সিরিয়া-আসাদ সরকার টিকে থাকছে কিসের জোরে? by বাছমা কোদমানি
সিরিয়ার সর্বস্তরের মানুষই উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, তারা প্রত্যেকে এই সরকারের অসৎ অভিপ্রায়ের শিকার। সুনি্ন নেতাদেরই এখন এই আন্দোলন যাতে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সংঘাতে রূপ না নেয় তার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
এ জন্য তাদের সংখ্যালঘুদের আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় প্রতিশোধের শিকার হতে হবে না মর্মে আশ্বাস প্রদান করতে হবে
সিরিয়ায় চার মাস ধরে চলা গণবিক্ষোভ এবং গত রোববার হামা শহরের কেন্দ্রস্থলে রক্তক্ষয়ী দমনাভিযানসহ বিক্ষোভকারীদের ওপর অব্যাহতভাবে বর্বর নির্যাতন চালানোর পরও দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ক্ষমতা থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন এবং তিনি সরকারে সংস্কার সাধনে সক্ষম বলে দাবি করছেন। তার পিতা হাফেজ আল আসাদের গড়ে তোলা বিশাল নিরাপত্তা বাহিনীই এখন তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার প্রধান অস্ত্র এবং এই বাহিনী প্রধানত তারই শিয়া ক্ষুদ্র আলওয়াইট গোত্র থেকে এসেছে।
সিরিয়ার জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মাত্র আলওয়াইট সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা মনে করছে, আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা গণহত্যার শিকার হবে। সে কারণেই তারা সর্বতোভাবে আসাদ সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাই সিরিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিজয়লাভ করতে হলে এই আলওয়াইট সম্প্রদায়ের ভয় দূর করতে হবে। এই আন্দোলন জয়ী হলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না মর্মে প্রত্যয় সৃষ্টি করতে হবে। অনেক পর্যবেক্ষক এটা অনেকটা অসম্ভব বলে মনে করেন। তাদের ধারণাটা ঠিক নয়। গত মার্চ থেকে সেখানে এ পর্যন্ত ১৫শ'র মতো লোক নিহত হওয়ার পরিসংখ্যানটি আলওয়াইট গোত্রের নেতাদের চোখ এড়িয়ে যায়নি নিশ্চয়। তারা বুঝতে পেরে থাকবেন যে, সরকারের ক্ষমতা দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হলে শক্তিশালী আলওয়াইট নেতারা আসাদ পরিবারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন তুলে নেওয়া শুরু করতে পারেন এবং তারা প্রকাশ্যে না হলেও বিরোধী আন্দোলনকে নীরব সমর্থন জোগাতে পারেন। বিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি শক্তিশালী আলওয়াইট সামরিক কমান্ডারদের সরকার পক্ষ ত্যাগে উৎসাহিত করতে পারে এবং তাদের অধস্তন সেনা কর্মকর্তাদের তারা সঙ্গী হিসেবে নিতে পারেন।
১৯৭০ সালে হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতায় আসার পর থেকে আলওয়াইটরা সিরিয়ার প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। কিন্তু ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসার পর কখনোই বাশার আল আসাদ তার পিতার মতো নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। তার পরিবর্তে বাশার তার সরকারের একটা ভদ্র ও মানবিক ইমেজ সৃষ্টি করতে চেষ্টা চালান এবং তিনি সুনি্নদের মধ্যে তার ভিত্তি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। সিরিয়ার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হলো সুনি্ন।
সেই মধ্য মার্চে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠার পর থেকে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের সামান্য সম্ভাবনাও দূর করার জন্য অনেক অনুগত সুনি্ন সৈনিকসহ সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিককে সরিয়ে দেন তিনি। মাহেরের নেতৃত্বাধীন একান্ত অনুগত আলওয়াইট সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে গঠিত বিখ্যাত চতুর্থ ডিভিশন বিক্ষোভকারীদের দমনাভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দেখা যায়, কোনো বাহিনীর কমান্ডে সুনি্ন জেনারেল থেকে থাকলেও বাহিনীর প্রকৃত ক্ষমতা তার একজন আলওয়াইট ডেপুটির করায়ত্ত থাকে। এই কাঠামোর কারণে সেনাবাহিনীর ওপর যেমন সহিংস দমনাভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে পুরোপুরি নির্ভর করা হয় না তেমনি তারা সামগ্রিকভাবে বিদ্রোহ করতেও সক্ষম নয়। এখানে মৃত্যুদণ্ডের ভয়ের কারণে অসুখী সৈনিকরা সরকারের বিরুদ্ধে নীরবে কাজ করে। বিরোধীদলীয় নেতারা বলেছেন, কখনও কখনও সহানুভূতিশীল সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা হামলার আগাম সংবাদ তাদের দিয়েছেন। তবে মিসরে, তিউনিসিয়ায় যেমনটা ঘটেছে, সেই একইভাবে সিরিয়ার শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তাদের সম্মিলিতভাবে সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিরোধী শক্তিগুলোকে মিসর ও তিউনিসিয়ার পরিস্থিতির মতো একই পরিস্থিতি এখানেও ঘটবে এমনটা আশা করাটা ঠিক হবে না।
সেনাবাহিনী নয়, সামগ্রিকভাবে আলওয়াইট সম্প্রদায়ের হাতেই রয়েছে পরিবর্তনের মূল চাবি। কিন্তু আসাদের ওপর থেকে তারা যাতে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় সে জন্য বিরোধীদের পক্ষ থেকে তাদের আশ্বস্ত করা দরকার। আসাদ-পরবর্তী যুগে আলওয়াইটদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা থাকবে, এমন একটা প্রতিশ্রুতি লাভের জন্য এই সম্প্রদায়ের নেতা ও ধর্মীয় গুরুরা মুসলিম ব্রাদারহুডসহ সুনি্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে গত মাসে একটি সমঝোতায় পেঁৗছাতে চেষ্টা করেছেন। আলওয়াইট সম্প্রদায় যাতে সামগ্রিকভাবে এই বিদ্রোহে শামিল হতে পারে সে জন্য বিরোধী পক্ষকে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত। আলওয়াইট এবং খ্রিস্টান, দ্রুস ও শিয়াসহ অন্য সংখ্যালঘুরা যারা আসাদ সরকারকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে টিকিয়ে রাখছে, তাদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দায়িত্বটা সংখ্যাগুরু সুনি্ন সম্প্রদায়ের ওপরই বর্তায়। সুনি্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতারাই সিরিয়াকে সম্প্রদায়গত হানাহানি থেকে রক্ষা করতে পারেন।
এই স্পর্শকাতর প্রক্রিয়া কেবল সিরীয়রা নিজেরা শুরু করতে পারে। আরব বা পশ্চিমাদের জন্য এতে ভূমিকা রাখার সুযোগটা সীমিত। বিদেশি হস্তক্ষেপের আশঙ্কাটা সিরীয়দের মজ্জাগত। আর এটা আসাদ সরকার আবিষ্কার করেনি, তবে মানুষের এই মনস্তত্ত্বকে সফলভাবে তারা কাজে লাগিয়েছেন। সিরিয়ায় যেই বিদেশি হস্তক্ষেপের পক্ষে সাফাই গাইতে চাইবে তাকেই বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। তাই বিদেশি যে কোনো সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি বিরোধীদের পরিবর্তে সরকারকেই শক্তি-সমর্থন জোগাবে। বাইরের শক্তিগুলো নিজেরা কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না এই ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে বিরোধী আন্দোলনকে সহায়তা করতে পারে। বিক্ষোভকে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের আলামত বলে আসাদ যে প্রচারণা চালাচ্ছেন, এই ঘোষণা তাকে দুর্বল করবে। এতে গরিষ্ঠ জনমনের অহেতুক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে যাব।
সিরিয়ার সর্বস্তরের মানুষই উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, তারা প্রত্যেকে এই সরকারের অসৎ অভিপ্রায়ের শিকার। সুনি্ন নেতাদেরই এখন এই আন্দোলন যাতে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সংঘাতে রূপ না নেয় তার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। এ জন্য তাদের সংখ্যালঘুদের আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় প্রতিশোধের শিকার হতে হবে না মর্মে আশ্বাস প্রদান করতে হবে। এতে আলওয়াইটরা বিরোধী আন্দোলনে শামিল হতে পারে এবং এভাবে আসাদ সরকারেরও অবসান ঘটতে পারে।
বাছমা কোদমানি : আরব রিফর্ম ইনিশিয়েটিভের পরিচালক। নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
No comments