ধর্ম-দেহ ও মনের সংযম সাধনাই রোজা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম হচ্ছে মাহে রমজানের রোজাব্রত পালন বা সংযম সাধনা। মানুষের দেহ ও মনকে সংযমের শাসনে রেখে ইসলামি শরিয়ত বা জীবনবিধানের পরিপন্থী যাবতীয় অসামাজিক ও অমানবিক কাজ পরিহার করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাকওয়া অর্জনের কঠোর সিয়াম সাধনাই মাহে রমজানের মূলকথা।
রোজার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করার অন্যতম শর্ত হলো, হালাল বস্তু দ্বারা আহার করা। পক্ষান্তরে হারাম বস্তু খেয়ে রোজা রাখলে এতে নফেসর পাশবিকতা অবদমিত হওয়ার পরিবর্তে তা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠবে। সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে মানুষের ইচ্ছাশক্তির বিকাশ, সংযম ও আত্মোন্নয়ন ঘটে।
রোজা অর্থ আত্মসংযম। মিথ্যাচারিতা, আজেবাজে, অহেতুক কথা বলা, চোখের গিবত এবং কটুবাক্য থেকে জিহ্বাকে সংযত রাখা, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হেফাজত করা এবং হারাম মাল না খাওয়া—সর্বক্ষেত্রেই সংযত হওয়া বাঞ্ছনীয়। রমজান মাসে রোজা প্রকৃতই রোজাদারদের হাত, পা, মুখ ও অন্তঃকরণকে সংযত করে। সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের রোজা চক্ষু, কান, জিহ্বা, হাত, পা এবং দৈহিক সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে অর্জিত হয়। যেমন—চোখকে অবৈধ দৃষ্টিপাত থেকে ফিরিয়ে রাখা। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন যে, ‘মন্দ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা শয়তানের একটি বিষমিশ্রিত তীর।’ যে আল্লাহর ভয়ে এটা বর্জন করে, আল্লাহ তাআলা তাকে ঈমানের এমন নূর প্রদান করেন, যার আস্বাদন সে অন্তরে অনুভব করে।
দেহকে আত্মনিয়ন্ত্রণে আনতে হলে দৈহিক প্রেরণাকে সংযত করতে হয়। আত্মিক শক্তিকে সমৃদ্ধ করতে হয়। দৈহিক কামনা-বাসনাকে সংযত করার জন্য একদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য ও রিপুর তাড়নাকে পরিত্যাগ করতে হয়, অন্যদিকে জিহ্বা ও মনের চাহিদা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এভাবে দৈহিক আকাঙ্ক্ষা ও প্রেরণাকে যত সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, অন্য কোনোভাবে তা সম্ভব নয়। তাই হারাম জিনিস দেখা, নিষিদ্ধ কথা শ্রবণ করা ও হারাম কাজ সম্পাদন করা প্রভৃতি থেকে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অবশ্যই বিরত রাখা উচিত। তবেই রোজার স্বাদ অনুভূত হবে এবং রোজাও প্রাণবন্ত হবে। মাহে রমজানে ত্যাগ ও সংযম সাধনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পাঁচটি বিষয় রোজাদারের রোজা বিনষ্ট করে দেয়—মিথ্যা বলা, কূটনামি করা, পশ্চাতে পরনিন্দা করা, মিথ্যা শপথ করা এবং খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো।’
মাহে রমজান হলো সংযম সাধনার একটি সুবর্ণ সুযোগের মাস। আর নিরলস সাধনা হলো নিজের বিরুদ্ধে, নফ্স, রিপু ও লালিত কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রকৃত মুজাহিদ তো সে-ই, যে তার নিজের নফ্স ও রিপুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।’ (মুসনাদে আহমাদ) রোজাব্রত পালন বা সিয়াম সাধনার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, অনর্থক কথাবার্তা, মিথ্যাচার, পরনিন্দা, গিবত, কটুবাক্য ব্যবহার প্রভৃতি গর্হিত কাজ থেকে জিহ্বাকে সংযম অবস্থায় রাখতে হবে। তাই নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ! তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে, তখন যেন মুখ দিয়ে অশ্লীল ও খারাপ কথা না বলে; কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করলে অথবা গালি দিলে সে যেন বলে—আমি রোজাদার।’ (বুখারি)
রোজাদারকে কু-কথা শ্রবণ করা থেকে নিজের কানকে বিরত রেখে সাধনা করতে হবে। কেননা, যেসব কথা বলা হারাম, সেগুলো শ্রবণ করাও হারাম। এ কারণেই মিথ্যা শ্রবণকারী ও হারাম ভক্ষণকারীদের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গিবতকারী ও শ্রবণকারী উভয়েই গুনাহের অংশীদার।’ সুতরাং রমজান মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা, রুটিনমাফিক উপবাস করা, মসজিদে যাওয়া, তারাবির নামাজ পড়া, ইফতার আর সেহির খাওয়াতেই রোজাব্রত পালন সম্পন্ন হয় না; এর সঙ্গে রোজাদার ব্যক্তির দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সংযম সাধনা করা বাঞ্ছনীয়।
মাহে রমজানে রোজাদারদের চোখকে খারাপ জিনিস দেখা থেকে বিরত রাখতে হবে। হাতকে চুরি, ডাকাতি, ঘুষ-দুর্নীতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন-খারাবি, ধর্ষণ, অপহরণ, মজুদদারি, চোরাকারবারিসহ সব ধরনের অবৈধ কাজকর্ম থেকে বা হারাম খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে হবে। কানকে নিষিদ্ধ কোনো কিছু শোনা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। মনকে কামনা-বাসনা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসামুক্ত রেখে মৃত্যু ও পরকালীন হিসাব-নিকাশের কথা সর্বদা স্মরণে রেখে আল্লাহভীতি বা তাকওয়া অর্জনে উন্মুখ হতে হবে।
মানুষের মধ্যে যেসব কুপ্রবৃত্তি রয়েছে, তা মানুষকে অন্যায়-অত্যাচার ও পাপাচারে লিপ্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। মাহে রমজানের রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশু প্রবৃত্তিকে দমন করা এবং ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান হওয়া। বছরের ১১ মাস প্রচুর খাওয়ার পর রমজানের এক মাস কিছুটা কম খেয়ে সংযম সাধনা করলে তেমন অসুবিধা হয় না। যার ইন্দ্রিয় তৃষ্ণা প্রবল, তাকে রোজা রাখার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ১২ মাসের মধ্যে একটি মাস ইন্দ্রিয় সংযমের জন্য রোজা পালনের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই মানুষের মঙ্গলের জন্যই সিয়াম সাধনাকে শরিয়তের বিধান হিসেবে নির্ধারিত করেছেন।
রোজা মানুষকে সংযমী মনোভাব গড়ে তোলার অতুলনীয় শিক্ষা দেয়। সংযত ও নিষ্ঠাবান হওয়ার যে মহান শিক্ষা মাহে রমজানে রয়েছে, আমরা যেন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি, যার ওপর নির্ভর করবে প্রকৃত রোজাদারদের সংযম সাধনা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
রোজা অর্থ আত্মসংযম। মিথ্যাচারিতা, আজেবাজে, অহেতুক কথা বলা, চোখের গিবত এবং কটুবাক্য থেকে জিহ্বাকে সংযত রাখা, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হেফাজত করা এবং হারাম মাল না খাওয়া—সর্বক্ষেত্রেই সংযত হওয়া বাঞ্ছনীয়। রমজান মাসে রোজা প্রকৃতই রোজাদারদের হাত, পা, মুখ ও অন্তঃকরণকে সংযত করে। সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের রোজা চক্ষু, কান, জিহ্বা, হাত, পা এবং দৈহিক সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে অর্জিত হয়। যেমন—চোখকে অবৈধ দৃষ্টিপাত থেকে ফিরিয়ে রাখা। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন যে, ‘মন্দ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা শয়তানের একটি বিষমিশ্রিত তীর।’ যে আল্লাহর ভয়ে এটা বর্জন করে, আল্লাহ তাআলা তাকে ঈমানের এমন নূর প্রদান করেন, যার আস্বাদন সে অন্তরে অনুভব করে।
দেহকে আত্মনিয়ন্ত্রণে আনতে হলে দৈহিক প্রেরণাকে সংযত করতে হয়। আত্মিক শক্তিকে সমৃদ্ধ করতে হয়। দৈহিক কামনা-বাসনাকে সংযত করার জন্য একদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য ও রিপুর তাড়নাকে পরিত্যাগ করতে হয়, অন্যদিকে জিহ্বা ও মনের চাহিদা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এভাবে দৈহিক আকাঙ্ক্ষা ও প্রেরণাকে যত সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, অন্য কোনোভাবে তা সম্ভব নয়। তাই হারাম জিনিস দেখা, নিষিদ্ধ কথা শ্রবণ করা ও হারাম কাজ সম্পাদন করা প্রভৃতি থেকে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অবশ্যই বিরত রাখা উচিত। তবেই রোজার স্বাদ অনুভূত হবে এবং রোজাও প্রাণবন্ত হবে। মাহে রমজানে ত্যাগ ও সংযম সাধনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পাঁচটি বিষয় রোজাদারের রোজা বিনষ্ট করে দেয়—মিথ্যা বলা, কূটনামি করা, পশ্চাতে পরনিন্দা করা, মিথ্যা শপথ করা এবং খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো।’
মাহে রমজান হলো সংযম সাধনার একটি সুবর্ণ সুযোগের মাস। আর নিরলস সাধনা হলো নিজের বিরুদ্ধে, নফ্স, রিপু ও লালিত কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রকৃত মুজাহিদ তো সে-ই, যে তার নিজের নফ্স ও রিপুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।’ (মুসনাদে আহমাদ) রোজাব্রত পালন বা সিয়াম সাধনার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, অনর্থক কথাবার্তা, মিথ্যাচার, পরনিন্দা, গিবত, কটুবাক্য ব্যবহার প্রভৃতি গর্হিত কাজ থেকে জিহ্বাকে সংযম অবস্থায় রাখতে হবে। তাই নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ! তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে, তখন যেন মুখ দিয়ে অশ্লীল ও খারাপ কথা না বলে; কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করলে অথবা গালি দিলে সে যেন বলে—আমি রোজাদার।’ (বুখারি)
রোজাদারকে কু-কথা শ্রবণ করা থেকে নিজের কানকে বিরত রেখে সাধনা করতে হবে। কেননা, যেসব কথা বলা হারাম, সেগুলো শ্রবণ করাও হারাম। এ কারণেই মিথ্যা শ্রবণকারী ও হারাম ভক্ষণকারীদের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গিবতকারী ও শ্রবণকারী উভয়েই গুনাহের অংশীদার।’ সুতরাং রমজান মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা, রুটিনমাফিক উপবাস করা, মসজিদে যাওয়া, তারাবির নামাজ পড়া, ইফতার আর সেহির খাওয়াতেই রোজাব্রত পালন সম্পন্ন হয় না; এর সঙ্গে রোজাদার ব্যক্তির দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সংযম সাধনা করা বাঞ্ছনীয়।
মাহে রমজানে রোজাদারদের চোখকে খারাপ জিনিস দেখা থেকে বিরত রাখতে হবে। হাতকে চুরি, ডাকাতি, ঘুষ-দুর্নীতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন-খারাবি, ধর্ষণ, অপহরণ, মজুদদারি, চোরাকারবারিসহ সব ধরনের অবৈধ কাজকর্ম থেকে বা হারাম খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে হবে। কানকে নিষিদ্ধ কোনো কিছু শোনা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। মনকে কামনা-বাসনা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসামুক্ত রেখে মৃত্যু ও পরকালীন হিসাব-নিকাশের কথা সর্বদা স্মরণে রেখে আল্লাহভীতি বা তাকওয়া অর্জনে উন্মুখ হতে হবে।
মানুষের মধ্যে যেসব কুপ্রবৃত্তি রয়েছে, তা মানুষকে অন্যায়-অত্যাচার ও পাপাচারে লিপ্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। মাহে রমজানের রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশু প্রবৃত্তিকে দমন করা এবং ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান হওয়া। বছরের ১১ মাস প্রচুর খাওয়ার পর রমজানের এক মাস কিছুটা কম খেয়ে সংযম সাধনা করলে তেমন অসুবিধা হয় না। যার ইন্দ্রিয় তৃষ্ণা প্রবল, তাকে রোজা রাখার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ১২ মাসের মধ্যে একটি মাস ইন্দ্রিয় সংযমের জন্য রোজা পালনের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই মানুষের মঙ্গলের জন্যই সিয়াম সাধনাকে শরিয়তের বিধান হিসেবে নির্ধারিত করেছেন।
রোজা মানুষকে সংযমী মনোভাব গড়ে তোলার অতুলনীয় শিক্ষা দেয়। সংযত ও নিষ্ঠাবান হওয়ার যে মহান শিক্ষা মাহে রমজানে রয়েছে, আমরা যেন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি, যার ওপর নির্ভর করবে প্রকৃত রোজাদারদের সংযম সাধনা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments