অবাঙালির ঠাকুর ও ওকাম্পো চর্চা by আন্দালিব রাশদী
অবাঙালি আবু সায়ীদ আইয়ুব বাংলা শিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ক্রমাগত লিখে গেছেন। রবীন্দ্র-সাহিত্যের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের স্বোপার্জিত অধিকারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র-লেখক তিনি। সেখানে তাঁর বাংলাচর্চার অন্যতম কারণ রবীন্দ্রনাথ ও গৌরী, তাঁর স্ত্রী।
স্ত্রীর মাতৃভাষার শ্রেষ্ঠ কবিকে আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কারের ব্রত নিয়ে নেমেছিলেন আরও একজন অবাঙালি, আনোয়ার দিল। জন্ম পাঞ্জাবের জলন্ধরে। লালিত-পালিত অ্যাবোটাবাদে। তাঁর পেছনের নারী আফিয়া দিল, তিনিও স্বনামখ্যাত। অশীতিপর এই দম্পতি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চায় নিভৃতে আমাদের অনেককেই ছাড়িয়ে গেছেন।
আনোয়ার দিল বাংলাদেশ নিয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশ: অ্যান ইন্টারকালচারাল মোজাইক (২০১০), বাংলাদেশ : অ্যান ইন্টারকালচারাল প্যানোরোমা (২০১১) আর আফিয়া দিলকে সঙ্গে নিয়ে লিখেছেন, বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ। তাঁর বিস্তৃত রচনাবলির যে ধারা, মনে হয় সে ধারা থেকে খানিকটা বেরিয়ে গিয়ে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর অ্যান্ড বিক্তোরিয়া ওকাম্পো: দ্য ক্রিয়েটিভ টাচ। বাজারে অবমুক্তির সময় দেখানো হয়েছে ফেব্রুয়ারি, ২০১২।
একবার পড়তে শুরু করলে বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যাঁদের আগ্রহ প্রবল, ৩৩২ পৃষ্ঠার বইটি শেষ না করে অন্য কোনো পর্বে মনোযোগী হতে চাইবেন না।
বিক্তোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কম লেখা হয়নি। তার পরও আবার কেন?
গ্রন্থটি নিজেই একটি সহজ উত্তর দেয়: বিক্তোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে প্রাপ্য সম্ভাব্য সর্বাধিক তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে এ বইটিতে। তার ওপর লেখক সচেতনভাবে এই দুজনের সম্পর্কের মাঝখানে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন একটি ‘ক্রিয়েটিভ টাচ’—সৃজনশীলতার স্পর্শ।
পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুজনার জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ভারতের কলকাতায় ১৮৬১ সালে। ১৯ বছর পর ১৮৯০ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর। ১৯২৪ সালের নভেম্বরে বিক্তোরিয়া ওকাম্পো নিজ বাড়িতে ঠাকুরকে পেলেন অতিথি হিসেবে। বিক্তোরিয়া উদ্বেলিত। ঠাকুরও পেলেন ৬৩ বছর বয়সে ‘দ্বিতীয় যৌবন’।
রবীন্দ্রনাথ ও বিক্তোরিয়া অবাঙালি আনোয়ার দিলের উপলক্ষ মাত্র। তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারার ইতিহাসটিই তুলে ধরতে চেয়েছেন।
তিনি রবীন্দ্রনাথকে জানেন আট বছর বয়স থেকে। আফিয়া দিলকে অবশ্য আরও অনেক পরে। তার পরও আনোয়ার দিলের স্ত্রী যদি আরবিভাষী হতেন, হয়তো তাঁর গবেষণা গ্রন্থটি হতো নাগিব মাহফুজকে নিয়ে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয়।
রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড বিক্তোরিয়া ওকাম্পো: দ্য ক্রিয়েটিভ টাচ সতত সৃজনশীল আনোয়ার দিলের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবেই থেকে যাবে। আগামী দিনের গবেষক যদি রবীন্দ্রনাথে এই ‘লাতিন আমেরিকা কানেকশন’ নিয়ে লিখতে বসবেন, হাতের কাছে সূত্র-গ্রন্থ হিসেবে এই ক্রিয়েটিভ টাচকেই রাখতে হবে।
গ্রন্থটি কখনো কখনো আবেগস্পৃষ্ট মনে হলেও আনোয়ার দিল উপযুক্ত সূত্র ও প্রামাণিক রচনা দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করিয়েছেন। বাংলাদেশচর্চার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথচর্চার জন্য পাঞ্জাবি এই লেখকের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই হয়। তাঁর চাওয়া কিছু থাকুক বা না থাকুক, নিরন্তর বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। তাঁকে উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্যের অভ্যাস আমাদের ঝেড়ে ফেলা দরকার।
যৌথ উদ্যোগে ইন্টারকালচারাল ফোরাম ও অ্যাডর্ন বুকস প্রকাশ করেছে এ বইটি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ্যান্ড বিক্তোরিয়া ওকাম্পো: দ্য ক্রিয়েটিভ টাচ থেকে তাঁর রচনার কয়েকটি অনুচ্ছেদ অনুবাদ করা হলো।
বিক্তোরিয়া ওকাম্পো জানলেন
ঠাকুর পেরুর পথে বুয়েনস এইরেস আসছেন
১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পেরুর জাতীয় উৎসবে যোগ দিতে সেখানে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্জেন্টিনা হয়ে যাবেন বলে লা নেশিওন (বুয়েনস এইরেস) পত্রিকা থেকে জানলেন বিক্তোরিয়া ওকাম্পো। আর তখন এটাও প্রত্যাশিত যে তিনি বুয়েনস এইরেসে কয়েক দিনের যাত্রাবিরতি দেবেন। লা নেশিওন পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লিখে বিক্তোরিয়া সম্প্রতি সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, দান্তে, রাসকিন ও গান্ধীকে নিয়ে—তিনজনের ওপর তাঁর প্রবল ভক্তি। এই যাত্রাবিরতির খবরে তিনি কেমন অনুভব করলেন। ‘ট্যাগোর অন দ্য ব্যাংকস অব দ্য রিভার প্লেট’ শীর্ষক একটি রচনায় তা উল্লেখ করেছেন।
‘১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঘোষিত হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেরুর পথে বুয়েনস এইরেস হয়ে যাবেন। ঠিক সে মুহূর্ত থেকেই আমরা যারা আদ্রে জিদের ফরাসি অনুবাদ ইয়েটসের ভূমিকাসহ তাঁর নিজের করা ইংরেজি ভাষান্তর ছেনোবিয়া কাম্পরুবির (হুয়ান র্যামন হিমেনেথের স্ত্রী) স্প্যানীয় অনুবাদে তাঁর কবিতা পড়েছি, আমরা গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে কবির আগমনের প্রতীক্ষা করছি। এটাই হবে বছরের একটি বড় ঘটনা। আর আমার জন্য তা হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনাগুলোর একটি।’ তাঁর যে কী উত্তেজনা, তা বিক্তোরিয়ার নিজের লেখাতেই প্রকাশিত হয়েছে:
সান ইসিদ্রোতে সেই বসন্তটি ছিল স্বচ্ছ ও উষ্ণ আর গোলাপের অসাধারণ প্রাচুর্য। সকালবেলাগুলো আমার রুমেই কাটত। জানালা সব খোলা। আমি সুবাস নিচ্ছি। ঠাকুরের লেখা থেকে পড়ছি। ঠাকুরকে নিয়ে ভাবছি। ঠাকুরের ওপর লিখছি। ঠাকুরের জন্য প্রতীক্ষায় রয়েছি। এই পাঠ, ভাবনা, লেখা ও প্রতীক্ষার ফলাফল কয়েক পাতার একটি রচনা, পরে যা লা নেশিওন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রবল প্রত্যাশার দিনগুলোতে আমার কখনো মনে হয়নি সান ইসিদ্রোর খাড়া পাহাড়ে, আমার ভবনে কবি আমারই অতিথি হবেন। এটুকু আশা করার সাহসও হয়নি যে কবি তাঁর সংক্ষিপ্ত অবস্থানকালে, কবি তাঁর একান্ত ভক্তের সঙ্গে, যেমন—আমি একজন, দেখা করার সময় বের করে নেবেন। ডোরিস মেয়ার লিখেছেন: ‘প্রবল উৎসাহে উদ্দীপিত বিক্তোরিয়া। তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন তাঁর বইপত্রে, সেই সাক্ষাতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে যতটা সম্ভব তাঁর রচনাবলি পড়তে থাকলেন। এ ধরনের উদ্দীপনার মুহূর্ত যখন তাঁকে পেয়ে বসেছে, যেন তাঁর ধর্মাচারের অংশ হিসেবেই কবির রচনা পাঠে তাঁর প্রতিক্রিয়া এবং তাঁর ব্যাখ্যা দিয়ে কবির কাছে কাল্পনিক চিঠি লিখতে শুরু করেন। আর এগুলোই হয়ে ওঠে লা নেশিওন পত্রিকায় (নভেম্বর ১৯২৪) প্রকাশিত প্রবন্ধ, যার নামায়ন যথার্থই হয়েছে, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠের আনন্দ’।
ডোরিস মেয়ারের ওকাম্পো
স্প্যানিশ সাহিত্যের তরুণ আমেরিকান অধ্যাপক ডোরিস মেয়ার যখন এগেইনস্ট দ্য উইন্ড অ্যান্ড দ্য টাইড লেখেন, তখন তিনি নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটিতে; তিনি বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর নিবেদিত ভক্ত এবং ১৯৬২ থেকে তাঁর সঙ্গে আন্তরিক বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। বইটি লিখতে তিনি তাঁর অনেক সহায়তা পেয়েছেন। ১৯৭৮ সালে মুদ্রণের আগে বিক্তোরিয়া ওকাম্পো তা পড়েও দেখেছেন। জীবনীর নামটি তিনি ওকাম্পোর কথা থেকেই নিয়েছেন, যেখানে তিনি বলেছেন উদ্দীপনাপূর্ণ ও স্বাধীন কর্মজীবনের জন্য তাঁর সংগ্রাম বাতাস ও স্রোতের বিরুদ্ধে পাল তোলার নিঃশেষিত উদ্যোগের মতো। মেয়ারের ভাষায়, ‘চারপাশের সবার গালমন্দের ঝুঁকি নিয়ে, প্রথাকে অস্বীকার করে কলঙ্কের প্ররোচনা দিয়ে তিনি প্রাপ্তবয়স্কের মতোই যাত্রা শুরু করলেন। বাতাস ও স্রোতের বিরুদ্ধে পাল তুলে দিয়ে তিনি সংস্কৃতির অঙ্গনে নিজ দেশের যেকোনো নারীর চেয়ে বেশি অর্জন করেছেন। সম্ভবত লাতিন আমেরিকার ইতিহাসেও সবচেয়ে বেশি অর্জন তাঁরই। এমনকি এখনো, ৮৮ বছর বয়সী বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর নামে আর্জেন্টিনায় চোখ কপালে উঠে যায়।’ এ ভূমিকাটি লিখিত হয়েছে ১৯৭৮-এর সেপ্টেম্বরে। ওকাম্পোর মৃত্যু হয় ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭৯।
প্রথম জীবনে ওকাম্পোর বইপ্রীতির ব্যাপারটি মেয়ার চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। দান্তের ডিভাইন কমেডিয়া পাঠ করে ওকাম্পো যা লিখেছেন, তাতে তাঁর প্রস্ফুটনোন্মুখ বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের চিত্রটি ধরা পড়ে: ‘আমার ইতালীয় শিক্ষক যখন আমাকে ইনফার্নোর কিছু অংশ পড়িয়ে ছাড়লেন, আমি তখন কেবল ষোলো ছুঁয়েছি। এই পঠন আমার মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, তার সঙ্গে তুলনীয় আমার শৈশবের প্রথম সমুদ্রস্নান—ঢেউয়ের বিস্ময়কর শক্তিতে যেভাবে সৈকত বালুকায় আছড়ে পড়ি।’
মেয়ার লিখছেন, ‘বিয়েটা ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি যখন আধ্যাত্মিক স্বস্তি ও দিকনির্দেশনা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তিনি ফ্লোরেন্সের নির্বাসিত কবির সুললিত পঙিক্তমালার কাছে ফিরে এলেন। তিনি স্মরণ করলেন, এই কবিও জীবনের অন্ধকার অরণ্যে পথ হারিয়ে আত্মার মুক্তি নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি পড়তে ও পুনরায় পড়তে শুরু করলেন কেমন করে কবি চূড়ান্ত সত্যের দিকনির্দেশনা পেয়েছেন।
বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর মৃত্যু (১৯৭৯)
প্রায় ৯০ বছর বয়সে ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭৯ বিক্তোরিয়া ওকাম্পো মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে হোর্হে লুইস বোর্হেস লিখলেন: ১৯২৪ সালের দিকে (সঠিক তারিখ গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা বলাই যথেষ্ট যে ঘটনাটা অনেক দূর-অতীতের) একজন অপরিচিত যুবক যে নিজেকে কবি ভাবত, কিন্তু নিজের কবিতাগুলো ছিল বড় অপছন্দের, তখনই বিখ্যাত বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে পরিচিত হলো। যেমনটা প্রত্যাশিত ছিল, যুবক কর্তৃত্বপ্রবণ এই ভদ্রমহিলাকে একটু ভয় পেয়েছিল, সেই প্রাথমিক ভয় ৫০ বছরেও পুরোপুরি মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।
আমাদের প্রথম কথোপকথন আমার মনে নেই। মনে হয় আমরা ভাষা নিয়ে কথা বলেছিলাম। যখন দেখলাম উন্মুক্ত স্বরবর্ণ ও মাঝেমধ্যে হ্রস স্বরের শান্ত কাস্টিলিয়ান সংগীত তিনি অনুভব করছেন না, আমি বিস্মিত হইনি। সময়ের সঙ্গে অন্যান্য বিষয় আমাদের কাছাকাছি এনে দেয়; আর্জেন্টাইন সংস্কৃতির নবায়ন, উত্তম একত্ববাদী ঐতিহ্য এবং ইংল্যান্ডের সাহিত্যের জন্য অনুরাগ। এই কথাগুলো লেখার সময় আমি কেবল শেক্সপিয়ার কি সুইনবার্নের কথা ভাবিনি। আমি ভেবেছি আয়নার ভেতর দিয়ে দেখা মেয়েটির কথা। লিমেরিকে চতুর নির্বুদ্ধিতার কথা এবং শার্লক হোমস ও তার বরাবরই অভ্রান্ত নয় এমন একজন বসওয়েল ডক্টর ওয়াটসনের বন্ধুত্বের কথা। অন্যরা আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছে। আমি লেখকদের বিচার করেছি তাঁদের .আলংকারিক ভাষা ও আবিষ্কারের শক্তি দিয়ে; আর বিক্তোরিয়া করেছেন তাঁদের মেজাজ ও জৈবনিক বৃত্তান্ত দিয়ে। বইটা তো মুখোশ, তিনি বইয়ের পেছনের মুখের অনুসন্ধান করেছেন। সুখান্বেষী পাঠক হিসেবে যা তাঁকে আগ্রহান্বিত করেছে, তা পড়েছেন এবং পুনরায় পড়েছেন। আমি সন্দিহান, লাগাতর পাঠ তাঁর ধাতে ছিল না। যেমন, এখন নেই আমার।
বিক্তোরিয়া মৃত এবং আমি জানি তাঁর সঙ্গে যে সম্পর্ক, তা কখনো ব্যাহত হয়নি। তা আমার কাছে আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনি মৌল বিষয় হয়ে আছে। আমি প্রায় লিখেই ফেলতে পারি, আমাদের নীরব সত্য এবং বন্ধুত্ব আজই শুরু হয়েছে।
আনোয়ার দিল বাংলাদেশ নিয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশ: অ্যান ইন্টারকালচারাল মোজাইক (২০১০), বাংলাদেশ : অ্যান ইন্টারকালচারাল প্যানোরোমা (২০১১) আর আফিয়া দিলকে সঙ্গে নিয়ে লিখেছেন, বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ। তাঁর বিস্তৃত রচনাবলির যে ধারা, মনে হয় সে ধারা থেকে খানিকটা বেরিয়ে গিয়ে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর অ্যান্ড বিক্তোরিয়া ওকাম্পো: দ্য ক্রিয়েটিভ টাচ। বাজারে অবমুক্তির সময় দেখানো হয়েছে ফেব্রুয়ারি, ২০১২।
একবার পড়তে শুরু করলে বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যাঁদের আগ্রহ প্রবল, ৩৩২ পৃষ্ঠার বইটি শেষ না করে অন্য কোনো পর্বে মনোযোগী হতে চাইবেন না।
বিক্তোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কম লেখা হয়নি। তার পরও আবার কেন?
গ্রন্থটি নিজেই একটি সহজ উত্তর দেয়: বিক্তোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে প্রাপ্য সম্ভাব্য সর্বাধিক তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে এ বইটিতে। তার ওপর লেখক সচেতনভাবে এই দুজনের সম্পর্কের মাঝখানে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন একটি ‘ক্রিয়েটিভ টাচ’—সৃজনশীলতার স্পর্শ।
পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুজনার জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ভারতের কলকাতায় ১৮৬১ সালে। ১৯ বছর পর ১৮৯০ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর। ১৯২৪ সালের নভেম্বরে বিক্তোরিয়া ওকাম্পো নিজ বাড়িতে ঠাকুরকে পেলেন অতিথি হিসেবে। বিক্তোরিয়া উদ্বেলিত। ঠাকুরও পেলেন ৬৩ বছর বয়সে ‘দ্বিতীয় যৌবন’।
রবীন্দ্রনাথ ও বিক্তোরিয়া অবাঙালি আনোয়ার দিলের উপলক্ষ মাত্র। তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারার ইতিহাসটিই তুলে ধরতে চেয়েছেন।
তিনি রবীন্দ্রনাথকে জানেন আট বছর বয়স থেকে। আফিয়া দিলকে অবশ্য আরও অনেক পরে। তার পরও আনোয়ার দিলের স্ত্রী যদি আরবিভাষী হতেন, হয়তো তাঁর গবেষণা গ্রন্থটি হতো নাগিব মাহফুজকে নিয়ে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয়।
রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড বিক্তোরিয়া ওকাম্পো: দ্য ক্রিয়েটিভ টাচ সতত সৃজনশীল আনোয়ার দিলের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবেই থেকে যাবে। আগামী দিনের গবেষক যদি রবীন্দ্রনাথে এই ‘লাতিন আমেরিকা কানেকশন’ নিয়ে লিখতে বসবেন, হাতের কাছে সূত্র-গ্রন্থ হিসেবে এই ক্রিয়েটিভ টাচকেই রাখতে হবে।
গ্রন্থটি কখনো কখনো আবেগস্পৃষ্ট মনে হলেও আনোয়ার দিল উপযুক্ত সূত্র ও প্রামাণিক রচনা দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করিয়েছেন। বাংলাদেশচর্চার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথচর্চার জন্য পাঞ্জাবি এই লেখকের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই হয়। তাঁর চাওয়া কিছু থাকুক বা না থাকুক, নিরন্তর বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। তাঁকে উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্যের অভ্যাস আমাদের ঝেড়ে ফেলা দরকার।
যৌথ উদ্যোগে ইন্টারকালচারাল ফোরাম ও অ্যাডর্ন বুকস প্রকাশ করেছে এ বইটি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ্যান্ড বিক্তোরিয়া ওকাম্পো: দ্য ক্রিয়েটিভ টাচ থেকে তাঁর রচনার কয়েকটি অনুচ্ছেদ অনুবাদ করা হলো।
বিক্তোরিয়া ওকাম্পো জানলেন
ঠাকুর পেরুর পথে বুয়েনস এইরেস আসছেন
১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পেরুর জাতীয় উৎসবে যোগ দিতে সেখানে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্জেন্টিনা হয়ে যাবেন বলে লা নেশিওন (বুয়েনস এইরেস) পত্রিকা থেকে জানলেন বিক্তোরিয়া ওকাম্পো। আর তখন এটাও প্রত্যাশিত যে তিনি বুয়েনস এইরেসে কয়েক দিনের যাত্রাবিরতি দেবেন। লা নেশিওন পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লিখে বিক্তোরিয়া সম্প্রতি সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, দান্তে, রাসকিন ও গান্ধীকে নিয়ে—তিনজনের ওপর তাঁর প্রবল ভক্তি। এই যাত্রাবিরতির খবরে তিনি কেমন অনুভব করলেন। ‘ট্যাগোর অন দ্য ব্যাংকস অব দ্য রিভার প্লেট’ শীর্ষক একটি রচনায় তা উল্লেখ করেছেন।
‘১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঘোষিত হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেরুর পথে বুয়েনস এইরেস হয়ে যাবেন। ঠিক সে মুহূর্ত থেকেই আমরা যারা আদ্রে জিদের ফরাসি অনুবাদ ইয়েটসের ভূমিকাসহ তাঁর নিজের করা ইংরেজি ভাষান্তর ছেনোবিয়া কাম্পরুবির (হুয়ান র্যামন হিমেনেথের স্ত্রী) স্প্যানীয় অনুবাদে তাঁর কবিতা পড়েছি, আমরা গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে কবির আগমনের প্রতীক্ষা করছি। এটাই হবে বছরের একটি বড় ঘটনা। আর আমার জন্য তা হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনাগুলোর একটি।’ তাঁর যে কী উত্তেজনা, তা বিক্তোরিয়ার নিজের লেখাতেই প্রকাশিত হয়েছে:
সান ইসিদ্রোতে সেই বসন্তটি ছিল স্বচ্ছ ও উষ্ণ আর গোলাপের অসাধারণ প্রাচুর্য। সকালবেলাগুলো আমার রুমেই কাটত। জানালা সব খোলা। আমি সুবাস নিচ্ছি। ঠাকুরের লেখা থেকে পড়ছি। ঠাকুরকে নিয়ে ভাবছি। ঠাকুরের ওপর লিখছি। ঠাকুরের জন্য প্রতীক্ষায় রয়েছি। এই পাঠ, ভাবনা, লেখা ও প্রতীক্ষার ফলাফল কয়েক পাতার একটি রচনা, পরে যা লা নেশিওন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রবল প্রত্যাশার দিনগুলোতে আমার কখনো মনে হয়নি সান ইসিদ্রোর খাড়া পাহাড়ে, আমার ভবনে কবি আমারই অতিথি হবেন। এটুকু আশা করার সাহসও হয়নি যে কবি তাঁর সংক্ষিপ্ত অবস্থানকালে, কবি তাঁর একান্ত ভক্তের সঙ্গে, যেমন—আমি একজন, দেখা করার সময় বের করে নেবেন। ডোরিস মেয়ার লিখেছেন: ‘প্রবল উৎসাহে উদ্দীপিত বিক্তোরিয়া। তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন তাঁর বইপত্রে, সেই সাক্ষাতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে যতটা সম্ভব তাঁর রচনাবলি পড়তে থাকলেন। এ ধরনের উদ্দীপনার মুহূর্ত যখন তাঁকে পেয়ে বসেছে, যেন তাঁর ধর্মাচারের অংশ হিসেবেই কবির রচনা পাঠে তাঁর প্রতিক্রিয়া এবং তাঁর ব্যাখ্যা দিয়ে কবির কাছে কাল্পনিক চিঠি লিখতে শুরু করেন। আর এগুলোই হয়ে ওঠে লা নেশিওন পত্রিকায় (নভেম্বর ১৯২৪) প্রকাশিত প্রবন্ধ, যার নামায়ন যথার্থই হয়েছে, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠের আনন্দ’।
ডোরিস মেয়ারের ওকাম্পো
স্প্যানিশ সাহিত্যের তরুণ আমেরিকান অধ্যাপক ডোরিস মেয়ার যখন এগেইনস্ট দ্য উইন্ড অ্যান্ড দ্য টাইড লেখেন, তখন তিনি নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটিতে; তিনি বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর নিবেদিত ভক্ত এবং ১৯৬২ থেকে তাঁর সঙ্গে আন্তরিক বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। বইটি লিখতে তিনি তাঁর অনেক সহায়তা পেয়েছেন। ১৯৭৮ সালে মুদ্রণের আগে বিক্তোরিয়া ওকাম্পো তা পড়েও দেখেছেন। জীবনীর নামটি তিনি ওকাম্পোর কথা থেকেই নিয়েছেন, যেখানে তিনি বলেছেন উদ্দীপনাপূর্ণ ও স্বাধীন কর্মজীবনের জন্য তাঁর সংগ্রাম বাতাস ও স্রোতের বিরুদ্ধে পাল তোলার নিঃশেষিত উদ্যোগের মতো। মেয়ারের ভাষায়, ‘চারপাশের সবার গালমন্দের ঝুঁকি নিয়ে, প্রথাকে অস্বীকার করে কলঙ্কের প্ররোচনা দিয়ে তিনি প্রাপ্তবয়স্কের মতোই যাত্রা শুরু করলেন। বাতাস ও স্রোতের বিরুদ্ধে পাল তুলে দিয়ে তিনি সংস্কৃতির অঙ্গনে নিজ দেশের যেকোনো নারীর চেয়ে বেশি অর্জন করেছেন। সম্ভবত লাতিন আমেরিকার ইতিহাসেও সবচেয়ে বেশি অর্জন তাঁরই। এমনকি এখনো, ৮৮ বছর বয়সী বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর নামে আর্জেন্টিনায় চোখ কপালে উঠে যায়।’ এ ভূমিকাটি লিখিত হয়েছে ১৯৭৮-এর সেপ্টেম্বরে। ওকাম্পোর মৃত্যু হয় ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭৯।
প্রথম জীবনে ওকাম্পোর বইপ্রীতির ব্যাপারটি মেয়ার চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। দান্তের ডিভাইন কমেডিয়া পাঠ করে ওকাম্পো যা লিখেছেন, তাতে তাঁর প্রস্ফুটনোন্মুখ বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের চিত্রটি ধরা পড়ে: ‘আমার ইতালীয় শিক্ষক যখন আমাকে ইনফার্নোর কিছু অংশ পড়িয়ে ছাড়লেন, আমি তখন কেবল ষোলো ছুঁয়েছি। এই পঠন আমার মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, তার সঙ্গে তুলনীয় আমার শৈশবের প্রথম সমুদ্রস্নান—ঢেউয়ের বিস্ময়কর শক্তিতে যেভাবে সৈকত বালুকায় আছড়ে পড়ি।’
মেয়ার লিখছেন, ‘বিয়েটা ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি যখন আধ্যাত্মিক স্বস্তি ও দিকনির্দেশনা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তিনি ফ্লোরেন্সের নির্বাসিত কবির সুললিত পঙিক্তমালার কাছে ফিরে এলেন। তিনি স্মরণ করলেন, এই কবিও জীবনের অন্ধকার অরণ্যে পথ হারিয়ে আত্মার মুক্তি নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি পড়তে ও পুনরায় পড়তে শুরু করলেন কেমন করে কবি চূড়ান্ত সত্যের দিকনির্দেশনা পেয়েছেন।
বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর মৃত্যু (১৯৭৯)
প্রায় ৯০ বছর বয়সে ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭৯ বিক্তোরিয়া ওকাম্পো মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে হোর্হে লুইস বোর্হেস লিখলেন: ১৯২৪ সালের দিকে (সঠিক তারিখ গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা বলাই যথেষ্ট যে ঘটনাটা অনেক দূর-অতীতের) একজন অপরিচিত যুবক যে নিজেকে কবি ভাবত, কিন্তু নিজের কবিতাগুলো ছিল বড় অপছন্দের, তখনই বিখ্যাত বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে পরিচিত হলো। যেমনটা প্রত্যাশিত ছিল, যুবক কর্তৃত্বপ্রবণ এই ভদ্রমহিলাকে একটু ভয় পেয়েছিল, সেই প্রাথমিক ভয় ৫০ বছরেও পুরোপুরি মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।
আমাদের প্রথম কথোপকথন আমার মনে নেই। মনে হয় আমরা ভাষা নিয়ে কথা বলেছিলাম। যখন দেখলাম উন্মুক্ত স্বরবর্ণ ও মাঝেমধ্যে হ্রস স্বরের শান্ত কাস্টিলিয়ান সংগীত তিনি অনুভব করছেন না, আমি বিস্মিত হইনি। সময়ের সঙ্গে অন্যান্য বিষয় আমাদের কাছাকাছি এনে দেয়; আর্জেন্টাইন সংস্কৃতির নবায়ন, উত্তম একত্ববাদী ঐতিহ্য এবং ইংল্যান্ডের সাহিত্যের জন্য অনুরাগ। এই কথাগুলো লেখার সময় আমি কেবল শেক্সপিয়ার কি সুইনবার্নের কথা ভাবিনি। আমি ভেবেছি আয়নার ভেতর দিয়ে দেখা মেয়েটির কথা। লিমেরিকে চতুর নির্বুদ্ধিতার কথা এবং শার্লক হোমস ও তার বরাবরই অভ্রান্ত নয় এমন একজন বসওয়েল ডক্টর ওয়াটসনের বন্ধুত্বের কথা। অন্যরা আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছে। আমি লেখকদের বিচার করেছি তাঁদের .আলংকারিক ভাষা ও আবিষ্কারের শক্তি দিয়ে; আর বিক্তোরিয়া করেছেন তাঁদের মেজাজ ও জৈবনিক বৃত্তান্ত দিয়ে। বইটা তো মুখোশ, তিনি বইয়ের পেছনের মুখের অনুসন্ধান করেছেন। সুখান্বেষী পাঠক হিসেবে যা তাঁকে আগ্রহান্বিত করেছে, তা পড়েছেন এবং পুনরায় পড়েছেন। আমি সন্দিহান, লাগাতর পাঠ তাঁর ধাতে ছিল না। যেমন, এখন নেই আমার।
বিক্তোরিয়া মৃত এবং আমি জানি তাঁর সঙ্গে যে সম্পর্ক, তা কখনো ব্যাহত হয়নি। তা আমার কাছে আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনি মৌল বিষয় হয়ে আছে। আমি প্রায় লিখেই ফেলতে পারি, আমাদের নীরব সত্য এবং বন্ধুত্ব আজই শুরু হয়েছে।
No comments