চিরকুট-আরব বসন্তের কুশীলবদের সঙ্গে by শাহাদুজ্জামান

ইতিহাস তোলপাড় করা সব ঘটনা ঘটছে আরব অঞ্চলে। একে একে ধসে পড়ছে সেখানকার দীর্ঘদিনের একনায়কেরা। বিপ্লবের বসন্ত লেগেছে সেখানে। আরব বসন্ত নিয়ে পত্রপত্রিকা, টিভির বরাতে আমরা নানা ভাষ্য শুনছি। সম্প্রতি সুযোগ হয়েছিল এই আরব বসন্তের কতিপয় কুশীলবের সঙ্গে আলাপের।


আরব অঞ্চলকেন্দ্রিক বিশ্বস্বাস্থ্যবিষয়ক একটি গবেষণা প্রকল্পে কাজ করছি এখন। যাঁদের সঙ্গে কাজ করছি, তাঁদের কাজের ক্ষেত্র জনস্বাস্থ্য, তাঁরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অথবা সরকারি বা বেসরকারি স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। পেশাগত পরিচয় যা-ই থাকুক না কেন, ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে তাঁরা নানাভাবে এই আরব বসন্তের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কুশীলব। সম্প্রতি লন্ডনে এক মিটিংয়ে মিলিত হয়েছিলাম তাঁদের সঙ্গে। কাজ শেষে নৈশভোজের টেবিলে আড্ডা হয়েছে এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে। ছিলেন তিউনেসিয়ার ওয়াফা, যিনি একনায়ক বেন আলী উৎখাতের পর অন্তর্বর্তী সরকারের খণ্ডকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, ছিলেন সিরিয়ার প্রাথমিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান আহমদ, ফিলিস্তিনের বেরজাইত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল্লাহ, জর্ডান বিশ্ববিদ্যালনের অধ্যাপক হায়দার, মিসরের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা রাবিয়া। গোপনীয়তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ছদ্ম নাম ব্যবহার করছি। খাওয়ার টেবিলের আড্ডায় কোনো বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না, তবু তাঁদের টুকরো মন্তব্যে শোনা গেল এ নিয়ে তাঁদের নিজস্ব বয়ান।
তিউনেসিয়ার এক সবজি বিক্রেতা তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে বস্তুত সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন পুরো আরব বিপ্লবের এই দাবানলের। এ অঞ্চলের বিপ্লবের পথিকৃৎ সেই তিউনেসিয়ার সাবেক মন্ত্রী ওয়াফার কাছ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা শোনার কৌতূহল সবার। কিন্তু ওয়াফা উচ্ছ্বাসের বদলে শোনালেন শঙ্কার কথা। বেন আলীকে উৎখাত করার পর প্রগতিশীল অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ স্বাস্থ্য গবেষক হিসেবে তাঁকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করেছিলেন। তিনি নিজে দেশের একটি বামপন্থী দলের সমর্থক। কিন্তু বেন আলীমুক্ত তিউনেসিয়ার প্রথম নির্বাচনে হার হলো প্রগতিশীল দলগুলোর। ইসলামপন্থী দল আল নাহদা ক্ষমতায় এসে তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারিত করে। ওয়াফা বলেন, এই ইসলামপন্থী দল তরুণদের বিপ্লবকে ছিনতাই করেছে। মিসরের রাবিয়া তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে বলেন, একই ব্যাপার ঘটেছে মিসরেও। সেখানেও প্রগতিশীলদের বিপ্লবের ফল ঘরে তুলেছে ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড। কেন এমন ঘটল, তা নিয়ে বলতে গিয়ে উভয়ই জানালেন, গত তিন-চার দশক ধরে তাঁদের দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ওপর নানা দমন-পীড়ন থাকায় প্রগতিশীল রাজনীতিবিদেরা তেমন কোনো কর্মকাণ্ডই চালাতে পারেননি। অনেকেই ছিলেন জেলে, নয় তো দেশের বাইরে। অন্যদিকে ইসলামপন্থীরা সরাসরি রাজনীতি করতে না পারলেও মসজিদ, নানা রকম ধর্মীয় জলসা ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ রেখেছে। প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ যাঁরা দেশে ছিলেন, তাঁরা শহুরে মধ্যবিত্তের ভেতর কিছু তাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন মাত্র। ফলে চার দশক পর যখন নির্বাচন হয়েছে, তখন সাধারণ মানুষ তাঁদেরই ভোট দিয়েছে, যাঁদের কথা তারা মাঝেমধ্যে শুনেছে। তবে এ অবস্থা খণ্ডকালীন বলেই তাদের ধারণা। পার্লামেন্টে ইসলামপন্থীদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, পাশাপাশি প্রগতিশীলরাও নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। ফলে তারা আশাবাদী যে পরিস্থিতি পাল্টাবে।
জর্ডানের হায়দার অবশ্য অতটা আশাবাদী নন। আরব অঞ্চলে একনায়কতান্ত্রিকতার অবসান ঘটানোর জোর সমর্থক হলেও যেভাবে তা ঘটছে, তিনি তাঁর ঘোর বিরোধী। তিনি বলেন, আরব বসন্তের নামে এসব অঞ্চলের মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা শক্তি তাদের ছক অনুযায়ী এ অঞ্চলে তাদের আধিপত্য আরও সুদৃঢ় করার পথ সুগম করছে মাত্র। তিনি মনে করেন, ইরাকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার নামে আমেরিকা দেশটিকে ১০০ বছর পিছিয়ে দিয়েছে, একনায়ক উৎখাতের নামে লিবিয়াকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কালে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে ওই সব অঞ্চলে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে উদগ্রীব হলেও সৌদি আরবের মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র নিয়ে আমেরিকার কোনো উচ্চবাচ্য নেই। এখন তারা সিরিয়ার পেছনে লেগেছে, ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি আর ইসরায়েলের শক্তি সংহত করার জন্য বাশারকে সরিয়ে তাদের মিত্র কোনো শক্তিকে সেখানে ক্ষমতায় বসাতে। পশ্চিমাদের তাঁবেদার হয়ে সেখানে কাজ করেছে সৌদি আরব ও কাতার। তারাই অস্ত্র পাঠিয়ে তৈরি করেছে মুক্ত সিরিয়ান আর্মি।
সিরিয়ার আহমদ অবশ্য বললেন সবকিছুকে শুধু কনসপিরেসি থিয়োরির আওতায় ব্যাখ্যা করার পক্ষপাতি তিনি নন। আহমদ চিকিৎসক, তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের রুপকে বললেন, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন কমে যায়, তখন নানা রকম ভাইরাসই শরীরে ঢোকার সুযোগ খোঁজে। পশ্চিমা শক্তি, মৌলবাদী ইসলামি শক্তি তেমনি সব ভাইরাস বলেই তিনি মনে করেন। সিরিয়ার নিজের শক্তি ক্রমেই শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে বলে এসব ভাইরাস এখন সেখানে ঢুকছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, সিরিয়া বহুকাল একটা ত্রাসের দেশ হয়ে আছে। সেখানে রাজনীতি নিয়ে কেউ মুখ খোলে না। সরকারের পক্ষ থেকে ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা, গুম সেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাঁর এক বন্ধুর কথা বললেন, যাঁকে বাশার সরকার ১২ বছর আট ফুট বাই আট ফুটের একটি ঘরে বন্দী করে রেখেছিল সে সরকারের সমালোচনা করে পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখেছিল বলে। আহমদ বলেন, তাঁর কৈশোর কেটেছে বাশারের বাবা আসাদের ভয়ে, তাঁর যৌবন কেটেছে ছেলে বাশারের আতঙ্কে। সিরিয়ার মানুষ যে সব রকম ভয় কাটিয়ে এভাবে কোনো দিন নিজেদের দাবি নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে—সেই বিশ্বাসই তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। আহমদ এখন আশাবাদী। আহমদ বলেন, আন্দোলনে বাশার উৎখাত হলে হয়তো তিউনেসিয়া এবং মিসরের মতো একই কারণে সিরিয়ায়ও কোনো ইসলামি দল ক্ষণকালীন ক্ষমতায় আসতে পারে। কিন্তু তবু তিনি এই একনায়কতন্ত্রের অবসান চান।
ফুয়াদ নিজে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তির ঘোর বিরোধী হলেও তিনি মনে করেন, প্রগতিশীলদের জনসম্পৃক্ততার ব্যর্থতার খেসারত হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীলদের আপাত উত্থানের এই ঐতিহাসিক মূল্য হয়তো তাঁদের দিতে হবে। কিন্তু তাতেও যদি স্বৈরশাসকের উৎখাত হয়, তখন অন্তত গণতন্ত্রের জন্য তাঁরা সত্যিকার সংগ্রাম শুরু করতে পারবেন। ফিলিস্তিনের আবদুল্লাহ এক ফাঁকে ঠাট্টা করে বলেন, তিনি খানিকটা ঈর্ষান্বিত। একসময় আরব অঞ্চলের খবর বলতে ছিল একমাত্র ফিলিস্তিনের খবর, কিন্তু এখন তাদের খবর যেন খানিকটা চাপা পড়ে গেছে। বলেন একসময় ফিলিস্তিনই ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ আরব অঞ্চল, এখন সে কাতারে যোগ দিয়েছে অন্যান্য দেশও। ফলে তাদেরও অভিজ্ঞতা হচ্ছে অবিরাম যুদ্ধাবস্থায় থাকার। আবদুল্লাহ আরও বলেন, আরব অঞ্চলে গণতন্ত্র, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমের এত মায়াকান্না হাস্যকর, কারণ এ আর এখন কারও জানতে বাকি নেই যে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি আছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবির স্বীকৃতির ভেতরই। অথচ এ বিষয়টিকে একটা দগদগে ঘায়ের মতো তারা জিইয়ে রেখেছে।
স্পষ্টতই ইতিহাসের একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে আরব অঞ্চল। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটছে সেখানে। কিন্তু এ পরিবর্তনের ফায়দা কারা লুটছে, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। পশ্চিমা আধিপত্যবাদী শক্তি, সামরিক শক্তি, রক্ষণশীল ধর্মীয় শক্তি পারস্পরিক যোগসাজশে এ ফায়দা নেওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। বিবিধ কারণে ঘটনার ওপর দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল শক্তির নিয়ন্ত্রণ এখনো শিথিল। কিন্তু এ অঞ্চলে যুগান্ত একবার ঘটে গেছে। তার পেছনে ফেরার আর পথ নেই। ঘটনার গতি কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। শুধু ওই অঞ্চলের নয়, গোটা বিশ্বের রাজনীতিতেই এ পরিবর্তনের একটা অভিঘাত আছে, প্রাসঙ্গিকতা আছে আমাদের দেশের রাজনীতির জন্যও। নৈশভোজের টেবিলে আরব বসন্তের কুশীলবদের মুখে তাঁদের নিজেদের বয়ান শুনতে শুনতে দেশের কথা ভাবি। আমাদের দেশে ওত পেতে থাকা স্বৈরশক্তি, ভিনদেশি স্বার্থান্বেষী শক্তি, ধর্মীয় রক্ষণশীল শক্তি মোকাবিলার সংগ্রামে আরব বসন্তের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাব কি?
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.