ভারত-মৌজ মাস্তি ম্যাজিক by অমিত বসু

গোটা জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিকাঠামোগত, ভাষা-সংস্কৃতিগত বিকাশের দাবি, প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা ন্যায়সঙ্গত এবং গণতান্ত্রিক। কিন্তু বিমল গুরুংয়ের আন্দোলন গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করেনি। জাতিগত ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেন।


কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনকে রাজনৈতিক মঞ্চে জায়গা দিতে রাজি নন তিনি



কাককে কাকাতুয়া করতে পারেন ম্যাজিসিয়ান। মানুষের শরীর দুই টুকরো করে জোড়া লাগানোও তার কাছে জলভাত। অদ্ভুত কেরামতিতে তাজমহল হাওয়া করে দেওয়াও অসম্ভব নয়। এসব ডাহা মিথ্যা জেনেও দর্শক এনজয় করেন। ম্যাজিকের মজা যারা নিতে পারেন না, তারা দুর্ভাগা। কিন্তু কোথাও রাজনীতিক, জাদুকর হতে চাইলে বিপদ। শ্বাপদসংকুল অরণ্যের ভয়ঙ্করতা। ম্যাজিক দেখাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মুখের কথা, চোখের চাহনি, হাতের ইশারায় দার্জিলিং সমস্যা ভ্যানিশ। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতা বিমল গুরুং খুশি। পাহাড়ে খুশির পরব। পর্যটকরা নির্বিঘ্নে ডানা মেলছেন ম্যান, টাইগার হিল, জনপাহাড়ে।
দারিদ্র্যে দ্রবীভূত পাহাড়ি মানুষগুলো মাথা তুলে বসছে, ক্ষতি নেই, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। করতালির ধাক্কায় ধস শৈলশহরে। সবাই একবাক্যে বলছেন, মমতা ম্যাজিকের জবাব নেই। গুরুংয়ের হাড়ে বাতাস লেগেছে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। পশ্চিমবঙ্গের মাথায় মুকুট, দার্জিলিংটা খুলে দিয়ে গোর্খাল্যান্ড করবেন। অধীশ্বর হবেন তিনি। সুভাষ ঘিসিং এই স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটা মাটি ছোঁয়নি। কী করে ছোঁবে? মমতা ম্যাজিকের টাচটা মিস করেছেন।
ম্যাজিক ফুরোতেই সম্বিত ফিরেছে। মিথ্যার প্রাচীর খসে বেরিয়ে এসেছে সত্যিটা। ঘুম ভেঙে গুরুংয়ের চিৎকার, ফিরিয়ে দাও আমার স্বপ্নকে। বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করাও ইচ্ছাগুলোকে। নইলে ছাড়ব না। আগুন জ্বালাব দার্জিলিংয়ে। তিব্বতি অর্থে দার্জিলিং বজ্রের দেশ। 'দোর্জে' মানে বজ্র, 'লিং' হচ্ছে স্থান। আবার যদি বজ্রপাত শুরু হয় তখন।
ম্যাজিক দেখানোর দিনটা ছিল ২০১১-এর ১৮ জুলাই। শিলিগুড়ির কাছে পিনটেল গ্রামে। মমতার পাশে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম আর গুরুং। স্বাক্ষরিত হয় ম্যাজিক চুক্তি। স্বাক্ষর করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের জয়েন্ট সেক্রেটারি কে কে পাঠক, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব জ্ঞান দত্ত গৌতম, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি। চুক্তির বিষয়বস্তু কিন্তু জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। গোপনীয়তা রহস্য বাড়ায়। ২ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় পাস হয় গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা 'জিটিএ' বিল। তারপরই বিষয়টি কিছুটা প্রকাশ্যে আসে। ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয় মোর্চা নেতাদের কথায়। তারা জানান, পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের রাস্তায় জিটিএ একটি পদক্ষেপ। তারা তরাই, ডুয়ার্সের একটা অংশ জিটিএর আওতায় আনার দাবি জানান। সেই দাবির ভিত্তিতে একটি কমিটি গঠিত হয়। এর বাস্তবতা পরখ করে তাদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা। কাজটা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। বিবাদের সূত্রপাত এখানেই। জিটিএতে তরাই, ডুয়ার্স ঢুকবে কেন?
১৯৮৮ সালের ২২ আগস্ট কলকাতার রাজভবনে কেন্দ্র, রাজ্য সরকার আর গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের মধ্যে চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল গোর্খা পার্বত্য পরিষদ। তার আওতায় ছিল চারটি সাব ডিভিশন_ দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং, মিরিক। ১৯৯২তে সংবিধান সংশোধন করে নেপালি ভাষাকে অষ্টম তফসিলের তালিকায় তোলা হয়। ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে দার্জিলিং ঈপ্সিত মর্যাদায় উন্নয়নের রাস্তায় দৌড়ানোর সুযোগ পায়। কিন্তু ঘিসিং ছুটতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। রাজ্য সরকার অর্থবৃষ্টি শুরু করলেও বিকাশ বন্ধ থাকে। সাফল্য দূরের কথা, অগ্রগতির জায়গায় অধোগতি। নিচে পড়ে থাকা মানুষগুলোকে টেনে তোলা যায়নি, বরং তারা আরও তলিয়ে যেতে থাকে। মাথার ওপর ছাদ এবং তাদের গ্রাসাচ্ছাদনের গ্যারান্টি ঘিসিং দিতে পারেননি। ব্যর্থতা ঢাকতে গোর্খাল্যান্ডের দাবিটাকে ফের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। কাজ হয়নি তাতে। ফল হয় উল্টো। ক্রমে তিনি মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তার হাতে গড়া শিষ্য বিমল গুরুং ঘিসিংয়ের রাজনৈতিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা গড়ে ময়দানে নামেন। প্রথমটায় রাজ্য সরকারের সঙ্গে আপসের রাজনীতিতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করলেও পরে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন তিনি। তাকে সাহস জোগায় বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, অস্থিরতা তৈরি করা। যাতে রাজ্য সরকার কোনো সমস্যার সমাধান করতে না পারে।
২০০৫-এ ষষ্ঠ তফসিলের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী স্বশাসিত পরিষদ গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের টালবাহানায় সেটি কার্যকর হয়নি। এই না হওয়াটাই টার্নিং পয়েন্ট। দীর্ঘদিন নির্ধারিত স্বশাসিত পরিষদ না থাকায় গণতান্ত্রিক ধারা রুদ্ধ হয়। সেই সুযোগে পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনের আগুন জ্বালেন গুরুং।
গোটা জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিকাঠামোগত, ভাষা-সংস্কৃতিগত বিকাশের দাবি, প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা ন্যায়সঙ্গত এবং গণতান্ত্রিক। কিন্তু বিমল গুরুংয়ের আন্দোলন গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করেনি। জাতিগত ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেন। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনকে রাজনৈতিক মঞ্চে জায়গা দিতে রাজি নন তিনি। পৌরসভার নির্বাচনে প্রায় সব আসনে মোর্চা প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিরোধী শক্তিকে মুছে ফেলার কাজে তারা অনেকটাই সফল। গুরুংয়ের সাফল্যে উত্তরবঙ্গে কেএলও, কামতাপুরী, গ্রেটার কোচবিহারের দাবি নতুন মাত্রা পাচ্ছে।
জিটিএতে অন্য দলের জায়গা হবে কি-না সন্দেহ। এর আইন তৈরির ক্ষমতা না থাকলেও প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়বে। ৫০ সদস্যের মধ্যে ৪৫ জন নির্বাচিত হবেন। বাকি পাঁচজন মনোনীত সদস্য হিসেবে জায়গা পাবেন। গোর্খা পার্বত্য পরিষদের থেকে বেশি ক্ষমতা থাকবে জিটিএর হাতে। কিন্তু এর ব্যবহার কেমন হবে সে নিয়ে হাজারো প্রশ্ন।
জিটিএতে গোর্খাল্যান্ড শব্দটা রয়েছে। সেটা অবশ্যই গুরুংয়ের নতুন রাজ্য গড়ারই স্বপ্ন দেখাবে। তিনি আগেই বলে রেখেছেন, জিটিএ পৃথক রাজ্য গঠনের প্রথম পদক্ষেপ। সেই কারণে ডুয়ার্স-তরাইয়ের একটা বড় অংশ দখলে রাখতে চাইছেন। দার্জিলিং দখলের ইতিহাস ১৭৮০তে নেপাল-সিকিম যুদ্ধ দার্জিলিং নিয়ে। দশ বছরেও এর মীমাংসা হয়নি। তেঁতুলিয়া চুক্তিতে সাময়িক শান্তি এলেও বিরোধের আগুন নেভেনি। ১৮৩৫-এর ১ ফেব্রুয়ারি সিকিমরাজ দার্জিলিংকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ১৮৩৯-এ চিকিৎসক ক্যাম্পবেল আর লেফটেন্যান্ট নেপিয়ারের উদ্যমে গড়ে ওঠে দার্জিলিং উপাসনালয়। তার রূপের আকর্ষণে আশপাশের মানুষ ছুটে যায় সেখানে। চাষাবাদ বাড়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১০০ গুণ। এখন লোক ১৭ লাখ। সূর্য কঞ্জুস, তাদের ঘরে ঢুকতে নারাজ। উত্তরবঙ্গ উৎসবের মধ্যেও তারা বিবরে। রাজনীতির জটিল আবর্তে নাস্তানাবুদ। দিলি্ল-কলকাতা তাদের নিয়ে খেলছে। দুরূহ অবসাদে একমাত্র স্বস্তি মমতা-ম্যাজিক। বিষণ্ন চোখের সামনে সত্যি-মিথ্যের গোলকধাঁধা।

অমিত বসু : ভারতীয় সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.