বজলুর রহমান : মৃত্যুঞ্জয়ী সাংবাদিক by জোবাইদা নাসরীন
মৃত্যুও কারও কারও জীবনের কাছে পরাজিত হয়। কারণ কারও জীবন মৃত্যুকে ছাড়িয়েও দীপ্যমান থাকে, উজ্জ্বল থাকে। সেই ধরনের জীবনের এক মানুষ ছিলেন সাংবাদিক বজলুর রহমান। তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা, সাধারণ জীবনযাপন সবার জন্য প্রেরণা। সহকর্মীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তিনি অর্জন করেছিলেন।
দেশবাসীর কাছে প্রশংসিত হতেন নীতি-আদর্শে অবিচল থাকার কারণে। তাই তো তার মৃত্যু শুধু তার শারীরিক অনুপস্থিতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি আছেন, থাকবেন তার ভালোবাসার উত্তরাধিকারদের কাছে। সাংবাদিকতা তার কেবল পেশা নয়, নেশাও ছিল। শিশুদের সংগঠিত করেছেন। সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে রেখেছেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
জীবনকে ভালোবেসেছেন। জীবন নিংড়ানো সেই ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন অনেকেই। তাকে ভালোবাসার মানুষ ছিল অনেক। যে ঈর্ষণীয় জীবন তিনি ধারণ করেছেন এবং সেই জীবনের চেতনা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধিত সাহসের সেই মানুষ সাংবাদিক বজলুর রহমান। ৬৭ বছরের জীবনে চিরকালই নিজেকে সমর্পিত করেছেন প্রাচুর্যবিহীন জীবনযাপনের কাছে। কিন্তু কর্মে, যুক্তিতে, চিন্তায়, মেধায় ও ঋজুতার সঞ্চয়ে যে জীবন তিনি তৈরি করেছিলেন, তার পাশে দাঁড়ানোর শক্তি খুব কম মানুষেরই আছে। বেঁচে থাকা অবস্থায় জাগতিক মোহকে তুচ্ছ করা এই মানুষটি ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতের প্রহরে, এক হৃদয় ঝাপটানো আকস্মিকতায় সবাইকে কাঁদিয়ে, কাঁপিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে তার সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
তার জীবনের প্রতিটি বাঁকই দারুণভাবে কীর্তিময় এবং আদর্শে উজ্জ্বল। জীবনের সব রস আহরণ করতে চেয়েছিলেন। ছিলেন অত্যন্ত জীবনবাদী মানুষ। তাই তো সময়ের দাবিতে নিজের বোধের তীব্র উপলব্ধিতে নিজেকে বারবার হাজির করেছেন রাজপথে, মিছিলে। ভীষণভাবে চিনেছেন, গড়েছেন নিজের সত্তাকে এবং সেটির মধ্যে ছিল না বাড়তি দেখানো প্রলেপ। আপাদমস্তক নিজেকে তৈরি করেছেন যুক্তির সোপানে, মুক্তির সাম্পানে। নিজেকে জড়িয়েছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে। ষাটের দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে পুরোটা সময়ই নিজেকে সামনের সারিতে রেখেছেন। আশির দশক থেকেই শারীরিকভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার বক্তব্য, বিশেল্গষণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যে ক'জন সাংবাদিক নিজের অবস্থান সমুন্নত রেখে গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা রেখেছিল, তিনি তাদের একজন।
ষাটের দশক থেকে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে তার সখ্য। সেই সখ্যকে ধরে রেখেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর নিজে হয়ে উঠেছিলেন সৃজনশীলতার এক তারকা। এখনকার যুগে সব মানুষই খ্যাতি, অর্থ ও ক্ষমতা চায়। কিন্তু তিনি ছিলেন সেখানেও অনড়। 'সংবাদ' ছেড়ে কোথাও যাননি। দীর্ঘদিন ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক। 'দর্শক' শিরোনামে দেশের বিভিন্ন হালহকিকত নিয়ে কলম লিখেছেন দীর্ঘদিন। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। 'সিক্রেসি অ্যাক্ট' বাতিল করার জন্য তার কলম ছিল অত্যন্ত ধারালো। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, 'সংবাদ যদি হয় এই দেশের সাংবাদিক তৈরির পাঠশালা, অবশ্যই সাংবাদিক বজলুর রহমান সেই পাঠশালার প্রধান। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিকের বেশিরভাগই তার হাতে তৈরি। এদেশের নারী সাংবাদিকদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকও তিনি ছিলেন। সংবাদ পত্রিকাতেই নারীরা প্রথম রাতের শিফটে কাজ শুরু করে।
সাংবাদিক বজলুর রহমান এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তার সম্পাদনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বের হতো 'মুক্তিযুদ্ধ' পত্রিকা। সেখানে থাকত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ খবর, যা অনুপ্রাণিত করত স্বাধীনতাকামী মানুষদের। ১৯৭০ সালের জুলাই থেকে তিনি সম্পাদনা করতেন কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা সাপ্তাহিক 'একতা'।
শিশু সংগঠন গড়ে তোলা মোটেও সহজ বিষয় নয়। কিন্তু তিনি সেই দুঃসাধ্য কাজটি করেছেন। শিশু সংগঠন খেলাঘর তার হাতেই সবচেয়ে বেশি প্রাণ পেয়েছে। 'ভাইয়া' সম্বোধনে অধিক পরিচিত বজলুর রহমান চেয়েছেন শিশুদের দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে তুলতে।
তিনি আছেন, তিনি থাকবেন এই বাংলাদেশের মানুষদের মাঝে। আপনজনদের ভালোবাসায়, এদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে।
জোবাইদা নাসরীন : সহকারী অধ্যাপক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
zobaidanasreen@gmail.com
জীবনকে ভালোবেসেছেন। জীবন নিংড়ানো সেই ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন অনেকেই। তাকে ভালোবাসার মানুষ ছিল অনেক। যে ঈর্ষণীয় জীবন তিনি ধারণ করেছেন এবং সেই জীবনের চেতনা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধিত সাহসের সেই মানুষ সাংবাদিক বজলুর রহমান। ৬৭ বছরের জীবনে চিরকালই নিজেকে সমর্পিত করেছেন প্রাচুর্যবিহীন জীবনযাপনের কাছে। কিন্তু কর্মে, যুক্তিতে, চিন্তায়, মেধায় ও ঋজুতার সঞ্চয়ে যে জীবন তিনি তৈরি করেছিলেন, তার পাশে দাঁড়ানোর শক্তি খুব কম মানুষেরই আছে। বেঁচে থাকা অবস্থায় জাগতিক মোহকে তুচ্ছ করা এই মানুষটি ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতের প্রহরে, এক হৃদয় ঝাপটানো আকস্মিকতায় সবাইকে কাঁদিয়ে, কাঁপিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে তার সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
তার জীবনের প্রতিটি বাঁকই দারুণভাবে কীর্তিময় এবং আদর্শে উজ্জ্বল। জীবনের সব রস আহরণ করতে চেয়েছিলেন। ছিলেন অত্যন্ত জীবনবাদী মানুষ। তাই তো সময়ের দাবিতে নিজের বোধের তীব্র উপলব্ধিতে নিজেকে বারবার হাজির করেছেন রাজপথে, মিছিলে। ভীষণভাবে চিনেছেন, গড়েছেন নিজের সত্তাকে এবং সেটির মধ্যে ছিল না বাড়তি দেখানো প্রলেপ। আপাদমস্তক নিজেকে তৈরি করেছেন যুক্তির সোপানে, মুক্তির সাম্পানে। নিজেকে জড়িয়েছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে। ষাটের দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে পুরোটা সময়ই নিজেকে সামনের সারিতে রেখেছেন। আশির দশক থেকেই শারীরিকভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার বক্তব্য, বিশেল্গষণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যে ক'জন সাংবাদিক নিজের অবস্থান সমুন্নত রেখে গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা রেখেছিল, তিনি তাদের একজন।
ষাটের দশক থেকে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে তার সখ্য। সেই সখ্যকে ধরে রেখেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর নিজে হয়ে উঠেছিলেন সৃজনশীলতার এক তারকা। এখনকার যুগে সব মানুষই খ্যাতি, অর্থ ও ক্ষমতা চায়। কিন্তু তিনি ছিলেন সেখানেও অনড়। 'সংবাদ' ছেড়ে কোথাও যাননি। দীর্ঘদিন ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক। 'দর্শক' শিরোনামে দেশের বিভিন্ন হালহকিকত নিয়ে কলম লিখেছেন দীর্ঘদিন। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। 'সিক্রেসি অ্যাক্ট' বাতিল করার জন্য তার কলম ছিল অত্যন্ত ধারালো। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, 'সংবাদ যদি হয় এই দেশের সাংবাদিক তৈরির পাঠশালা, অবশ্যই সাংবাদিক বজলুর রহমান সেই পাঠশালার প্রধান। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিকের বেশিরভাগই তার হাতে তৈরি। এদেশের নারী সাংবাদিকদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকও তিনি ছিলেন। সংবাদ পত্রিকাতেই নারীরা প্রথম রাতের শিফটে কাজ শুরু করে।
সাংবাদিক বজলুর রহমান এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তার সম্পাদনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বের হতো 'মুক্তিযুদ্ধ' পত্রিকা। সেখানে থাকত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ খবর, যা অনুপ্রাণিত করত স্বাধীনতাকামী মানুষদের। ১৯৭০ সালের জুলাই থেকে তিনি সম্পাদনা করতেন কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা সাপ্তাহিক 'একতা'।
শিশু সংগঠন গড়ে তোলা মোটেও সহজ বিষয় নয়। কিন্তু তিনি সেই দুঃসাধ্য কাজটি করেছেন। শিশু সংগঠন খেলাঘর তার হাতেই সবচেয়ে বেশি প্রাণ পেয়েছে। 'ভাইয়া' সম্বোধনে অধিক পরিচিত বজলুর রহমান চেয়েছেন শিশুদের দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে তুলতে।
তিনি আছেন, তিনি থাকবেন এই বাংলাদেশের মানুষদের মাঝে। আপনজনদের ভালোবাসায়, এদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে।
জোবাইদা নাসরীন : সহকারী অধ্যাপক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
zobaidanasreen@gmail.com
No comments