স্মরণ-প্রদীপের পেছনের স্বজন by জোবাইদা নাসরীন

বর্তমান যে সময়টা চলছে, সেটি অস্থিরতার, তুমুল প্রতিযোগিতার, একে-ওকে ধাক্কা মেরে সামনে এগিয়ে যাওয়া আর ব্যাপক মিডিয়ামুখিতার। পদ-পদবি আর ক্ষমতার কাঙালপনা দেখতে দেখতে ক্লান্ত থাকা আমাদের চোখ, মন সবকিছুই যেন অবসাদগ্রস্ত হতে থাকে। কিন্তু কোনো কোনো মানুষের জীবন আমাদের সত্যিই টানে।


তাঁরা চলতি জীবনের এই ঢঙের সঙ্গে নিজেদের জড়াতে চান না। খ্যাতি, লোভ, অমরত্ব, জাগতিক চাওয়া-পাওয়া কিছুই যেন তাঁদের জীবনকে স্পর্শ করে না। তাঁরা অন্যের সাফল্যে ঈর্ষায় নিজেকে আক্রান্ত করেন না কিংবা নিজের আভিজাত্যের দম্ভে অন্যকে এড়িয়ে চলার চিন্তা করেন না। চেনাজানা জীবনের বাইরে জীবনধারণের এই ঈর্ষনীয় বোধের অধিকারী মানুষ খুব কমই আছেন এই পৃথিবীতে। যুগে যুগে প্রখর ঋজুতা আর ব্যক্তিত্বের ওপর ভর করেই কিছু মানুষ এগিয়েছেন, সব সময় প্রচারমুখিতার বিপরীতে আড়ালে থাকতে চেয়েছেন এবং চাননি চলতি বাজারে প্রতিযোগী হতে, তাঁদেরই একজন সাংবাদিক বজলুর রহমান। চিরকাল খ্যাতি আর অমরত্বের প্রতি নির্লোভ এই মানুষটি ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ছিন্ন করেন পৃথিবীর সঙ্গে ভালোবাসার সব লেনদেন।
নিজে পেছনে থাকতে চাইলেও অন্যদের এগিয়ে যাওয়ার প্রতি হাত বাড়িয়েছেন সবচেয়ে বেশি। নিজে সব সময় প্রদীপটি ধরে রেখেছেন, যেন অন্যরা সেই আলোতে পথ চিনে নিতে পারেন। কথা বলতেন একেবারেই কম। শুনতেন বেশি। এমন লোক এখন সমাজে বিরল। সবাই শুধু কথা বলতে চায়, নিজেকে নানা ভঙ্গিমায় জানাতে চায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তাঁর অবস্থান সবার বিপরীতে। কথা বলতেন নিচুস্বরে, অত্যন্ত ধীরলয়ে। কিন্তু অবাক বিষয়, সবাই যেন তাঁকে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। জীবনাচরণের মতোই ছিল তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের ভঙ্গিটিও। অন্যের ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে অন্যের মত গুরুত্ব দিয়ে শোনা এবং সেটির প্রতি সম্মান দেখানোতে তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। আদর্শিকভাবে খুব স্পষ্ট থাকলেও মননের ঔদার্যতায় অন্য কাউকে অশ্রদ্ধা করেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সবাই যে সাংবাদিক ছিলেন কিংবা তাঁর বয়সী—এমন নয়; রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, লেখক, সাহিত্যিক কিংবা শিক্ষার্থী, বয়স-পেশায় রুচি কিংবা জানাশোনার পরিধিতে হয়তো সবাই আলাদা, কিন্তু সবাই একত্র হওয়ার মূল কারণ তিনি। সেই আড্ডায় একটা বিষয় স্পষ্ট হতো সবার কাছে তা হলো, তিনি সবার মতোই কিন্তু কোথায় যেন আলাদা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সেরা ছাত্রদের একজন বজলুর রহমান ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে নিজের জীবনকে বেঁধে ছিলেন। মিছিলের সঙ্গী হয়ে পাড়ি দিয়েছেন ষাটের দশকের সেই অগ্নিঝরা উত্তাল দিনগুলো। #সেই বয়সকে সেই সময়ের সঙ্গে একাত্ম করে প্রতিবাদের সেই ঝড়েই যেন দেখেছিলেন জীবনের সব বোঝাপড়া। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন কলমসৈনিক এবং রাজপথের মানুষ। ১৯৬৩ সালে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের বৈঠকের নেপথ্যেও তাঁর ভূমিকা ছিল। তিনি মনে মনে বিশ্বাস করতেন, জাতীয়তাবাদী ও বাম রাজনীতির মিলিত ধারাই পাকিস্তানি শাসকদের সব চক্রান্ত নস্যাৎ করতে পারবে। পরবর্তী সময়ে ছয় দফার প্রতি ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ষাটের এই পুরো দশকেই তিনি যুক্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং আফ্রো-এশীয় গণসংহতি আন্দোলনের সঙ্গে। তারপর এলো সেই অবিস্মরণীয় মুক্তিযুদ্ধ। এ যেন এক আন্দোলনময় জীবনেরই ধারাবাহিকতা। তাই সেখানেও লড়াইয়ের স্পষ্ট ছাপ। মুক্তিযুদ্ধের কঠিন বাস্তবতায়ও বের করেছেন মুক্তিযুদ্ধ নামক পত্রিকাটি। মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনের খবর, পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের খবর বহন করা সেই পত্রিকাটি সে সময় বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিকামী মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি ছিলেন আপসহীন সংগ্রামী মানুষ।
সেই সঙ্গে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই লোভনীয় সব চাকরি করেছেন, করছেন জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন। কিন্তু তিনি সেসব আহ্বান মাড়িয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকেছেন একই কর্মস্থলে। এটি এই সময়ে নিঃসন্দেহে বিরল। ভালোবেসেছেন পেশাকে, তাকে জীবনের অংশ মনে করেছেন। ৪৭ বছর একই পেশায়, একই প্রতিষ্ঠানে কাটিয়েছেন। ১৯৭০-এর জুলাই মাস থেকে তাঁর সম্পাদনায় বের হতো কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা সাপ্তাহিক একতা। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ ছিল।
রাজনৈতিক এবং সাংবাদিকতার বাইরেও তিনি ছিলেন একজন ভালো সংগঠক। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের সংগঠন ‘খেলাঘর’ এর ছোট ছোট শিশুদের কাছে তিনি ছিলেন ‘ভাইয়া’। সেই ‘ভাইয়া’ ডাকটি তাঁর জন্য চিরস্থায়ী হয়েছে ৫০ বছর ধরেই। সেই ৫০ বছর আগে যাঁরা খেলাঘর করতেন, তাঁদের কাছে তিনি যেমন আছেন ‘ভাইয়া’ হিসেবে এবং এখন যে শিশুটি খেলাঘর করে সেও তাঁকে ‘ভাইয়া’ হিসেবেই চিনে। এটিই আসলে অমরত্ব, যে অমরত্বের সুধা তিনি স্বেচ্ছায় পান করতে চাননি।
সদা ফিটফাট থাকা এই মানুষটির ভেতর একটি কোমল-হূদয় কাছের লোকজনকে আবিষ্ট করত সব সময়। ঘনিষ্ঠ লোকদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, বাসায় পিঠা-পুলি তৈরি হলে তাঁদের ঢেকে খাওয়ানো এগুলোর মধ্যে তিনি আনন্দ পেতেন। সংবাদ অফিসে তাঁর কক্ষটিতে সব সময় খুবই নিম্নস্বরে বাজত সেতার কিংবা তবলার সুর। প্রকৃতির প্রতি, সুরের প্রতি তাঁর একটা পক্ষপাতিত্ব ছিল। আর পক্ষপাত ছিল মানুষের ব্যক্তিক স্বাধীনতায়। ঘোষণা দিয়ে কিংবা সবাইকে জানান দিয়ে নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন তা নয়, কিন্তু জীবনযাপনে, বিশ্বাসে তিনি ছিলেন নারী স্বাধীনতার একজন পুরোধামানুষ।
জৌলুসের বাইরে গিয়ে মাত্র ৮০০ স্কোয়ার ফিটের বাসায় নিজের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাপনকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই জীবনের ছন্দ হারিয়ে গেছে চার বছর আগের এই দিনে। জীবন যাঁর এত ঈর্ষনীয়, সে জীবনের দীপ্তি তো সহজে নেভবার নয়। তাই আজও অনেকের মতো আমিও খুঁজে বেড়াই আমার এই স্বজনকে।
 জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.