যুক্তি তর্ক গল্প-ইন্দিরাকে সম্মাননা ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক by আবুল মোমেন

ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানোর মাধ্যমে একটি জাতীয় কর্তব্য পালন করা হলো। যেকোনো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তি ও জাতি উপকারীর উপকার স্বীকার করে, নানাভাবে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটায়। বাংলাদেশের মানুষ যে সত্যিই বীরের জাতি, মর্যাদাবোধসম্পন্ন জাতি, সে কথা অনেক বিলম্বে হলেও প্রকাশ পেল এবারে।


এই সময়ে মনে পড়ছে ১৯৮৪ সালে দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসনের জগদ্দলের নিচে থেকে একটি শোকসভার আয়োজন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার অস্বীকৃত এবং সর্বত্র একটা অনিশ্চয়তার ছাপ। সেদিন চট্টগ্রামের প্রয়াত সাহসী সাংবাদিক মোহাম্মদ শরীফ রাজা এই আয়োজনের আহ্বায়ক হতে এবং শোকসভায় সভাপতিত্ব করতে রাজি হয়েছিলেন। বেশ মনে পড়ছে, যথেষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আমাদের ওই সভা আয়োজন করতে হয়েছিল।
১৯৭১ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের সহযোগিতা—মুক্তিযুদ্ধে এবং শরণার্থীদের আশ্রয়দানে—না পেলে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীনতা অর্জন এবং বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো না। মুক্তিযুদ্ধে অনেকের সহযোগিতা আমরা পেয়েছি, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবু সবার মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা ছিল স্বতন্ত্র, বস্তুত সবার ঊর্ধ্বে। তা ছাড়া পঁচাত্তর-পরবর্তী দুঃসময়ে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানাকে তিনি কেবল আশ্রয় দেননি, প্রয়োজনীয় অভিভাবকত্বও দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি প্রদান একটি প্রশ্নাতীত বিষয়।
তাই বলে ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনে সমালোচনার কিছু নেই, ব্যাপারটা এমন নয়। আমরা লক্ষ করি, শ্রীমতী গান্ধীর আমলে গণতান্ত্রিক ভারতে সরকার ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল, তিনি নিজে দলে প্রায় একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অতীতে সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য অনুযায়ী ভারতে প্রধানমন্ত্রী ও শাসক দলের প্রধান স্বতন্ত্র দুই ব্যক্তি হতেন। নেহরুর মতো প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রীর আমলেও ব্যবস্থাটা এমনই ছিল। লালবাহাদুর শাস্ত্রী, বলাই বাহুল্য, সেই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুও সেই রীতি অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয় দফা নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতীয় কংগ্রেসের দীর্ঘ ঐতিহ্য ভঙ্গ করে নিজেই দল ও সরকারপ্রধান হলেন এবং সরকারের তথা মন্ত্রিসভার মধ্যে তিনি একক ও পরম ক্ষমতাধর সুপার মন্ত্রী হয়ে গেলেন। এতে ভারতের মতো বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রেও একধরনের অনুদার ও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাই চালু হলো। তবে জরুরি অবস্থা জারি আর ‘গরিবি হটাও’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনুসৃত জবরদস্তির খেসারত দিয়ে তাঁকে পরবর্তী নির্বাচনে ভরাডুবির সম্মুখীন হতে হয়।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা ও নেহরু পরিবারের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকে রাজনীতি ও ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেও তাঁকে শেষ পর্যন্ত জনতার রায়ে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছিল। তবে ঝানু রাজনীতিক ইন্দিরা পুনরায় ক্ষমতায় ফিরেও এসেছিলেন, আবার উগ্রপন্থী রাজনীতির জিঘাংসার বলিও হতে হলো তাঁকে।
যা হোক, জন্মের সূত্র ধরে বাংলাদেশের অনেক ঋণ ভারত ও ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। সেই ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হয়েছে তাঁকে মরণোত্তর সম্মাননা জানানোর মাধ্যমে। এই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে চূড়ান্ত সময়ে বাংলাদেশের মাটিতে যে প্রায় ১২ হাজার ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্মরণে ও সম্মানে দেশের কোথাও একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রসঙ্গও তোলা যায়। এটিও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন একটি জাতির ঋণস্বীকার ও ঋণ শোধের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এই ঋণ স্বীকার ও ঋণ শোধের অর্থ এ নয় যে সরকার বা যাঁরা এটা চাইছেন, তাঁরা ভারতের কাছে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে চান, ভারতের প্রতি নতজানু নীতি অনুসরণে আগ্রহী। না, বিষয়টি একেবারেই তা নয়। যেহেতু ভারত ও বাংলাদেশ দুটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র, তাই এখানে সহযোগিতার স্বীকৃতি যেমন পৃথকভাবে দিতে হবে, তেমনি আবার স্বার্থের বিঘ্ন ঘটলে তা-ও জোরালোভাবে জানাতে হবে। আমরা জানি, বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে পাকিস্তানের কাছ থেকে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য লাভ করেছে। ইদানীং এর ধার ও ব্যাপ্তি কিছুটা কমলেও এখনো বেশ কার্যকর আছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান করে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী দেশ ভারতের কাছের দল হিসেবেই আওয়ামী লীগ চিহ্নিত হয়েছে। তা ছাড়া দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ তার বিরোধী শক্তির কাছে ভারতপন্থী দল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় ভারতীয় বিমান পরিহার করেছেন, মাত্র তিন মাসের মধ্যে বিজয়ী মিত্রবাহিনীর বড় শরিক ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছিলেন, সীমান্ত ও ছিটমহল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিও করেছিলেন। বিপরীতে জিয়ার আমলেই প্রাইভেটাইজেশন ও মুক্ত বাজারের কল্যাণে ভারতীয় পণ্যে বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে যায় এবং প্রথমবারের মতো ভারতীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি দেশে আসতে থাকে। এই ধারা জিয়ার পরে এরশাদের আমলেও অব্যাহত ছিল। এভাবে শিল্প-কারখানার খুচরা যন্ত্রাংশ, যানবাহন এবং ভোগ্যপণ্যসহ বাংলাদেশের বাজারে ভারতের একতরফা প্রাধান্য বিস্তৃত হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানের রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে সংশয় ও সন্দেহের টানাপোড়েন অব্যাহত রাখায় বাংলাদেশের অনুকূলে সুবিধা আদায়ের জন্য কার্যকর উদ্যোগ তারা নিতে পারেনি। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বা ঠেকিয়েই ক্ষমতাসীন ছিল। ফলে তাদের রাজনীতি আওয়ামী লীগের বিপরীত ধারায় চলেছে—একদিকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও ভারত-বিরোধিতা এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে ইসলাম-বিরোধী ও ভারতপন্থী দল হিসেবে প্রচারণা চালানোই ছিল তাদের রাজনীতির প্রধান বিষয়। উগ্র ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও ভারত-বিরোধিতার রাজনীতির কারণে স্বভাবতই এসব আমলে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিকও ছিল না, সুস্থও ছিল না।
আমরা জানি, বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর সম্পর্ক বরাবর কঠিন ও উত্থানপতনময় হয়ে থাকে। ভারতের সঙ্গে অধিকাংশ প্রতিবেশীর সম্পর্কেই টানাপোড়েন এর প্রকট দৃষ্টান্ত। কিন্তু তা কারও জন্যই ভালো হচ্ছে না। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি দিকও বিবেচনায় থাকা দরকার বলে মনে করি। যেকোনো জাতির বিকাশের প্রশ্নে তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ধারা ও অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন জাতীয় বিকাশের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যদি সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাবাহিকতা না থাকে, তাহলে জাতির মানস ও ভাবজগৎ নানা বিভ্রান্তি, বিতর্ক ও টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকবে, সেই জাতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনের সম্ভাবনাগুলোও ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হলো, সেই পাকিস্তান আমল থেকে ভারতবিরোধী মনোভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার প্রত্যাখ্যান করে মুসলিম সংস্কৃতির উৎসস্থল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের প্রবণতা লালন করা। জনগণের একটি বড় অংশের এই বিভ্রান্তির ফলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে এবং এর প্রভাবে আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ, বিভ্রান্ত ও বিবদমান জাতি কোনোভাবেই এগোতে পারে না।
একটি কথা এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার। সব জাতিই তার আঞ্চলিক ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতির আবহেই বিকশিত হয় বটে, তবে উন্নত জাতি তার সভ্যতার পরিচয়টাও লালন করে। যদি আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নাটক, নৃত্য, চারুকলা ইত্যাদি নিয়ে চুলচেরা গবেষণা করি, যদি এসব ক্ষেত্রে শিকড় সন্ধান করি, যদি নতুন পথের সন্ধানে নামি, তাহলে কিন্তু যে উৎসে গিয়ে পৌঁছাব তার নাম ভারতীয় সভ্যতা। মনে রাখতে হবে, এ সভ্যতায় হিন্দু-বৌদ্ধের যেমন অবদান আছে, তেমনি মুসলিম অবদানও বিপুল। সভ্যতার একই ঠিকানা থাকার অর্থ এ নয় যে দেশের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ন হবে। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো একই সভ্যতার অন্তর্গত, কিন্তু ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন প্রভৃতি যে কেবল পৃথক দেশ তা নয়, তারা নিজেদের মধ্যে বহু যুদ্ধবিগ্রহ করেছে, এমনকি শত বছরের যুদ্ধের কথাও আমরা জানি। বৃহত্তর তুর্কি-পারস্য সভ্যতার বিশাল অঞ্চলও কত দেশেই না বিভক্ত, কিন্তু তারা সবাই শাহনামা নিয়ে যেমন গর্ব করে, তেমনি হাফিজ-রুমী নিয়েও গর্বিত হয়। তাই বলব, সভ্যতা নিয়ে বিভ্রান্তি ও হীনম্মন্যতা না কাটলে আমাদের পক্ষে সামনে এগোনো হবে রীতিমতো কঠিন। সভ্যতা দীর্ঘ সময় নিয়ে মানুষের মানসসম্পদ ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে বিকশিত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আর রাষ্ট্র সাধারণত বস্তুগত নানা বিবেচনা, পক্ষপাত ও প্রয়োজন থেকে সৃষ্ট হয়। রাষ্ট্রের ভাঙাগড়া, সীমানা পরিবর্তন অল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার ঘটতে পারে। ইউরোপের মানচিত্রে গত কুড়ি বছরে রাষ্ট্রসীমানায় কত ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে দেখেছি আমরা। যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানিও দেখেছি, কিন্তু তাই বলে তাদের সভ্যতার ঠিকানা বদল হয়নি। ভারত-রাষ্ট্রও রাষ্ট্র হিসেবে বর্তমান অবস্থায়ই থাকবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে যাবে তা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার ও সভ্যতার ঠিকানা, দেশপ্রেম ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যে গুলিয়ে ফেললে ঠিক হবে না। যেকোনো রকম উগ্র ও ক্ষুদ্র ধারণা বা ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে সাময়িক উত্তেজনা, স্বল্পদর্শী বিবেচনা, অন্ধ জাত্যভিমানের আবর্তে ঘুরপাক খেলে জাতি হিসেবে বিকশিত ও সফল হওয়া কঠিন হবে বলেই মনে করি।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.