গন্তব্য ঢাকা-স্বপ্ন দেখতেও ভয় হয় by শর্মিলা সিনড্রেলা
ছোট্ট একটি দোকানের এদিক-সেদিক সাজানো টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে। দামি কিছু নয়, কম দামি জিনিসগুলো দিয়েই পরিপাটি সাজানো দোকানটি। এই যেমন সেফটিপিন, চাবির রিং, কিছু সস্তা টিপ, চিরুনি বা চুলে দেওয়ার কালো ক্লিপ। পথ চলতে চলতে হঠাৎ চোখ পড়ে বিক্রেতার হাতের দিকে। হাতের আঙুলগুলো কেমন যেন ক্ষতবিক্ষত।
জানার আগ্রহ নিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াই। প্রশ্ন করি, এ রকম কেন হলো হাত দুটো? জবাব দিলেন, ‘ছোটবেলায় অসুখে পড়েছিলাম। কুষ্ঠরোগ ধরেছিল আমাকে। সেই রোগে শুধু এই হাতই না, পায়ের আঙুলও নষ্ট হয়ে গেছে। মা-বাবা অনেক চিকিৎসা করিয়েছে, কিন্তু এগুলো বাঁচাতে পারেনি। অনেক দিন ভুগেছি, তারপর আজ ১৫-১৬ বছর হলো ভালো আছি।’
লোকটির নাম মোহাম্মদ ইদ্রিস। তাঁর জীবনের গল্প, তাঁর গ্রামের গল্প শোনার আগ্রহ নিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াই। প্রশ্ন করি ধাপে ধাপে, কোথায় থাকেন? জবাব দেন, ‘এখানেই।’ চমকে তাকাই। এখানেই মানে? এই দোকানেই? এত ছোট্ট দোকানটায় যে ঠিকমতো হাত-পা ছড়িয়ে বসাও সম্ভব নয়। সেখানেই ঘুম! কীভাবে সম্ভব? বলেন, ‘তা ছাড়া আর কী করব? থাকার তো আর জায়গা নাই। তা ছাড়া দোকান ফেলে রেখে গেলে তো ঢাকা শহরে যেকোনো সময় চুরি হয়ে যাবে।’
গল্প করতে করতে জানতে থাকি তাঁর জীবনের গল্প। ‘চিটাগাংয়ের আগ্রাবাদ চৌমুহনীতে আমাদের বাড়ি। তখন গ্রামে আমার এসব জিনিসেরই বেশ বড় একটা দোকান ছিল। বেশ ভালোই যাচ্ছিল আমার জীবন। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক বন্ধু এসে বলল, “চল, ঢাকায়। বেশ ভালো কাজ পাবি।” ভাবলাম, বেশ তো, এর থেকে যদি ভালো থাকা যায়, তবে যাই না ঢাকায়। কিন্তু আসার পর সেই বন্ধু আমাকে লাগাল ভিক্ষার কাজে। অনেক খারাপ লেগেছিল। কিন্তু গ্রামের সব ব্যবসার পাট তখন চুকিয়ে এসেছি। তাই কী করব আর গ্রামে যেয়ে? বিবেকে কুলাত না ভিক্ষা করতে। কিন্তু কিছু করারও তো ছিল না। ভিক্ষায় আয় হয় বেশি। এই দোকানে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলে না। আমার মতো গরিবেরাই কেবল আমার কাছ থেকে কিনে। তবু ভিক্ষা করব না বলে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি। এই বছরের জানুয়ারি থেকে এই দোকানটা চালু করেছি।’
হাইকোর্ট ও কার্জন হলের মাঝামাঝি রাস্তায় দিনের প্রায় সময়ই কাটান তিনি। আর যাবেনই বা কোথায়? মাঝেমধ্যে হয়তো ঢাকা মেডিকেলের গেটে দাঁড়ান পসরা সাজিয়ে। বলেন, ‘গ্রামে যাই এক বছর পর পর। কখনো বা দুই বছরে একবার যাই। গ্রামে স্ত্রী আছে। খুব খুশি হয় আমি বাড়ি গেলে। পানি, খাবার-দাবার সবই হাতের কাছে এগিয়ে দেয়। খাবার-দাবার তৈরি করে। বাজারসদাই আনে, নিজের কাছে রাখা টাকা থেকে আমার জন্য কাপড়চোপড়ও কিনে। ওর নাম কালনী বেগম। তবে শুধু আমি ওকে কাজল বলে ডাকি।’ ছেলেমেয়ে আর প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে দু-চার দিন থাকার পরই আবার ঢাকায় ফিরে আসেন মোহাম্মদ ইদ্রিস।
এত দিন ঢাকায় থাকেন, গ্রামে ফিরতে মন কেমন করে না? গ্রামের স্মৃতি মনে পড়ে না? ‘না, এখন আর তেমন খারাপ লাগে না। যখন ভিক্ষা করতাম, তখন তো ঈদেও বাড়ি যেতাম না। ঈদেও তো ওই কাজ করতে হতো।
‘এবার ঈদের দিন বোধ হয় বাড়িতে থাকতে পারব। তবে গ্রামের অনেক কিছুই মনে পড়ে। এই যেমন, আমাদের বাড়ি থেকে পাহাড় দেখা যায়। আর সমুদ্রও কাছে। আগে বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনেক সময় পাহাড়ে, সমুদ্রের ধারে আবার কখনো রেলস্টেশনে চলে যেতাম। তারপর গল্পগুজার করে আড্ডা দিয়ে রাতে বাড়ি ফিরতাম। কোনো দিন বা ফিরতামই না। এখনো ওদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, তবে আর আগের মতো তেমনভাবে সময় কাটানো হয় না।’
আরও যোগ করেন তিনি, ‘আমরা চার ভাই। বাবার যেটুকু জমি ছিল, সেখানে চারটা বাড়ি করা হয়েছে। চাষের জমি আর নেই। চুরি ছাড়া অনেক কাজই আমি করেছি। এখন একটু সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। আর এভাবে দোকানটা নিয়ে চলতে চলতে একেবারে আজিমপুরে যেতে পারলেই হলো।’
মোহাম্মদ ইদ্রিসের কাছ থেকে জানতে পারি, তিনি কেবল সবুজ পাঠের কয়েকটি পাতা পড়েছেন। তার পরও তাঁর কথাগুলো বেশ গোছানো। তাঁর ছেলেটা পড়াশোনা ছেড়ে কাজ করছে। মেয়েটাকে পড়াতে চান তিনি।
কিন্তু অভাবের জীবনে সেই স্বপ্ন বুনতেও বোধ হয় ভয় হয় তাঁর। বলেন, ‘আল্লায় যে কী করবে, কে জানে?’
শর্মিলা সিনড্রেলা
লোকটির নাম মোহাম্মদ ইদ্রিস। তাঁর জীবনের গল্প, তাঁর গ্রামের গল্প শোনার আগ্রহ নিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াই। প্রশ্ন করি ধাপে ধাপে, কোথায় থাকেন? জবাব দেন, ‘এখানেই।’ চমকে তাকাই। এখানেই মানে? এই দোকানেই? এত ছোট্ট দোকানটায় যে ঠিকমতো হাত-পা ছড়িয়ে বসাও সম্ভব নয়। সেখানেই ঘুম! কীভাবে সম্ভব? বলেন, ‘তা ছাড়া আর কী করব? থাকার তো আর জায়গা নাই। তা ছাড়া দোকান ফেলে রেখে গেলে তো ঢাকা শহরে যেকোনো সময় চুরি হয়ে যাবে।’
গল্প করতে করতে জানতে থাকি তাঁর জীবনের গল্প। ‘চিটাগাংয়ের আগ্রাবাদ চৌমুহনীতে আমাদের বাড়ি। তখন গ্রামে আমার এসব জিনিসেরই বেশ বড় একটা দোকান ছিল। বেশ ভালোই যাচ্ছিল আমার জীবন। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক বন্ধু এসে বলল, “চল, ঢাকায়। বেশ ভালো কাজ পাবি।” ভাবলাম, বেশ তো, এর থেকে যদি ভালো থাকা যায়, তবে যাই না ঢাকায়। কিন্তু আসার পর সেই বন্ধু আমাকে লাগাল ভিক্ষার কাজে। অনেক খারাপ লেগেছিল। কিন্তু গ্রামের সব ব্যবসার পাট তখন চুকিয়ে এসেছি। তাই কী করব আর গ্রামে যেয়ে? বিবেকে কুলাত না ভিক্ষা করতে। কিন্তু কিছু করারও তো ছিল না। ভিক্ষায় আয় হয় বেশি। এই দোকানে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলে না। আমার মতো গরিবেরাই কেবল আমার কাছ থেকে কিনে। তবু ভিক্ষা করব না বলে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি। এই বছরের জানুয়ারি থেকে এই দোকানটা চালু করেছি।’
হাইকোর্ট ও কার্জন হলের মাঝামাঝি রাস্তায় দিনের প্রায় সময়ই কাটান তিনি। আর যাবেনই বা কোথায়? মাঝেমধ্যে হয়তো ঢাকা মেডিকেলের গেটে দাঁড়ান পসরা সাজিয়ে। বলেন, ‘গ্রামে যাই এক বছর পর পর। কখনো বা দুই বছরে একবার যাই। গ্রামে স্ত্রী আছে। খুব খুশি হয় আমি বাড়ি গেলে। পানি, খাবার-দাবার সবই হাতের কাছে এগিয়ে দেয়। খাবার-দাবার তৈরি করে। বাজারসদাই আনে, নিজের কাছে রাখা টাকা থেকে আমার জন্য কাপড়চোপড়ও কিনে। ওর নাম কালনী বেগম। তবে শুধু আমি ওকে কাজল বলে ডাকি।’ ছেলেমেয়ে আর প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে দু-চার দিন থাকার পরই আবার ঢাকায় ফিরে আসেন মোহাম্মদ ইদ্রিস।
এত দিন ঢাকায় থাকেন, গ্রামে ফিরতে মন কেমন করে না? গ্রামের স্মৃতি মনে পড়ে না? ‘না, এখন আর তেমন খারাপ লাগে না। যখন ভিক্ষা করতাম, তখন তো ঈদেও বাড়ি যেতাম না। ঈদেও তো ওই কাজ করতে হতো।
‘এবার ঈদের দিন বোধ হয় বাড়িতে থাকতে পারব। তবে গ্রামের অনেক কিছুই মনে পড়ে। এই যেমন, আমাদের বাড়ি থেকে পাহাড় দেখা যায়। আর সমুদ্রও কাছে। আগে বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনেক সময় পাহাড়ে, সমুদ্রের ধারে আবার কখনো রেলস্টেশনে চলে যেতাম। তারপর গল্পগুজার করে আড্ডা দিয়ে রাতে বাড়ি ফিরতাম। কোনো দিন বা ফিরতামই না। এখনো ওদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, তবে আর আগের মতো তেমনভাবে সময় কাটানো হয় না।’
আরও যোগ করেন তিনি, ‘আমরা চার ভাই। বাবার যেটুকু জমি ছিল, সেখানে চারটা বাড়ি করা হয়েছে। চাষের জমি আর নেই। চুরি ছাড়া অনেক কাজই আমি করেছি। এখন একটু সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। আর এভাবে দোকানটা নিয়ে চলতে চলতে একেবারে আজিমপুরে যেতে পারলেই হলো।’
মোহাম্মদ ইদ্রিসের কাছ থেকে জানতে পারি, তিনি কেবল সবুজ পাঠের কয়েকটি পাতা পড়েছেন। তার পরও তাঁর কথাগুলো বেশ গোছানো। তাঁর ছেলেটা পড়াশোনা ছেড়ে কাজ করছে। মেয়েটাকে পড়াতে চান তিনি।
কিন্তু অভাবের জীবনে সেই স্বপ্ন বুনতেও বোধ হয় ভয় হয় তাঁর। বলেন, ‘আল্লায় যে কী করবে, কে জানে?’
শর্মিলা সিনড্রেলা
No comments