রাজনীতি-রাষ্ট্রপতিদের সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা বাঞ্ছনীয় by আবদুল মান্নান

বাংলাদেশে এখনো যে কজন পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন, তার একদম সামনের কাতারে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। জাতির জনকের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন আর তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত আসনে বসিয়েছেন।


তাঁর এই নিয়োগ ছিল সর্বমহলে প্রশংসিত, সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। শেখ হাসিনাকে দেখেছি, অনেক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে যত না রাষ্ট্রপতি হিসেবে সম্মান করেন, তার চেয়ে বেশি পিতৃতুল্য জ্ঞান করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২১ আগস্টের নির্মম গ্রেনেড হামলায় তাঁর প্রিয় সহধর্মিণীকে হারিয়েছেন।
এমন একজন রাষ্ট্রপতির কর্মকাণ্ড কিনা চতুর্দিকে সমালোচিত হচ্ছে খুনের দায়ে দণ্ডিত লক্ষ্মীপুরের একজন বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করার কারণে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির এককভাবে তেমন ক্ষমতা নেই। তিনি যা কিছু সিদ্ধান্ত দেন, তা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়ে আসা সুপারিশ অনুযায়ী। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর আবার সুপারিশ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে। আবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে বলতে হয়, অনেকে সুপারিশ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় কী, সে কথা বিবেচনায় রেখে। কিছু বিষয় আছে, যেখানে সাংবিধানিক বা আইনগত দিক জড়িত। সে ক্ষেত্রে যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সুপারিশ পাঠান, তাঁদের খেয়াল রাখা উচিত, এমন কোনো সুপারিশ যেন তাঁর কাছে না যায়, যা আইন বা নৈতিকতার প্রশ্নে দুর্বল। প্রধানমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীদের পক্ষে সব ফাইল পড়ে তারপর সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব নয়। যাঁরা গোড়া থেকে সুপারিশ বা মন্তব্য করেন, তাঁরা যদি সতর্ক না হন অথবা তাঁদের কোনো অস ৎ উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে সহজে তাঁরা মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীকে বেকায়দায় ফেলতে পারেন অথবা বিতর্কিত করতে পারেন। সার্বিক অবস্থায় বিপ্লবের সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে যা হয়েছে—এটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে—এখানেও তেমন একটা কিছু ঘটেছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি যা করেছেন, তা আইনসিদ্ধ এবং সাংবিধানিক ক্ষমতাবলেই করেছেন। তবে তিনি ইচ্ছা করলে পুরো বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য ফেরত পাঠাতে পারতেন। সেটি তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব এখতিয়ার। কেন তিনি তাঁর সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি, সেই কৈফিয়তও আমরা চাইতে পারি না।
স্বাধীনতার পর থেকে সম্ভবত বঙ্গবন্ধু ছাড়া সব রাষ্ট্রপতিই সাংবিধানিক ক্ষমতা বা সামরিক ফরমানবলে অনেক সাজাপ্রাপ্ত আসামির সাজা মওকুফ করেছেন। এই মুহূর্তে যার কথা সবার আগে মনে পড়ে, তিনি হচ্ছেন বর্তমানে জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতজন ছাত্রকে পাশের সূর্যসেন হল থেকে তুলে এনে মুহসীন হলে ব্রাশফায়ার করে খুন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ২৫ মার্চের কালরাত্রি ছাড়া এটি ছিল এ পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা। খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয় ছাত্রলীগের ত ৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানকে। বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এই কারাদণ্ড কোনো সামরিক আদালতে নয়, সাধারণ বিচারিক আদালতেই হয়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলতে পারবেন না যে এটি ক্যাঙারু কোর্টের বিচার। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে নিজের দল ভারী করার জন্য শফিউল আলম প্রধানের সাজা মওকুফ করে তাঁকে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। বর্তমানে তিনি জাগপা সভাপতি এবং খালেদা জিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক মিত্র। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্য হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তাঁদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনীতিকের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃতও করেছিলেন।
১৯৮৬ সালে গাজীপুরে আওয়ামী লীগের নেতা ময়েজ উদ্দিন প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন। সেই খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত হন আজম খান। পরে জেনারেল এরশাদ আজম খানকে শুধু ক্ষমাই করেননি, তাঁকে একই মঞ্চে নিয়ে সভা-সমাবেশও করেছেন। তখন ব্যারিস্টার মওদুদ তাঁর আইনমন্ত্রী। মহিউদ্দিন আহম্মদ জিন্টু নামের একজন জোড়া খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলে মামলায় ফাঁসির হুকুম হয়। সঙ্গে আরও তিনজন। জিন্টু পালিয়ে সুইডেন চলে যান। জিন্টু ও তাঁর দোসরদের যখন সাজা হয়, তখন এরশাদ ক্ষমতায়। সঙ্গে ব্যারিস্টার মওদুদ। মওদুদ আবার বেশি দিন ক্ষমতার বাইরে থাকেত অনভ্যস্ত। এরশাদের পতন হলে ব্যারিস্টার মওদুদ সময়মতো বিএনপিতে যোগ দেন এবং পরে আইনমন্ত্রী হন। ২০০৩ সালে সুইডেনে গিয়ে জিন্টুর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। ফিরে এসে গোপনে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের মাধ্যমে জিন্টুর মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করিয়ে নেন। বিপ্লবের বিষয় নিয়ে বর্তমানে বিএনপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম বেশ সোচ্চার। প্রচারমাধ্যম সোচ্চার হওয়ার কারণ, বলা হয়, স্বাধীন প্রচারমাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু এ ব্যাপারে বিএনপির কথা বলার কতটুকু নৈতিক অবস্থান আছে তা ভেবে দেখতে হবে।
আওয়ামী লীগ বিপ্লব বা তাহেরদের কর্মকাণ্ডের কারণে অতীতে অনেকবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। তার পরও দলে তাঁদের কদর কেন কমে না, তা বোধগম্য নয়। অনেক আগে আমি একবার লিখেছিলাম, আওয়ামী লীগ কখনো কখনো তাদের শক্তির উ ৎস যে জনগণ, তা ভুলে যায় এবং সে কারণেই তারা তাহের বা বিপ্লবদের ওপর অযথা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনে। বিপ্লবের সাজা মওকুফের পর নুরুল ইসলামের পরিবার সরকার ও রাষ্ট্রপতির কাছে বেশ কিছু প্রশ্ন রেখেছে। এর কি কোনো উত্তর আছে? আগামী নির্বাচনে লক্ষ্মীপুরের জনগণ যদি আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তাদের কি দোষ দেওয়া যাবে? ফেনীর জয়নাল হাজারী বা নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে কোথায় থাকবেন? বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একটি অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করেছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণে। সেই আওয়ামী লীগকে কেন নির্বাচনের আড়াই বছর আগে গলায় গামছা পরতে হচ্ছে? কেন ধরনা দিতে হচ্ছে রাজনীতির নতুন গণক ঠাকুর ওয়ান ম্যান পার্টি কর্নেল (অব.) অলি আহমদের কাছে? এমন প্রশ্ন তো আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষীরা করতেই পারেন।
রাষ্ট্রপতির আসনটা কোনো পদ নয়। এটি একটি প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউশন। সেই ইনস্টিটিউশনটা প্রথমে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছিলেন বা করতে বাধ্য হয়েছিলেন আমাদের পেশারই একজন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। সে কারণে আমরা যারা সেই পেশার মানুষ, তারা সবাই কমবেশি লজ্জিত হয়েছিলাম। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে দেশের জনগণ একজন দেবতুল্য মানুষ বলে মনে করে। তিনিও রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেননি। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। বরখাস্ত হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইনগত সব পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। ওই ব্যক্তিদ্বয় চ্যান্সেলর তথা রাষ্ট্রপতি বরাবর তাঁদের দণ্ড মওকুফের জন্য আবেদন করেন। প্রায় সাত বছর পর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কোনো কিছু জানতে না চেয়েই তাঁদের শুধু দণ্ডই মওকুফ করেননি, বকেয়া সব বেতন-ভাতা দিয়ে আগের কর্মস্থলে যোগদানের সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং মন্তব্য করেন, তাঁদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নাকি চরম অবিচার করেছে।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বঙ্গভবন থেকে বিতাড়িত রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে সরাসরি পদোন্নতি দিয়ে অধ্যাপক করে দিয়েছিলেন। ওই শিক্ষক ইতিপূর্বে দুবার পদোন্নতির আবেদন করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচকমণ্ডলী তাঁর নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকার কারণে দুবারই আবেদন বাতিল করে দেয়। নির্বাচন কমিটিতে চ্যান্সেলরের পাঁচজন প্রতিনিধি থাকেন। আইন অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক কোনো ব্যাপারে সংক্ষুব্ধ হলে তিনি চ্যান্সেলরের কাছে আবেদন করতে পারেন। এ ঘটনা খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে, ১৯৯৪ সালের। বদরুদ্দোজা ২০০২ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর পূর্বসূরির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কিছু জানতে না চেয়ে তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে ওই শিক্ষককে সরাসরি অধ্যাপক বানিয়ে দেন। এটি হয়তো আইনসিদ্ধ হয়েছে, তবে কতটুক নৈতিক হয়েছে, সে প্রশ্ন তো করা যেতেই পারে।
কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সবার বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক। রাষ্ট্রপতির পদটি এর অন্যতম। আমাদের সংবিধান মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে খুব বেশি ক্ষমতা দেয়নি ঠিক, তবে যেটুকু দিয়েছে, তা ব্যবহারের সময় যত্নবান এবং সতর্ক হতে তাঁকে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, দপ্তর বা মন্ত্রণালয় সঠিকভাবে পরামর্শ না দেয়, তাহলে তিনি অযথা বিতর্কিত হবেন।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি চেকআপের জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমরা তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.