বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-মাইলিন ক্লাশের কাছে খোলা চিঠি by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
মাইলিন, আপনি একজন ব্রিটিশ জননী। আপনার পুরো নাম মাইলিন ক্লাশ। 'সেভ দ্য চিলড্রেন' সংস্থাটির দূত আপনি। আপনার অন্য সামাজিক পরিচিতিও রয়েছে। আপনি একজন বিশিষ্ট পপসংগীতশিল্পী, পিয়ানিস্ট ও মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমা বিশ্বে এ প্রজন্মের সংগীতপ্রেমীদের কাছে আপনি ভীষণ সমাদৃত- তা আমরা অনেকেই জানি।
সম্প্রতি আপনি 'সেভ দ্য চিলড্রেন'-এর দূত হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সফর আপনার মধ্যে অনেক বেদনা ও কষ্টের দানা পুঁতে দিয়েছে। এই কষ্ট ও বেদনা আপনাকে কাঁদিয়েছেও অঝোরে। সে ছবি ছাপা হয়েছে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২, এ দেশের একটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়। মমতাময়ী মাইলিন আপনার প্রতি ফোঁটা অশ্রুকণা একটি বস্তিবাসী শিশু, যার নাম তিশা তার ললাট ভিজিয়েছে। মাইলিন, মমতাময়ী মা, আপনার অনুভূতি ও মমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আপনার কোলজুড়ে তিশা খানিক সময়ের জন্য হলেও মমতার ওম পেয়েছে তার ললাট আপনার অশ্রুতে ভিজে যাওয়ার পরও। মাইলিন, আপনার হয়তো জানা নেই, এমন পরিসংখ্যানহীন তিশা এ দেশের নগর-মহানগরের অভিজাত পাড়াগুলোর পাশেই খুপরি ঘরে কিংবা গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে বেড়ে উঠছে অবহেলা আর অনাদরে। দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশে অসংখ্য শিশুর যে করুণ উপাখ্যান রয়েছে, তিশা এর খণ্ডিত দৃষ্টান্ত মাত্র। আপনার এ কান্না তিশাদের ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের জন্য শেষ পর্যন্ত কতটা কল্যাণ বয়ে আনবে আমরা জানি না, তবে এটুকু তো বলতে পারি, এ দেশে তিশা, রহিমরা কখনো কখনো ক্ষণিকের জন্য হলেও এভাবেই ভাগ্যবতী কিংবা ভাগ্যবান হয়ে ওঠে। আপনার কাছে আমাদের ঋণ বেড়ে গেল। আপনার কান্না বিশ্ব-মিডিয়ার দৃষ্টি কেড়েছে। এর ফলে ভাগ্যবিড়ম্বিতদের জন্য কল্যাণকর কিছু হবে কি না তা বলা মুশকিল।
মাইলিন, আপনি ঢাকার কয়েকটি বস্তি ঘুরে হতদরিদ্রদের জীবনচিত্র দেখে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, 'বাংলাদেশে দরিদ্রতার মাত্রা বেদনাদায়ক।' কিন্তু আপনি যা প্রত্যক্ষ করেছেন এটি খণ্ডিত চিত্র মাত্র। আপনি শুনলে হয়তো বিস্ময়ে আঁতকে উঠবেন, বাংলাদেশের রাজধানী এই ঢাকায় প্রায় তিন লাখ টোকাই, যাদের পথশিশু হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়, তারা চরম মানবেতর জীবন যাপন করে। ওদের আসলে নেই কোনো আবাস। বস্তির খুপরি ঘরেও এদের স্থান নেই। ওরা পথেই ঘুমায়, পথেই খায়, পথেই কাজ করে- পথেই খেলে! কিন্তু ওরা পথে জন্ম নেয়নি। ঘরের এই শিশুরাই কোনো না কোনো কারণে বেরিয়ে পড়ে। মাইলিন, আপনি হয়তো এও জানেন না, ভাসমান মানুষের মধ্যে এরাই সবচেয়ে নির্যাতিত ও বঞ্চিত। আমাদের তথাকথিত ভাগ্যনিয়ন্ত্রকরা অতীতে ওদের নিয়ে নানা রকম মশকরা করেছেন, ওদের ভাগ্য বদলে দেওয়ার নামে তাদের মুখে কত উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। অনেকে আবার নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে, কখনো কখনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লোটার লক্ষ্যেও তাদের ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ নাকি ওদের ভাগ্যোন্নয়নে বিদেশে ওদের দেখিয়ে বরাদ্দটরাদ্দও এনেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদেরই উদরে তা পুরেছেন! মাইলিন, আর আপনি আমাদের এই উত্তর-প্রজন্মের জন্য, জীর্ণশীর্ণ, হাড্ডি ও অস্থিসার মানুষ নামের ভাগ্যবিড়ম্বিতদের কাউকে কাউকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছেন, এ তো ওদের পরম ভাগ্যই বলা চলে। মাইলিন, তিশার মায়ের কাছ থেকে ওদের বিপন্ন-বিপর্যস্ত জীবনের কাহিনী শুনে আপনি বলেছেন, 'এই শিশুদের বয়স আমার দুটি মেয়ে এভা ও হিরোর বয়সের সমান। আমি তাদের এক মুহূর্তের জন্যও রুমে একা রাখি না। কিন্তু মর্মন্তুদ ব্যাপার হচ্ছে, এদের একা রেখেই তাদের মা-বাবারা দীর্ঘ সময়ের জন্য বাইরে কাজে যান। ওদের পুষ্টিহীন জীর্ণশীর্ণ শরীর বড় বেশি আহত করে।' মাইলিন, কী করবে বলুন, জঠরজ্বালা তো মেটাতে হবে। মাইলিন, এ দেশে একদিকে যেমন কারো কারো সন্তানরা খাবার পা দিয়ে মাড়িয়ে যায়, অন্যদিকে তিশাদের মতো অসংখ্য শিশু একমুঠো ভাতের জন্য ওই খুপরি ঘরে গুমরায়। পুষ্টির বিষয়টি তো আরো পরের ব্যাপার মাইলিন। বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের যে চিত্রটি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা যেন পাহাড়ের চূড়া আর তলদেশের দৃষ্টান্তের সঙ্গেই শুধু মেলে। মাইলিন, আপনি বাংলাদেশের বস্তি ঘুরে যাওয়ার পর ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য সান-এ 'সি, পোভার্টি অ্যান্ড ডিসপেয়ার ইন দ্য স্লামস অব বাংলাদেশ' (দেখুন বাংলাদেশের বস্তিগুলোর দরিদ্রতা ও হতাশা) শিরোনামে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনটিতে ওই চিত্রটিই উপস্থাপিত হয়েছে। মাইলিন, আমাদের দেশে যাঁরা সরকারে থাকেন, তাঁদের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত থাকেন বিরোধী দলের তথাকথিত অথবা স্বার্থবাদী রাজনীতির ধারক-বাহকরা। এ চিত্র নতুন কিছু নয়। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাইলিন, আপনি যাদের দেখে এতটা ব্যথিত, আমাদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রকরা কিন্তু এর সামান্যতমও নন। বরং তাঁরা ওই ব্রিটিশ দৈনিকের প্রতিবেদনটিকে তাঁদের হীনস্বার্থবাদী রাজনীতির উপকরণ হিসেবে হয়তো কাজে লাগাবেন, দরিদ্র বস্তিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নে মনোনিবেশ না করে। মাইলিন, আমাদের দেশপ্রেমবোধ কতটা প্রখর, তা এ থেকেই আপনি খানিকটা অনুমান করে নিতে পারবেন নিশ্চয়ই।
মাইলিন, এ দেশে কত সহস্র মা ভয়াবহ পুষ্টিহীনতার শিকার, নানা রকম চরম প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতার তীরে বিদ্ধ, সে হিসাবও আপনাকে দেওয়া ভার। এই জীর্ণদেহী মায়েরা যে উত্তর-প্রজন্মের জন্ম দিচ্ছেন, তাঁরা কি পুষ্টিহীনতায় না ভুগে পারেন? আমাদের এই যে তিলোত্তমা ঢাকা, যাকে নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই, এখানে ৩০ শতাংশেরও বেশি মানুষ (অবশ্য মানুষ নয়, এই সমাজে তারা লোক হিসেবে পরিচিত) বস্তিতে বাস করে। তাদের দৈনিক গড় আয় শুনলে শিউরে উঠবেন। তিশাদের মা-বাবারা এরই গণ্ডিবদ্ধ। মাইলিন, আপনি তিশার মায়ের সামনে সাংবাদিকদের আরো জানিয়েছেন, 'আমি ওর সামনে কাঁদতে চাইনি। এতে সে মনে করতে পারে, আমি তাকে করুণা করছি। কিন্তু তাদের দুরবস্থা আমার সব বাঁধ ভেঙে দেয়। আমি এসব প্রত্যক্ষ করার পর নিজেকে আড়ালে রাখতে পারি না। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রচেষ্টায় অনেক শিশুর কল্যাণ হচ্ছে। আমি এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।' আপনার যে অনুভূতি, এই অনুভূতিটুকু যদি এ দেশের বিত্তবান মানুষের মধ্যে ৬০ শতাংশকেও তাড়া করত, নাড়া দিত- তাহলে অনেক তিশার জীবনচিত্র পাল্টে যেত। মাইলিন, আমরা একে অন্যের সমালোচনা করতে বড় বেশি অভ্যস্ত। আমরা পরনিন্দা, পরচর্চায় বড় বেশি পারঙ্গম। আমাদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রকদের অনেকেই জনকল্যাণের নামে বড় বেশি স্ববিরোধিতায় মত্ত। আপনি যে বস্তিগুলো ঘুরে অঝোরে কেঁদে আপনার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, একসময় দেখবেন তা আমাদের অপরাজনীতির বড় খোরাক হয়ে গেছে। সরকারকে ঘায়েলের বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। মাইলিন, আপনি তাতে লজ্জা পাবেন না, কষ্টও পাবেন না। এখানে মানবতা বিপন্ন। মাইলিন, অনেক স্বপ্ন, প্রতিজ্ঞা, অঙ্গীকার ব্যক্ত করে লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনে যে রক্তস্নাত বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে চার দশক আগে, এর চিত্র এত হতচ্ছাড়া হওয়ার কথা ছিল না। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ই ছিল। কিন্তু কেন এবং কাদের ব্যর্থতায় আজ এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে- এর জবাব সন্ধানে আপনাকে খুব বেগ পেতে হবে না। আপনি একটু পর্যবেক্ষণ করলেই সব পেয়ে যাবেন। আপনার মতো মানবদরদি যাঁরা এ দেশে আছেন, সংখ্যায় তাঁরা অনেক কম এবং তাঁদের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আর যাঁরা প্রকৃতই কিছু করতে পারেন তাঁদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ মুখোশধারী। এ লজ্জা আমাদের পীড়া দেয় না মাইলিন।
মাইলিন, যারা একদিন এ রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করেছে, মুক্তিকামী মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালিয়েছে কিংবা গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে, তারা স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র চার দশকের মধ্যে আবার রাষ্ট্রক্ষমতারও অংশীদার হয়েছে। বিলম্বে হলেও গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওই সব অপরাধীর বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বটে; কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষশক্তি বলে দাবিদার একটি মহল তাদের বাঁচাতে বড় বেশি তৎপর। তাদের ছায়াতলেই ওরা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। বলুন তো মাইলিন, এরপর এ দেশকে ঘিরে আপনি আপাতত আর কী আশা করতে পারেন? এমন নৈতিকতার ধস এবং স্ববিরোধিতা আপনি বিশ্বের কয়টি দেশে দেখেছেন? না- মাইলিন, তবুও আমরা আশাবাদী শুভবোধই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে। মাইলিন, আপনি আবার আসবেন, অবশ্যই আসবেন- তখন হয়তো সত্যিকারের সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা দেখতে পাবেন, যেখানে তিশারা আপনার সব কষ্ট-বেদনা ধুয়ে-মুছে নেবে তাদের উজ্জ্বল জীবনচিত্র দিয়ে। ভালো থাকুন মাইলিন, অশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
মাইলিন, আপনি ঢাকার কয়েকটি বস্তি ঘুরে হতদরিদ্রদের জীবনচিত্র দেখে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, 'বাংলাদেশে দরিদ্রতার মাত্রা বেদনাদায়ক।' কিন্তু আপনি যা প্রত্যক্ষ করেছেন এটি খণ্ডিত চিত্র মাত্র। আপনি শুনলে হয়তো বিস্ময়ে আঁতকে উঠবেন, বাংলাদেশের রাজধানী এই ঢাকায় প্রায় তিন লাখ টোকাই, যাদের পথশিশু হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়, তারা চরম মানবেতর জীবন যাপন করে। ওদের আসলে নেই কোনো আবাস। বস্তির খুপরি ঘরেও এদের স্থান নেই। ওরা পথেই ঘুমায়, পথেই খায়, পথেই কাজ করে- পথেই খেলে! কিন্তু ওরা পথে জন্ম নেয়নি। ঘরের এই শিশুরাই কোনো না কোনো কারণে বেরিয়ে পড়ে। মাইলিন, আপনি হয়তো এও জানেন না, ভাসমান মানুষের মধ্যে এরাই সবচেয়ে নির্যাতিত ও বঞ্চিত। আমাদের তথাকথিত ভাগ্যনিয়ন্ত্রকরা অতীতে ওদের নিয়ে নানা রকম মশকরা করেছেন, ওদের ভাগ্য বদলে দেওয়ার নামে তাদের মুখে কত উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। অনেকে আবার নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে, কখনো কখনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লোটার লক্ষ্যেও তাদের ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ নাকি ওদের ভাগ্যোন্নয়নে বিদেশে ওদের দেখিয়ে বরাদ্দটরাদ্দও এনেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদেরই উদরে তা পুরেছেন! মাইলিন, আর আপনি আমাদের এই উত্তর-প্রজন্মের জন্য, জীর্ণশীর্ণ, হাড্ডি ও অস্থিসার মানুষ নামের ভাগ্যবিড়ম্বিতদের কাউকে কাউকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছেন, এ তো ওদের পরম ভাগ্যই বলা চলে। মাইলিন, তিশার মায়ের কাছ থেকে ওদের বিপন্ন-বিপর্যস্ত জীবনের কাহিনী শুনে আপনি বলেছেন, 'এই শিশুদের বয়স আমার দুটি মেয়ে এভা ও হিরোর বয়সের সমান। আমি তাদের এক মুহূর্তের জন্যও রুমে একা রাখি না। কিন্তু মর্মন্তুদ ব্যাপার হচ্ছে, এদের একা রেখেই তাদের মা-বাবারা দীর্ঘ সময়ের জন্য বাইরে কাজে যান। ওদের পুষ্টিহীন জীর্ণশীর্ণ শরীর বড় বেশি আহত করে।' মাইলিন, কী করবে বলুন, জঠরজ্বালা তো মেটাতে হবে। মাইলিন, এ দেশে একদিকে যেমন কারো কারো সন্তানরা খাবার পা দিয়ে মাড়িয়ে যায়, অন্যদিকে তিশাদের মতো অসংখ্য শিশু একমুঠো ভাতের জন্য ওই খুপরি ঘরে গুমরায়। পুষ্টির বিষয়টি তো আরো পরের ব্যাপার মাইলিন। বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের যে চিত্রটি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা যেন পাহাড়ের চূড়া আর তলদেশের দৃষ্টান্তের সঙ্গেই শুধু মেলে। মাইলিন, আপনি বাংলাদেশের বস্তি ঘুরে যাওয়ার পর ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য সান-এ 'সি, পোভার্টি অ্যান্ড ডিসপেয়ার ইন দ্য স্লামস অব বাংলাদেশ' (দেখুন বাংলাদেশের বস্তিগুলোর দরিদ্রতা ও হতাশা) শিরোনামে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনটিতে ওই চিত্রটিই উপস্থাপিত হয়েছে। মাইলিন, আমাদের দেশে যাঁরা সরকারে থাকেন, তাঁদের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত থাকেন বিরোধী দলের তথাকথিত অথবা স্বার্থবাদী রাজনীতির ধারক-বাহকরা। এ চিত্র নতুন কিছু নয়। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাইলিন, আপনি যাদের দেখে এতটা ব্যথিত, আমাদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রকরা কিন্তু এর সামান্যতমও নন। বরং তাঁরা ওই ব্রিটিশ দৈনিকের প্রতিবেদনটিকে তাঁদের হীনস্বার্থবাদী রাজনীতির উপকরণ হিসেবে হয়তো কাজে লাগাবেন, দরিদ্র বস্তিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নে মনোনিবেশ না করে। মাইলিন, আমাদের দেশপ্রেমবোধ কতটা প্রখর, তা এ থেকেই আপনি খানিকটা অনুমান করে নিতে পারবেন নিশ্চয়ই।
মাইলিন, এ দেশে কত সহস্র মা ভয়াবহ পুষ্টিহীনতার শিকার, নানা রকম চরম প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতার তীরে বিদ্ধ, সে হিসাবও আপনাকে দেওয়া ভার। এই জীর্ণদেহী মায়েরা যে উত্তর-প্রজন্মের জন্ম দিচ্ছেন, তাঁরা কি পুষ্টিহীনতায় না ভুগে পারেন? আমাদের এই যে তিলোত্তমা ঢাকা, যাকে নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই, এখানে ৩০ শতাংশেরও বেশি মানুষ (অবশ্য মানুষ নয়, এই সমাজে তারা লোক হিসেবে পরিচিত) বস্তিতে বাস করে। তাদের দৈনিক গড় আয় শুনলে শিউরে উঠবেন। তিশাদের মা-বাবারা এরই গণ্ডিবদ্ধ। মাইলিন, আপনি তিশার মায়ের সামনে সাংবাদিকদের আরো জানিয়েছেন, 'আমি ওর সামনে কাঁদতে চাইনি। এতে সে মনে করতে পারে, আমি তাকে করুণা করছি। কিন্তু তাদের দুরবস্থা আমার সব বাঁধ ভেঙে দেয়। আমি এসব প্রত্যক্ষ করার পর নিজেকে আড়ালে রাখতে পারি না। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রচেষ্টায় অনেক শিশুর কল্যাণ হচ্ছে। আমি এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।' আপনার যে অনুভূতি, এই অনুভূতিটুকু যদি এ দেশের বিত্তবান মানুষের মধ্যে ৬০ শতাংশকেও তাড়া করত, নাড়া দিত- তাহলে অনেক তিশার জীবনচিত্র পাল্টে যেত। মাইলিন, আমরা একে অন্যের সমালোচনা করতে বড় বেশি অভ্যস্ত। আমরা পরনিন্দা, পরচর্চায় বড় বেশি পারঙ্গম। আমাদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রকদের অনেকেই জনকল্যাণের নামে বড় বেশি স্ববিরোধিতায় মত্ত। আপনি যে বস্তিগুলো ঘুরে অঝোরে কেঁদে আপনার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, একসময় দেখবেন তা আমাদের অপরাজনীতির বড় খোরাক হয়ে গেছে। সরকারকে ঘায়েলের বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। মাইলিন, আপনি তাতে লজ্জা পাবেন না, কষ্টও পাবেন না। এখানে মানবতা বিপন্ন। মাইলিন, অনেক স্বপ্ন, প্রতিজ্ঞা, অঙ্গীকার ব্যক্ত করে লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনে যে রক্তস্নাত বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে চার দশক আগে, এর চিত্র এত হতচ্ছাড়া হওয়ার কথা ছিল না। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ই ছিল। কিন্তু কেন এবং কাদের ব্যর্থতায় আজ এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে- এর জবাব সন্ধানে আপনাকে খুব বেগ পেতে হবে না। আপনি একটু পর্যবেক্ষণ করলেই সব পেয়ে যাবেন। আপনার মতো মানবদরদি যাঁরা এ দেশে আছেন, সংখ্যায় তাঁরা অনেক কম এবং তাঁদের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আর যাঁরা প্রকৃতই কিছু করতে পারেন তাঁদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ মুখোশধারী। এ লজ্জা আমাদের পীড়া দেয় না মাইলিন।
মাইলিন, যারা একদিন এ রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করেছে, মুক্তিকামী মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালিয়েছে কিংবা গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে, তারা স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র চার দশকের মধ্যে আবার রাষ্ট্রক্ষমতারও অংশীদার হয়েছে। বিলম্বে হলেও গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওই সব অপরাধীর বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বটে; কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষশক্তি বলে দাবিদার একটি মহল তাদের বাঁচাতে বড় বেশি তৎপর। তাদের ছায়াতলেই ওরা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। বলুন তো মাইলিন, এরপর এ দেশকে ঘিরে আপনি আপাতত আর কী আশা করতে পারেন? এমন নৈতিকতার ধস এবং স্ববিরোধিতা আপনি বিশ্বের কয়টি দেশে দেখেছেন? না- মাইলিন, তবুও আমরা আশাবাদী শুভবোধই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে। মাইলিন, আপনি আবার আসবেন, অবশ্যই আসবেন- তখন হয়তো সত্যিকারের সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা দেখতে পাবেন, যেখানে তিশারা আপনার সব কষ্ট-বেদনা ধুয়ে-মুছে নেবে তাদের উজ্জ্বল জীবনচিত্র দিয়ে। ভালো থাকুন মাইলিন, অশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments