রবীন্দ্র সাহিত্য সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব by সাদি মহম্মদ
গান শুনতে আমি বরাবরই পছন্দ করতাম। আমাদের বাসায় যে ছোট রেডিওটি ছিল ওতে সারাদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ফেরদৌসী বেগম_তাঁদের আধুনিক গান বাজত। তখন সারা দিন গান শুনে শুনে কান পরিষ্কার করতে চেষ্টা করতাম। সত্যি করে যদি বলি, তাহলে বলব রবীন্দ্রনাথের গান প্রথমে আমার পছন্দ ছিল না।
মনে হতো কেমন যেন একটু ভিন্ন গলায় গান করেন। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যাঁকে আমি গানে আমার আদর্শ মানি। তাঁর গলাতেই শুনলাম 'এই কথাটি মনে রেখো'। তখন ভাবলাম যে এত দিন ধরে গান শুনছি অথচ হেমন্তের এই আধুনিক গানটা তো আগে শুনিনি। পর মুহূর্তেই রেডিওতে বলা হলো এতক্ষণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনলেন। আমি একদম অবাক হয়ে গেলাম, ভাবলাম রবীন্দ্রনাথের গান এত সুন্দর! এত আধুনিক! এত স্পষ্ট উচ্চারণে তাঁর গান গাওয়া যায়! তাহলে এতদিন আমি কী শিখেছি। তখন থেকেই রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি ভালো লাগা শুরু। আস্তে আস্তে আমি গানের মধ্যে এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে দুই বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পরেও পরের বছরটা বাদ দিলাম। তখন শুধু মনে হতো এমন কী হতে পারে না যে সারাদিনই শুধু গান গাইব আর কিছুই না। কিন্তু ১৯৭৪-৭৫ সালের পরিপ্রেক্ষিতে এমন ভাবাটা ছিল অলীক কল্পনা। যা এখনকার ছেলেমেয়েরা সহজেই ভাবতে পারে। গানকে পেশা হিসেবে নিতে পারে। এরই মধ্যে আমার ভাগ্য ভালো দেখেই কি না, তখন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখলাম, ভারত সরকারে বৃত্তি নিয়ে যাঁরা যেতে চান তাঁরা আবেদন করতে পারেন। আমি আবেদন করলাম, আমার আবেদন গৃহীত হলো এবং ১৯৭৫-১৯৭৬ শিক্ষাবর্ষে শান্তিনিকেতনে চলে গেলাম।
শান্তিনিকেতনে গিয়ে আমি রবীন্দ্রনাথকে আরো একবার নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। আমার আগের জানা সব শেখাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম এবং ওই সময় থেকেই শুরু হলো আমার নতুন জীবন এবং সত্যিকার অর্থে আমার গান শেখা। সেখানে রবীন্দ্রনাথের যাঁরা ছাত্রছাত্রী ছিলেন সরাসরি তাঁদের আমার গুরু হিসেবে পেয়েছি। শ্রী ভূমিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশী। তাঁদের কাছে গান শিখতে গিয়ে অনুভব করলাম তাঁর গানের কতটা গভীরতা, কতটা ব্যাপ্তি। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন সেখানকার পরিবেশ দেখে আমার মনে হতো যেন আমি রবীন্দ্র ভুবনে আছি। সেখানকার সব কিছুতেই ছিল একটা প্রশান্তির ছোঁয়া। সেখানকার মাটি, গাছের পাতা ঝড়ার শব্দ, পাখির ডাক_এসবই আমাকে বিহ্বল করে দিত। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে গান শেখার জন্য শান্তিনিকেতনের মতো একটা পরিবেশ পেয়েছিলাম। যা আমাকে পুরোপুরি গানের সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করেছিল, অনুভূতিগুলোকে করেছিল আরো প্রখর।
ছয় বছরের শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৮২ সালে দেশে ফিরে সরকারি সংগীত কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দিলাম। এখন পর্যন্ত আমি ছাত্রছাত্রীদের আমার জানার সবটুকু দিয়ে তাদের সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছি। কষ্ট হয়, যখন দেখি এখনকার এরা সংগীত শিক্ষার জন্য সে রকম পরিবেশ পাচ্ছে না। তাঁকে এবং তাঁর সৃষ্টিকে জানার সঠিক সুযোগ পাচ্ছে না। যদিও রবীন্দ্রনাথকে জানার শেষ নেই। তাঁর গানের যে একটা অতল ব্যাপার আছে, সেখানে কেউই পেঁৗছাতে পারবে না। তিনি নিজেই বলেছেন 'তাঁকে জানা আমার ফুরাবে না'।
অবাক লাগে যখন রবীন্দ্রনাথকে দেখি যে এক জীবনে মানুষ কত কী করতে পারে। দুই হাজার ২০০ গান তাঁর নিজের সুর করা। এ ছাড়াও তো রয়েছে তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা। রবীন্দ্রনাথের সব সৃষ্টিকর্মের মধ্যে নতুনকে গ্রহণ করার একটা প্রবণতা দেখা গেছে। এ জন্যই বোধহয় তিনি আমাদের এত বৈচিত্র্যময়তা উপহার দিতে পেরেছেন।
নতুন যাঁরা রবীন্দ্রচর্চা করছেন তাঁদের প্রতি অনুরোধ থাকল যে তাঁরা যেন তাঁর গানগুলোকে নিয়ে নিরীক্ষা না চালান। নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে যেন তাঁর গানগুলোকে নষ্ট করে না ফেলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন 'আমার গানের ওপর তোমরা স্টিম রোলার চালিও না, যাতে আমার গানটি চ্যাপ্টা হয়ে যায়, যাতে আমার গানটিকে চেনাই না যায়।'
বর্তমানে গানের ক্ষেত্রে অনেক নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রেও সেটা ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে মনে রাখতে হবে, যাতে গানের কাব্যটি ঢাকা না পড়ে। তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে এর সংরক্ষণ আমাদেরই দায়িত্ব। আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারের এই অসামান্য রত্নগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। সরকারিভাবে যদি রবীন্দ্রচর্চার জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়, তাহলে অনেক কাজ করা সম্ভব হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রবীন্দ্র সাহিত্যের বা সৃষ্টিকর্মের সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও একজন শিক্ষক হিসেবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আমাকে ভীষণ আপ্লুত করেছে। আমাদের শিল্পীদের তাই চাওয়া, শান্তিনিকেতনের মতো এত বড় পরিসরে না হোক; কিন্তু শান্তিনিকেতনের যে নির্জন পরিবেশটা রয়েছে সে রকম একটি পরিবেশ যেন এ বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য নির্বাচন করা হয়।
পরিশেষে বলব, শিল্পী হিসেবে আমি কতটুকু সার্থক জানি না, তবে আমি একজন সফল শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চাই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার শিক্ষার্থীদের সবটুকু জ্ঞান ঢেলে দিতে চাই। মৃত্যুর পরও যেন মানুষ বলে তিনি একজন ভালো ও সফল শিক্ষক ছিলেন।
শান্তিনিকেতনে গিয়ে আমি রবীন্দ্রনাথকে আরো একবার নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। আমার আগের জানা সব শেখাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম এবং ওই সময় থেকেই শুরু হলো আমার নতুন জীবন এবং সত্যিকার অর্থে আমার গান শেখা। সেখানে রবীন্দ্রনাথের যাঁরা ছাত্রছাত্রী ছিলেন সরাসরি তাঁদের আমার গুরু হিসেবে পেয়েছি। শ্রী ভূমিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশী। তাঁদের কাছে গান শিখতে গিয়ে অনুভব করলাম তাঁর গানের কতটা গভীরতা, কতটা ব্যাপ্তি। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন সেখানকার পরিবেশ দেখে আমার মনে হতো যেন আমি রবীন্দ্র ভুবনে আছি। সেখানকার সব কিছুতেই ছিল একটা প্রশান্তির ছোঁয়া। সেখানকার মাটি, গাছের পাতা ঝড়ার শব্দ, পাখির ডাক_এসবই আমাকে বিহ্বল করে দিত। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে গান শেখার জন্য শান্তিনিকেতনের মতো একটা পরিবেশ পেয়েছিলাম। যা আমাকে পুরোপুরি গানের সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করেছিল, অনুভূতিগুলোকে করেছিল আরো প্রখর।
ছয় বছরের শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৮২ সালে দেশে ফিরে সরকারি সংগীত কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দিলাম। এখন পর্যন্ত আমি ছাত্রছাত্রীদের আমার জানার সবটুকু দিয়ে তাদের সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছি। কষ্ট হয়, যখন দেখি এখনকার এরা সংগীত শিক্ষার জন্য সে রকম পরিবেশ পাচ্ছে না। তাঁকে এবং তাঁর সৃষ্টিকে জানার সঠিক সুযোগ পাচ্ছে না। যদিও রবীন্দ্রনাথকে জানার শেষ নেই। তাঁর গানের যে একটা অতল ব্যাপার আছে, সেখানে কেউই পেঁৗছাতে পারবে না। তিনি নিজেই বলেছেন 'তাঁকে জানা আমার ফুরাবে না'।
অবাক লাগে যখন রবীন্দ্রনাথকে দেখি যে এক জীবনে মানুষ কত কী করতে পারে। দুই হাজার ২০০ গান তাঁর নিজের সুর করা। এ ছাড়াও তো রয়েছে তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা। রবীন্দ্রনাথের সব সৃষ্টিকর্মের মধ্যে নতুনকে গ্রহণ করার একটা প্রবণতা দেখা গেছে। এ জন্যই বোধহয় তিনি আমাদের এত বৈচিত্র্যময়তা উপহার দিতে পেরেছেন।
নতুন যাঁরা রবীন্দ্রচর্চা করছেন তাঁদের প্রতি অনুরোধ থাকল যে তাঁরা যেন তাঁর গানগুলোকে নিয়ে নিরীক্ষা না চালান। নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে যেন তাঁর গানগুলোকে নষ্ট করে না ফেলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন 'আমার গানের ওপর তোমরা স্টিম রোলার চালিও না, যাতে আমার গানটি চ্যাপ্টা হয়ে যায়, যাতে আমার গানটিকে চেনাই না যায়।'
বর্তমানে গানের ক্ষেত্রে অনেক নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রেও সেটা ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে মনে রাখতে হবে, যাতে গানের কাব্যটি ঢাকা না পড়ে। তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে এর সংরক্ষণ আমাদেরই দায়িত্ব। আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারের এই অসামান্য রত্নগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। সরকারিভাবে যদি রবীন্দ্রচর্চার জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়, তাহলে অনেক কাজ করা সম্ভব হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রবীন্দ্র সাহিত্যের বা সৃষ্টিকর্মের সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও একজন শিক্ষক হিসেবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আমাকে ভীষণ আপ্লুত করেছে। আমাদের শিল্পীদের তাই চাওয়া, শান্তিনিকেতনের মতো এত বড় পরিসরে না হোক; কিন্তু শান্তিনিকেতনের যে নির্জন পরিবেশটা রয়েছে সে রকম একটি পরিবেশ যেন এ বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য নির্বাচন করা হয়।
পরিশেষে বলব, শিল্পী হিসেবে আমি কতটুকু সার্থক জানি না, তবে আমি একজন সফল শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চাই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার শিক্ষার্থীদের সবটুকু জ্ঞান ঢেলে দিতে চাই। মৃত্যুর পরও যেন মানুষ বলে তিনি একজন ভালো ও সফল শিক্ষক ছিলেন।
No comments