দূরদেশ-বিলেতে এই ভয়াবহ দাঙ্গার কারণ কী by আলী রীয়াজ
দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমার প্রবাসী জীবনে বিভিন্ন শহরে বসবাসের সুযোগ হয়েছে। কিন্তু ঢাকার পরে যে শহর আমার সবচেয়ে পছন্দের, তা হলো লন্ডন। লন্ডনে পাঁচ বছর বসবাস করার পর ইংল্যান্ডের অন্য একটি শহরে যে এক বছর কাটিয়েছি, সে সময়ও লন্ডনের আকর্ষণ এড়াতে পারিনি। অনেক ছুটির দিনই কেটেছে লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায়।
তারপর গত এক দশকে বহুবার লন্ডনে যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের কারণেও লন্ডনকে দূরের শহর মনে হয় না। লন্ডনের সেই প্রিয় ও পরিচিত এলাকাগুলোর যে ছবি কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্রে দেখতে পেয়েছি, তাতে শুধু বিস্মিত ও হতবাকই হইনি, ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি।
লন্ডনসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গার সময় অগ্নিকাণ্ড, লুটপাট ও মৃত্যুর ঘটনা এতটাই অভাবিত ছিল যে কখনো কখনো একে অবিশ্বাস্যও মনে হয়েছে। বন্ধুদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে যোগাযোগ করলে কমবেশি সবাই তাঁদের বিস্ময় প্রকাশে কুণ্ঠিত হননি। উদ্বিগ্ন ব্রিটিশ নাগরিকেরা ধর্ম-বর্ণভেদে প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছেন: তাঁরা হতবাক। বিস্ময়ের পাশাপাশি তাঁদেরও প্রশ্ন: কেন এমন হলো? এই ভয়াবহ দাঙ্গার কারণ কী? এই প্রশ্ন কেবল সাধারণ নাগরিকদের নয়, ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে বিশ্লেষক—সবারই। ব্রিটেনের সমাজতত্ত্ববিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও বুঝতে চাইছেন, কেন এই দাঙ্গা।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে বন্ধুবান্ধবের প্রতিক্রিয়া এবং ব্রিটিশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মন্তব্য থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে লন্ডনের টটেনহাম এলাকায় ৪ আগস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত মার্ক ডুগানের মৃত্যু এই ব্যাপক ও বিস্তৃত দাঙ্গার কারণ নয়, উপলক্ষ। উপলক্ষ এই অর্থে নয় যে এই মৃত্যুর কোনো তাৎপর্য নেই। উপলক্ষ এই অর্থে যে এ ধরনের যেকোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারত। দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি সবাই এর কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করছেন। যেহেতু এখনো কারও পক্ষেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে স্থানীয়ভাবে প্রতিটি ঘটনার সূত্রপাত ও বিস্তারের বর্ণনা সংগ্রহ করে অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি, সেহেতু এখন পর্যন্ত যেসব কথাবার্তা, তা আমরা বিশ্লেষণ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারব না।
এ ধরনের বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণ, কিংবা এক অর্থে তত্ত্ব আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি। এসবের মধ্যে তরুণদের ভেতরে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের (রোল-মডেল) অভাব, বিশেষত বাড়িতে বাবার অনুপস্থিতি, র্যাপ গানের সংস্কৃতির প্রভাব এবং প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থাকে কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে বর্ণনা করা হয়েছে সমাজের ভেতরে সুবিধাবাদী প্রবণতাকে। এসবের বাইরে কোনো কোনো বিশ্লেষক আরও গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণকে এর জন্য দায়ী করেছেন। অর্থনৈতিক কারণগুলোর মধ্যে একদিকে বলা হচ্ছে, সমাজের একাংশের ওয়েলফেয়ার-নির্ভরতা (অর্থাৎ সরকারের দেওয়া সামাজিক সুবিধার ওপর নির্ভরতা) তাদের দায়িত্বহীন ও বিশৃঙ্খল করে তুলেছে। ঠিক বিপরীতভাবে বলা হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকারের সাম্প্রতিক কৃচ্ছ্রর পরিকল্পনা, যার পরিণতিতে সামাজিক খাতে ব্যয় অকল্পনীয়ভাবে কাটছাঁট করা হয়েছে। ফলে সমাজের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ সুবিধাবঞ্চিত হয়ে, ক্ষুব্ধ হয়ে এই দাঙ্গার মধ্য দিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে, ভোক্তাবাদ বা কনজিউমারইজম সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলেছে যে সমাজের একটি অংশ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ভোগবিলাসে অংশ নিতে না পেরে গোটা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে এই দাঙ্গা-হাঙ্গামার পথ বেছে নিয়েছে। বর্ণবাদের প্রসঙ্গ এসেছে—প্রধানত কৃষ্ণাঙ্গরাই এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। কেননা ব্রিটিশ সমাজে আফ্রো-ক্যারিবীয় জনগোষ্ঠী সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার এই জনগোষ্ঠী প্রচলিত পথে তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত।
সমাজের সঙ্গে এই বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নে কেবল যে বর্ণের প্রসঙ্গই গুরুত্বপূর্ণ, তা নয়, ব্রিটেনের তরুণেরাও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে তাদের ক্ষোভ প্রকাশের কোনো পথ খোলা নেই। এসব বিশ্লেষণের পেছনে যেমন যুক্তি রয়েছে, তেমনই এসবের বিরুদ্ধেও যুক্তির অভাব হবে না। কিন্তু এসব কারণের কোনো একটি কারণ ব্রিটেনের এই দাঙ্গার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারবে বলে মনে হয় না।
ব্রিটেনের দাঙ্গা, বিশেষত বর্ণদাঙ্গার ঘটনার অনেক উদাহরণ রয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে পুলিশের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণদের দাঙ্গার ঘটনা অনেক। সে সময় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে এশীয় তরুণেরাও যুক্ত হয়েছিল এবং একাধিকবার বর্ণবাদী গোষ্ঠী এবং পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটেছে। ১৯৯১-৯২ সালে কার্ডিক থেকে নিউ ক্যাসেল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে শ্বেতাঙ্গ দরিদ্র মানুষের সঙ্গে পুলিশের দাঙ্গা হয়েছে। ২০০১ সালে ব্রাডফোর্ড (১৪-১৫ এপ্রিল, ৭ জুলাই), ওল্ডহ্যাম (২৬-২৯ মে), বার্নলি (২৪-২৬ জুন) শহরে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটে। কিন্তু এবারের দাঙ্গা অতীতের সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে বলেই মনে হয়। দাঙ্গার ভয়াবহতা এবং এর পরিসর—দুইই ব্রিটেনের জন্য অভূতপূর্ব। সে কারণেই এ দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধান অনেক বেশি জরুরি। ২০০১ সালের একাধিক দাঙ্গার পর সরকারি কমিশন, বেসরকারি কমিশন ইত্যাদির প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছিল এবং তাতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তার কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ; কিন্তু সেগুলো যে বড় ধরনের দাঙ্গা বন্ধ করতে পারেনি, সেটা নিশ্চিত।
এখন যেসব বিশ্লেষক ব্রিটেনের সামাজিক খাতে ব্যয় হ্রাসকে এই দাঙ্গার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের বক্তব্য ব্রিটিশ সরকার এবং অন্যান্য দেশের সরকারের একটু নিষ্ঠার সঙ্গে শোনা দরকার। যদিও এ কথা সত্য যে ব্রিটেনের সামাজিক খাতে ব্যয় হ্রাসের অধিকাংশই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, তথাপি এর সম্ভাবনা এবং অব্যাহত অর্থনৈতিক সংকটের মুখেই এই দাঙ্গা হয়েছে, সেটা ভুলে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
ব্রিটেনের এই দাঙ্গার খবর আটলান্টিকের অন্য পারের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। এর কারণ কেবল ঘটনার সংবাদমূল্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এখন একটা অস্থির সময় চলছে। অনেকেরই জানা আছে, সরকারের ঋণ গ্রহণের সীমা বাড়ানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট ওবামার সরকার আগামী ১০ বছরে ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় সংকোচনে রাজি হতে বাধ্য হয়েছে। রিপাবলিকান পার্টি, বিশেষত দলের দক্ষিণপন্থী টি-পার্টির চাপের মুখে এই সংকোচনে ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা রাজি হয়েছেন। এই পরিমাণ ঘাটতি হ্রাসের জন্য ওবামা ধনী লোকদের ও করপোরেশনের দেওয়া কর-রেয়াত প্রত্যাহারের জন্য চেষ্টা করলেও তাতে এযাবৎ সমর্থ হননি। এখন কংগ্রেসের ১২ সদস্যের যে কমিটি করা হয়েছে, তাঁরা ব্যয় হ্রাস ও কর বাড়ানোর প্রস্তাব করবেন, সেটাই ভরসা।
এই বিতর্কে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হলো জনসাধারণ, বিশেষত গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য সরকারের করণীয় আছে কি না, সে প্রশ্নে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। রিপাবলিকানরা সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের বক্তব্য, ‘সরকার সমস্যার সমাধান নয়, সরকারই সমস্যা’কে চূড়ান্ত বলে ধরে নিয়েছে। তারা এই আদর্শিক অবস্থান থেকে অর্থ সাশ্রয়ের নামে, সরকারের আকার ছোট করার নামে, সমাজে ব্যক্তিগত দায়িত্বশীলতা বাড়ানোর নামে সব ধরনের সামাজিক খাতে ব্যয় কমিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। তাদের অবস্থান ব্রিটেনের কনজারভেটিভ সরকারের অবস্থান থেকে ভিন্ন নয়। ফলে রিপাবলিকানদের এই প্রচেষ্টা যদি সফল হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের গরিব ও মধ্যবিত্তদের জন্য অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে, কেবল তা-ই নয়, তাদের জন্য বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখাও দুষ্কর হয়ে পড়বে।
ব্রিটেনে দাঙ্গার পেছনে রাষ্ট্রের ওপর আস্থার প্রশ্নটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেছে বলেই আমার ধারণা। ব্রিটিশ সরকারের ব্যয় সংকোচনের নীতির অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টি (এবং যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান পার্টি) গত বছরগুলোতে যেভাবে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে, তাতে সাধারণ মানুষ ক্রমেই সন্দিহান যে রাষ্ট্র তাদের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত করতে এবং তাদের জন্য কর্ম ও খাদ্যের সংস্থান করতে উৎসাহী কি না। এটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা পারা না-পারার প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র আদৌ সেটা চায় কি না।
বিশ্বজুড়ে মঙ্গার প্রেক্ষাপটে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রই শুধু নয়, অন্যান্য দেশও সমস্যা মোকাবিলায় ব্যয় সংকোচন, বিশেষত সামাজিক খাতে ব্যয় সংকোচনকে সমাধান হিসেবে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে। গ্রিসে সাম্প্রতিক সময়ের সংঘাতের কথা অনেকেরই স্মরণে থাকবে। ইতালি ও ফ্রান্সেও এসব পদক্ষেপ বিবেচনাধীন বা বাস্তবায়নের পথে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিটেনের দাঙ্গা অনেকের জন্য হুঁশিয়ারি বলে বিবেচিত হতে পারে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, কেবল অর্থনৈতিক বিশ্লেষণই এই দাঙ্গার কারণ, প্রকৃতি ও পরিধি ব্যাখ্যা করতে পারবে না। এযাবৎ দাঙ্গার ঘটনায় যুক্ত ব্যক্তিদের পরিচিতি ও প্রোফাইল এবং দাঙ্গার সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে যত দূর জানা গেছে, তাতে এটা স্পষ্ট, খুব সহজেই এর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। কারণ অনুসন্ধানের এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি প্রয়োজন পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষোভের কারণগুলো মোকাবিলা করা যায়।
ইলিনয়
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
লন্ডনসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গার সময় অগ্নিকাণ্ড, লুটপাট ও মৃত্যুর ঘটনা এতটাই অভাবিত ছিল যে কখনো কখনো একে অবিশ্বাস্যও মনে হয়েছে। বন্ধুদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে যোগাযোগ করলে কমবেশি সবাই তাঁদের বিস্ময় প্রকাশে কুণ্ঠিত হননি। উদ্বিগ্ন ব্রিটিশ নাগরিকেরা ধর্ম-বর্ণভেদে প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছেন: তাঁরা হতবাক। বিস্ময়ের পাশাপাশি তাঁদেরও প্রশ্ন: কেন এমন হলো? এই ভয়াবহ দাঙ্গার কারণ কী? এই প্রশ্ন কেবল সাধারণ নাগরিকদের নয়, ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে বিশ্লেষক—সবারই। ব্রিটেনের সমাজতত্ত্ববিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও বুঝতে চাইছেন, কেন এই দাঙ্গা।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে বন্ধুবান্ধবের প্রতিক্রিয়া এবং ব্রিটিশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মন্তব্য থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে লন্ডনের টটেনহাম এলাকায় ৪ আগস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত মার্ক ডুগানের মৃত্যু এই ব্যাপক ও বিস্তৃত দাঙ্গার কারণ নয়, উপলক্ষ। উপলক্ষ এই অর্থে নয় যে এই মৃত্যুর কোনো তাৎপর্য নেই। উপলক্ষ এই অর্থে যে এ ধরনের যেকোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারত। দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি সবাই এর কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করছেন। যেহেতু এখনো কারও পক্ষেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে স্থানীয়ভাবে প্রতিটি ঘটনার সূত্রপাত ও বিস্তারের বর্ণনা সংগ্রহ করে অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি, সেহেতু এখন পর্যন্ত যেসব কথাবার্তা, তা আমরা বিশ্লেষণ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারব না।
এ ধরনের বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণ, কিংবা এক অর্থে তত্ত্ব আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি। এসবের মধ্যে তরুণদের ভেতরে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের (রোল-মডেল) অভাব, বিশেষত বাড়িতে বাবার অনুপস্থিতি, র্যাপ গানের সংস্কৃতির প্রভাব এবং প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থাকে কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে বর্ণনা করা হয়েছে সমাজের ভেতরে সুবিধাবাদী প্রবণতাকে। এসবের বাইরে কোনো কোনো বিশ্লেষক আরও গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণকে এর জন্য দায়ী করেছেন। অর্থনৈতিক কারণগুলোর মধ্যে একদিকে বলা হচ্ছে, সমাজের একাংশের ওয়েলফেয়ার-নির্ভরতা (অর্থাৎ সরকারের দেওয়া সামাজিক সুবিধার ওপর নির্ভরতা) তাদের দায়িত্বহীন ও বিশৃঙ্খল করে তুলেছে। ঠিক বিপরীতভাবে বলা হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকারের সাম্প্রতিক কৃচ্ছ্রর পরিকল্পনা, যার পরিণতিতে সামাজিক খাতে ব্যয় অকল্পনীয়ভাবে কাটছাঁট করা হয়েছে। ফলে সমাজের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ সুবিধাবঞ্চিত হয়ে, ক্ষুব্ধ হয়ে এই দাঙ্গার মধ্য দিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে, ভোক্তাবাদ বা কনজিউমারইজম সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলেছে যে সমাজের একটি অংশ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ভোগবিলাসে অংশ নিতে না পেরে গোটা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে এই দাঙ্গা-হাঙ্গামার পথ বেছে নিয়েছে। বর্ণবাদের প্রসঙ্গ এসেছে—প্রধানত কৃষ্ণাঙ্গরাই এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। কেননা ব্রিটিশ সমাজে আফ্রো-ক্যারিবীয় জনগোষ্ঠী সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার এই জনগোষ্ঠী প্রচলিত পথে তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত।
সমাজের সঙ্গে এই বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নে কেবল যে বর্ণের প্রসঙ্গই গুরুত্বপূর্ণ, তা নয়, ব্রিটেনের তরুণেরাও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে তাদের ক্ষোভ প্রকাশের কোনো পথ খোলা নেই। এসব বিশ্লেষণের পেছনে যেমন যুক্তি রয়েছে, তেমনই এসবের বিরুদ্ধেও যুক্তির অভাব হবে না। কিন্তু এসব কারণের কোনো একটি কারণ ব্রিটেনের এই দাঙ্গার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারবে বলে মনে হয় না।
ব্রিটেনের দাঙ্গা, বিশেষত বর্ণদাঙ্গার ঘটনার অনেক উদাহরণ রয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে পুলিশের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণদের দাঙ্গার ঘটনা অনেক। সে সময় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে এশীয় তরুণেরাও যুক্ত হয়েছিল এবং একাধিকবার বর্ণবাদী গোষ্ঠী এবং পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটেছে। ১৯৯১-৯২ সালে কার্ডিক থেকে নিউ ক্যাসেল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে শ্বেতাঙ্গ দরিদ্র মানুষের সঙ্গে পুলিশের দাঙ্গা হয়েছে। ২০০১ সালে ব্রাডফোর্ড (১৪-১৫ এপ্রিল, ৭ জুলাই), ওল্ডহ্যাম (২৬-২৯ মে), বার্নলি (২৪-২৬ জুন) শহরে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটে। কিন্তু এবারের দাঙ্গা অতীতের সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে বলেই মনে হয়। দাঙ্গার ভয়াবহতা এবং এর পরিসর—দুইই ব্রিটেনের জন্য অভূতপূর্ব। সে কারণেই এ দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধান অনেক বেশি জরুরি। ২০০১ সালের একাধিক দাঙ্গার পর সরকারি কমিশন, বেসরকারি কমিশন ইত্যাদির প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছিল এবং তাতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তার কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ; কিন্তু সেগুলো যে বড় ধরনের দাঙ্গা বন্ধ করতে পারেনি, সেটা নিশ্চিত।
এখন যেসব বিশ্লেষক ব্রিটেনের সামাজিক খাতে ব্যয় হ্রাসকে এই দাঙ্গার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের বক্তব্য ব্রিটিশ সরকার এবং অন্যান্য দেশের সরকারের একটু নিষ্ঠার সঙ্গে শোনা দরকার। যদিও এ কথা সত্য যে ব্রিটেনের সামাজিক খাতে ব্যয় হ্রাসের অধিকাংশই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, তথাপি এর সম্ভাবনা এবং অব্যাহত অর্থনৈতিক সংকটের মুখেই এই দাঙ্গা হয়েছে, সেটা ভুলে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
ব্রিটেনের এই দাঙ্গার খবর আটলান্টিকের অন্য পারের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। এর কারণ কেবল ঘটনার সংবাদমূল্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এখন একটা অস্থির সময় চলছে। অনেকেরই জানা আছে, সরকারের ঋণ গ্রহণের সীমা বাড়ানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট ওবামার সরকার আগামী ১০ বছরে ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় সংকোচনে রাজি হতে বাধ্য হয়েছে। রিপাবলিকান পার্টি, বিশেষত দলের দক্ষিণপন্থী টি-পার্টির চাপের মুখে এই সংকোচনে ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা রাজি হয়েছেন। এই পরিমাণ ঘাটতি হ্রাসের জন্য ওবামা ধনী লোকদের ও করপোরেশনের দেওয়া কর-রেয়াত প্রত্যাহারের জন্য চেষ্টা করলেও তাতে এযাবৎ সমর্থ হননি। এখন কংগ্রেসের ১২ সদস্যের যে কমিটি করা হয়েছে, তাঁরা ব্যয় হ্রাস ও কর বাড়ানোর প্রস্তাব করবেন, সেটাই ভরসা।
এই বিতর্কে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হলো জনসাধারণ, বিশেষত গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য সরকারের করণীয় আছে কি না, সে প্রশ্নে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। রিপাবলিকানরা সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের বক্তব্য, ‘সরকার সমস্যার সমাধান নয়, সরকারই সমস্যা’কে চূড়ান্ত বলে ধরে নিয়েছে। তারা এই আদর্শিক অবস্থান থেকে অর্থ সাশ্রয়ের নামে, সরকারের আকার ছোট করার নামে, সমাজে ব্যক্তিগত দায়িত্বশীলতা বাড়ানোর নামে সব ধরনের সামাজিক খাতে ব্যয় কমিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। তাদের অবস্থান ব্রিটেনের কনজারভেটিভ সরকারের অবস্থান থেকে ভিন্ন নয়। ফলে রিপাবলিকানদের এই প্রচেষ্টা যদি সফল হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের গরিব ও মধ্যবিত্তদের জন্য অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে, কেবল তা-ই নয়, তাদের জন্য বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখাও দুষ্কর হয়ে পড়বে।
ব্রিটেনে দাঙ্গার পেছনে রাষ্ট্রের ওপর আস্থার প্রশ্নটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেছে বলেই আমার ধারণা। ব্রিটিশ সরকারের ব্যয় সংকোচনের নীতির অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টি (এবং যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান পার্টি) গত বছরগুলোতে যেভাবে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে, তাতে সাধারণ মানুষ ক্রমেই সন্দিহান যে রাষ্ট্র তাদের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত করতে এবং তাদের জন্য কর্ম ও খাদ্যের সংস্থান করতে উৎসাহী কি না। এটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা পারা না-পারার প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র আদৌ সেটা চায় কি না।
বিশ্বজুড়ে মঙ্গার প্রেক্ষাপটে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রই শুধু নয়, অন্যান্য দেশও সমস্যা মোকাবিলায় ব্যয় সংকোচন, বিশেষত সামাজিক খাতে ব্যয় সংকোচনকে সমাধান হিসেবে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে। গ্রিসে সাম্প্রতিক সময়ের সংঘাতের কথা অনেকেরই স্মরণে থাকবে। ইতালি ও ফ্রান্সেও এসব পদক্ষেপ বিবেচনাধীন বা বাস্তবায়নের পথে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিটেনের দাঙ্গা অনেকের জন্য হুঁশিয়ারি বলে বিবেচিত হতে পারে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, কেবল অর্থনৈতিক বিশ্লেষণই এই দাঙ্গার কারণ, প্রকৃতি ও পরিধি ব্যাখ্যা করতে পারবে না। এযাবৎ দাঙ্গার ঘটনায় যুক্ত ব্যক্তিদের পরিচিতি ও প্রোফাইল এবং দাঙ্গার সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে যত দূর জানা গেছে, তাতে এটা স্পষ্ট, খুব সহজেই এর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। কারণ অনুসন্ধানের এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি প্রয়োজন পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষোভের কারণগুলো মোকাবিলা করা যায়।
ইলিনয়
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments