সাদাকালো-ক্ষুদ্রঋণ সহায়তার ঐতিহ্য নিয়ে কিছু কথা by আহমদ রফিক

ব্রিটিশ বঙ্গে গ্রামীণ দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বদৌলতে সৃষ্ট নব্য জমিদার শ্রেণীর শাসন এবং ভয়াবহ মহাজনি শোষণ। অনেক ক্ষেত্রে আবার জমিদারির সঙ্গে মহাজনি কারবার। এর ওপর মধ্যস্বত্বভোগী উপশ্রেণীর উৎপাত, সেখানে সুদের ব্যবসা।


কৃষকের চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় কৃষি খাতে যেমন উৎপাদন ব্যাহত হয়, তেমনি ঘটে রাজস্ব ঘাটতি।
হয়তো এসব ঘটনা বিবেচনায় এনে কৃষক শ্রেণীর দুর্দশা কিছুটা লাঘব করতে ১৯০৪ সালে সমবায়ভিত্তিক যে আইন জারি হয় তা হলো, 'কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি অ্যাক্ট'। এ সমবায়ী ব্যবস্থার সুবাদে সহজ শর্তে দরিদ্র কৃষকদের ঋণ-সহায়তা দানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালের 'লোন কম্পানি'গুলোর উদ্দেশ্য ছিল গরিব জনশ্রেণীকে ঋণ-সহায়তা দান। আরো অনেক পরে ঋণ ও ঋণের সুদ মেটাতে না পারা গরিব কৃষকদের সাহায্যার্থে তৈরি হয় 'রুরাল ইনডেটেডনেস অ্যাক্ট'। এর ফলে একপর্যায়ে দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের ঋণ ফেরৎ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকেনি।
আমাদের জাতীয় সংসদে দিন দুই আগে প্রশ্নোত্তর সুবাদে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেন। তাঁর মতে, ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা দান আধুনিককালের ঘটনা নয়। শতবর্ষেরও আগে ওই আইনের আওতায় কোনো ধরনের 'কোলেটারাল সিকিউরিটি' ছাড়াই গরিব কৃষক বা শ্রমজীবী মানুষকে ঋণ-সহায়তা দানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এর সমবায়ী চরিত্র। যা আজকালকার ক্ষুদ্রঋণ সহায়তার ব্যবস্থায় নেই।
কিন্তু অনেক সময় সরকারি আইন সদিচ্ছা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তৃণমূল স্তরের জনগণের খুব একটা উপকারে আসে না, অর্থাৎ উপকারে আসতে পারে না। সরকারি ব্যবস্থায় অনেক বাধা, অনেক সীমাবদ্ধতা সদিচ্ছাকে হার মানায়, উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। সে জন্যই ওইসব আইনের সুফল ব্যাপক স্তরে জনগণের হাতে পেঁৗছায় না।
এর প্রমাণ এর পরও মধ্যস্বত্বভোগী ও মহাজনি ব্যবসার রমরমা অবস্থা যথেষ্ট সচল ছিল। মহাজনি ঋণের ভয়াবহতার ছবি আমরা রবীন্দ্রনাথের লেখায় বা পত্রাবলিতে দেখতে পাই। বিষয়টা রবীন্দ্রনাথের মানবিক চেতনায় গভীর দাগ কেটেছিল। পাঠক সাধারণের অবগতির জন্য সমবায়মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে কিছু তথ্য সংযোজন করতে চাই, যা হয়তো কেউ কেউ জানেন, কিন্তু অনেকে জানেন না বা তাঁদের জানার সুযোগ হয়নি।
সাহিত্যসেবী রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সমবায়নীতির একজন আন্তরিক প্রবক্তা। সমবায় সম্পর্কে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা এখনো বিবেচনার যোগ্য। এখানে একই সঙ্গে মানবিক চেতনার রবীন্দ্রনাথকেও দেখতে পাই। তাঁর ভাষায়_'শ্রেষ্ঠত্বের উৎকর্ষে সকল মানুষের জন্মগত অধিকার। গ্রামে গ্রামে আজ মানুষের সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।... আমার মনে হয়, কো-অপারেটিভ প্রণালীই দেশকে দারিদ্র্য হইতে বাঁচাইবার একমাত্র উপায়। ধনী আপনার টাকার জোরে নির্ধনের শক্তিকে সস্তাদামে কিনিয়া লইতে চায়, ইহাতে টাকা ও ক্ষমতা কেবল এক জায়গাতেই বড়ো হইয়া ওঠে এবং বাকি জায়গায় সেই বড়ো টাকার আওতায় ছোটো শক্তিগুলি মাথা তুলিতে পারে না। কিন্তু সমবায় প্রণালীতে পরস্পর পরস্পরকে জিতিয়া বড়ো হইতে চাহিবে না। মিলিয়া বড়ো হইবে।' শ্রমজীবীদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'নির্ধনের দুর্বলতা সভ্যতাকে দুর্বল ও অসম্পূর্ণ করে রেখেছিল। আজ নির্ধনকেই বল লাভ করে তার প্রতিকার করতে হবে।' আপাতত সে প্রতিকারের উপায় সংস্কারবাদী পন্থায় সমবায়নীতির সার্বিক প্রয়োগের মাধ্যমে, যাতে জনসংঘ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। এ ভাবনা রবীন্দ্রনাথের।
তাঁর ভাষায়_'ধন অর্জনে সর্বসাধারণের শক্তি সম্মিলিত হতে পারে', যদি 'জীবিকা সমবায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।' তাতে করেই 'গ্রামগুলো বেঁচে উঠবে এবং দেশকে বাঁচাবে।' সমবায়ব্যবস্থা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে শোষিত জনশ্রেণীর মুক্তির একটা উপায় পল্লী-পুনর্গঠনের এবং আদর্শ পল্লীসমাজ গঠনের মাধ্যমে দেখতে পান কবি।
গ্রামের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতায় গ্রামের মুক্তি, মুক্তি আদর্শ সমাজ গঠনের মাধ্যমে। বহুকাল আগের 'গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে' ঘোষণার পর আমরা একালে এসে বাংলাদেশে শুনতে পাই এ স্লোগান যে '৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে'। কিন্তু গ্রামকে বাঁচাতে হলে যে গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্পের বিকাশ এবং কৃষির বাইরেও গ্রামে উপার্জনের একাধিক উৎস তৈরি করতে হবে, সেদিকে আমাদের প্রচেষ্টা এখনো যথেষ্ট নয়। কুমিল্লার কোটবাড়ীতে একদা সূচিত সমবায়ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। কালীগ্রাম পরগনার শতবর্ষ আগে কৃষি সমবায়, তাঁত সমবায় ও অন্যান্য জীবিকাভিত্তিক সমবায় সংগঠন গড়ে উঠে কালীগ্রামের দুস্থ সমাজকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল, একালে তার যথাযথ প্রয়োগে বাধা কোথায়? এ সম্ভাবনার কথা আমরা ভেবে দেখছি না। গ্রাম কিন্তু দিনের পর দিন অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে, তার অন্যতম প্রধান আয়ের পথ বিদেশে কর্মরতদের পাঠানো টাকা। সেই সঙ্গে অন্য কিছু।
আগেকার কথা, অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণ সহায়তার প্রসঙ্গে ফিরে যাই। ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা অর্থাৎ মাইক্রোক্রেডিট সিস্টেমের পূর্ব-ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলছিলেন সমবায়মন্ত্রী। সেখানে আমাদের বক্তব্য, শুধু ১৯০৪ সালের আইনই নয়, এ বিষয়ে বিশ শতকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ গ্রামোন্নয়নের ও স্বনির্ভর পল্লী গঠনের যে পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করেন, তাতে দেখা যায় যে ওই সমবায় ভিত্তিতে ১৯০৫ সালে পতিসরে স্থাপিত হয় 'কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক'।
রবীন্দ্রনাথের ধার-দেনা করে স্থাপিত ওই কৃষি ব্যাংক থেকে কৃষকদের ঋণ সহায়তা দানের যে নিয়ম প্রচলিত ছিল, সেখানেও ঋণ নেওয়ার জন্য কোনো আমানত বা 'কোলেটারাল সিকিউরিটি'র বাধ্যবাধকতা ছিল না। কৃষক নিঃশর্তভাবে মাত্র ১২ শতাংশ সহজ-সরল সুদে ঋণ নিয়েছে, তাকে ঋণের জন্য আর মহাজনের বাড়ি দৌড়াতে হয়নি এবং মহাজনি ঋণের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতে হয়নি। কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক ২০ বছরের অধিক সময়ের সফলতায় সেখানকার মুসলমানপ্রধান গরিব প্রজাদের জন্য অসাধ্য সাধন করেছিল।
তথ্য হিসেবে আরো জানাতে চাই যে এরও আগে সম্ভবত বছর দুই-তিন আগে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের গরিব কৃষকদের ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা দানের জন্য সেখানে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। কিন্তু পরে শিলাইদহ থেকে পল্লী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কালীগ্রামে স্থানান্তর হওয়ার পর ওই কৃষি ব্যাংকের আমানত কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংকে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, তারও আগে স্বল্প সময়ের জন্য এবং স্বল্প আয়তনে শাহজাদপুরে একই উদ্দেশ্যে 'কর্জা তহবিল' গঠন করা হয় এবং তা ভাগ্নে সত্যপ্রসাদের কাছ থেকে 'পাঁচ হাজার টাকা হাওলাত' নিয়ে। নিয়েছিলেন মামা রবীন্দ্রনাথ (প্রশান্তকুমার পাল)।
তাই আমরা দেখতে পাই, বিশ শতকের শুরুতেই দরিদ্র কৃষকদের মহাজনের হাত থেকে বাঁচাতে ক্ষুদ্রঋণ সহায়তার কার্যক্রম শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ পূর্বোক্ত 'অ্যাক্ট'-এর পাশাপাশি এবং কিছু সময় আগে। স্বভাবতই মানতে হয়, দারিদ্র্য বিমোচনের বর্তমান যে ব্যবস্থা দেশ-বিদেশে যথেষ্ট প্রশংসিত, তাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের পথিকৃতের ভূমিকা এবং তাঁর ওই কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম-পদ্ধতি এখনো আমাদের গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে নানা দিক থেকে অনুসরণযোগ্য। এ তথ্যগুলো পাঠকদের গোচরে আনতে পূর্বোক্ত সূত্র ধরে এ ছোট্ট লেখা।

লেখক : রবীন্দ্র গবেষক, ভাষা সংগ্রামী, কবি ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.