দুর্ঘটনা-‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা’ by শামসুল হক

যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে ভুলটা ছিল গোড়াতেই। সড়ক অবকাঠামোর বিন্যাস ও পরিকল্পনায় গুরুতর ভুল ছিল। মহাসড়ক হলো হাই ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক লাইনের মতো, এর ধারেকাছে কারও যাওয়ার কথা নয়। সব সড়কের মধ্যে এর অবস্থান সবার ওপরে, কারণ এর উচ্চগতি।


এর সঙ্গে কম গতির গ্রামীণ সড়ক, সংযোগ সড়ক, প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি কোনো ধরনের সড়কেরই সরাসরি যুক্ত থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে মহাসড়কের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের সড়ক যুক্ত। উত্তরোত্তর নতুন নতুন সড়ক মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। এই বিন্যাসটা বিশৃঙ্খল।
সঠিক বিন্যাস না থাকার জন্যই দুর্ঘটনা বাড়ছে। আমরা দেখতে পাই, দুর্ঘটনা হচ্ছে বাঁকে, সেতুর আগে-পরে, শহরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়। চালকেরা যখন মহাসড়কে ওঠেন, তখন তাঁদের প্রত্যাশা থাকে যে তিনি মানসম্মত সড়কের ওপর দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে বড় বাঁক থাকবে না, উঁচু-নিচু থাকবে না, হঠা ৎ স্বল্পগতির যান, পথচারী বা গরু-ছাগল ঢুকে পড়বে না। অথচ মহাসড়কে কিছুদূর পর পর বাসস্ট্যান্ড, বাজার, বড় গাছ ইত্যাদি। মহাসড়কের পাশে জনবসতিও থাকার কথা নয়। চালক যদি বোঝেন যে এ অবস্থায় তাঁকে কম গতিতে চালাতে হবে, তাহলে দুর্ঘটনা কিছু কমার কথা। কারণ, গতিই দুর্ঘটনাকে মারাত্মক করে তোলে। কিন্তু যাঁরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গাড়ি চালান, তাঁদের সময়মতো পৌঁছানোর দায়বদ্ধতা থাকে, অথবা শিপমেন্টের তাড়া থাকে। এ সময়-বাঁধা তাড়ার সঙ্গে সড়ক বিন্যাসের সংঘাত থেকেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনা এ রকম অবস্থাতেই ঘটে।
যারা মহাসড়ক ব্যবহার করবে, তাদেরও দায়দায়িত্ব আছে। তারা কারা? গাড়ির চালক, যাত্রী ও পথচারী। মহাসড়কের আশপাশে পথচারীদের আসার কথা নয়। কারণ, সে সবচেয়ে দুর্বল পক্ষ। একটা ছোট্ট ধাক্কাতেই তার সর্বনাশ। ৫৪ শতাংশ প্রাণহানিকর দুর্ঘটনা হয় পথচারীদের বেলায়; যেখানে মহাসড়কে এক সেকেন্ডে কোনো গাড়ি ২০০-৩০০ ফুট কাছে চলে আসে, সেখানে মাথায় একটা বোঝা নিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হওয়া ভয়ানক বিপজ্জনক। উন্নত দেশে মহাসড়কের আশপাশে কোনো বসতি থাকে না। থাকলেও তাদের সমান্তরাল নিজস্ব সার্ভিস রোড থাকে। তারা জানে, এ রাস্তা দিয়ে ১০০-১৫০ কিলোমিটার বেগে গাড়ির স্রোত চলবে। তাই তারা মহাসড়কের ওপর বা নিচ দিয়ে চলাচল করে। তাদের টাকা আছে, সব ধরনের সুরক্ষার বন্দোবস্ত তারা করতে পারে। এ ক্ষেত্রেও আমরা ব্যর্থ।
সুতরাং আমাদের সড়কের বিন্যাস, পরিকল্পনা ও পরিবেশ—তিন ক্ষেত্রেই মারাত্মক গলদ আছে। দুর্ঘটনার প্রধান তিনটি কারণ এটাই। যত দিন এমন থাকবে, তত দিন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকবে।
এখন সম্পদের ঘাটতি হেতু আমাদের সচেতনতার ওপরই নির্ভর করতে হবে। তা হলেও নিরাপদ চালক তৈরির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আমরা কখনো উপলব্ধি করিনি। অল্প কয়েকটি সরকারি প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে, যেখানে এক সপ্তাহের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়; তা দিয়ে নিরাপদ চালক তৈরি করা সম্ভব নয়। প্রতিবছর ৩০-৩৫ হাজার বাণিজ্যিক গাড়ি রাস্তায় নামছে, অথচ সরকারি পর্যায়ে চালক তৈরি করতে পারছি মাত্র ১০-১৫ হাজার। এই অবস্থায় চালকের সহকারী চালক সেজে চালকের আসনে বসছেন। কিন্তু সরকার যদি বেসরকারিভাবে অনেক ফিটনেস সেন্টার, ড্রাইভিং সেন্টারের অনুমোদন দিত, সব বেসরকারি ড্রাইভিং স্কুলগুলোকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে মানসম্মত চালক পেতাম। তাঁদের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক অর্জন করতে পারতাম। এখন যাঁরা ইতিমধ্যে ঢুকে গেছেন, তাঁদের সংখ্যা ও প্রভাব এত বেশি যে কিছু করা কঠিন। যে বদভ্যাস ১০ বছর ধরে ঢুকেছে, সেটা দূর করতেও ১০ বছর লাগবে। সরকার যে এক-দুই দিনের ট্রেনিং দেয়, তা কাজের নয়।
আমরা চালক তৈরির দায়িত্ব নিইনি, তাঁদের ভালো রাস্তা দিইনি, তাঁদের মানোন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করিনি, কিন্তু কেবল তাদের দোষারোপ করে গেছি। অন্যদিকে এখন চালক ও মালিকেরা বড় প্রেশার গ্রুপ হয়ে গেছেন। তাঁদের সামলানো কঠিন। কিন্তু গোড়াতেই নজরটা পড়লে সমস্যা আজ বড় সংকটে পরিণত হতো না।
এরপর আসে আইনের প্রয়োগের কথা। চালক সচেতন হলেই আইনকানুন মানবেন, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। উন্নত দেশগুলোয় আইন প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য হাইওয়ে পুলিশেরও কোনো বিকল্প নেই। মহাসড়কে অবৈধ চালক বা কোনো আনফিট যান ঢুকে পড়ল কি না, সেগুলো তারা দেখে। কিন্তু আমাদের দেশে হাইওয়ে পুলিশের জনবল, সরঞ্জাম কিছুই প্রায় নেই। অনেকেই চালক প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহী, কিন্তু সুফল পেতে গেলে যে আইনের প্রয়োগ দরকার, সেই হুঁশ নেই। কোনো ব্যবস্থার সুফল পেতে হলে তার প্রকৌশল পরিকল্পনা ঠিক থাকতে হয়, তারপর দেখতে হয় প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগ। এর কোনো একটি না থাকলে পুরোটাই বিফল হতে পারে।
দুর্ঘটনার বেলায় আমরা যা দেখি, তা হলো পরিণতি। কোথা থেকে ঘটনার শুরু, তা আমরা জানি না। হাইওয়েতে দুর্ঘটনা উসকে দেয় ছোট ছোট যান। একটা কম গতির ছোট গাড়ি বা করিমন-নছিমন রাস্তায় থাকলে পেছনের সব গাড়িই ওভারটেকে বাধ্য হয়। ডিভাইডারবিহীন সড়কে ওভারটেক বিপজ্জনক বিষয়। অথচ বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিশৃঙ্খল সড়ক ওভারটেকের চাহিদা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দুর্ঘটনা হলে বড় গাড়িকে দোষ দিচ্ছি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওভারটেক যে ডেকে আনছে, তাকে দেখছি না। মানুষ দেখে রক্ত আর খোঁজে বড় গাড়ি। এর পরিণতি কিন্তু সামাজিক ক্রসফায়ারের দিকে চলে যাচ্ছে। কারণের দিকে না তাকালে কখনোই প্রতিকার হবে না।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে গলদ হয়েছিল গোড়াতেই। দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগ হয়েছিল পক্ষপাতপূর্ণভাবে সড়কের দিকে। আন্তর্জাতিক যেসব সংস্থা ও দেশ অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ করেছে, তারা তাদের লাভের স্বার্থেই সড়ককে অগ্রাধিকার দিয়েছে। অথচ নৌ ও রেল ছিল বিশুদ্ধ গণপরিবহনের উপযুক্ত মাধ্যম, আমজনতার মাধ্যম। অথচ স্বাধীনতার পর সড়ক খাতে মোট বিনিয়োগের ১ শতাংশও এ দুটি খাতে দেওয়া হয়নি।
পৃথিবীর সব জায়গাতেই মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম বা বিবিধ ধরনের পরিবহনের সমন্বিত ব্যবস্থাকেই আদর্শ ধরা হয়। সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগের সমন্বিত ব্যবস্থাই টেকসই, জনবান্ধব ও নিরাপদ। সড়কভিত্তিক যোগাযোগ কখনোই টেকসই নয়। এর পরিণতি অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার ও দুর্ঘটনা। কিন্তু দাতাদের পরামর্শে আমরা এই সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থার দিকে যাইনি। ঋণ নেওয়ার মতো আমাদের স্বার্থ রক্ষার কৌশলটাও থাকতে হবে। এর জন্য দরকার ছিল সমন্বয়, ধারাবাহিকতা ও বিনিয়োগ—এসবেরই সম্মিলিত ফল হলো আজকের এই মর্মান্তিক দুরবস্থা।
ড. শামসুল হক: অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট; সাবেক পরিচালক, অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

No comments

Powered by Blogger.