কাগুজে কাণ্ড by শেখ রোকন
বই পড়ছেন মানে প্রকারান্তরে আপনি গাছ কাটছেন_ মুদ্রণমাধ্যম হিসেবে কাগজ ব্যবহারের বিপক্ষে পরিবেশবাদীদের এমন স্লোগান বাজার পাওয়ার আগে খোদ বইকেই তুলনা করা হতো গাছের সঙ্গে। কারণ সহজ-সরল। বৃক্ষের মতো বইয়েরও পাতা থাকে। এ নিয়ে গ্রামবাংলায় প্রচলিত ধাঁধা এখনও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
একুশে বইমেলা যদি বসন্তের বদলে শরৎ বা হেমন্তে আয়োজিত হতো, বিষয়টিকে তুলনা করা যেত পাতাঝরা চিত্রকল্পের সঙ্গে। আবার বাঁধাইয়ের দুর্বলতার কারণে কোনো কোনো বইয়ের পাতা হয়তো বইমেলা শেষ হওয়ার আগেই ঝরতে শুরু করে। এসব পাতা ঠিক বই থেকেও ঝরে না। বইমেলায় যারা গেছেন, তারা জানেন প্রবেশমুখে দাঁড়ানো কিছু লোক কীভাবে আগতদের হাতে গুঁজে দেয় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। দামি কাগজ, রঙিন-সাদা-কালো, ঝকঝকে ছাপা, নানা আকৃতির এসব প্রচারপত্রের সিংহভাগই বইয়ের বিজ্ঞাপন। এক মাসে যদি কমবেশি চার হাজার বই ছাপা হয়, তার বিজ্ঞাপন যে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা ছাপিয়ে বইমেলার প্রবেশপথেও ভিড় জমাবে, তা নিশ্চিত।
অনিশ্চয়তা হচ্ছে, যাদের হাতে গুঁজে দেওয়া হয়, তাদের কতজন অন্তত একবারের জন্য হলেও এতে চোখ বোলান? বইমেলায় ঢুকতে গিয়ে নিজে কয়েকবার এগুলো উল্টেপাল্টে দেখেছি বিষয়টি বোঝার জন্য। কিন্তু সহ-পদযাত্রীদের দেখেছি পত্রপাঠ তা ফেলে দিতে। বেশ কয়েক বছর আগে দেখা নাম ভুলে যাওয়া এক হিন্দি মুভির দৃশ্যও মনে পড়ে গিয়েছিল। ব্যস্ত এভিনিউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আর্তমানবতার সাহায্যার্থে লিফলেট বিলি করছিল একদল তরুণ-তরুণী। কিন্তু করপোরেট কেতাদুরস্ত লোকজনের সময় ছিল না তা পড়ে দেখার। একনজর দেখে বা না দেখেই ছুড়ে ফেলছিল সেই আবেদনপত্র। নায়ক এসে দেখিয়ে দিলেন নতুন পদ্ধতি। প্রতিটি লিফলেট দলা পাকিয়ে পথিকের হাতে তুলে দিলে পথিক অন্তত কৌতূহলবশত সেটা খুলে দেখেন।
বইমেলার প্রবেশপথে দাঁড়ানো বিজ্ঞাপনদাতাদের কাউকে অবশ্য কার্যকর এই পথ মাড়াতে দেখা যায়নি। তবে দর্শনার্থীদের কেউ কেউ সৃজনশীল বটে। প্রচারপত্র না পড়েই ছিঁড়ে কুটি কুটি করতে করতে বইমেলায় ঢোকেন। ফলাফল জঞ্জালের শনৈঃশনৈ উন্নতি। প্রতিদিন বইমেলা শেষে বাংলা একাডেমীর সামনের রাস্তায় স্তূপ হয়ে থাকে বর্ণিল কাগুজে বিজ্ঞাপন। বইমেলার ছুৎমার্গ নিয়ে চিন্তিত বইপ্রেমীরা একাডেমী চত্বরে ও বাইরের রাস্তায় বইমেলার 'পরিবেশ' নিয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করতে করতে বই হাতে ঘরে ফেরেন। ওদিকে পায়ের নিচে পড়ে থাকা 'বিজ্ঞাপন তরঙ্গ' ধুলো আর সুখতলার মাখামাখিতে ধারণ করে বিচিত্র চেহারা।
গাছ কেটে কাগজ বানিয়ে বই প্রকাশ_ তাও পরিবেশবাদীরা মানতে পারেন। কাগজের এমন অপচয় মানা যায় কোন প্রাণে? প্রকাশনা ছাড়া অন্যান্য স্টল সরিয়ে পরিচ্ছন্ন বইমেলার দাবি নাগরিক সমাজ থেকে প্রতি বছর তোলা হয়। সেসব দোকানের থেকে প্রবেশপথে বিজ্ঞাপনের জঞ্জাল কি আরও বিপর্যয়কর নয়? বিজ্ঞাপনের এমন হিড়িক সামাল দিতে গিয়ে কাগজের দর আর ছাপাখানার ব্যস্ততাও কি কয়েকগুণ বেড়ে যায় না? অনিবার্য পরিণতি হলো বইয়ের দাম বৃদ্ধি, মুদ্রণমান কমে যাওয়া। সৈয়দ মুজতবা আলী এই দৃশ্য দেখলে হয়তো বাঙালির বই না পড়ার কারণ সম্পর্কে তার তত্ত্বে বিজ্ঞাপনের এই বাড়াবাড়িও যুক্ত করতেন।
বড় কথা, কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করে এই কাগুজে কাণ্ডে তথা দণ্ডায়মান লেখকদেরই-বা কী লাভ হয়? দর্শনার্থীদের বিরক্তি আর তাচ্ছিল্য অর্জন ছাড়া আর কী জোটে?
skrokon@gmail.com
অনিশ্চয়তা হচ্ছে, যাদের হাতে গুঁজে দেওয়া হয়, তাদের কতজন অন্তত একবারের জন্য হলেও এতে চোখ বোলান? বইমেলায় ঢুকতে গিয়ে নিজে কয়েকবার এগুলো উল্টেপাল্টে দেখেছি বিষয়টি বোঝার জন্য। কিন্তু সহ-পদযাত্রীদের দেখেছি পত্রপাঠ তা ফেলে দিতে। বেশ কয়েক বছর আগে দেখা নাম ভুলে যাওয়া এক হিন্দি মুভির দৃশ্যও মনে পড়ে গিয়েছিল। ব্যস্ত এভিনিউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আর্তমানবতার সাহায্যার্থে লিফলেট বিলি করছিল একদল তরুণ-তরুণী। কিন্তু করপোরেট কেতাদুরস্ত লোকজনের সময় ছিল না তা পড়ে দেখার। একনজর দেখে বা না দেখেই ছুড়ে ফেলছিল সেই আবেদনপত্র। নায়ক এসে দেখিয়ে দিলেন নতুন পদ্ধতি। প্রতিটি লিফলেট দলা পাকিয়ে পথিকের হাতে তুলে দিলে পথিক অন্তত কৌতূহলবশত সেটা খুলে দেখেন।
বইমেলার প্রবেশপথে দাঁড়ানো বিজ্ঞাপনদাতাদের কাউকে অবশ্য কার্যকর এই পথ মাড়াতে দেখা যায়নি। তবে দর্শনার্থীদের কেউ কেউ সৃজনশীল বটে। প্রচারপত্র না পড়েই ছিঁড়ে কুটি কুটি করতে করতে বইমেলায় ঢোকেন। ফলাফল জঞ্জালের শনৈঃশনৈ উন্নতি। প্রতিদিন বইমেলা শেষে বাংলা একাডেমীর সামনের রাস্তায় স্তূপ হয়ে থাকে বর্ণিল কাগুজে বিজ্ঞাপন। বইমেলার ছুৎমার্গ নিয়ে চিন্তিত বইপ্রেমীরা একাডেমী চত্বরে ও বাইরের রাস্তায় বইমেলার 'পরিবেশ' নিয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করতে করতে বই হাতে ঘরে ফেরেন। ওদিকে পায়ের নিচে পড়ে থাকা 'বিজ্ঞাপন তরঙ্গ' ধুলো আর সুখতলার মাখামাখিতে ধারণ করে বিচিত্র চেহারা।
গাছ কেটে কাগজ বানিয়ে বই প্রকাশ_ তাও পরিবেশবাদীরা মানতে পারেন। কাগজের এমন অপচয় মানা যায় কোন প্রাণে? প্রকাশনা ছাড়া অন্যান্য স্টল সরিয়ে পরিচ্ছন্ন বইমেলার দাবি নাগরিক সমাজ থেকে প্রতি বছর তোলা হয়। সেসব দোকানের থেকে প্রবেশপথে বিজ্ঞাপনের জঞ্জাল কি আরও বিপর্যয়কর নয়? বিজ্ঞাপনের এমন হিড়িক সামাল দিতে গিয়ে কাগজের দর আর ছাপাখানার ব্যস্ততাও কি কয়েকগুণ বেড়ে যায় না? অনিবার্য পরিণতি হলো বইয়ের দাম বৃদ্ধি, মুদ্রণমান কমে যাওয়া। সৈয়দ মুজতবা আলী এই দৃশ্য দেখলে হয়তো বাঙালির বই না পড়ার কারণ সম্পর্কে তার তত্ত্বে বিজ্ঞাপনের এই বাড়াবাড়িও যুক্ত করতেন।
বড় কথা, কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করে এই কাগুজে কাণ্ডে তথা দণ্ডায়মান লেখকদেরই-বা কী লাভ হয়? দর্শনার্থীদের বিরক্তি আর তাচ্ছিল্য অর্জন ছাড়া আর কী জোটে?
skrokon@gmail.com
No comments