সহজিয়া কড়চা-রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যোগাযোগব্যবস্থার অকল্পনীয় উন্নতি হওয়ায় ভৌগোলিকভাবে পৃথিবী একেবারে ছোট হয়ে গেছে। পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ আরেক প্রান্তের মানুষের কাছাকাছি এসেছে—এক শতাব্দী আগে এক জেলার মানুষের সঙ্গে আরেক জেলার মানুষের যতটা দূরত্ব ছিল, তার চেয়ে বেশি নিকটবর্তী।
কিন্তু মানবজাতির অদৃষ্টের পরিহাস হলো, এখনই মানুষ পরস্পর থেকে মানসিকভাবে বেশি বিচ্ছিন্ন। বিভেদ ও বৈরিতায় জর্জরিত বিশ্ব।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে দুনিয়ার কোনো খবরই আজ আর গোপন থাকছে না। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বা শায়েস্তা খাঁর রাজত্বের খবর শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ডের রাজারা জানতেন না। এখন বাংলাদেশে কী ঘটছে, তা ব্যাংককের সাংবাদিকেরা ভালো জানেন। অন্যদিকে ইংলাক সিনাওয়াত্রার রূপ-সৌন্দর্য থেকে শুরু করে তাঁর বাবা-মা শুধু নন, নানা-নানি দাদা-দাদির সব খবরই আমাদের অজপাড়াগাঁর পাঠকটিও জানেন। পত্রপত্রিকা, রেডিও-টিভি প্রভৃতি প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিকল্প প্রচারমাধ্যম ইন্টারনেট, ব্লগ, টুইটার, ফেসবুক প্রভৃতি কী কী সব। একুশ শতককে কেউ যদি গণযোগাযোগের শতাব্দী বলে আখ্যায়িত করে, তাতে ভুল হবে না।
আজ কোনো দেশের সরকার যদি গোপনে কিছু করতে চায় এবং মনে করে যে তা আর কেউ জানবে না, তা হলে তা হবে কাচের ঘরের ভেতরে বসে অপকর্ম করার মতো। কাচের বাইরে থেকে যাদের চোখ আছে, তারা সবই দেখে ফেলবে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে মানুষের চোখ এখন দুটি নয়, অন্তত তিনটি। সংবাদমাধ্যমের মানুষের চোখ শুধু যে তিনটি তা-ই নয়—তাঁদের বিকল্প চোখও আছে। তা হলো নাক ও কান। বহু ঘটনার ঘ্রাণ তাঁরা নাক দিয়ে শুঁকেই জানতে পারেন, কোনো কোনো বিষয় তাঁদের কানের ভেতর দিয়ে মরমে গিয়ে ঢোকে।
আধুনিক সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যম রাজনীতিরই একটি বাহু বা শাখা। আমাদের মফস্বল শহর থেকে প্রকাশিত একটি কাগজের যেমন একটি রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য আছে, লন্ডন-নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র-সাময়িকীগুলোরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। বিবিসি, সিএনএন ও আল-জাজিরা শুধু সাংবাদিকতা করে না; রাজনীতিও করে। পশ্চিমের সাংবাদিকেরা তাঁদের দেশের নীতি-নির্ধারকদের স্বার্থের দিকটিও খেয়াল রাখেন, তাঁদের তা রাখতে বলা হোক বা না হোক। ১৯৭২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তা লক্ষ করেছি। পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমের সাংবাদিকদের অনেকেই পূর্ব বাংলার বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের পেছনে লেগে থাকতেন। কলকাতায় দেওয়া কী এক বক্তব্যে নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক সংবাদদাতা মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর সরকারের পতনই ঘটে এবং পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করা হয়।
এখন কেউ কেউ আওয়ামী লীগের প্রগাঢ় অনুরাগীতে পরিণত হয়েছেন, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কলম ছিল তীক্ষ তলোয়ারের মতো। মুজিব সরকারের পতন ঘটিয়ে তাঁদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকুলতা ছিল লেনিন ও মাও সে তুংয়ের চেয়ে বেশি। নিউজউইক, ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর প্রভৃতি যাঁদের বাড়িতে বাঁধাই করা আছে, তাঁরা দেখে নিতে পারেন। অন্যদিকে, জিয়াউর রহমানের সরকার যে তাঁর পূর্ববর্তী সরকারের চেয়ে ভালো—এ কথা পাঁচ বছরব্যাপী প্রচার করার মতো সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কোনো অভাবই ঘটেনি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত।
শতাব্দীর শেষ দশক দুটিতে বাংলাদেশের ইতিবাচক বা প্রশংসনীয় সংবাদ দৈবা ৎ পশ্চিমা মাধ্যমে দেখা গেছে। তবে এখন ইতালির প্রধানমন্ত্রী বেরলুসকোনি, বিশ্বব্যাংকের বরখাস্ত হওয়া কামুক নারীপাগল এমডি কিংবা ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট যেমন মুখরোচক সংবাদ শিরোনাম, আশির দশকে আমাদেরও নারীঘটিত অর্থা ৎ প্রেসিডেন্ট ও পুরুষঘটিত সংবাদ পশ্চিমা নামীদামি কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। সে খবর না পড়ে শুধু শুনেই আমাদের মন ভরেছে, কিন্তু হেঁট হয়েছে মাথা।
একটি হতভাগ্য জাতি একটু একটু করে তার অর্থনীতি শক্ত করছে, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূর করছে, গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়ে লড়াই করছে, ধর্মান্ধতা দূর করে একটি প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, সেসব নিয়ে লিখতেন না বিশেষ কেউ। একটু ভালো খবরের জন্য তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো চেয়ে থাকতাম। তিন মাসেও বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশি কাগজে কোনো সুখবর দেখতে পাইনি।
এখন যাঁরা কম্পিউটার ব্যবহার করেন, যাঁদের ইন্টারনেট আছে তাঁরা আমার চেয়ে হাজার গুণ বেশি দুনিয়ার খোঁজখবর রাখেন। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন প্রভৃতি আধুনিক যন্ত্র থেকে দূরে থাকতে গিয়ে এখন দেখছি সবার থেকে পিছিয়ে পড়েছি। তবে শতাব্দীর শেষ তিনটি দশক যে পরিবেশে আমি ছিলাম, তাতে দুনিয়ার হালহকিকত ভালোই জানা যেত। বার্তা সংস্থাগুলোর খবর ছাড়াও, পৃথিবীর বিখ্যাত সংবাদপত্র ও সাময়িকী পড়ার সুযোগ পেয়েছি। ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে হপ্তায় হপ্তায় লন্ডন টাইমস, টেলিগ্রাফ, দ্য ইকোনমিক টাইমস, গার্ডিয়ান প্রভৃতির বান্ডিল আসত অফিসে। তাতে ছয় মাসেও বাংলাদেশের নামগন্ধ খুঁজে পেতাম না।
ভারতীয় দৈনিকগুলোর মধ্যে আমি পঁচিশ বছর নিয়মিত পাঠ করেছি চেন্নাই থেকে প্রকাশিত দ্য হিন্দু এবং দিল্লির দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হারুন হাবীব ছিলেন হিন্দু ও ফ্রন্টলাইন সাময়িকীর বাংলাদেশ প্রতিনিধি। তাঁর কাছে প্রতিদিন হিন্দু আসত। আমরা একই ঘরে বসতাম। হারুনের কাগজ যেন আমারই কাগজ। ডাকপিয়ন দিয়ে যাওয়া মাত্র কখনো হারুন না পড়েই আমার দিকে ছুড়ে দিতেন। বাড়িতে এনেও পড়তাম খুঁটিয়ে। আমার আরেক বন্ধু-সহকর্মী জগ্লুল আহেমদ চৌধূরীর কাছে আসত টাইমস অব ইন্ডিয়া। তাঁর উদারতায় সেটিও হয়ে গিয়েছিল আমারই কাগজ। বাড়িতে এনে পড়তাম। হারুনের ফ্রন্টলাইনই বহু বছর পড়েছি। চাকরি ছাড়ার পর কিনে পাঠ করি, তবে অনিয়মিত। ইন্ডিয়া টুডেসহ ভারতের অন্য কাগজ অফিসে রাখা হতো।
বহু বছর কেরালার মালয়ালা মনোরমা গ্রুপের উইক সৌজন্য কপি পেতাম। আরও কোনো কোনো ভারতীয় ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক সাময়িকী মুফতে অর্থা ৎ সৌজন্য কপি পেতাম। ভারতের ওই সব পত্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে আমি অপরিশোধ্য ঋণের দায়ে আবদ্ধ। কোনো কাগজেরই আমি প্রতিনিধি ছিলাম না। একবার আমার বন্ধু পিটিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অচিন রায়ের মাধ্যমে সাগরময় ঘোষ আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ-এর সঙ্গে যুক্ত হতে প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন, আলস্যবশত আমি রাজি হইনি।
ভারতের বহু ইংরেজি দৈনিক ও সাময়িকী বিশ্বমানের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকার কাগজের চেয়ে চরিত্রে উন্নত বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। ফ্রন্টলাইন, উইক, ইন্ডিয়া টুডে খুবই উন্নত মানের কাগজ। ভাষাশৈলী, রচনার বিষয়বস্তু ও বস্তুনিষ্ঠতায় অত্যন্ত প্রগতিশীল। সত্তর-আশির দশকে ব্লিটজ, দ্য ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি পড়ে খুব ভালো লাগত। সত্তরের শুরুতে বামপন্থীদের ফ্রন্টিয়ার এবং নাউ মাঝে মাঝে পড়তাম। মিসেস গান্ধীর ইমার্জেন্সির পরে ওগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
শুরুতেই বলেছি, সব কাগজেরই একটা রাজনৈতিক নীতি থাকে—ডান, বাম, মধ্য, প্রগতিকামী ও প্রতিক্রিয়াশীল যা-ই হোক। স্বাধীন নিরপেক্ষ সংবাদপত্রগুলো কোনো না কোনো ধারাকে সমর্থন দেয়। বড় বড় শিল্পপতি বের করেন অথবা কিনে নেন বিভিন্ন কাগজ। তাঁদেরও রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে। বিড়লাদের হিন্দুস্তান টাইমস, গান্ধী পরিবারের দ্য ন্যাশনাল হেরাল্ড, গোয়েঙ্কাদের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শে অন্যদের মিলবে না। অনেক সময় বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থায় কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের সমস্যায় পড়তে হয়। ইমার্জেন্সির সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধীকে জড়িয়ে এক অসৌজন্যমূলক প্রতিবেদন ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে লিখে লরেন্স লিফশুলজ ভারত থেকে বহিষ্কৃত হন। ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসি বিতাড়িত হয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে স্বাধীনতার পর।
মনে হতে পারে পশ্চিমারা অতি বস্তুনিষ্ঠ এবং সত্য থেকে তাঁদের একচুল নড়চড় নেই। কিন্তু অনেক সময় আমার মনে হয়েছে তাঁদের বস্তুনিষ্ঠতা এমন যে সংবাদের প্রাণটি নয়, বস্তুটিই তাঁদের কাছে প্রধান। তাঁরা যে কোন জিনিসটিকে খবর মনে করেন, তা তাঁরাই ভালো জানেন। বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে যান জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। রয়টার্সের সাংঘাতিক সাংবাদিক তাঁর পৌঁছার সংবাদ পৃথিবীর মানুষকে জানালেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে তাজা মাছ, সরু চাল প্রভৃতি তাঁর প্লেনে নিয়ে এসেছেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও অন্যান্য কাজে হিমশিম খাচ্ছেন, সেসব ব্যাপারে সহানুভূতিমূলক কোনো কথা রিপোর্টে নেই। তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন মিজানুর রহমান। তাঁর সঙ্গে প্রতিদিন ফোনে আমাদের কথা হতো, তাঁকে আমি বিষয়টি জানাই এবং অনুরোধ করি, তিনি যেন ওই সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেন, খবরের ওই অংশটির মূল্য কোথায়?
পশ্চিমা সাংবাদিকদের রচিত প্রতিবেদনের মূল ঘটনাটিই সব নয়, তার সঙ্গে যে চাটনিটুকু থাকে, তার তা ৎ পর্যই সবচেয়ে বেশি। ঘটনা যে ঘটছে তার কুশীলব বা চরিত্র কে বা কারা। তাদের বসবাস এশিয়ায় না ইউরোপে। তাঁরা কোন ধর্মের অনুসারী প্রভৃতি। একটি ক্লাসিক উদাহরণ দিয়ে আমি পশ্চিমের বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রসঙ্গ শেষ করব। ২০০৬-এর সেপ্টেম্বরে সাইয়ুজ টিএমএ-৮ নভোযানে ইরানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান আনুশেহ্ আনসারী এগারো দিন মহাশূন্যে কাটান। প্রাইভেট নভোচারীর মধ্যে তিনিই প্রথম নারী। তাঁকে বহনকারী নভোযানটি যখন ভূমি থেকে উ ৎ ক্ষিপ্ত হয়, তখন দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাঁর ফুফু অথবা খালা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করছিলেন: আল্লাহ, তুমি আনুশেহেক হেফাজত করো। মুসলিম নারী ভয়ে কাঁদছেন, সে কথাও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ হিসেবে প্রচার করা হয়। মহাকাশে যে মুসলিম নারী গেছেন, তাঁর সাহসের চেয়ে যিনি মাটিতে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁদলেন, সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি ইকোনমিস্ট সাময়িকীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটি সংখ্যায় বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দশ-বারো বছর আগে ইকোনমিস্ট-এ দুরবিন দিয়েও বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যেত না। ২০০২-৩ থেকে তাঁরা ঘন ঘন বাংলাদেশ ও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে লেখালেখি করছেন। ইকোনমিস্ট অত্যন্ত উন্নত মানের একটি সাময়িকী। খুবই গবেষণা করে তাঁরা লেখেন। তাঁদের সম্পাদকীয়, বিশ্বরাজনীতির পর্যবেক্ষণমূলক নিবন্ধ এবং অবিচুয়ারি বা কীর্তিমান মানুষদের মৃত্যুসংবাদ অতি সুলিখিত ও জ্ঞানগর্ভ। খালেদা জিয়ার জোট সরকারের সময় থেকে বাংলাদেশের ওপর তাদের নজর পড়েছে। চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন সম্পর্কেও তাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করে নিবন্ধ ছেপেছেন। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বামদের ভরাডুবি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা তাঁদের নিবন্ধে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের পর্যবেক্ষণ মোটামুটি নির্ভুল ও তথ্যনির্ভর।
বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রতিবেদনে সরকার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে প্রতিবাদ করেছে। অত দীর্ঘ প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল না। আট-নয়টি বাক্যে শ খানেক শব্দে প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ জানানো যেত। বিদেশের কোন কাগজে কী লিখল, তাতে উ ৎ ফুল্ল অথবা মূর্ছিত না হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ওই রিপোর্টে যদি কোনো বিব্রতকর তথ্য বা অপ্রীতিকর সত্য থেকে থাকে, তা নিয়ে উচ্চবাচ্য না করলেই ভালো হতো। বিব্রতকর তথ্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে যাদের কিছুটা সন্দেহ ছিল, তারাও সত্য বলে ধরে নিতে পারে। যেসব কথা বলা হয়েছে, তা বাংলাদেশের বাতাসে ভাসে। যার খুশি সে তা বিশ্বাস করতে পারে, যার খুশি সে অবিশ্বাসও করতে পারে। সরকারের বিচলিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
কোনো বিরূপ ও বিদ্বিষ্ট সমালোচনার সবচেয়ে সাবলীল ও কার্যকর জবাব হচ্ছে নিজের দিক থেকে সঠিক থাকা এবং নিজের প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরা। আস্তিন গুটিয়ে ঝগড়া করতে গেলে নিজের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটে। ইকোনমিস্ট-এর রিপোর্টে ক্ষতি যেটুকু হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন সরকারের দিক থেকে নিজেদের সংশোধন করার কোনো সুযোগ আছে কি না, তা ভেবে দেখা উচিত। কোনো বিদেশি পত্রিকার কথায় বাংলাদেশের মানুষের জনমত গড়ে উঠবে না। বাংলার মানুষের অনুভূতি খুবই তীক্ষ। ওই সব প্রতিবেদনে যদি তাদের অনুভূতির প্রকাশ ঘটে থাকে, তাহলে ওই পত্রিকা ও বাংলাদেশের জনগণকে দোষ দেওয়া যাবে না।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি কথা সবিনয়ে বলতে চাই। ওই রিপোর্টে যা ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে ইকোনমিস্টকে হুমকি ও ধমক দেওয়ায়। ধমকে ঘাবড়ানোর পাত্র তারা নয়। তাদের খুঁটির জোর অতি শক্ত। ইকোনমিস্টকে অন্য কোনো শোভন ভাষায় আমরা নিন্দা করতে পারতাম। তারা জঙ্গিবাদ, মাদক ও অস্ত্র বিক্রির অর্থ খেয়ে প্রতিবেদন করেছে—এই অভিযোগ আমাদের সরকারের জন্য গুরুতর আত্মঘাতী হয়েছে।
এখন আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমকে অবহেলা করা সম্ভব নয়। তাদের পেছনে রয়েছে দাতাগোষ্ঠী। তারা বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্যাঁচ কষে। জোট সরকার এক প্যাঁচে পড়ে গিয়েছিল, মহাজোট সরকার ডবল প্যাঁচে পড়লে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটবে। তাই বিদেশি সাংবাদিক ও আমাদের নেতাদের কাছে সংযত ও ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ প্রত্যাশা করি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে দুনিয়ার কোনো খবরই আজ আর গোপন থাকছে না। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বা শায়েস্তা খাঁর রাজত্বের খবর শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ডের রাজারা জানতেন না। এখন বাংলাদেশে কী ঘটছে, তা ব্যাংককের সাংবাদিকেরা ভালো জানেন। অন্যদিকে ইংলাক সিনাওয়াত্রার রূপ-সৌন্দর্য থেকে শুরু করে তাঁর বাবা-মা শুধু নন, নানা-নানি দাদা-দাদির সব খবরই আমাদের অজপাড়াগাঁর পাঠকটিও জানেন। পত্রপত্রিকা, রেডিও-টিভি প্রভৃতি প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিকল্প প্রচারমাধ্যম ইন্টারনেট, ব্লগ, টুইটার, ফেসবুক প্রভৃতি কী কী সব। একুশ শতককে কেউ যদি গণযোগাযোগের শতাব্দী বলে আখ্যায়িত করে, তাতে ভুল হবে না।
আজ কোনো দেশের সরকার যদি গোপনে কিছু করতে চায় এবং মনে করে যে তা আর কেউ জানবে না, তা হলে তা হবে কাচের ঘরের ভেতরে বসে অপকর্ম করার মতো। কাচের বাইরে থেকে যাদের চোখ আছে, তারা সবই দেখে ফেলবে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে মানুষের চোখ এখন দুটি নয়, অন্তত তিনটি। সংবাদমাধ্যমের মানুষের চোখ শুধু যে তিনটি তা-ই নয়—তাঁদের বিকল্প চোখও আছে। তা হলো নাক ও কান। বহু ঘটনার ঘ্রাণ তাঁরা নাক দিয়ে শুঁকেই জানতে পারেন, কোনো কোনো বিষয় তাঁদের কানের ভেতর দিয়ে মরমে গিয়ে ঢোকে।
আধুনিক সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যম রাজনীতিরই একটি বাহু বা শাখা। আমাদের মফস্বল শহর থেকে প্রকাশিত একটি কাগজের যেমন একটি রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য আছে, লন্ডন-নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র-সাময়িকীগুলোরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। বিবিসি, সিএনএন ও আল-জাজিরা শুধু সাংবাদিকতা করে না; রাজনীতিও করে। পশ্চিমের সাংবাদিকেরা তাঁদের দেশের নীতি-নির্ধারকদের স্বার্থের দিকটিও খেয়াল রাখেন, তাঁদের তা রাখতে বলা হোক বা না হোক। ১৯৭২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তা লক্ষ করেছি। পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমের সাংবাদিকদের অনেকেই পূর্ব বাংলার বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের পেছনে লেগে থাকতেন। কলকাতায় দেওয়া কী এক বক্তব্যে নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক সংবাদদাতা মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর সরকারের পতনই ঘটে এবং পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করা হয়।
এখন কেউ কেউ আওয়ামী লীগের প্রগাঢ় অনুরাগীতে পরিণত হয়েছেন, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কলম ছিল তীক্ষ তলোয়ারের মতো। মুজিব সরকারের পতন ঘটিয়ে তাঁদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকুলতা ছিল লেনিন ও মাও সে তুংয়ের চেয়ে বেশি। নিউজউইক, ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর প্রভৃতি যাঁদের বাড়িতে বাঁধাই করা আছে, তাঁরা দেখে নিতে পারেন। অন্যদিকে, জিয়াউর রহমানের সরকার যে তাঁর পূর্ববর্তী সরকারের চেয়ে ভালো—এ কথা পাঁচ বছরব্যাপী প্রচার করার মতো সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কোনো অভাবই ঘটেনি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত।
শতাব্দীর শেষ দশক দুটিতে বাংলাদেশের ইতিবাচক বা প্রশংসনীয় সংবাদ দৈবা ৎ পশ্চিমা মাধ্যমে দেখা গেছে। তবে এখন ইতালির প্রধানমন্ত্রী বেরলুসকোনি, বিশ্বব্যাংকের বরখাস্ত হওয়া কামুক নারীপাগল এমডি কিংবা ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট যেমন মুখরোচক সংবাদ শিরোনাম, আশির দশকে আমাদেরও নারীঘটিত অর্থা ৎ প্রেসিডেন্ট ও পুরুষঘটিত সংবাদ পশ্চিমা নামীদামি কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। সে খবর না পড়ে শুধু শুনেই আমাদের মন ভরেছে, কিন্তু হেঁট হয়েছে মাথা।
একটি হতভাগ্য জাতি একটু একটু করে তার অর্থনীতি শক্ত করছে, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূর করছে, গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়ে লড়াই করছে, ধর্মান্ধতা দূর করে একটি প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, সেসব নিয়ে লিখতেন না বিশেষ কেউ। একটু ভালো খবরের জন্য তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো চেয়ে থাকতাম। তিন মাসেও বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশি কাগজে কোনো সুখবর দেখতে পাইনি।
এখন যাঁরা কম্পিউটার ব্যবহার করেন, যাঁদের ইন্টারনেট আছে তাঁরা আমার চেয়ে হাজার গুণ বেশি দুনিয়ার খোঁজখবর রাখেন। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন প্রভৃতি আধুনিক যন্ত্র থেকে দূরে থাকতে গিয়ে এখন দেখছি সবার থেকে পিছিয়ে পড়েছি। তবে শতাব্দীর শেষ তিনটি দশক যে পরিবেশে আমি ছিলাম, তাতে দুনিয়ার হালহকিকত ভালোই জানা যেত। বার্তা সংস্থাগুলোর খবর ছাড়াও, পৃথিবীর বিখ্যাত সংবাদপত্র ও সাময়িকী পড়ার সুযোগ পেয়েছি। ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে হপ্তায় হপ্তায় লন্ডন টাইমস, টেলিগ্রাফ, দ্য ইকোনমিক টাইমস, গার্ডিয়ান প্রভৃতির বান্ডিল আসত অফিসে। তাতে ছয় মাসেও বাংলাদেশের নামগন্ধ খুঁজে পেতাম না।
ভারতীয় দৈনিকগুলোর মধ্যে আমি পঁচিশ বছর নিয়মিত পাঠ করেছি চেন্নাই থেকে প্রকাশিত দ্য হিন্দু এবং দিল্লির দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হারুন হাবীব ছিলেন হিন্দু ও ফ্রন্টলাইন সাময়িকীর বাংলাদেশ প্রতিনিধি। তাঁর কাছে প্রতিদিন হিন্দু আসত। আমরা একই ঘরে বসতাম। হারুনের কাগজ যেন আমারই কাগজ। ডাকপিয়ন দিয়ে যাওয়া মাত্র কখনো হারুন না পড়েই আমার দিকে ছুড়ে দিতেন। বাড়িতে এনেও পড়তাম খুঁটিয়ে। আমার আরেক বন্ধু-সহকর্মী জগ্লুল আহেমদ চৌধূরীর কাছে আসত টাইমস অব ইন্ডিয়া। তাঁর উদারতায় সেটিও হয়ে গিয়েছিল আমারই কাগজ। বাড়িতে এনে পড়তাম। হারুনের ফ্রন্টলাইনই বহু বছর পড়েছি। চাকরি ছাড়ার পর কিনে পাঠ করি, তবে অনিয়মিত। ইন্ডিয়া টুডেসহ ভারতের অন্য কাগজ অফিসে রাখা হতো।
বহু বছর কেরালার মালয়ালা মনোরমা গ্রুপের উইক সৌজন্য কপি পেতাম। আরও কোনো কোনো ভারতীয় ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক সাময়িকী মুফতে অর্থা ৎ সৌজন্য কপি পেতাম। ভারতের ওই সব পত্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে আমি অপরিশোধ্য ঋণের দায়ে আবদ্ধ। কোনো কাগজেরই আমি প্রতিনিধি ছিলাম না। একবার আমার বন্ধু পিটিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অচিন রায়ের মাধ্যমে সাগরময় ঘোষ আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ-এর সঙ্গে যুক্ত হতে প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন, আলস্যবশত আমি রাজি হইনি।
ভারতের বহু ইংরেজি দৈনিক ও সাময়িকী বিশ্বমানের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকার কাগজের চেয়ে চরিত্রে উন্নত বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। ফ্রন্টলাইন, উইক, ইন্ডিয়া টুডে খুবই উন্নত মানের কাগজ। ভাষাশৈলী, রচনার বিষয়বস্তু ও বস্তুনিষ্ঠতায় অত্যন্ত প্রগতিশীল। সত্তর-আশির দশকে ব্লিটজ, দ্য ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি পড়ে খুব ভালো লাগত। সত্তরের শুরুতে বামপন্থীদের ফ্রন্টিয়ার এবং নাউ মাঝে মাঝে পড়তাম। মিসেস গান্ধীর ইমার্জেন্সির পরে ওগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
শুরুতেই বলেছি, সব কাগজেরই একটা রাজনৈতিক নীতি থাকে—ডান, বাম, মধ্য, প্রগতিকামী ও প্রতিক্রিয়াশীল যা-ই হোক। স্বাধীন নিরপেক্ষ সংবাদপত্রগুলো কোনো না কোনো ধারাকে সমর্থন দেয়। বড় বড় শিল্পপতি বের করেন অথবা কিনে নেন বিভিন্ন কাগজ। তাঁদেরও রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে। বিড়লাদের হিন্দুস্তান টাইমস, গান্ধী পরিবারের দ্য ন্যাশনাল হেরাল্ড, গোয়েঙ্কাদের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শে অন্যদের মিলবে না। অনেক সময় বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থায় কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের সমস্যায় পড়তে হয়। ইমার্জেন্সির সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধীকে জড়িয়ে এক অসৌজন্যমূলক প্রতিবেদন ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে লিখে লরেন্স লিফশুলজ ভারত থেকে বহিষ্কৃত হন। ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসি বিতাড়িত হয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে স্বাধীনতার পর।
মনে হতে পারে পশ্চিমারা অতি বস্তুনিষ্ঠ এবং সত্য থেকে তাঁদের একচুল নড়চড় নেই। কিন্তু অনেক সময় আমার মনে হয়েছে তাঁদের বস্তুনিষ্ঠতা এমন যে সংবাদের প্রাণটি নয়, বস্তুটিই তাঁদের কাছে প্রধান। তাঁরা যে কোন জিনিসটিকে খবর মনে করেন, তা তাঁরাই ভালো জানেন। বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে যান জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। রয়টার্সের সাংঘাতিক সাংবাদিক তাঁর পৌঁছার সংবাদ পৃথিবীর মানুষকে জানালেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে তাজা মাছ, সরু চাল প্রভৃতি তাঁর প্লেনে নিয়ে এসেছেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও অন্যান্য কাজে হিমশিম খাচ্ছেন, সেসব ব্যাপারে সহানুভূতিমূলক কোনো কথা রিপোর্টে নেই। তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন মিজানুর রহমান। তাঁর সঙ্গে প্রতিদিন ফোনে আমাদের কথা হতো, তাঁকে আমি বিষয়টি জানাই এবং অনুরোধ করি, তিনি যেন ওই সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেন, খবরের ওই অংশটির মূল্য কোথায়?
পশ্চিমা সাংবাদিকদের রচিত প্রতিবেদনের মূল ঘটনাটিই সব নয়, তার সঙ্গে যে চাটনিটুকু থাকে, তার তা ৎ পর্যই সবচেয়ে বেশি। ঘটনা যে ঘটছে তার কুশীলব বা চরিত্র কে বা কারা। তাদের বসবাস এশিয়ায় না ইউরোপে। তাঁরা কোন ধর্মের অনুসারী প্রভৃতি। একটি ক্লাসিক উদাহরণ দিয়ে আমি পশ্চিমের বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রসঙ্গ শেষ করব। ২০০৬-এর সেপ্টেম্বরে সাইয়ুজ টিএমএ-৮ নভোযানে ইরানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান আনুশেহ্ আনসারী এগারো দিন মহাশূন্যে কাটান। প্রাইভেট নভোচারীর মধ্যে তিনিই প্রথম নারী। তাঁকে বহনকারী নভোযানটি যখন ভূমি থেকে উ ৎ ক্ষিপ্ত হয়, তখন দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাঁর ফুফু অথবা খালা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করছিলেন: আল্লাহ, তুমি আনুশেহেক হেফাজত করো। মুসলিম নারী ভয়ে কাঁদছেন, সে কথাও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ হিসেবে প্রচার করা হয়। মহাকাশে যে মুসলিম নারী গেছেন, তাঁর সাহসের চেয়ে যিনি মাটিতে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁদলেন, সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি ইকোনমিস্ট সাময়িকীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটি সংখ্যায় বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দশ-বারো বছর আগে ইকোনমিস্ট-এ দুরবিন দিয়েও বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যেত না। ২০০২-৩ থেকে তাঁরা ঘন ঘন বাংলাদেশ ও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে লেখালেখি করছেন। ইকোনমিস্ট অত্যন্ত উন্নত মানের একটি সাময়িকী। খুবই গবেষণা করে তাঁরা লেখেন। তাঁদের সম্পাদকীয়, বিশ্বরাজনীতির পর্যবেক্ষণমূলক নিবন্ধ এবং অবিচুয়ারি বা কীর্তিমান মানুষদের মৃত্যুসংবাদ অতি সুলিখিত ও জ্ঞানগর্ভ। খালেদা জিয়ার জোট সরকারের সময় থেকে বাংলাদেশের ওপর তাদের নজর পড়েছে। চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন সম্পর্কেও তাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করে নিবন্ধ ছেপেছেন। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বামদের ভরাডুবি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা তাঁদের নিবন্ধে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের পর্যবেক্ষণ মোটামুটি নির্ভুল ও তথ্যনির্ভর।
বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রতিবেদনে সরকার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে প্রতিবাদ করেছে। অত দীর্ঘ প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল না। আট-নয়টি বাক্যে শ খানেক শব্দে প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ জানানো যেত। বিদেশের কোন কাগজে কী লিখল, তাতে উ ৎ ফুল্ল অথবা মূর্ছিত না হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ওই রিপোর্টে যদি কোনো বিব্রতকর তথ্য বা অপ্রীতিকর সত্য থেকে থাকে, তা নিয়ে উচ্চবাচ্য না করলেই ভালো হতো। বিব্রতকর তথ্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে যাদের কিছুটা সন্দেহ ছিল, তারাও সত্য বলে ধরে নিতে পারে। যেসব কথা বলা হয়েছে, তা বাংলাদেশের বাতাসে ভাসে। যার খুশি সে তা বিশ্বাস করতে পারে, যার খুশি সে অবিশ্বাসও করতে পারে। সরকারের বিচলিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
কোনো বিরূপ ও বিদ্বিষ্ট সমালোচনার সবচেয়ে সাবলীল ও কার্যকর জবাব হচ্ছে নিজের দিক থেকে সঠিক থাকা এবং নিজের প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরা। আস্তিন গুটিয়ে ঝগড়া করতে গেলে নিজের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটে। ইকোনমিস্ট-এর রিপোর্টে ক্ষতি যেটুকু হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন সরকারের দিক থেকে নিজেদের সংশোধন করার কোনো সুযোগ আছে কি না, তা ভেবে দেখা উচিত। কোনো বিদেশি পত্রিকার কথায় বাংলাদেশের মানুষের জনমত গড়ে উঠবে না। বাংলার মানুষের অনুভূতি খুবই তীক্ষ। ওই সব প্রতিবেদনে যদি তাদের অনুভূতির প্রকাশ ঘটে থাকে, তাহলে ওই পত্রিকা ও বাংলাদেশের জনগণকে দোষ দেওয়া যাবে না।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি কথা সবিনয়ে বলতে চাই। ওই রিপোর্টে যা ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে ইকোনমিস্টকে হুমকি ও ধমক দেওয়ায়। ধমকে ঘাবড়ানোর পাত্র তারা নয়। তাদের খুঁটির জোর অতি শক্ত। ইকোনমিস্টকে অন্য কোনো শোভন ভাষায় আমরা নিন্দা করতে পারতাম। তারা জঙ্গিবাদ, মাদক ও অস্ত্র বিক্রির অর্থ খেয়ে প্রতিবেদন করেছে—এই অভিযোগ আমাদের সরকারের জন্য গুরুতর আত্মঘাতী হয়েছে।
এখন আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমকে অবহেলা করা সম্ভব নয়। তাদের পেছনে রয়েছে দাতাগোষ্ঠী। তারা বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্যাঁচ কষে। জোট সরকার এক প্যাঁচে পড়ে গিয়েছিল, মহাজোট সরকার ডবল প্যাঁচে পড়লে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটবে। তাই বিদেশি সাংবাদিক ও আমাদের নেতাদের কাছে সংযত ও ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ প্রত্যাশা করি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments