রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা by এ এম এম শওকত আলী

রাজনৈতিক উত্তাপ প্রশমনের লক্ষ্যে বিবাদমান দুই প্রধান দলের নেতারা ধীরে ধীরে সচেষ্ট হচ্ছেন। এমনই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মূল প্রশ্নটি হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না অন্তর্বর্তীকালের সরকার। যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, মূল উদ্দেশ্য অভিন্ন। তবে এর কাঠামোগত বিষয়ে ঐকমত্য হবে কি না এ বিষয়টি এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না।


এর আগে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান স্বীকৃত ছিল না। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের নেতা প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যে রূপরেখা দিয়েছিলেন সে কাঠামোতে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার কাঠামোর কোনো অবকাশ নেই। অতীতে অধুনাবিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সংবিধানে বর্ণিত প্রথায় নিয়োগ লাভ করেছেন। ২০০৬ সালে এ প্রথার সর্বপ্রথম ব্যত্যয় ঘটে। এর কারণ কারো অজানা নয়। অতএব, বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।
ক্ষমতাসীন দলের প্রধান কর্তৃক ঘোষিত নির্দলীয় সরকারের রূপরেখার মূল ভিত্তি ছিল কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সরকার গঠন করা সংবিধানসম্মত নয়। এখন কী হবে? স্মরণ করা যেতে পারে যে প্রথমে ১৯৯১ সালে সর্বদলীয় রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ফসল হিসেবেই ওই সময় যে সরকার গঠিত হয়, তা ছিল অনির্বাচিত সরকার। তবে ধরে নেওয়া যায় যে ওই সময় তীব্র রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের লক্ষ্যেই এ প্রথা সাময়িকভাবে চালু হয়। পরবর্তী সময় ১৯৯১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরবর্তী নির্বাচন যত নিকটবর্তী হয়, ততই রাজনৈতিক সংকট আবার ঘনীভূত হয়। সংসদে জামায়াতসহ সব বিরোধী দলই পদত্যাগ করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে সোচ্চার হয়। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দল এ দাবি মেনে নেয়।
ওই সময় এবং বর্তমান সময়ের মধ্যে একটি মিল অবশ্যই দৃশ্যমান। ওই সময়ও দেশের সুধীসমাজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিবাদমান দল দুটিকে আলাপ-আলোচনা এবং সমঝোতার মাধ্যমে সংকট নিরসনের অনুরোধ জ্ঞাপন করে। এর সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রদূতসহ কমনওয়েলথের মহাসচিবও ঢাকায় এসে সমঝোতা সৃষ্টির লক্ষ্যে চেষ্টা করেন, যা ফলপ্রসূ হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে। সবাই মনে করে যে সাংবিধানিক স্বীকৃতির ফলে এ প্রথা স্থায়ীত্ব লাভ করবে। দুই দৃশ্যপটের অন্য একটি সাদৃশ্য ছিল। তা হলো, নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালীকরণ এবং এর মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। লক্ষ্য অর্জন হয় ২০০৭ সালে, তবে অনেক রক্তক্ষয়ের পর। মূল কারণ ছিল প্রধান দুই দলের মধ্যে নির্দলীয় সরকারপ্রধান নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে ভিন্ন মত। শেষ পর্যন্ত ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি স্বঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সেটাই ছিল একটি বড় ভুল। এরই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করে সংসদ ও পরবর্তী সময় নির্বাচিত সরকার গঠনের কাজ ওই সরকার করতে ব্যর্থ হয়। ওই সময়ের প্রধান কাজ ছিল, নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করা। যে কাজটি সুষ্ঠুভাবেই করা হয়েছিল। আইডি কার্ডসহ নির্ভুল ভোটার তালিকাও করা হয়। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন। আবার নির্বাচিত সরকার এবং এ সরকারের দাবি অন্তর্বর্তী সরকার যার প্রধান হবে ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন সহকারী বিদেশমন্ত্রীর আহ্বানের পরই রাজনৈতিক উত্তাপ প্রশমনের কিছু বিষয় দৃশ্যমান হয়। এ মন্ত্রী দুই দলকেই সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এখন শোনা যাচ্ছে, সংলাপে দুই দলই রাজি। প্রধান বিরোধী দলের নেতারা এখন সংলাপে অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী কিছু প্রভাবশালী দেশের দূতাবাসও এতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের স্থান হলো বিভিন্ন দূতাবাস কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক ধারাই প্রধান দুই দলকে বাধ্য করেছে নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে এসব অনুষ্ঠানকে বেছে নেওয়ার। এর বাইরে কী কোনো স্থান নেই। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৬ সালে প্রধান দুই দলের মহাসচিবরাও একমত হয়ে সংলাপে বসেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত নিষ্ফল হয়। এখন কি হবে সে প্রশ্নের উত্তর সহসা দেওয়া সম্ভব নয়।
তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক ধারার পরিবর্তনের চেষ্টা এ দেশের সুশাসনে বিশ্বাসী সব নাগরিকই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে করেছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়- বিশেষ করে প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিরা। যাঁরা এ দেশে কাজ করছেন। প্রয়োজনে ওই সব দেশের প্রভাবশালী নেতারাও এ চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বিদেশমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর এমনই একটি উদাহরণ। তাঁর একটি উক্তি হলো, দুই নেত্রীকেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ খুঁজে বের করতে হবে। এর অর্থ সুস্পষ্ট। কোনো নেত্রীই এককভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এ ধরনের চেষ্টা করাও গণতান্ত্রিক বিকাশের অন্তরায়। অথচ দুই দলই সব কার্যক্রম বা দলীয় সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের অজুহাতেই করছে বলে প্রতীয়মান হয়। অতীতে এবং এখনো এ ধারা দৃশ্যমান। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাজনীতি মানেই সংঘাতের রাজনীতি। মতবিরোধ আর সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি সমার্থক নয়।
সমঝোতার জন্য অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সঙ্গে অজ্ঞাতেও হয়তোবা কিছু আলোচনা চলছে, যা এখনো অজানা। কিন্তু এ বিষয়ে অগ্রগতি কি তা স্পষ্ট নয়। এখনো এ বিষয়টি জনগণের কাছে স্পষ্ট না হলেও সবাই সমঝোতার পক্ষে। অনেকেই হয়তো আশা করছে, অবশেষে সমঝোতা হবে। যদি না হয় তাহলে তাঁরা নিরাশ হবেন। অনানুষ্ঠানিক আলোচনা যখন শুরু হয়েছে তখন নিশ্চয়ই দুই দলই অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে পরিকল্পনাও শুরু করেছে। দুই দল প্রাথমিকভাবে যে রূপরেখা দিয়েছে, তা এখন পর্যন্ত কোনো দলই মেনে নেয়নি। অবশ্য এ রূপরেখা অনানুষ্ঠানিক আলোচনার আগেই দুই দল ঘোষণা করে। অনির্বাচিত বা অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে এর আগে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৯ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন অনেকে মনে করছেন যে এ ধরনের সরকার বাঞ্ছনীয় নয়।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আজ যে দল শত্রু কাল সে মিত্রও হতে পারে। আজ যে বিষয়টি না তা পরবর্তী সময় গ্রহণযোগ্য ও অতীতে যে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ছিল পরে তা অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো, ১৯৯৬ সালে সাংবিধানিকভাবে গৃহীত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যার সে অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। এ কারণে সমঝোতার জন্য কি বিষয়গুলো সিদ্ধান্তের জন্য জরুরি তার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রয়োজন উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ। পরিবেশ বর্তমানে সামান্য হলেও অশান্ত। দুই দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারাই স্বীকার করছেন যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হচ্ছে। বর্তমানে কিছুটা অশান্ত পরিবেশ আরো শান্ত করার জন্য দুই দলের নেতারাই যদি রাজনীতিসংক্রান্ত প্রকাশ্য বক্তব্যে সংযমী হন তা হলেই ভালো হয়। কারণ বক্তব্য ও পাল্টা বক্তব্যের ধারা অব্যাহত থাকলে পরিবেশ অশান্তই হবে।
সমঝোতা অর্জনের লক্ষ্যে কিছু সংবাদও ইতিমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। যা আশাব্যঞ্জক। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে বিভিন্ন দূতাবাসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ছাড়াও সম্প্রতি কোনো এক জেলার বার কাউন্সিল নির্বাচনের প্রাক্কালে দুই দলের নেতারা সৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। নিরাশাব্যঞ্জক বিষয়টি হলো, পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়ার প্রবণতা এখনো দৃশ্যমান। ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক সংবাদ অনুযায়ী প্রধান বিরোধী দলের কিছু নেতা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরেও কিছু মতবিরোধ দৃশ্যমান। একজন মন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বিদেশমন্ত্রীর কথায় বাংলাদেশ পরিচালিত হবে না। অন্যদিকে আরেকজন মন্ত্রী বলেছেন, ওই সহকারী বিদেশমন্ত্রীর বাক্যই হবে সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। এর ফলে কোনো দল সমঝোতার বিষয়ে কতটুকু আন্তরিক তা স্পষ্ট নয়।
সবশেষে বলা যায়, প্রধান বিরোধী দলের ১২ মার্চের কর্মসূচির কারণে জনগণের মনে যথেষ্ট উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। চলমান রাজনৈতিক ধারায় একটি ঘটনা বা কর্মসূচি অন্য একটি ইস্যু বা মতভেদের কারণ হয়। অতএব, একে অপরকে তীক্ষ্ন বাক্যবাণে জর্জরিত না করে শিগগিরই দুই দলের নূ্যনতম সমঝোতায় পৌঁছানো ভালো হবে। এরপর আনুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের পথ খুঁজে বের করা সহজসাধ্য হবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.