নিরাপদ সড়ক-এভাবে আর চলতে পারে না by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
গত ১৩ আগস্ট ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক ও অকালমৃত্যুতে বাংলাদেশের সড়ক ও যানবাহন ব্যবস্থাপনায় সরকারের নিদারুণ ব্যর্থতায় দেশবাসী সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে। একই দিনে পাবনায় আরও একটি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা এখন সিরিজের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে একটি মিনি ট্রাক রাস্তার পাশে খাদে পড়ে গেলে প্রায় ৪১ জন স্কুল-কলেজছাত্র মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে এত মানুষের মৃত্যু স্মরণকালের ইতিহাসে আর দেখা যায় না।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। তবু যখন তারেক মাসুদের মতো খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার বা মিশুক মুনীরের মতো অভিজ্ঞ ও দক্ষ টিভি সাংবাদিক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে মৃত্যুবরণ করেন, তখন দেশের মানুষ নিশ্চুপ থাকতে পারে না। দেশের ঘরে ঘরে, আড্ডায়, অফিসে, গণমাধ্যমে বহু মানুষ সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে এখন সোচ্চার।
তবে অভ্যাসমতো আমরা আবার আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাব। আমাদের স্বাভাবিক জীবনে আমরা ফিরে যাব। আবার যদি সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো বিশিষ্ট বা বরেণ্য ব্যক্তি মারা যান, তখন আমরা আবার হয়তো ক্ষোভে ফুঁসে উঠব। মাঝখানে থাকবে দীর্ঘ বিরতি।
কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। এটা শুধু আমার কথা নয়, বহু মানুষ গত কয়েক দিন নানা ভঙ্গিতে প্রায় একই রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। অনেকে বলতে পারেন, দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, এর ওপর কারও হাত নেই। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার পুরোটাই নিয়তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এখানে সরকারের অনেক করণীয় রয়েছে। বিশেষ করে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের।
সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দায়ী অদক্ষ ও অমনোযোগী ড্রাইভার। সংবাদপত্রের নানা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঘুষ দিয়ে এ দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। এটা কোনো সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায় না। ইউরোপ, আমেরিকায় বহু মানুষ এক দফা পরীক্ষায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পায় না। তাদের বারবার পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষায় থিওরিটিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল দুটোই বেশ শক্ত ধাঁচের। বহু টাকা ব্যয় করে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়। কারণ ওই সব দেশের সরকার জানে, বাস, ট্রাক নিয়ে রাস্তায় নামলেই তো পথচারী বা অন্য কোনো গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। আর সড়ক দুর্ঘটনা মানে মৃত্যু, অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিদেশের এই কড়াকড়ির কথা সরকার জানে না, তা নয়। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারগুলো হলো ঢিলেঢালা। ক্ষমতাসীনেরা নিজের ও আত্মীয়স্বজনের পকেট ভরাতেই বেশি মনোযোগী। তাই মন্ত্রীরা বড় বড় প্রকল্প নিয়েই বেশি ব্যস্ত। যেসব প্রকল্পে দাতা সংস্থা বা বিদেশি কোম্পানি যুক্ত, সেসব প্রকল্পে তাঁদের আগ্রহ আরও বেশি। শহরের রাস্তাঘাট বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাঁদের কোথায়? এগুলো দেখার জন্য উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারাই আছেন। আমাদের প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র এমনভাবে বিকশিত হয়েছে যে, একজন উপসচিব বা যুগ্ম সচিব দায়িত্ব নিয়ে বা উদ্যোগ নিয়ে ছোটখাটো পলিসিগত কোনো কাজ করতে পারেন না। সব কাজেই তাঁকে সচিব বা মন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হতে হয়। সচিব বা মন্ত্রীর সময় খুব মূল্যবান। বড় বড় প্রকল্পের ফাইল দেখতে ও প্রকল্পের নানা হিস্যা ঠিকমতো সামলাতেই তাঁরা ব্যস্ত। আর মেগা প্রকল্প হলে তার হিস্যা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও নানা ঠিকানায় পৌঁছাতে হয়। দাতা সংস্থা বা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে এসব ব্যাপারে দরদাম করা, প্রসেস করা, ঠিকমতো যথাসময়ে হিস্যা পৌঁছানো এসব কাজেই মন্ত্রী-সচিবের ব্যস্ততা বেশি। তাঁদের হাতে সময় খুব কম। মাত্র পাঁচ বছর। পরের পাঁচ বছর সম্পর্কে কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কাজেই মন্ত্রী, সচিব বা ওপরের কর্তাদের খুবই তাড়া বড় বড় প্রকল্প নিয়ে। বড় বড় চুক্তি নিয়ে।
বিআরটিএ নামের সরকারি প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বহু বছর যাবৎ বহু অভিযোগ। এগুলো কি মনগড়া অভিযোগ? কোনো বিরোধী দলকে বিআরটিএ নিয়ে কোনো কথা বলতে আমি কখনো শুনিনি। গণমাধ্যম বলেছে, বা নাগরিক সমাজের কোনো ফোরাম বলেছে। অথচ আজ পর্যন্ত কোনো সরকার বিআরটিএকে একটি দুর্নীতিমুক্ত, পরিচ্ছন্ন প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেনি। ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস ও প্রাসঙ্গিক নানা কাজের দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানের ওপর। শুধু দুর্নীতিমুক্ত করা নয়, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার নিয়মাবলি পর্যালোচনা করা, লাইসেন্স রিনিউ করার নিয়মাবলি পর্যালোচনা করা, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নানা বিষয় রয়েছে, যেগুলো এখনো মান্ধাতা আমলের। ড্রাইভিং লাইসেন্স-সংক্রান্ত প্রতিটি নিয়ম পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী নিয়মনীতি রচনা করা দরকার। প্রাইভেট গাড়ি চালানোর লাইসেন্স, বড় বড় বাস-ট্রাক চালানোর লাইসেন্স আর হাইওয়েতে চালানোর লাইসেন্স একই নিয়মে পাওয়া উচিত নয়। প্রয়োজন হলে শুধু শহরে গাড়ি চালানোর মতো একধরনের ‘বিশেষ লাইসেন্স’ ইস্যু করা যেতে পারে, যে লাইসেন্সে শুধু প্রাইভেট গাড়ি চালাতে পারবে; বাস বা ট্রাক বা মাইক্রোবাস চালাতে পারবে না। যারা শুধু প্রাইমারি পর্যন্ত পড়তে চায় তাদের বিএ ক্লাসের সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়ার তো দরকার নেই। এ রকম নানা বিকল্পের কথা ভাবতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার নিয়ম কড়া করে ‘ঘুষের রেট’ বাড়িয়ে দিলে কাজের কাজ কিছু হবে না। নিয়মাবলি কড়া করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে দুর্নীতির মাত্রা অনেক কমাতে হবে (দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে—এমন কথা লিখতে সাহস পাই না, কারণ বাংলাদেশে তা অসম্ভব!)।
গাড়ি, ট্রাক ও বাসের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করে নতুন নিয়ম প্রণয়ন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বর্তমানে যারা লাইসেন্স পেয়েছে, কোনো নিয়মের মধ্যে এনে তাদের পুনরায় পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে বাস ও ট্রাকের ড্রাইভারদের। হেলপার যাতে কখনো বাস বা ট্রাক চালাতে না পারে সে জন্য হাইওয়েতে আকস্মিক চেকিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। হেলপার কোনো বাস বা ট্রাক চালালে সেই বাস বা ট্রাকই বাজেয়াপ্ত করতে হবে। কারণ এই যানবাহনটি বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বাস বা ট্রাকের মালিকের দায়িত্বহীনতার খেসারত দিতে হবে। না হলে কেউ শিক্ষা নেবে না (এ ক্ষেত্রেও ঘুষ একটা বাধা হতে পারে, তা জেনেও প্রস্তাব দিচ্ছি)।
সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে আইনের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের আইন মন্ত্রণালয় (সব আমলের) যে কোনো সচেতনতা বা সক্রিয়তার পরিচয় দেয়নি, তা বললে অসত্য বলা হবে না। সড়ক দুর্ঘটনায় কে নিহত হলো তা তাদের কাছে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। আইন মন্ত্রণালয় ব্যস্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে। কারণ এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতি করা যায়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। নেত্রীকে খুশি করা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির জন্য মামলা-মোকদ্দমা, আইন বা ড্রাইভারের শাস্তি ইত্যাদি খুবই নীরস বিষয়। আইনমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা আমলারা এসব ছোটখাটো বিষয়ে মাথা ঘামাতে চান বলে মনে হয় না। অতীতেও তেমন মাথা ঘামাতে কোনো আইনমন্ত্রীকে দেখিনি।
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর মনে হয় আইন মন্ত্রণালয়কে এবার একটু মাথা ঘামাতে হবে। না হলে এই সরকারের আর রক্ষা নেই। যুদ্ধাপরাধীর বিচার বা ২১ আগস্টের বিচারের রব তুলে আর বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা যাবে বলে মনে হয় না। মানুষ নানা কারণে খেপে উঠেছে।
কাজেই দায়ী ড্রাইভারের চরম দণ্ড দেওয়ার দাবি আর উপেক্ষা করা যাবে না। দুর্ঘটনাসংক্রান্ত যাবতীয় আইন ও শাস্তির বিধান পর্যালোচনা করে একে হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য আইন ও শাস্তির বিধান করতে হবে। এবং এই পর্যালোচনার কাজ এখনই শুরু করতে হবে। আর বিলম্বের সুযোগ নেই।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও মানুষ মারা যাচ্ছে। বুয়েটের হিসাবে বছরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুতে জনমনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তার ধাক্কায় যদি সরকারের চৈতন্য জাগ্রত হয় তাহলে কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমরা যারা সাধারণ, আমরা অনেক সময় অনেক কিছু ভুলে যাই। হয়তো আজকের এই ক্ষোভও একদিন ফিকে হয়ে যাবে (রাজনীতিবিদদের এটাই ভরসা)। হয়তো তখন অন্য কোনো ইস্যু নাগরিক মনে প্রভাব বিস্তার করবে। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যেন এমনটি না হয়। নাগরিক সমাজ যদি সড়ক দুর্ঘটনা ইস্যুতে সড়ক উন্নয়ন, সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে কড়াকড়ি, ভুয়া লাইসেন্স উদ্ধার, হেলপার দিয়ে বাস-ট্রাক চালানো বন্ধ, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ, বড় বড় হাইওয়ে পর্যায়ক্রমে চার লেনে উন্নীত করা, যানবাহনের স্পিড নিয়ন্ত্রণ ও তা মনিটরিং, ঘাতক ড্রাইভারদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও অর্থদণ্ড ইত্যাদি দাবিতে সোচ্চার থাকে, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা হ্রাস পেতে পারে।
দুর্ঘটনা বলেকয়ে হয় না। কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষে যতটা ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সরকার যেন তা নিতে অবহেলা না করে।
দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সুশাসন ইত্যাদি কারণে বর্তমান সরকার নানাভাবে এখন সমালোচিত। তাদের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী। ঠিক এ রকম সময় সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের দুজন কৃতী সন্তানের মর্মান্তিক মৃত্যু সাধারণ মানুষকে সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এ সময় সরকার যদি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেয় তাহলে জনগণের এই ক্ষোভ বৃহত্তর ইস্যুতে সম্প্রসারিত হতে পারে। পরিস্থিতি কিন্তু সেদিকেই এগোচ্ছে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। তবু যখন তারেক মাসুদের মতো খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার বা মিশুক মুনীরের মতো অভিজ্ঞ ও দক্ষ টিভি সাংবাদিক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে মৃত্যুবরণ করেন, তখন দেশের মানুষ নিশ্চুপ থাকতে পারে না। দেশের ঘরে ঘরে, আড্ডায়, অফিসে, গণমাধ্যমে বহু মানুষ সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে এখন সোচ্চার।
তবে অভ্যাসমতো আমরা আবার আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাব। আমাদের স্বাভাবিক জীবনে আমরা ফিরে যাব। আবার যদি সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো বিশিষ্ট বা বরেণ্য ব্যক্তি মারা যান, তখন আমরা আবার হয়তো ক্ষোভে ফুঁসে উঠব। মাঝখানে থাকবে দীর্ঘ বিরতি।
কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। এটা শুধু আমার কথা নয়, বহু মানুষ গত কয়েক দিন নানা ভঙ্গিতে প্রায় একই রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। অনেকে বলতে পারেন, দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, এর ওপর কারও হাত নেই। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার পুরোটাই নিয়তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এখানে সরকারের অনেক করণীয় রয়েছে। বিশেষ করে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের।
সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দায়ী অদক্ষ ও অমনোযোগী ড্রাইভার। সংবাদপত্রের নানা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঘুষ দিয়ে এ দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। এটা কোনো সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায় না। ইউরোপ, আমেরিকায় বহু মানুষ এক দফা পরীক্ষায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পায় না। তাদের বারবার পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষায় থিওরিটিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল দুটোই বেশ শক্ত ধাঁচের। বহু টাকা ব্যয় করে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়। কারণ ওই সব দেশের সরকার জানে, বাস, ট্রাক নিয়ে রাস্তায় নামলেই তো পথচারী বা অন্য কোনো গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। আর সড়ক দুর্ঘটনা মানে মৃত্যু, অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিদেশের এই কড়াকড়ির কথা সরকার জানে না, তা নয়। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারগুলো হলো ঢিলেঢালা। ক্ষমতাসীনেরা নিজের ও আত্মীয়স্বজনের পকেট ভরাতেই বেশি মনোযোগী। তাই মন্ত্রীরা বড় বড় প্রকল্প নিয়েই বেশি ব্যস্ত। যেসব প্রকল্পে দাতা সংস্থা বা বিদেশি কোম্পানি যুক্ত, সেসব প্রকল্পে তাঁদের আগ্রহ আরও বেশি। শহরের রাস্তাঘাট বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাঁদের কোথায়? এগুলো দেখার জন্য উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারাই আছেন। আমাদের প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র এমনভাবে বিকশিত হয়েছে যে, একজন উপসচিব বা যুগ্ম সচিব দায়িত্ব নিয়ে বা উদ্যোগ নিয়ে ছোটখাটো পলিসিগত কোনো কাজ করতে পারেন না। সব কাজেই তাঁকে সচিব বা মন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হতে হয়। সচিব বা মন্ত্রীর সময় খুব মূল্যবান। বড় বড় প্রকল্পের ফাইল দেখতে ও প্রকল্পের নানা হিস্যা ঠিকমতো সামলাতেই তাঁরা ব্যস্ত। আর মেগা প্রকল্প হলে তার হিস্যা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও নানা ঠিকানায় পৌঁছাতে হয়। দাতা সংস্থা বা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে এসব ব্যাপারে দরদাম করা, প্রসেস করা, ঠিকমতো যথাসময়ে হিস্যা পৌঁছানো এসব কাজেই মন্ত্রী-সচিবের ব্যস্ততা বেশি। তাঁদের হাতে সময় খুব কম। মাত্র পাঁচ বছর। পরের পাঁচ বছর সম্পর্কে কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কাজেই মন্ত্রী, সচিব বা ওপরের কর্তাদের খুবই তাড়া বড় বড় প্রকল্প নিয়ে। বড় বড় চুক্তি নিয়ে।
বিআরটিএ নামের সরকারি প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বহু বছর যাবৎ বহু অভিযোগ। এগুলো কি মনগড়া অভিযোগ? কোনো বিরোধী দলকে বিআরটিএ নিয়ে কোনো কথা বলতে আমি কখনো শুনিনি। গণমাধ্যম বলেছে, বা নাগরিক সমাজের কোনো ফোরাম বলেছে। অথচ আজ পর্যন্ত কোনো সরকার বিআরটিএকে একটি দুর্নীতিমুক্ত, পরিচ্ছন্ন প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেনি। ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস ও প্রাসঙ্গিক নানা কাজের দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানের ওপর। শুধু দুর্নীতিমুক্ত করা নয়, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার নিয়মাবলি পর্যালোচনা করা, লাইসেন্স রিনিউ করার নিয়মাবলি পর্যালোচনা করা, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নানা বিষয় রয়েছে, যেগুলো এখনো মান্ধাতা আমলের। ড্রাইভিং লাইসেন্স-সংক্রান্ত প্রতিটি নিয়ম পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী নিয়মনীতি রচনা করা দরকার। প্রাইভেট গাড়ি চালানোর লাইসেন্স, বড় বড় বাস-ট্রাক চালানোর লাইসেন্স আর হাইওয়েতে চালানোর লাইসেন্স একই নিয়মে পাওয়া উচিত নয়। প্রয়োজন হলে শুধু শহরে গাড়ি চালানোর মতো একধরনের ‘বিশেষ লাইসেন্স’ ইস্যু করা যেতে পারে, যে লাইসেন্সে শুধু প্রাইভেট গাড়ি চালাতে পারবে; বাস বা ট্রাক বা মাইক্রোবাস চালাতে পারবে না। যারা শুধু প্রাইমারি পর্যন্ত পড়তে চায় তাদের বিএ ক্লাসের সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়ার তো দরকার নেই। এ রকম নানা বিকল্পের কথা ভাবতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার নিয়ম কড়া করে ‘ঘুষের রেট’ বাড়িয়ে দিলে কাজের কাজ কিছু হবে না। নিয়মাবলি কড়া করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে দুর্নীতির মাত্রা অনেক কমাতে হবে (দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে—এমন কথা লিখতে সাহস পাই না, কারণ বাংলাদেশে তা অসম্ভব!)।
গাড়ি, ট্রাক ও বাসের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করে নতুন নিয়ম প্রণয়ন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বর্তমানে যারা লাইসেন্স পেয়েছে, কোনো নিয়মের মধ্যে এনে তাদের পুনরায় পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে বাস ও ট্রাকের ড্রাইভারদের। হেলপার যাতে কখনো বাস বা ট্রাক চালাতে না পারে সে জন্য হাইওয়েতে আকস্মিক চেকিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। হেলপার কোনো বাস বা ট্রাক চালালে সেই বাস বা ট্রাকই বাজেয়াপ্ত করতে হবে। কারণ এই যানবাহনটি বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বাস বা ট্রাকের মালিকের দায়িত্বহীনতার খেসারত দিতে হবে। না হলে কেউ শিক্ষা নেবে না (এ ক্ষেত্রেও ঘুষ একটা বাধা হতে পারে, তা জেনেও প্রস্তাব দিচ্ছি)।
সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে আইনের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের আইন মন্ত্রণালয় (সব আমলের) যে কোনো সচেতনতা বা সক্রিয়তার পরিচয় দেয়নি, তা বললে অসত্য বলা হবে না। সড়ক দুর্ঘটনায় কে নিহত হলো তা তাদের কাছে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। আইন মন্ত্রণালয় ব্যস্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে। কারণ এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতি করা যায়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। নেত্রীকে খুশি করা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির জন্য মামলা-মোকদ্দমা, আইন বা ড্রাইভারের শাস্তি ইত্যাদি খুবই নীরস বিষয়। আইনমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা আমলারা এসব ছোটখাটো বিষয়ে মাথা ঘামাতে চান বলে মনে হয় না। অতীতেও তেমন মাথা ঘামাতে কোনো আইনমন্ত্রীকে দেখিনি।
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর মনে হয় আইন মন্ত্রণালয়কে এবার একটু মাথা ঘামাতে হবে। না হলে এই সরকারের আর রক্ষা নেই। যুদ্ধাপরাধীর বিচার বা ২১ আগস্টের বিচারের রব তুলে আর বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা যাবে বলে মনে হয় না। মানুষ নানা কারণে খেপে উঠেছে।
কাজেই দায়ী ড্রাইভারের চরম দণ্ড দেওয়ার দাবি আর উপেক্ষা করা যাবে না। দুর্ঘটনাসংক্রান্ত যাবতীয় আইন ও শাস্তির বিধান পর্যালোচনা করে একে হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য আইন ও শাস্তির বিধান করতে হবে। এবং এই পর্যালোচনার কাজ এখনই শুরু করতে হবে। আর বিলম্বের সুযোগ নেই।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও মানুষ মারা যাচ্ছে। বুয়েটের হিসাবে বছরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুতে জনমনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তার ধাক্কায় যদি সরকারের চৈতন্য জাগ্রত হয় তাহলে কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমরা যারা সাধারণ, আমরা অনেক সময় অনেক কিছু ভুলে যাই। হয়তো আজকের এই ক্ষোভও একদিন ফিকে হয়ে যাবে (রাজনীতিবিদদের এটাই ভরসা)। হয়তো তখন অন্য কোনো ইস্যু নাগরিক মনে প্রভাব বিস্তার করবে। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যেন এমনটি না হয়। নাগরিক সমাজ যদি সড়ক দুর্ঘটনা ইস্যুতে সড়ক উন্নয়ন, সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে কড়াকড়ি, ভুয়া লাইসেন্স উদ্ধার, হেলপার দিয়ে বাস-ট্রাক চালানো বন্ধ, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ, বড় বড় হাইওয়ে পর্যায়ক্রমে চার লেনে উন্নীত করা, যানবাহনের স্পিড নিয়ন্ত্রণ ও তা মনিটরিং, ঘাতক ড্রাইভারদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও অর্থদণ্ড ইত্যাদি দাবিতে সোচ্চার থাকে, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা হ্রাস পেতে পারে।
দুর্ঘটনা বলেকয়ে হয় না। কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষে যতটা ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সরকার যেন তা নিতে অবহেলা না করে।
দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সুশাসন ইত্যাদি কারণে বর্তমান সরকার নানাভাবে এখন সমালোচিত। তাদের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী। ঠিক এ রকম সময় সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের দুজন কৃতী সন্তানের মর্মান্তিক মৃত্যু সাধারণ মানুষকে সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এ সময় সরকার যদি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেয় তাহলে জনগণের এই ক্ষোভ বৃহত্তর ইস্যুতে সম্প্রসারিত হতে পারে। পরিস্থিতি কিন্তু সেদিকেই এগোচ্ছে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments