চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-পাকিস্তানের ভূত ও কৃত্রিম এক জাতিতত্ত্ব by যতীন সরকার
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে কয়েক মাস ধরে যেসব ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যেতে থাকে, সেসব থেকেই স্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে যে পাকিস্তানের ভূত বাংলাদেশকে খুব শক্ত করে চেপে ধরেছে। সেসবের অনুপুঙ্খ বর্ণনা বা বিশ্লেষণের জন্য আমি কলম ধরিনি। সেই ভূতের আছরে আমি নিজে কী রকম বিপর্যস্ত হচ্ছিলাম, সে কথাই এখানে স্মরণ করছি।
সে বছরের ৩ নভেম্বরে জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরে এর প্রতিবাদে যে মিছিল বেরিয়েছিল, সে মিছিলে আমিও শামিল হয়েছিলাম। মিছিল শেষে পথসভায় দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে ফেলেছিলাম। খুবই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম সেদিন।
কিন্তু অচিরেই সেই আশাবাদের বেলুনটি একেবারে ফুটো হয়ে গেল। এল ৭ নভেম্বর। সেই দিনটিতে ঢাকায় যা যা ঘটেছিল, সে সব নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ যে কালোমেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, সেই কালোমেঘ কখন কিভাবে অপসৃত হয়ে প্রকৃত সত্যটি অনাবৃত হবে, কিংবা কোনো দিন আদৌ তা হবে কি না, সে সব কোনো কিছু নিয়ে কোনো কিছু বলার, এমনকি অনুমান করারও ক্ষমতা বা যোগ্যতা আমার নেই। তবে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে সূচিত পাকিস্তানের ভূতের আছর যে ৭ নবেম্বর থেকে আরো তীব্র হতে থাকে, সে বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। ৭ নভেম্বরে থেকেই স্পষ্ট হতে থাকে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতাবিরোধীরাই আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি করে ফেলেছে। আর কি আশ্চর্য, আমার মতো একান্ত গুরুত্বহীন মানুষকেও সেই বন্দিদশায় আটকে পড়তে হলো।
দেখা গেল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যাদের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল তাদের প্রায় কেউই গ্রেপ্তারের হাত এড়াতে পারছে না। যখন-তখন তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে আসছে, কেউ বা তাদের কর্মস্থলে কিংবা হাটবাজারে পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমার বন্ধুবান্ধব অনেকের গ্রেপ্তার হওয়ার খবরও প্রতিনিয়তই পাচ্ছি।
যদিও ছেলেবেলা থেকেই ছিলাম রাজনীতিসচেতন, তবু কোনোদিনই আমি 'পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট' হইনি। আমি কেবল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা প্রগতিশীল রাজনীতির পক্ষে নানা আলোচনাসভায় বক্তৃতা দিয়ে গেছি, পত্রিকার পাতায় কিছু কিছু লিখেছিও। এতেই পুলিশের খাতায় আমার নাম উঠে গেল এবং লোকজনের কাছে আমি কমিউনিস্ট বলে পরিচিত হয়ে গেলাম। তাই আমারও পুলিশের হাতে ধরাপড়া যে একান্ত অনিবার্য- এ কথাই আমার শুভার্থীরা বারবার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে লাগলেন এবং উপদেশ দিলেন গা-ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য। তাঁদের উপদেশ মান্য করে কিছুদিন এখানে-ওখানে পালিয়েও থেকেছি। কিন্তু খুব বেশি দিন ধরে পালিয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ আমি তো চাকরি করে খাই। কলেজ মাস্টারির সেই চাকরি বজায় রাখার জন্য কলেজে আমাকে যেতেই হয়, তা না হলে পরিবারের সবার জন্য পেটের ভাত জোগানোই হবে অসম্ভব। কাজেই যেকোনো সময় পুলিশের হতে ধরা পড়া অনিবার্য জেনেও জনসমক্ষে চলাফেরা করার কোনো বিকল্প ছিল না আমার।
তা ছাড়া আমার অন্তর্নিহিত একটি দুর্গুণের হাত থেকেও আমি মুক্ত থাকতে পারেনি। আমার মনে যখন যা ভাবনা আসে, মুখের ভাষায় তখনই তা উগলে না ফেলে আমি একটুও স্বস্তি পাই না, তখন তখনই তা বলে ফেলি। বিশেষ করে কোনো সভা-সমাবেশে আমার কথাটি বলার সুযোগ পেলে তো সে সুযোগ (আসলে যা দুর্যোগ) কিছুতেই আমি হাতছাড়া করি না। অনেক সময়ই এ রকম আচরণের জন্য আমাকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়, নির্বুদ্ধিতার অভিযোগে নিন্দিত ও তিরস্কৃত হতে হয়। কিন্তু কোনো দুর্ভোগ, নিন্দা ও তিরস্কারই আমাকে নিবৃত্ত বা নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না।
এ রকম আচরণই করেছিলাম ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও। শুনতে পেলাম, একুশে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত সংস্কৃতি সপ্তাহের এক দিনের আলোচনাসভায় (সম্ভবত ১৫ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ঘোরবিরোধী ও পাকিস্তানপ্রেমিক সাংবাদিক খন্দকার আবদুল হামিদ 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'-এর তত্ত্ব হাজির করেছেন। সে তত্ত্বটি স্বরূপত দ্বিজাতিতত্ত্বেরই রকমফের মাত্র। সেই তত্ত্বটিকেই সে সময়কার বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে, এখন থেকে এ দেশে কোনো বাঙালি নেই, সবাই 'বাংলাদেশি'। পত্রিকার পাতায় খবরটি পড়ে আমার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল।
হ্যাঁ, বাংলাদেশের নাগরিক রূপে আমরা সবাই বাংলাদেশি বটে, কিন্তু বাংলাদেশি জাতি বলে কোনো জাতি হতে পারে না, প্রকারান্তরে পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে ফিরিয়ে আনার বিশেষ বদমতলব থেকেই এই তথাকথিত জাতিতত্ত্বটি উপজাত। এর বিরুদ্ধে আমাকে কিছু বলতেই হবে।
সেই বলার সুযোগটিই পেয়ে গেলাম ১৮ ফেব্রুয়ারি। এর আগের দুই বছরের মতো এবারও বাংলা একাডেমীতে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ আমি আগেই পেয়েছিলাম। সেই আমন্ত্রণের সুযোগ নিয়েই আমার মনের ভেতর জমে থাকা সব কথা- কোনোরূপ রাঘঢাক না করে ১৮ ফেব্রুয়ারির আলোচনাসভায় একেবারে উজাড় করে দিলাম। কুচক্রীদের সব কুকর্ম প্রতিহত করার জন্য এই মুহূর্ত থেকেই যে গণআন্দোলন করা দরকার, সে কথাও অবলীলায় বলে ফেললাম। শ্রোতারা মুহুর্মুহু হাততালি দিয়ে আমার বক্তব্যকে সমর্থন জানালেন। কিন্তু সে সময়ে ভাবিনি যে এই হাততালিই আমাকে হাতকড়া পরানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখল।
আমি না ভাবলেও ঠিক তখনই সে কথা ভেবে ফেলেছিলেন শ্রোতাদের একেবারে পেছনের সারিতে উপবিষ্ট আবদুল হক। তিনি সেই আবদুল হক, পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে বহাল থেকেও, বিগত শতকের ষাটের দশকেই নীরবে নিভৃতে যিনি পাকিস্তানবিরোধী লেখালেখি করে গিয়েছিলন, সে সব লেখায় পাকিস্তানের হাত থেকে তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তির আর্তিও আকারে-ইঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছিল। ১৯৬৬ সালেই আবু আহসান ছদ্মনামে তখনকার অত্যন্ত উন্নতমানের সাহিত্যপত্র 'সমকাল'-এ 'যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতা' ও 'মুসলিম জাতীয়তাবাদ : পুনর্নিরীক্ষা' শীর্ষক দুটো অসাধারণ প্রবন্ধে তিনি পাকিস্তানের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছিলেন। আবু আহসান যে আসলে আবদুল হকই, সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের সে বিষয়ে স্পষ্ট অবহিতি ছিল বলে শুনেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষে আবদুল হককে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। কারণ নিভৃতচারী ও অতিসতর্ক হক সাহেব সবসময়ই আটঘাট বেঁধে চলতেন। কখনো কারো সঙ্গে কথায় বা আলাপে তাঁর মতবাদের বা কার্যক্রমের প্রকাশ ঘটাতেন না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গেও নিজেকে কখনো যুক্ত করেননি, অথচ দেশ-বিদেশের সব রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের পরিচয় সন্ধানে তিনি ছিলেন অনলস। রাজনীতিতে রোজই যা যা ঘটত, সে সবের খুঁটিনাটি বিবরণ তাঁর ডায়েরিতে লিখে রাখতেন।
[সেই ডায়েরির নির্বাচিত অংশ নিয়ে নূরুল হুদার সম্পাদনায় ১৯৯৬ সালে যে অসাধারণ বইটি প্রকাশিত হয়, সেটি অনেক পরে, ২০০৭ সালে আমার হাতে আসে। তখন থেকে এ বইটি আমার প্রায় নিত্যপাঠ্যের অন্তর্গত হয়ে গেছে।]
বক্তৃতামঞ্চ থেকে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবদুল হক আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, 'যতীনবাবু, মনে রাখবন অচিরেই আপনাকে জেলখানায় ঢুকতে হবে। এর কোনো অন্যথা হবে না।'
কথাটা বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, দ্রুত তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।
চলে তো গেলেন, কিন্তু আমার বুকে যেন একটা পাষাণভার চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন ধরেই আমি আবদুল হকের স্নেহধন্য। স্নেহবশত আমাকে সংযত ও সতর্ক করে দিতেই হয়তো তিনি চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার পক্ষে সংযত বা সতর্ক হওয়ার কোনোই উপায় ছিল না। ধরেই নিয়েছিলাম যে আবদুল হকের বক্তব্য অবশ্যই সত্য হবে, অতিসত্বরই আমাকে লাল দালানে ঢোকানো হবে। এ রকম ভাবতে ভাবতেই ময়মনসিংহে ফিরে এলাম।
এর মাত্র পক্ষকাল পরেই, ১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ রাতে এক দঙ্গল পুলিশ এসে আমার বাসাটিকে ঘিরে ফেলল এবং আমাকে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেল। আমরা যারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলাম না, তাদের সবার প্রতিই স্বাধীনতা অপহরণকারী অপশক্তিটির ছিল সীমাহীন আক্রোশ। সেই আক্রোশ থেকেই কৃত্রিম এক জাতিতত্ত্বের উদ্ভাবন, সেই জাতিতত্ত্বের সঙ্গে পাকিস্তানের ভূতের সীমাহীন সৌহার্দ্য।
লেখক : শিক্ষাবিদ
কিন্তু অচিরেই সেই আশাবাদের বেলুনটি একেবারে ফুটো হয়ে গেল। এল ৭ নভেম্বর। সেই দিনটিতে ঢাকায় যা যা ঘটেছিল, সে সব নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ যে কালোমেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, সেই কালোমেঘ কখন কিভাবে অপসৃত হয়ে প্রকৃত সত্যটি অনাবৃত হবে, কিংবা কোনো দিন আদৌ তা হবে কি না, সে সব কোনো কিছু নিয়ে কোনো কিছু বলার, এমনকি অনুমান করারও ক্ষমতা বা যোগ্যতা আমার নেই। তবে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে সূচিত পাকিস্তানের ভূতের আছর যে ৭ নবেম্বর থেকে আরো তীব্র হতে থাকে, সে বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। ৭ নভেম্বরে থেকেই স্পষ্ট হতে থাকে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতাবিরোধীরাই আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি করে ফেলেছে। আর কি আশ্চর্য, আমার মতো একান্ত গুরুত্বহীন মানুষকেও সেই বন্দিদশায় আটকে পড়তে হলো।
দেখা গেল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যাদের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল তাদের প্রায় কেউই গ্রেপ্তারের হাত এড়াতে পারছে না। যখন-তখন তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে আসছে, কেউ বা তাদের কর্মস্থলে কিংবা হাটবাজারে পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমার বন্ধুবান্ধব অনেকের গ্রেপ্তার হওয়ার খবরও প্রতিনিয়তই পাচ্ছি।
যদিও ছেলেবেলা থেকেই ছিলাম রাজনীতিসচেতন, তবু কোনোদিনই আমি 'পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট' হইনি। আমি কেবল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা প্রগতিশীল রাজনীতির পক্ষে নানা আলোচনাসভায় বক্তৃতা দিয়ে গেছি, পত্রিকার পাতায় কিছু কিছু লিখেছিও। এতেই পুলিশের খাতায় আমার নাম উঠে গেল এবং লোকজনের কাছে আমি কমিউনিস্ট বলে পরিচিত হয়ে গেলাম। তাই আমারও পুলিশের হাতে ধরাপড়া যে একান্ত অনিবার্য- এ কথাই আমার শুভার্থীরা বারবার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে লাগলেন এবং উপদেশ দিলেন গা-ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য। তাঁদের উপদেশ মান্য করে কিছুদিন এখানে-ওখানে পালিয়েও থেকেছি। কিন্তু খুব বেশি দিন ধরে পালিয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ আমি তো চাকরি করে খাই। কলেজ মাস্টারির সেই চাকরি বজায় রাখার জন্য কলেজে আমাকে যেতেই হয়, তা না হলে পরিবারের সবার জন্য পেটের ভাত জোগানোই হবে অসম্ভব। কাজেই যেকোনো সময় পুলিশের হতে ধরা পড়া অনিবার্য জেনেও জনসমক্ষে চলাফেরা করার কোনো বিকল্প ছিল না আমার।
তা ছাড়া আমার অন্তর্নিহিত একটি দুর্গুণের হাত থেকেও আমি মুক্ত থাকতে পারেনি। আমার মনে যখন যা ভাবনা আসে, মুখের ভাষায় তখনই তা উগলে না ফেলে আমি একটুও স্বস্তি পাই না, তখন তখনই তা বলে ফেলি। বিশেষ করে কোনো সভা-সমাবেশে আমার কথাটি বলার সুযোগ পেলে তো সে সুযোগ (আসলে যা দুর্যোগ) কিছুতেই আমি হাতছাড়া করি না। অনেক সময়ই এ রকম আচরণের জন্য আমাকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়, নির্বুদ্ধিতার অভিযোগে নিন্দিত ও তিরস্কৃত হতে হয়। কিন্তু কোনো দুর্ভোগ, নিন্দা ও তিরস্কারই আমাকে নিবৃত্ত বা নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না।
এ রকম আচরণই করেছিলাম ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও। শুনতে পেলাম, একুশে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত সংস্কৃতি সপ্তাহের এক দিনের আলোচনাসভায় (সম্ভবত ১৫ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ঘোরবিরোধী ও পাকিস্তানপ্রেমিক সাংবাদিক খন্দকার আবদুল হামিদ 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'-এর তত্ত্ব হাজির করেছেন। সে তত্ত্বটি স্বরূপত দ্বিজাতিতত্ত্বেরই রকমফের মাত্র। সেই তত্ত্বটিকেই সে সময়কার বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে, এখন থেকে এ দেশে কোনো বাঙালি নেই, সবাই 'বাংলাদেশি'। পত্রিকার পাতায় খবরটি পড়ে আমার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল।
হ্যাঁ, বাংলাদেশের নাগরিক রূপে আমরা সবাই বাংলাদেশি বটে, কিন্তু বাংলাদেশি জাতি বলে কোনো জাতি হতে পারে না, প্রকারান্তরে পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে ফিরিয়ে আনার বিশেষ বদমতলব থেকেই এই তথাকথিত জাতিতত্ত্বটি উপজাত। এর বিরুদ্ধে আমাকে কিছু বলতেই হবে।
সেই বলার সুযোগটিই পেয়ে গেলাম ১৮ ফেব্রুয়ারি। এর আগের দুই বছরের মতো এবারও বাংলা একাডেমীতে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ আমি আগেই পেয়েছিলাম। সেই আমন্ত্রণের সুযোগ নিয়েই আমার মনের ভেতর জমে থাকা সব কথা- কোনোরূপ রাঘঢাক না করে ১৮ ফেব্রুয়ারির আলোচনাসভায় একেবারে উজাড় করে দিলাম। কুচক্রীদের সব কুকর্ম প্রতিহত করার জন্য এই মুহূর্ত থেকেই যে গণআন্দোলন করা দরকার, সে কথাও অবলীলায় বলে ফেললাম। শ্রোতারা মুহুর্মুহু হাততালি দিয়ে আমার বক্তব্যকে সমর্থন জানালেন। কিন্তু সে সময়ে ভাবিনি যে এই হাততালিই আমাকে হাতকড়া পরানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখল।
আমি না ভাবলেও ঠিক তখনই সে কথা ভেবে ফেলেছিলেন শ্রোতাদের একেবারে পেছনের সারিতে উপবিষ্ট আবদুল হক। তিনি সেই আবদুল হক, পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে বহাল থেকেও, বিগত শতকের ষাটের দশকেই নীরবে নিভৃতে যিনি পাকিস্তানবিরোধী লেখালেখি করে গিয়েছিলন, সে সব লেখায় পাকিস্তানের হাত থেকে তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তির আর্তিও আকারে-ইঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছিল। ১৯৬৬ সালেই আবু আহসান ছদ্মনামে তখনকার অত্যন্ত উন্নতমানের সাহিত্যপত্র 'সমকাল'-এ 'যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতা' ও 'মুসলিম জাতীয়তাবাদ : পুনর্নিরীক্ষা' শীর্ষক দুটো অসাধারণ প্রবন্ধে তিনি পাকিস্তানের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছিলেন। আবু আহসান যে আসলে আবদুল হকই, সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের সে বিষয়ে স্পষ্ট অবহিতি ছিল বলে শুনেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষে আবদুল হককে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। কারণ নিভৃতচারী ও অতিসতর্ক হক সাহেব সবসময়ই আটঘাট বেঁধে চলতেন। কখনো কারো সঙ্গে কথায় বা আলাপে তাঁর মতবাদের বা কার্যক্রমের প্রকাশ ঘটাতেন না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গেও নিজেকে কখনো যুক্ত করেননি, অথচ দেশ-বিদেশের সব রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের পরিচয় সন্ধানে তিনি ছিলেন অনলস। রাজনীতিতে রোজই যা যা ঘটত, সে সবের খুঁটিনাটি বিবরণ তাঁর ডায়েরিতে লিখে রাখতেন।
[সেই ডায়েরির নির্বাচিত অংশ নিয়ে নূরুল হুদার সম্পাদনায় ১৯৯৬ সালে যে অসাধারণ বইটি প্রকাশিত হয়, সেটি অনেক পরে, ২০০৭ সালে আমার হাতে আসে। তখন থেকে এ বইটি আমার প্রায় নিত্যপাঠ্যের অন্তর্গত হয়ে গেছে।]
বক্তৃতামঞ্চ থেকে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবদুল হক আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, 'যতীনবাবু, মনে রাখবন অচিরেই আপনাকে জেলখানায় ঢুকতে হবে। এর কোনো অন্যথা হবে না।'
কথাটা বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, দ্রুত তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।
চলে তো গেলেন, কিন্তু আমার বুকে যেন একটা পাষাণভার চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন ধরেই আমি আবদুল হকের স্নেহধন্য। স্নেহবশত আমাকে সংযত ও সতর্ক করে দিতেই হয়তো তিনি চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার পক্ষে সংযত বা সতর্ক হওয়ার কোনোই উপায় ছিল না। ধরেই নিয়েছিলাম যে আবদুল হকের বক্তব্য অবশ্যই সত্য হবে, অতিসত্বরই আমাকে লাল দালানে ঢোকানো হবে। এ রকম ভাবতে ভাবতেই ময়মনসিংহে ফিরে এলাম।
এর মাত্র পক্ষকাল পরেই, ১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ রাতে এক দঙ্গল পুলিশ এসে আমার বাসাটিকে ঘিরে ফেলল এবং আমাকে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেল। আমরা যারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলাম না, তাদের সবার প্রতিই স্বাধীনতা অপহরণকারী অপশক্তিটির ছিল সীমাহীন আক্রোশ। সেই আক্রোশ থেকেই কৃত্রিম এক জাতিতত্ত্বের উদ্ভাবন, সেই জাতিতত্ত্বের সঙ্গে পাকিস্তানের ভূতের সীমাহীন সৌহার্দ্য।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments