তাঁর সৃষ্টি সর্বকালের by অণিমা রায়
রবীন্দ্রসংগীত কখনো জানতাম না। কখন চিনেছি বা কতটুকু জেনেছি, আমার কিছুই স্পষ্ট মনে আসে না। এ যেন আমার নিয়তিরই নির্দিষ্ট। কী কারণে রবীন্দ্রসংগীতকে আমি এমন মন-প্রাণ দিয়ে মেনেছি তা হয়তো নিজে বুঝি কখনো, কিন্তু বোঝানো মুশকিল। যাকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি, সেই রবিঠাকুরকে ভক্তি করি অনেক বেশি।
'কি পাইনি তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি' অথবা 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে, আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে যা'_এই যে কথাগুলো এমন অন্তরের কথা কে এমন করে বলতে পেরেছে। আমি ধন্য যে তাঁকে মানি। তাঁকে না মেনে আমার উপায় নেই। আমি আনন্দ পাই, আমি জীবন পাই তাতে। আমার কোনো শাসন নেই, আমার নিজের ভেতরে তাঁকে মানায়। সে জন্য তাঁকে জানতে চেষ্টা করছি। তাঁর সৃষ্টিকর্মে তাঁকে আমার অবতার মনে হয়। একটি কঠিন যুগের পরিবর্তনের জন্য যাঁর আবির্ভাব। গল্প, কবিতা, গান_সব সৃষ্টিকর্মে তিনি আমাদের নতুন আলোর সন্ধান দিয়েছেন। মানবজীবনের সব মুহূর্তকে তিনি স্পর্শ করেছেন পরম মমতায়। তাঁর গানে আমি নিজেকে খুঁজে পাই, ছবি দেখি, গল্প পড়ি; কখন সেই গল্পের নায়িকা হয়ে যাই_নিজেই জানি না। শুধু বুঝি, তাঁকে জানতে হলে তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মকে জানতে হবে।
আমার শিশুমনে ১০ বছর বয়সে শুধু তাঁর গানের সুরে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর গান শিখতে চাইতাম। আজ বুঝি, কোন অমূল্য ধনকে আমি ধরতে চেয়েছি। সেদিন না বুঝেই জীবনকে আমি দুটি ভাগে ভাগ করেছি। একটি জীবিকার জীবন, অন্যটি জীবনের জীবন। জীবিকার জীবন নানা অভাবকে নিয়ে, যা মোচনের জন্য লেখাপড়া করেছি, আইন পড়েছি, শিক্ষকতা করেছি। গানের জীবন আমার জীবিকার জন্য নয়, ওটা আনন্দে পরিপূর্ণতার জীবন।
আমি যে গান করি তা কেবল দরকারের জন্য নয়, শেখানোর জন্য নয়_এ আমার প্রাণের খোরাক, এ আমার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। কোনো ছেলেমেয়ে গান শিখতে এলে আমার মনে হয় এ ভগবানের দান।
মৃত্যুর এক বছর আগে গীতালি গানের স্কুলের উদ্বোধনে রবিঠাকুর বলেছিলেন, 'আমার গান একটু দরদ দিয়ে, প্রাণ দিয়ে শিখিও, মন দিয়ে। স্টিম রোলার চালিয়ো না। আমার গান নিয়ে দোকানদারি চলছে।' তাঁর কথাগুলোই কেবল মেনে চলার চেষ্টা করছি। কিন্তু এ সংগ্রাম দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে চারপাশের কোলাহলে, আজকালের রীতিমতো যন্ত্রে পরিণত হওয়া ছেলেমেয়েকে কী করে বোঝাই প্রাণের কথা, সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, যখন ব্যর্থ হই কঠিন বাদ্যে অভ্যস্ত মনকে রবীন্দ্রসুরে ডোবাতে। আবার আশায় বুক বাঁধি, নতুন করে শুরু করি, আরো একটি দিন সংকল্প পেরে ওঠার।
রবীন্দ্রনাথ সবার, সর্বশ্রেণীর, তাঁর সৃষ্টি সর্বকালের। এ সহজ-সুন্দর মানুষটিকে শুধু গেঁথে চাই আজকের ছেলেমেয়েদের মনে।
আমার রবীন্দ্রনাথ মোটেও দুর্বোধ্য নয়। তিনি সর্বজনীন_এটা প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে তিনি হারাবেন না, আমরাই তাঁকে হারাব। শুধু রবীন্দ্রনাথকে সবার জন্য তাঁর দর্শন অন্তরে বাঁধার জন্য কত কি না করেছি। প্রায় ১৫ বছর ধরে কত সংগঠনের সঙ্গে সমবেত কণ্ঠ মিলিয়েছি, ছুটে গেছি যদি আরো দুটি নতুন গান শিখতে পারি তার তাগিদে। ছায়ানট, সংগীত মহাবিদ্যালয়, সুরবাণী একাডেমী, সুরতীর্থ বাংলার মুখ, সংগীত বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা, সব শেষে আমার নিজের প্রতিষ্ঠান সুরবিহার। আরো কত, মনে পড়ে না। এর সবটাই তাকে জানার চেষ্টায়।
যে মানুষটি আমার জন্মের ৩৮ বছর আগে এ পৃথিবী ত্যাগ করেছেন তাঁকে এত কাছের, এত যে আপন লাগে তাঁর সৃষ্টিতে, মনে ভাবি এই তো আমার চিরবন্ধু, চিরনির্মল, চিরশান্তি।
আমার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নিজের জীবনের একটি ছোট অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করি।
'আমার সকল দুঃখের প্রদীপ'_প্রথম গাওয়া গান অঙ্ক ক্লাসে। তখনো জানতাম না এটি একটি রবীন্দ্রসংগীত। এ গান গেয়ে আমি তো রীতিমতো স্টার হয়ে গেলাম ক্লাসে। সে যে কী আনন্দ। স্যারও বলতেন, 'তুই গান শিখলে ভালো করবি' তারপর বাড়িতে প্রায়ই জিদ করতাম গান শিখব বলে। আমার পরিবারে গান গায় বা গান শেখে এমন কেউ তখন ছিল না। কিন্তু গানপাগল মেজো কাকা (বিমল রায়) আমার আগ্রহকে আমল দিলেন এবং অবশেষে ১০ বছর বয়সে হারমোনিয়াম কেনার জন্য দুই হাজার ৩০০ টাকা পেলাম। মনে পড়ে বড়দি আর বিমল কাকা আমাকে নিয়ে হারমোনিয়াম কিনতে গিয়েছিলেন। তারপর কার কাছে শিখব গান? এও একটা বড় ব্যাপার। বিমল কাকার চেষ্টায় ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীতের ছাত্র দেবাশীষ চক্রবর্তীকে ঠিক করা হলো আমাকে বাড়িতে গান শেখানোর জন্য। আর ভর্তি করে দিলেন মহাখালীতে বাড়ির কাছে 'সুরবাণী' একাডেমীতে। এটাই আমার মূলত গান শেখার শুরু। সারাক্ষণ গান গাইতাম বলে বিরক্তও হতেন অনেকে, কিন্তু তাতে আমার কিছুই আসত-যেত না। কত সাধনার ফল আমার সেই হারমোনিয়াম। রবীন্দ্রনাথ তাই সেই থেকে আমার দিনাতিপাতের সঙ্গী। আমার চলার শক্তি, আনন্দ_সবকিছুই।
No comments