চালচিত্র-উপেক্ষিত মধ্যবিত্ত, তাকাতে হবে তাদের দিকেও by শুভ রহমান
ক্ষমতায় যাঁরাই যখন থাকেন, প্রধানত দারিদ্র্য দূর করার কথাই তাঁরা বলেন। এতে দারিদ্র্য যে তেমন দূর হয় তা নয়, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের আসনটি পাকা হয়। সে ধারার দারিদ্র্য বিমোচনের স্লোগানটা পাল্টায়নি। দারিদ্র্য দূর করার জন্য যত কাগজ খরচ হয়েছে, যত কৌশলপত্র তৈরি হয়েছে, তার অর্থমূল্য দিয়ে প্রকৃত দারিদ্র্য অনেক বেশি দূর করা যেত।
বাস্তবে এখন পর্যন্ত বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তরাই শাসকশ্রেণীকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখছে। শাসকরা জানেন, মধ্যবিত্তকে কখনো তুষ্ট করা যাবে না, আর তার দরকারও নেই। নিজের গরজেই মধ্যবিত্ত নানাভাবে সরকারকে তুষ্ট করেই নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। মধ্যবিত্তদের অভাব-অনটন কখনো মেটে না, তার বেতন একগুণ বাড়ার আগেই বাজারে জিনিসের দাম বেড়ে যায় কমপক্ষে দ্বিগুণ। সরকারও মধ্যবিত্ত বা পেটি বুর্জোয়ার শ্রেণীচরিত্র জানে_সরকার নিজেও মোটামুটি সেই শ্রেণীরই। মধ্যবিত্তই সরকারের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী, আবার পরোক্ষ তাঁবেদার।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ কাগজে বেরিয়েছে মূলত দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে। তাতে মোদ্দা কথা যেটা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, দেশে দারিদ্র্য কমছে, কমছে ধনী-দরিদ্রের আয়ের বৈষম্যও। জরিপে যা-ই বেরোক, সাধারণ মানুষের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাটা অন্য রকম। তারা চোখের ওপরই দেখতে পায়, ধনী আরো ধনী, দরিদ্র আরো দরিদ্র হচ্ছে। বৈষম্য-ব্যবধান কমছে না, বাড়ছেই। আর দারিদ্র্য আরো বাড়ছে বলেই বাড়ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা, বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা, অবনতি ঘটছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। অবশ্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ এক লেখায় দারিদ্র্য ও আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে যে বিশাল প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এই দুই সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের আন্তরিক প্রয়াসের যেসব বিবরণী দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। সরকার, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দেশের দারিদ্র্য দূর করতে, দেশের ভালো করতে যথাসাধ্যই চেষ্টা করছে। সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন : 'যথাসাধ্য ভালো বলে, ওগো আরো ভালো/কোন স্বর্গপুরী তুমি করে থাকো আলো/আরো ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হয়/অকর্মণ্য দাম্ভিকের_কবির এ তির্যক কথার মর্মার্থ হলো, ভালোর কোনো শেষ নেই, তাই আরো ভালোর কথা বলে প্রকৃতপক্ষে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হয় প্রতিপক্ষকে, আর কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী 'আরো ভালোর দল'কে যথার্থই বলেছেন : 'খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত আছে। আওয়ামী লীগ আমলে দেশে মঙ্গা হয় না। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত, মানুষ নানাভাবে সাহায্য পাচ্ছে। বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, স্তন্যদানকারী মা, সন্তানসম্ভবা গরিব মা, স্কুলে গমনকারী গরিব শিশুর মাসহ এ ধরনের নানাভাবে সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টিকারী আর্থিক অনুদান সরকার দিয়ে যাচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে। গরিব মানুষের কষ্ট লাঘব হচ্ছে।' তিনি আরো লিখেছেন : 'সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশে ধরে রাখা হয়েছে, এবার বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছে। চাকরিজীবীরা সন্তুষ্ট মনে চাকরি করে যাচ্ছেন, ব্যবসায়ীরা এত শান্তিতে কোনো দিন ব্যবসা করতে পারেননি...।'
প্রধানমন্ত্রী অতীতের হাওয়া ভবনের জুলুম ও তত্ত্বাবধায়ক আমলের আতঙ্কের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর গোটা নিবন্ধের মূল প্রশ্নটিতেই ফিরে এসে বলেছেন, এর পরও 'আরো ভালো'র দল বলবে, তার পরও দেশের অবস্থা ভালো নেই। এর কারণ কী? কারণ একটাই, অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক সরকার থাকলে তাদের দাম থাকে। এই শ্রেণীটা জীবনে জনগণের মুখোমুখি হতে পারে না, ভোটে জিততে পারে না। কিন্তু ক্ষমতার লোভ ছাড়তে পারে না।
প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলোর নির্মম বাস্তবতা ও সত্যতা অনস্বীকার্য। তিনি যা বলেছেন, তার মধ্যে দেশের জনসংখ্যার বৃহদাংশের মনের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। আজকের লেখায় আমরা জনগণের যে অংশটির অর্থাৎ মধ্যবিত্তের পক্ষ অবলম্বন করে যে দু-চার কথা বলতে চাইছি, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তাঁদের অনেকটাই কভার করা হয়ে গেছে। মধ্যবিত্তদের মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্তরা, যাঁরা প্রায় দরিদ্রের পর্যায়েই পড়েন; প্রধানমন্ত্রীর লেখায় উলি্লখিত নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধার তাঁরাও ভাগীদার। আর ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা তো প্রধানত মধ্যবিত্তের কাতারেই পড়েন। প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী 'এত শান্তিতে তাঁরা কোনো দিন ব্যবসা করতে পারেননি।' এ কথাটার সত্যতাও কেউই অস্বীকার করবে না।
তবু আমরা মধ্যবিত্তের জীবন ও দুর্ভোগের অন্য দু-একটি দিক তুলে ধরতে চাই। প্রকৃতপক্ষে যা মধ্যবিত্তের সংকট, স্বপ্ন, সম্ভাবনা নিয়ে আমার পরিকল্পিত বৃহত্তর রচনার উপক্রমণিকা ও সারাংশ মাত্র। মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীরা শান্তিতে চাকরি, ব্যবসা_এসব করছে ঠিকই; কিন্তু মধ্যবিত্ত হিসেবে, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তরা যে নিদারুণ দুর্ভোগ ও সংকটেও ভুগছে, ভুগছে অনুচ্চারিত ও অপ্রকাশিত দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভে, ভুগছে আশাহত হয়ে, প্রতিপদে অপমানিত হতে হতে এবং বুকের ভেতর চেপে রাখা কষ্ট দূর করার কোনো উপায় না পেয়ে_এগুলোও অস্বীকার করার কোনো জো নেই। ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারও যে সেদিকে তাকায় না, ভ্রূক্ষেপ করে না, সেটাও অনস্বীকার্যই।
মধ্যবিত্তের অবস্থানটাই এমন যে তাদের ক্রমাগত নিচেই নেমে যেতে হয়, দরিদ্র-সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গে অনিবার্যভাবে মিশে যাওয়া ছাড়া তার গত্যন্তর থাকে না। সে প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই তার রোধ করার উপায় বা ক্ষমতা থাকে না। তার আরেক অংশ থাকে ঊর্ধ্বমুখী, সুযোগ পেলেই ওপরের শ্রেণীতে উঠে যেতে চায় এবং প্রাণপণে চেষ্টা করে; কিন্তু কদাচ তাতে সফল হয়। সেটা ভাগ্যবদলের লটারির মতো। ১০ টাকা দিয়ে লাখ টাকার একটা লটারির টিকিট কেনার মোহ ও প্রবণতা প্রধানত এক শ্রেণীর অসচেতন মধ্যবিত্তেরই থাকে, দরিদ্র শ্রেণীর কাছে ১০ টাকার নগদ মূল্যটাই সব। সেটি সে হাতছাড়া করে না।
মধ্যবিত্তের যন্ত্রণাটা দরিদ্র-সর্বহারার চেয়ে শতগুণ বেশি। তার যন্ত্রণা তার মনের ভেতরেই পুষে রাখতে হয়, কদাচ তা প্রকাশ পায়। দরিদ্র মানুষের যন্ত্রণা নগ্ন এবং বেপরোয়া। তার রূপ অনেক ক্ষেত্রেই করুণ এবং বীভৎস। মধ্যবিত্ত সব সময় মরমে মরে থাকে। ওএমএসের চাল মধ্যবিত্ত গৃহবধূকেও ঘোমটা টেনে লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করতে দেখা যায়। সাধ্যে কুলাক বা না কুলাক_মধ্যবিত্তের মেকি ঠাট বজায় রাখতে প্রাণ বিসর্জনও দিতে হবে। 'উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট'_এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত।
কিন্তু সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা যতই রিডিকিউলাস হোক, মধ্যবিত্তকে দোদুল্যচিত্ত, ভীরু, কাপুরুষ মনে হোক, তার বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা ও অবদানই কিন্তু গোটা সমাজের নান্দনিক বিনির্মাণের জন্য দায়ী। ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া মধ্যবিত্ত ইউরোপ জয় করেছে, রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বাংলা ও এ উপমহাদেশেরও নবজাগরণ ঘটিয়েছে। মধ্যবিত্ত ছাড়া এ ভূখণ্ডসহ গোটা পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান ও ভাস্কর্য কিভাবে গড়ে উঠত? মানবজাতি তার বিশাল ঐতিহ্যের জন্য মধ্যবিত্তের কাছে চিরঋণী। রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান_সব কিছুরই কর্ণধার মধ্যবিত্ত।
আমাদের ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতার স্বার্থে দরিদ্রের কথা ভাবে কিংবা ভাবে বলে দাবি করে; কিন্তু আত্মবিকাশের কথাটি অর্থাৎ স্ব-শ্রেণী, তথা মধ্যশ্রেণীর বিকাশের কথাটি বিস্মৃতই থাকে। স্ব-শ্রেণীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা মধ্যবিত্তই করে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, জনগণের জন্যই তো সরকার অনেক কিছু করে, মধ্যবিত্তের জন্য, আলাদা করে করার কী আছে, করতে হবে কেন? দরিদ্র শ্রেণীর জন্য যেমন নানা পৃথক কর্মসূচি নিতে হয়, মধ্যবিত্তের জন্যও বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়ই বটে। মধ্যবিত্ত যাতে তার মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পায়, সে জন্য সীমিত ও স্বল্প আয় ও মধ্য আয়ের লোকদের কথা ভাবতে হবে আলাদা করেই। শুধু একটা চাকরি দেওয়া কিংবা উচ্চশিক্ষার দুয়ার খানিকটা উন্মোচিত রাখা কিংবা মেধাবিকাশ ও সংস্কৃতিচর্চার কিছু কুণ্ঠিত ও অপ্রশস্ত সুযোগ-সুবিধা বিস্তার করার মধ্যেই শাসকদের কর্তব্য সমাধা করলে চলবে না।
মধ্যবিত্ত সমাজের এক বিশাল ও অপরিহার্য সম্পদ ও শক্তি। সক্রেটিস থেকে শুরু করে লিওনার্দ দ্য ভিঞ্চি, মিকেলাঞ্জেলো, পিকাসো, রুশো, ভলতেয়ার, ইবনে সিনা থেকে ফ্রান্সিস বেকন, গ্যালিলিও, এডিসন, নিউটন, আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল যুগে যুগে মধ্যবিত্তের রেনেসাঁসের শ্রেষ্ঠ ফসল। মানবসম্পদ ও সভ্যতাকে উন্নত, বিকশিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত, মেধা ও মননে অত্যুজ্জ্বল, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তত্ত্বে সমৃদ্ধ করে তুলতে মধ্যবিত্তকে তার ঐতিহ্যের পথ ধরেই অফুরন্ত ও উদার সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সে ব্যাপারে কার্পণ্য বস্তুত সমাজকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ দেশের দুর্ভাগ্য যে এখানে বুকের রক্ত দিয়ে গড়া বাংলা একাডেমীর পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে কয়েক যুগ লেগে যায়। জাতীয় নাট্যশালার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ স্বাধীনতার চার দশকেও হয় না। জাতীয় বিজ্ঞানচর্চা, জাতীয় মানমন্দির, জাতীয় আর্ট মিউজিয়াম, জাতীয় ভাস্কর্য নির্মাণ, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গড়ার তাগিদই অনুভূত হয় না। মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কত দিনে ঘটে! গোটা সমাজের মূল্যবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত হবে তো মধ্যবিত্তের সার্বিক বিকাশের মধ্য দিয়েই।
আমাদের, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তকে কেন নিত্য সিএনজি অটোরিকশা ধরনের অত্যাবশ্যকীয় পরিবহনের জন্য চরম লাঞ্ছনা ও মনঃকষ্ট ভোগ করতে হবে, কেন দৈনন্দিন আহার্য ও নিত্যপণ্য সংগ্রহে উঞ্ছবৃত্তি করতে আর অপমানিত হতে হবে, কেন অতিথি আপ্যায়ন, বিনোদন, সম্মানজনকভাবে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে প্রতিমুহূর্তে হেনস্তার শিকার হতে হবে! নিরীহ এবং ছাপোষা মধ্যবিত্তই কিন্তু পৃথিবীর সব বড় বিপ্লব, উপপ্লব, আন্দোলন-সংগ্রামের আসল মাথা। মধ্যবিত্ত ছাড়া কি ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের কোনো একটি দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম সার্থকভাবে পরিচালিত হতে পারত? সমাজের আমূল পরিবর্তনের জন্য দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্ব অপরিহার্য হলেও সে পরিবর্তনের পথপরিদর্শক মধ্যবিত্তই।
মধ্যবিত্তই দেশের সৃজনশীলতার আধার। মধ্যবিত্তের বন্ধ্যত্ব বস্তুত সমাজকেই বন্ধ্যা করে রাখে। মধ্যবিত্তের মুক্তিই অন্য সব শ্রেণীর মুক্তির পূর্বশর্ত।
২৯.০৬.২০১১
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ কাগজে বেরিয়েছে মূলত দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে। তাতে মোদ্দা কথা যেটা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, দেশে দারিদ্র্য কমছে, কমছে ধনী-দরিদ্রের আয়ের বৈষম্যও। জরিপে যা-ই বেরোক, সাধারণ মানুষের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাটা অন্য রকম। তারা চোখের ওপরই দেখতে পায়, ধনী আরো ধনী, দরিদ্র আরো দরিদ্র হচ্ছে। বৈষম্য-ব্যবধান কমছে না, বাড়ছেই। আর দারিদ্র্য আরো বাড়ছে বলেই বাড়ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা, বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা, অবনতি ঘটছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। অবশ্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ এক লেখায় দারিদ্র্য ও আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে যে বিশাল প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এই দুই সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের আন্তরিক প্রয়াসের যেসব বিবরণী দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। সরকার, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দেশের দারিদ্র্য দূর করতে, দেশের ভালো করতে যথাসাধ্যই চেষ্টা করছে। সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন : 'যথাসাধ্য ভালো বলে, ওগো আরো ভালো/কোন স্বর্গপুরী তুমি করে থাকো আলো/আরো ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হয়/অকর্মণ্য দাম্ভিকের_কবির এ তির্যক কথার মর্মার্থ হলো, ভালোর কোনো শেষ নেই, তাই আরো ভালোর কথা বলে প্রকৃতপক্ষে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হয় প্রতিপক্ষকে, আর কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী 'আরো ভালোর দল'কে যথার্থই বলেছেন : 'খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত আছে। আওয়ামী লীগ আমলে দেশে মঙ্গা হয় না। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত, মানুষ নানাভাবে সাহায্য পাচ্ছে। বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, স্তন্যদানকারী মা, সন্তানসম্ভবা গরিব মা, স্কুলে গমনকারী গরিব শিশুর মাসহ এ ধরনের নানাভাবে সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টিকারী আর্থিক অনুদান সরকার দিয়ে যাচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে। গরিব মানুষের কষ্ট লাঘব হচ্ছে।' তিনি আরো লিখেছেন : 'সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশে ধরে রাখা হয়েছে, এবার বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছে। চাকরিজীবীরা সন্তুষ্ট মনে চাকরি করে যাচ্ছেন, ব্যবসায়ীরা এত শান্তিতে কোনো দিন ব্যবসা করতে পারেননি...।'
প্রধানমন্ত্রী অতীতের হাওয়া ভবনের জুলুম ও তত্ত্বাবধায়ক আমলের আতঙ্কের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর গোটা নিবন্ধের মূল প্রশ্নটিতেই ফিরে এসে বলেছেন, এর পরও 'আরো ভালো'র দল বলবে, তার পরও দেশের অবস্থা ভালো নেই। এর কারণ কী? কারণ একটাই, অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক সরকার থাকলে তাদের দাম থাকে। এই শ্রেণীটা জীবনে জনগণের মুখোমুখি হতে পারে না, ভোটে জিততে পারে না। কিন্তু ক্ষমতার লোভ ছাড়তে পারে না।
প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলোর নির্মম বাস্তবতা ও সত্যতা অনস্বীকার্য। তিনি যা বলেছেন, তার মধ্যে দেশের জনসংখ্যার বৃহদাংশের মনের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। আজকের লেখায় আমরা জনগণের যে অংশটির অর্থাৎ মধ্যবিত্তের পক্ষ অবলম্বন করে যে দু-চার কথা বলতে চাইছি, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তাঁদের অনেকটাই কভার করা হয়ে গেছে। মধ্যবিত্তদের মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্তরা, যাঁরা প্রায় দরিদ্রের পর্যায়েই পড়েন; প্রধানমন্ত্রীর লেখায় উলি্লখিত নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধার তাঁরাও ভাগীদার। আর ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা তো প্রধানত মধ্যবিত্তের কাতারেই পড়েন। প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী 'এত শান্তিতে তাঁরা কোনো দিন ব্যবসা করতে পারেননি।' এ কথাটার সত্যতাও কেউই অস্বীকার করবে না।
তবু আমরা মধ্যবিত্তের জীবন ও দুর্ভোগের অন্য দু-একটি দিক তুলে ধরতে চাই। প্রকৃতপক্ষে যা মধ্যবিত্তের সংকট, স্বপ্ন, সম্ভাবনা নিয়ে আমার পরিকল্পিত বৃহত্তর রচনার উপক্রমণিকা ও সারাংশ মাত্র। মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীরা শান্তিতে চাকরি, ব্যবসা_এসব করছে ঠিকই; কিন্তু মধ্যবিত্ত হিসেবে, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তরা যে নিদারুণ দুর্ভোগ ও সংকটেও ভুগছে, ভুগছে অনুচ্চারিত ও অপ্রকাশিত দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভে, ভুগছে আশাহত হয়ে, প্রতিপদে অপমানিত হতে হতে এবং বুকের ভেতর চেপে রাখা কষ্ট দূর করার কোনো উপায় না পেয়ে_এগুলোও অস্বীকার করার কোনো জো নেই। ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারও যে সেদিকে তাকায় না, ভ্রূক্ষেপ করে না, সেটাও অনস্বীকার্যই।
মধ্যবিত্তের অবস্থানটাই এমন যে তাদের ক্রমাগত নিচেই নেমে যেতে হয়, দরিদ্র-সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গে অনিবার্যভাবে মিশে যাওয়া ছাড়া তার গত্যন্তর থাকে না। সে প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই তার রোধ করার উপায় বা ক্ষমতা থাকে না। তার আরেক অংশ থাকে ঊর্ধ্বমুখী, সুযোগ পেলেই ওপরের শ্রেণীতে উঠে যেতে চায় এবং প্রাণপণে চেষ্টা করে; কিন্তু কদাচ তাতে সফল হয়। সেটা ভাগ্যবদলের লটারির মতো। ১০ টাকা দিয়ে লাখ টাকার একটা লটারির টিকিট কেনার মোহ ও প্রবণতা প্রধানত এক শ্রেণীর অসচেতন মধ্যবিত্তেরই থাকে, দরিদ্র শ্রেণীর কাছে ১০ টাকার নগদ মূল্যটাই সব। সেটি সে হাতছাড়া করে না।
মধ্যবিত্তের যন্ত্রণাটা দরিদ্র-সর্বহারার চেয়ে শতগুণ বেশি। তার যন্ত্রণা তার মনের ভেতরেই পুষে রাখতে হয়, কদাচ তা প্রকাশ পায়। দরিদ্র মানুষের যন্ত্রণা নগ্ন এবং বেপরোয়া। তার রূপ অনেক ক্ষেত্রেই করুণ এবং বীভৎস। মধ্যবিত্ত সব সময় মরমে মরে থাকে। ওএমএসের চাল মধ্যবিত্ত গৃহবধূকেও ঘোমটা টেনে লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করতে দেখা যায়। সাধ্যে কুলাক বা না কুলাক_মধ্যবিত্তের মেকি ঠাট বজায় রাখতে প্রাণ বিসর্জনও দিতে হবে। 'উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট'_এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত।
কিন্তু সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা যতই রিডিকিউলাস হোক, মধ্যবিত্তকে দোদুল্যচিত্ত, ভীরু, কাপুরুষ মনে হোক, তার বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা ও অবদানই কিন্তু গোটা সমাজের নান্দনিক বিনির্মাণের জন্য দায়ী। ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া মধ্যবিত্ত ইউরোপ জয় করেছে, রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বাংলা ও এ উপমহাদেশেরও নবজাগরণ ঘটিয়েছে। মধ্যবিত্ত ছাড়া এ ভূখণ্ডসহ গোটা পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান ও ভাস্কর্য কিভাবে গড়ে উঠত? মানবজাতি তার বিশাল ঐতিহ্যের জন্য মধ্যবিত্তের কাছে চিরঋণী। রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান_সব কিছুরই কর্ণধার মধ্যবিত্ত।
আমাদের ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতার স্বার্থে দরিদ্রের কথা ভাবে কিংবা ভাবে বলে দাবি করে; কিন্তু আত্মবিকাশের কথাটি অর্থাৎ স্ব-শ্রেণী, তথা মধ্যশ্রেণীর বিকাশের কথাটি বিস্মৃতই থাকে। স্ব-শ্রেণীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা মধ্যবিত্তই করে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, জনগণের জন্যই তো সরকার অনেক কিছু করে, মধ্যবিত্তের জন্য, আলাদা করে করার কী আছে, করতে হবে কেন? দরিদ্র শ্রেণীর জন্য যেমন নানা পৃথক কর্মসূচি নিতে হয়, মধ্যবিত্তের জন্যও বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়ই বটে। মধ্যবিত্ত যাতে তার মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পায়, সে জন্য সীমিত ও স্বল্প আয় ও মধ্য আয়ের লোকদের কথা ভাবতে হবে আলাদা করেই। শুধু একটা চাকরি দেওয়া কিংবা উচ্চশিক্ষার দুয়ার খানিকটা উন্মোচিত রাখা কিংবা মেধাবিকাশ ও সংস্কৃতিচর্চার কিছু কুণ্ঠিত ও অপ্রশস্ত সুযোগ-সুবিধা বিস্তার করার মধ্যেই শাসকদের কর্তব্য সমাধা করলে চলবে না।
মধ্যবিত্ত সমাজের এক বিশাল ও অপরিহার্য সম্পদ ও শক্তি। সক্রেটিস থেকে শুরু করে লিওনার্দ দ্য ভিঞ্চি, মিকেলাঞ্জেলো, পিকাসো, রুশো, ভলতেয়ার, ইবনে সিনা থেকে ফ্রান্সিস বেকন, গ্যালিলিও, এডিসন, নিউটন, আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল যুগে যুগে মধ্যবিত্তের রেনেসাঁসের শ্রেষ্ঠ ফসল। মানবসম্পদ ও সভ্যতাকে উন্নত, বিকশিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত, মেধা ও মননে অত্যুজ্জ্বল, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তত্ত্বে সমৃদ্ধ করে তুলতে মধ্যবিত্তকে তার ঐতিহ্যের পথ ধরেই অফুরন্ত ও উদার সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সে ব্যাপারে কার্পণ্য বস্তুত সমাজকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ দেশের দুর্ভাগ্য যে এখানে বুকের রক্ত দিয়ে গড়া বাংলা একাডেমীর পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে কয়েক যুগ লেগে যায়। জাতীয় নাট্যশালার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ স্বাধীনতার চার দশকেও হয় না। জাতীয় বিজ্ঞানচর্চা, জাতীয় মানমন্দির, জাতীয় আর্ট মিউজিয়াম, জাতীয় ভাস্কর্য নির্মাণ, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গড়ার তাগিদই অনুভূত হয় না। মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কত দিনে ঘটে! গোটা সমাজের মূল্যবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত হবে তো মধ্যবিত্তের সার্বিক বিকাশের মধ্য দিয়েই।
আমাদের, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তকে কেন নিত্য সিএনজি অটোরিকশা ধরনের অত্যাবশ্যকীয় পরিবহনের জন্য চরম লাঞ্ছনা ও মনঃকষ্ট ভোগ করতে হবে, কেন দৈনন্দিন আহার্য ও নিত্যপণ্য সংগ্রহে উঞ্ছবৃত্তি করতে আর অপমানিত হতে হবে, কেন অতিথি আপ্যায়ন, বিনোদন, সম্মানজনকভাবে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে প্রতিমুহূর্তে হেনস্তার শিকার হতে হবে! নিরীহ এবং ছাপোষা মধ্যবিত্তই কিন্তু পৃথিবীর সব বড় বিপ্লব, উপপ্লব, আন্দোলন-সংগ্রামের আসল মাথা। মধ্যবিত্ত ছাড়া কি ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের কোনো একটি দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম সার্থকভাবে পরিচালিত হতে পারত? সমাজের আমূল পরিবর্তনের জন্য দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্ব অপরিহার্য হলেও সে পরিবর্তনের পথপরিদর্শক মধ্যবিত্তই।
মধ্যবিত্তই দেশের সৃজনশীলতার আধার। মধ্যবিত্তের বন্ধ্যত্ব বস্তুত সমাজকেই বন্ধ্যা করে রাখে। মধ্যবিত্তের মুক্তিই অন্য সব শ্রেণীর মুক্তির পূর্বশর্ত।
২৯.০৬.২০১১
No comments