কাল রঙ্গ-'হেক্কানি' ব্যাপারস্যাপার! by হিলাল ফয়েজী
এই নশ্বর জীবনে অবিনশ্বর ধমকানি-মটকানি-মলানি খেয়েছি প্রচুর সেই বাল্যবেলা থেকেই। বাপরে বাপ বাপহুজুর, জননী গরীয়সী-গর্জিনী, বৃংহতি-উৎপাদক বৃহৎ ভ্রাতা, নানা ধরনের উটকো-চিকনো-মুটকো গার্জেনরা মিলেমিশে জীবনের স্বপ্নময় শৈশবটাকে বুঝি দুঃস্বপ্নের শবদেহে পরিণত করেই ছেড়েছিলেন। এদিকে এই জিন্দেগিতে ধাক্কানিও কম জোটেনি।
ঘটনাক্রমে একটি জাতীয় সংগঠনের প্রধান দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ও হায়রে মিছিলে এমনকি নিবেদিত সাথি বাম-কমরেডদের কনুই-কনি্নতেও কম বিব্রত হইনি। সবাই আগে যেতে চায়। অতএব, অন্যকে মোক্ষম ধাক্কায় কুপোকাত করতে হবে বৈকি! জীবনের উদয়াচলের সেসব কাহিনী-বচন বয়ান নিয়ে নব-মহাভারত রচনা মোটেও কঠিন কিছু নয়। কিন্তু অস্তাচলের এ বেলায় এসেও যে অবশেষে এমন 'হেক্কানি' ভক্ষণ করব, তা কদাচ-কভু ভাবিনি। এই 'হেক্কানি কা কাহানি' নিয়েই আজকের কালরঙ্গ।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিকালে আমরা যারা বঙ্গমর্ত্যে ইহকাল-গর্তে আবির্ভূত হয়েছি, এই জমিনে জনজীবনে ট্রানজিস্টর-রেডিওর চল হয়েছে তারও পরে। ১৯৬৪ সালে জীবনে প্রথম কাউকে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে যেদিন বাধ্য হলাম সদরঘাটের বড় পোস্টাপিসে, বাবাগো বাবা, মাগো মা, সেই যে ম্যালেরিয়া-কাঁপুনি শুরু হয়েছিল, বুঝি বা ভূমিকম্পে ভবসংসার যায় যায় ছারখার!
আর এখন ২০১২ খিস্টাব্দ। মাত্র অর্ধশতাব্দী। এই সময়কালেই নিত্যদিনের জীবনে প্রযুক্তির যে প্রমত্ত টর্নেডো-ঘূর্ণিনাচন, এই গরিবি অর্থনীতির বঙ্গীয় প্রাঙ্গণেও কী যে তুমুল তোলপাড়, মানবসভ্যতায় এমন হারে ব্যাপারটা আর কখনোই ঘটেনি। হাতের মুঠোয় পৃথিবী। স্বদেশির মৃত্যুসংবাদ শুনি প্রবাসীর মুঠোফোন থেকে। যেকোনো খবর মুহূর্তে জানতে পারি ইন্টারনেটের ধরিত্রী-ভাণ্ডার থেকে। হতদরিদ্র বঙ্গবাসীর হাতে হাতে মোবাইল নামক সদা বকবক অবিরাম টকশো। নব হরমোন বয়ঃসন্ধিক্ষণ নিত্য বাকুমবাকুম। খুদে বার্তার বিশাল ভুবন-বাঁধন। বহুজাতিক মায়াজালে বন্দি জাতীয় গণজাগরণ-গণসংগীত আর মহান একুশের সব মহিমা। প্রযুক্তির বিপণন-বিজ্ঞাপন বচন-বদন-নৃত্যবিভঙ্গ এখন ছোট্ট শিশুর, বুড়ো-বুড়িরও চোখের চুইংগাম। ব্যক্তিগত ব্লগ খোলেন একদা কম্পিউটারবিমুখ প্রকাণ্ড বাম নেতারাও। উপহার পান আইফোন-ব্ল্যাকবেরি কালোজাম। পর্দাছোঁয়া একি অপরূপ নরম টাচ স্ক্রিন। আজ থেকে শতবর্ষ পরে রবীন্দ্রনাথ ও শেকসপিয়র একযোগে ভুবন সফরে এলে যখন যুগপৎ ভিরমি খেয়ে পড়বেন অভাবনীয় প্রযুক্তি-মহাতাণ্ডবে, তখন যেন জরুরি চিকিৎসার মহাজরুরি আয়োজন থাকে হে অনাগত মর্ত্যবাসী!
আজকের কাহিনী বলব বলেই তো এতক্ষণ এত শত কথা বলা। আজন্ম জাগতিক বোকাসোকা হিসেবে এই হিলাল ফয়েজী মানব প্রাণীটির প্রসিদ্ধি স্বীয় বৃত্তে কম নয়। তারও একটি চালু ই-মেইল ঠিকানা আছে। অলস জীবটি ঘরে বসে বসে প্রায় পঞ্চসহস্র ঠিকানায় নিত্য-নিয়ত পত্র চালাচালি করে থাকে নানা উসিলায়। লোকটির বিশাল টাক থাকলেও টাকার ভাঁড়ার অশেষ বাড়ন্ত। তবুও সে জুয়াড়ির মতো এসব বেহিসাবি ভার্চুয়াল নেশায় মত্ত বহুকাল ধরে। অতএব, ই-মেইলের নানা কীর্তিকাণ্ড তারও কম জানা নয়।
যেমন- আফ্রিকাসহ সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যে যত একনায়কের পতন ঘটে, অমনি সেসব রাজত্বের অনেক ব্যাংকের বেনামি শত কোটি ডলারের মালপানি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য আপনাকে লোভনীয় পার্টনার হওয়ার হাতছানির মেইল পাঠানো হবে অজানা প্রান্তর থেকে। বঙ্গদেশি বদমাইশি শেয়ারবাজারে হঠাৎ টংকরাজ হওয়ার জন্য পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার আহাম্মক বীরপুরুষ তো কম দেখি না। দ্বিগুণ-ত্রিগুণ মুনাফা দেওয়ার হায় হায় কম্পানির পেছনেও ছুটে বঙ্গীয় বেকুব পঙ্গপাল। অজানা ই-মেইলের প্রস্তাবিত ব্যবসায়ী অংশীদার হওয়ার মায়াবি ফাঁদে আটকে যাওয়ার পুঙ্গবও নিশ্চয়ই এখানে কম নেই। যেই ফাঁদে ধরা দিলেন, অমনি খসিয়ে নেওয়ার কৌশলে কুপোকাৎ করে দেওয়া হবে আপনাকে। এ ছাড়া আপনার 'শরীরী তাগদ' পুনরুজ্জীবিত করে দেওয়ারও কত যে দাওয়াই-দাওয়াতের নিত্য স্পাম ই-মেইল। আরেকটি আছে সেমিনার-ফাঁদ। মার্কিনি বেহেশতি দেশে সেমিনারের প্রথম অংশ এবং গরিব কোনো দেশে দ্বিতীয় অংশ... এমন বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে আপনাকে আমন্ত্রণের দে দোল দে দোল দুলুনি-ভুলুনি। অবশেষে কায়দা করে পকেট কর্তন-শুলুনি! এসব ইত্যাকার ফাঁদ অবশ্য সময়ে অকেজো হয়ে যায়। ঠগিরা নবফাঁদের আয়োজন গড়ে।
বছর দেড়-দুয়েক ধরে এমনি এক ফাঁদ চলছে, যার নাম দেওয়া যেতে পারে 'হেক্কানি'! পরিচিত কয়েকজনকে কেন্দ্র করে এমনি ফাঁদে পড়েছি কয়েকবার। যেমন- আমার একজন ঘনিষ্ঠ কেউ বিদেশে-বিভুঁইয়ে বিপাকে পড়ে গেছেন হঠাৎ, সব কিছু হারিয়ে হায় হায় অসহায়, একমাত্র ই-মেইল যোগাযোগই সম্বল, তাকে অবিলম্বে দেশে ফেরার প্রয়োজনে পাঠাতে হবে নির্দিষ্ট ঠিকানায় কয়েক হাজার ডলার। প্রথমবার তো বেশ ঘাবড়ে চমকে খোঁজ নিয়ে দেখি বন্ধুবর খোশমেজাজে স্বদেশেই আছেন। শুধু ঘটেছে একখান হেক্কানি কাহিনী। প্রযুক্তির এ যুগে প্রবল মেধাবী ছাওয়াল-ছাওয়ালিরা ই-মেইল আর ওয়েবসাইট 'হ্যাক' করার কুশাগ্র বুদ্ধি ব্যবহার করে এক নব 'হেক্কানি' যুগপর্ব সূচিত করেছে। আপনার ই-মেইলের পাসওয়ার্ড ডাকাতি করে সব ঠিকানা টুকে ঠুকে দিল আপনারই ই-মেইল থেকে আপনার নামে অমন সকরুণ আর্তনাদ। কয়েক দিন আগে এই আমারই ই-মেইল থেকে আমারই নামে পৃথিবীময় আমারই পঞ্চসহস্র ঠিকানায় অনেক আপনজনের কাছেই ছড়িয়ে পড়ল এমন অসহায় আহাজারির আর্তনাদ- বিলেতে হঠাৎ সফরে এসে আমার সবই গেছে, শুধু পাসপোর্টখানি আছে, ওগো কে কোথায় আছ হে আপনজন, পাঠিয়ে দাও অতি তাড়াতাড়ি আড়াই হাজার ডলার, দেশে ফিরেই শোধ দেব। তার পরই শুরু হলো পরবর্তী রুপালি পর্দার অধ্যায়।
এই জগতে সাতসমুদ্র তের নদীজুড়ে এই অকম্মা-অথর্ব-অযোগ্যের যে এত আপনজন আছে, এই হেক্কানি-ঠেক্কানির আগে এমনভাবে তা বুঝিনি। যারা 'হেক্কানি' বিষয়ে আগে থেকেই জানেন, তাঁরা তাড়াতাড়ি পাসওয়ার্ড বদলে ফেলার পরামর্শে ভরপুর করে দিলেন। বিলেতে নিজ নিজ স্বজনের কাছে অনেকে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার বার্তা পাঠিয়ে দিলেন। অনেকে আমার মোবাইলফোনে অনুমানে ফোন দিয়ে দেখলেন আমি যে এখানে স্বভূমে, স্বদেশে, বহাল মহালে-মহলে, সদলে সবলে। অকল্যান্ডে আমার 'অকওয়ার্ড' অবস্থার কথা জেনে শ্যালক ও শ্যালকপত্নী তো আকুল এবং ব্যাকুল। টরেন্টো থেকে আইটি বিশেষজ্ঞ ভাগ্নে তো ড্যামেজ কন্ট্রোল এক কাঁদি পরামর্শ-কদলি পাঠিয়ে দিলেন।
১৯৮৫ সালে কিউবার হাভানায় পশ্চিম বাংলার (আদি উৎস-বরিশাল) এক মেয়ে বাসবী বসু মজুমদারের 'হিলাল দা' বনে গেলাম। সেই বোনটি এখন স্প্যানিশ ভাষা শেখান দিলি্লর কাছে এক বিশ্ব মানের বিদ্যালয়ে। স্বীয় ই-মেইলে এমনি সকাতর সানুনয় এসওএস দেখে বঙ্গদেশি ভ্রাতা হিলাল দাকে উদ্ধারকল্পে বাসবী বানু তো ভাইবোন মিলে একদিনে লাখো রুপির তহবিল গড়ে ফেলল। পরে ঢাকায় ফোন করে হেক্কানিবিষয়ক ব্যাপারস্যাপার জেনে বেচারিদের আক্কেল গোলন্দাজ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলার মতো গুড়ুমগুড়ুম করে উঠল।
একদিকে এমন সহানুভূতির ঢল দেখে আবেগে আঁখি টলটল করে উঠল। অন্যদিকে শংকার ডংকা বেজে উঠল হৃদি-মাঝারে। এরপর সত্যি সত্যিই যদি 'একদিন বাঘ আসিয়া পড়ে' তাহলে এই বুড়ো রাখাল বালকটির কী দশা হবে গো!
লেখক : রম্য লেখক
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিকালে আমরা যারা বঙ্গমর্ত্যে ইহকাল-গর্তে আবির্ভূত হয়েছি, এই জমিনে জনজীবনে ট্রানজিস্টর-রেডিওর চল হয়েছে তারও পরে। ১৯৬৪ সালে জীবনে প্রথম কাউকে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে যেদিন বাধ্য হলাম সদরঘাটের বড় পোস্টাপিসে, বাবাগো বাবা, মাগো মা, সেই যে ম্যালেরিয়া-কাঁপুনি শুরু হয়েছিল, বুঝি বা ভূমিকম্পে ভবসংসার যায় যায় ছারখার!
আর এখন ২০১২ খিস্টাব্দ। মাত্র অর্ধশতাব্দী। এই সময়কালেই নিত্যদিনের জীবনে প্রযুক্তির যে প্রমত্ত টর্নেডো-ঘূর্ণিনাচন, এই গরিবি অর্থনীতির বঙ্গীয় প্রাঙ্গণেও কী যে তুমুল তোলপাড়, মানবসভ্যতায় এমন হারে ব্যাপারটা আর কখনোই ঘটেনি। হাতের মুঠোয় পৃথিবী। স্বদেশির মৃত্যুসংবাদ শুনি প্রবাসীর মুঠোফোন থেকে। যেকোনো খবর মুহূর্তে জানতে পারি ইন্টারনেটের ধরিত্রী-ভাণ্ডার থেকে। হতদরিদ্র বঙ্গবাসীর হাতে হাতে মোবাইল নামক সদা বকবক অবিরাম টকশো। নব হরমোন বয়ঃসন্ধিক্ষণ নিত্য বাকুমবাকুম। খুদে বার্তার বিশাল ভুবন-বাঁধন। বহুজাতিক মায়াজালে বন্দি জাতীয় গণজাগরণ-গণসংগীত আর মহান একুশের সব মহিমা। প্রযুক্তির বিপণন-বিজ্ঞাপন বচন-বদন-নৃত্যবিভঙ্গ এখন ছোট্ট শিশুর, বুড়ো-বুড়িরও চোখের চুইংগাম। ব্যক্তিগত ব্লগ খোলেন একদা কম্পিউটারবিমুখ প্রকাণ্ড বাম নেতারাও। উপহার পান আইফোন-ব্ল্যাকবেরি কালোজাম। পর্দাছোঁয়া একি অপরূপ নরম টাচ স্ক্রিন। আজ থেকে শতবর্ষ পরে রবীন্দ্রনাথ ও শেকসপিয়র একযোগে ভুবন সফরে এলে যখন যুগপৎ ভিরমি খেয়ে পড়বেন অভাবনীয় প্রযুক্তি-মহাতাণ্ডবে, তখন যেন জরুরি চিকিৎসার মহাজরুরি আয়োজন থাকে হে অনাগত মর্ত্যবাসী!
আজকের কাহিনী বলব বলেই তো এতক্ষণ এত শত কথা বলা। আজন্ম জাগতিক বোকাসোকা হিসেবে এই হিলাল ফয়েজী মানব প্রাণীটির প্রসিদ্ধি স্বীয় বৃত্তে কম নয়। তারও একটি চালু ই-মেইল ঠিকানা আছে। অলস জীবটি ঘরে বসে বসে প্রায় পঞ্চসহস্র ঠিকানায় নিত্য-নিয়ত পত্র চালাচালি করে থাকে নানা উসিলায়। লোকটির বিশাল টাক থাকলেও টাকার ভাঁড়ার অশেষ বাড়ন্ত। তবুও সে জুয়াড়ির মতো এসব বেহিসাবি ভার্চুয়াল নেশায় মত্ত বহুকাল ধরে। অতএব, ই-মেইলের নানা কীর্তিকাণ্ড তারও কম জানা নয়।
যেমন- আফ্রিকাসহ সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যে যত একনায়কের পতন ঘটে, অমনি সেসব রাজত্বের অনেক ব্যাংকের বেনামি শত কোটি ডলারের মালপানি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য আপনাকে লোভনীয় পার্টনার হওয়ার হাতছানির মেইল পাঠানো হবে অজানা প্রান্তর থেকে। বঙ্গদেশি বদমাইশি শেয়ারবাজারে হঠাৎ টংকরাজ হওয়ার জন্য পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার আহাম্মক বীরপুরুষ তো কম দেখি না। দ্বিগুণ-ত্রিগুণ মুনাফা দেওয়ার হায় হায় কম্পানির পেছনেও ছুটে বঙ্গীয় বেকুব পঙ্গপাল। অজানা ই-মেইলের প্রস্তাবিত ব্যবসায়ী অংশীদার হওয়ার মায়াবি ফাঁদে আটকে যাওয়ার পুঙ্গবও নিশ্চয়ই এখানে কম নেই। যেই ফাঁদে ধরা দিলেন, অমনি খসিয়ে নেওয়ার কৌশলে কুপোকাৎ করে দেওয়া হবে আপনাকে। এ ছাড়া আপনার 'শরীরী তাগদ' পুনরুজ্জীবিত করে দেওয়ারও কত যে দাওয়াই-দাওয়াতের নিত্য স্পাম ই-মেইল। আরেকটি আছে সেমিনার-ফাঁদ। মার্কিনি বেহেশতি দেশে সেমিনারের প্রথম অংশ এবং গরিব কোনো দেশে দ্বিতীয় অংশ... এমন বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে আপনাকে আমন্ত্রণের দে দোল দে দোল দুলুনি-ভুলুনি। অবশেষে কায়দা করে পকেট কর্তন-শুলুনি! এসব ইত্যাকার ফাঁদ অবশ্য সময়ে অকেজো হয়ে যায়। ঠগিরা নবফাঁদের আয়োজন গড়ে।
বছর দেড়-দুয়েক ধরে এমনি এক ফাঁদ চলছে, যার নাম দেওয়া যেতে পারে 'হেক্কানি'! পরিচিত কয়েকজনকে কেন্দ্র করে এমনি ফাঁদে পড়েছি কয়েকবার। যেমন- আমার একজন ঘনিষ্ঠ কেউ বিদেশে-বিভুঁইয়ে বিপাকে পড়ে গেছেন হঠাৎ, সব কিছু হারিয়ে হায় হায় অসহায়, একমাত্র ই-মেইল যোগাযোগই সম্বল, তাকে অবিলম্বে দেশে ফেরার প্রয়োজনে পাঠাতে হবে নির্দিষ্ট ঠিকানায় কয়েক হাজার ডলার। প্রথমবার তো বেশ ঘাবড়ে চমকে খোঁজ নিয়ে দেখি বন্ধুবর খোশমেজাজে স্বদেশেই আছেন। শুধু ঘটেছে একখান হেক্কানি কাহিনী। প্রযুক্তির এ যুগে প্রবল মেধাবী ছাওয়াল-ছাওয়ালিরা ই-মেইল আর ওয়েবসাইট 'হ্যাক' করার কুশাগ্র বুদ্ধি ব্যবহার করে এক নব 'হেক্কানি' যুগপর্ব সূচিত করেছে। আপনার ই-মেইলের পাসওয়ার্ড ডাকাতি করে সব ঠিকানা টুকে ঠুকে দিল আপনারই ই-মেইল থেকে আপনার নামে অমন সকরুণ আর্তনাদ। কয়েক দিন আগে এই আমারই ই-মেইল থেকে আমারই নামে পৃথিবীময় আমারই পঞ্চসহস্র ঠিকানায় অনেক আপনজনের কাছেই ছড়িয়ে পড়ল এমন অসহায় আহাজারির আর্তনাদ- বিলেতে হঠাৎ সফরে এসে আমার সবই গেছে, শুধু পাসপোর্টখানি আছে, ওগো কে কোথায় আছ হে আপনজন, পাঠিয়ে দাও অতি তাড়াতাড়ি আড়াই হাজার ডলার, দেশে ফিরেই শোধ দেব। তার পরই শুরু হলো পরবর্তী রুপালি পর্দার অধ্যায়।
এই জগতে সাতসমুদ্র তের নদীজুড়ে এই অকম্মা-অথর্ব-অযোগ্যের যে এত আপনজন আছে, এই হেক্কানি-ঠেক্কানির আগে এমনভাবে তা বুঝিনি। যারা 'হেক্কানি' বিষয়ে আগে থেকেই জানেন, তাঁরা তাড়াতাড়ি পাসওয়ার্ড বদলে ফেলার পরামর্শে ভরপুর করে দিলেন। বিলেতে নিজ নিজ স্বজনের কাছে অনেকে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার বার্তা পাঠিয়ে দিলেন। অনেকে আমার মোবাইলফোনে অনুমানে ফোন দিয়ে দেখলেন আমি যে এখানে স্বভূমে, স্বদেশে, বহাল মহালে-মহলে, সদলে সবলে। অকল্যান্ডে আমার 'অকওয়ার্ড' অবস্থার কথা জেনে শ্যালক ও শ্যালকপত্নী তো আকুল এবং ব্যাকুল। টরেন্টো থেকে আইটি বিশেষজ্ঞ ভাগ্নে তো ড্যামেজ কন্ট্রোল এক কাঁদি পরামর্শ-কদলি পাঠিয়ে দিলেন।
১৯৮৫ সালে কিউবার হাভানায় পশ্চিম বাংলার (আদি উৎস-বরিশাল) এক মেয়ে বাসবী বসু মজুমদারের 'হিলাল দা' বনে গেলাম। সেই বোনটি এখন স্প্যানিশ ভাষা শেখান দিলি্লর কাছে এক বিশ্ব মানের বিদ্যালয়ে। স্বীয় ই-মেইলে এমনি সকাতর সানুনয় এসওএস দেখে বঙ্গদেশি ভ্রাতা হিলাল দাকে উদ্ধারকল্পে বাসবী বানু তো ভাইবোন মিলে একদিনে লাখো রুপির তহবিল গড়ে ফেলল। পরে ঢাকায় ফোন করে হেক্কানিবিষয়ক ব্যাপারস্যাপার জেনে বেচারিদের আক্কেল গোলন্দাজ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলার মতো গুড়ুমগুড়ুম করে উঠল।
একদিকে এমন সহানুভূতির ঢল দেখে আবেগে আঁখি টলটল করে উঠল। অন্যদিকে শংকার ডংকা বেজে উঠল হৃদি-মাঝারে। এরপর সত্যি সত্যিই যদি 'একদিন বাঘ আসিয়া পড়ে' তাহলে এই বুড়ো রাখাল বালকটির কী দশা হবে গো!
লেখক : রম্য লেখক
No comments