিশের নিজেরই অপরাধমূলক তৎপরতা। এই পুলিশের সঙ্গে সম্পর্কিত আছে র্যাবসহ বিভিন্ন ধরনের বাহিনী। পুলিশ যেখানে নাগরিকদের রক্ষকের ভূমিকা বাদ দিয়ে নিজেই তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে, সেখানে সমাজে অপরাধের বিস্তার যে অবাধে ঘটতে থাকবে এটা স্বাভাবিক।
পুলিশের অপরাধমূলক তৎপরতার সব থেকে বিপজ্জনক দিক হলো, প্রায়ই প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে ব্যর্থ হয়ে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দিয়ে নিরপরাধ লোককে অপরাধী সাজানোর জন্য নানা ক্রিমিনাল পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ। এটা কিছুদিন আগে লিমনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। আসল অপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে তার মতো একজন নিরীহ ও নিরপরাধ ছাত্রকে গুলি করে তার পা নষ্ট করে দেওয়ার মতো অপরাধ যেখানে র্যাব নিজেই করে, সেখানে তার দ্বারা যে সাধারণ চোর, ডাকাত ও গুণ্ডারা উৎসাহিত হয়ে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে র্যাব-পুলিশের সহায়তায় আইনকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরাও খুন-জখম করবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। লিমনের ব্যাপার নিয়ে দেশব্যাপী এত বিক্ষোভ ও লেখালেখি সত্ত্বেও র্যাব যে এখনও পর্যন্ত তাদের অপরাধমূলক অবস্থান থেকে একটুকুও নড়েনি, এটা অপরাধের জগৎ ভালোভাবেই লক্ষ্য করে। এর মধ্যেই তারা নিজেদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পায়। এ জন্য বাংলাদেশে এখন অপরাধের যত ঘটনা ঘটছে সেগুলো যে শুধু র্যাব-পুলিশের নিজেদের অপরাধমূলক তৎপরতা থেকে উৎসাহ লাভ করেই ঘটছে তাই নয়। এসব ঘটনার অধিকাংশই ঘটছে তাদের সঙ্গে সাধারণ অপরাধীদের যোগসাজশের মাধ্যমে অথবা অপরাধী পাকড়াও করার ক্ষেত্রে তাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য। এ সম্পর্কিত রিপোর্ট এখন সংবাদপত্রের পাতায় নিয়মিত ব্যাপার।
পুলিশ যে তাদের অপরাধমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভকে মোটেই পরোয়া করে না, এর প্রধান কারণ পুলিশের অপরাধের জন্য তাদের দ্রুত শাস্তি তো দূরের কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো শাস্তির ব্যবস্থা সরকারিভাবে করা হয় না। পুলিশ যেভাবে অপরাধীদের নিজেদের নাকের ডগায় অপরাধ চালিয়ে যেতে অনেক ক্ষেত্রেই সহায়তা করে, তেমনি সরকার আবার পুলিশের অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা তো দূরের কথা, তাদের শাস্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টাই করে থাকে। সরকার ও সরকারি লোকজন নিজেরা যেসব অপরাধ করে তার জন্য পুলিশের সাহায্য তাদের প্রয়োজন হয়। কাজেই পুলিশকে অপরাধের শাস্তি থেকে রক্ষা করা হয়ে দাঁড়ায় সরকারের দায়িত্ব!
পুলিশের অপরাধমূলক বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের এই মুহূর্তের এক দৃষ্টান্ত হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ডাকাত বলে গ্রেফতার করে, তাকে নিজেদের হেফাজতে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা। আবদুল কাদেরকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিরপরাধ জেনেও পুলিশ যে এখনও তার বিরুদ্ধে মামলা তুলে না নিয়ে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করছে এটা স্বাভাবিক অবস্থায় সম্ভব নয়। এটা সম্ভব হচ্ছে বর্তমানে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় দেশজুড়ে এক অস্বাভাবিক অপরাধের পরিবেশ গড়ে ওঠার কারণে। একের পর এক সরকার যদি নানা ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতায় নিজেরা জড়িত না থাকত এবং অপরাধ দমনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করত, তাহলে এই পরিস্থিতি দেশে এভাবে সৃষ্টি হতো না। অপরাধের জগৎ দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকা এবং চারদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা দাঁড়াত না। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি, গৃহবধূ নির্যাতন, ক্রমবর্ধমান হারে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ১০-২০ জনের মৃত্যু, নদীতে জলদস্যুদের অবাধ অপরাধ, লিমন ও কাদেরের মতো ছাত্রের ওপর র্যাব-পুলিশের নির্যাতন একই অপরাধের সূত্রে গ্রথিত আছে। এবং এসব অপরাধের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র আছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার ও রাষ্ট্রের অপরাধ দমন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তো বটেই, উপরন্তু তাদের নিজেদেরই নানা ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতার।
১.৮.২০১১
No comments