সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বাঙালির অন্তরে বেঁচে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ by সৈয়দ আবদুল হাদী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় একেবারে ছোটবেলা থেকে। আমার বাবা রবীন্দ্রসংগীতের খুব ভক্ত ছিলেন। শৈশবে দেখতাম, বাবা রবীন্দ্রসংগীত গুন গুন করে গাইতেন। ছোটবেলা থেকেই সেগুলো শুনে আসছি_মনের মাঝে গেঁথে গেছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতি তো মানুষ সহজে ভোলে না।


বাবার কাছে শুনে শুনে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি আগ্রহ জন্মাল। তখন বুঝতাম না রবীন্দ্রনাথ কে, তাঁর আদর্শ কী তাও জানতাম না। কিন্তু গানগুলো ভালো লাগত। এভাবেই রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা শুরু।
যখন কলেজ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সঙ্গে আরো জড়িয়ে গেলাম। কারণ আমার বিষয় ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। স্বাভাবিকভাবেই পাঠ্যে রবীন্দ্রনাথ পড়তে হতো এবং তখন থেকেই রবীন্দ্রচর্চার পরিধিটা আরো গভীর হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তখন থেকেই রবীন্দ্রসংগীত গাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হওয়ার পর আধুনিক শিল্পী হিসেবে বেতারে অন্তর্ভুক্ত হলাম। আধুনিক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতও করতাম। আমার প্রথম গুরু ছিলেন আবদুল আহাদ তাঁর কাছেই আমি প্রথম তালিম নিই। একটা কথা বলে নিই, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আবদুল আহাদই প্রথম শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। দেশ ভাগের আগের সময়কার কথা, তিনিই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম রবীন্দ্রসংগীত শেখানো শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন সময় আমাকে বেতার এবং রবীন্দ্রসংগীত কনফারেন্সে গান করান। আর নিজের জন্য, নিজের আত্মার তৃপ্তির জন্য যখন গান করতাম; সেটা ছিল রবীন্দ্রসংগীত।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের আরো গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করলাম। এখন এই পরিণত বয়সে এসে মনে করলাম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের কিছু গান নিয়ে একটা অ্যালবাম করার চিন্তা অনেক আগে থেকেই ছিল। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে আমার এই প্রচেষ্টার অ্যালবাম " যখন ভাঙল মিলনমেলা।" এই অ্যালবামের অধিকাংশ গানই করেছি, যেগুলো আমার বাবার মুখে ছোটবেলায় শুনতাম। আমি খুব আনন্দিত হই, যখন দেখি সবাই রবীন্দ্রসংগীত করছে। কিন্তু একই সঙ্গে আবার পীড়িত হই, যখন রবীন্দ্রসংগীত বিকৃত করা হয়। একজন শিল্পী রবীন্দ্রসংগীত তাঁর নিজস্ব ঢঙে গাইতেই পারেন, কিন্তু ভাবগাম্ভীর্য ব্যহত করে নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, 'আমার গান তো মানুষ স্নান ঘরে চিৎকার করে গাইবেই; কিন্তু তা গাইবে অন্তরের দরদ দিয়ে।'
রবীন্দ্রসংগীতের প্রধান বিষয় হচ্ছে ভাব সম্পদ। গানের বাণীকে ব্যাহত করা, গাম্ভীর্য বিনষ্ট করা কিছুতেই উচিত নয়। গায়কের নিজস্ব ধারা থাকতে পারে, কিন্তু কোনোক্রমেই সুর ও ভাবগাম্ভীর্যকে নষ্ট করা চলবে না।
আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শ, মানবিকতা তাঁর সবকিছুই আমার অন্তরকে আলোকিত করেছে। তিনি নির্দিষ্ট কোনো জাতির নন, তিনি বিশ্বজাতীয়তায় বিশ্বাসী। প্রথম জীবনে পারিবারিক কারণে তিনি ভারতীয় জাতীয়বাদী ছিলেন, ভারতীয় ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মানবতাবাদী অর্থাৎ সব মানব জাতি এক, জাতভেদের ঊধর্ে্ব বিশ্বাসী হন। রবীন্দ্রনাথের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে জাতীয়তাবাদ থেকে অনেক দূরে সরে বিশ্বমানবতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, বাঙালিকে আমার গান গাইতে হবে, শুনতে হবে, আমার গানে কোন ফাঁক রাখিনি যা কাউকে পূরণ করে দিতে হবে। আমার কবিতা মানুষ ভুলে গেলেও গান মনে রাখবে। রবীন্দ্রনাথ তার সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে আন্দোলিত করেছেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাস করতেন না, তিনি আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা বলেছেন। তাঁর আদর্শ ছিল আত্মার শক্তি বৃদ্ধি করা। তাঁর ছোটগল্পগুলো পড়লেই বোঝা যায়, মানুষের অন্তরের গভীরে পেঁৗছেছেন তিনি।
আমার মতে, নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তুলনা করা ঠিক নয়। কারণ দুজনের পথ ভিন্ন। নজরুল ছিলেন সাম্যবাদী, তিনি একটি সময়ের প্রতীক। ভারতবর্ষ পরাধীনকালে তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন যোদ্ধা ও সংগ্রামী, মানুষের শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সংগ্রামের পথে যাননি। তিনি মানবাত্মার মুক্তির কথা বলেছেন। নজরুল একভাবে দেশকে দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন অন্যভাবে। কিন্তু দুজনের আদর্শ ছিল এক_প্রেম ও মানবতা।
রবীন্দ্রসাহিত্য আমাকে অবশ্যই মুগ্ধ করে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ থেকেই আমি এই বিষয়ে পড়াশোনা করি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের যত গভীরে যাই, ততই ভাবি_তিনি কতটা মানবপ্রেমী ছিলেন, বিশ্বপ্রেমী ছিলেন! এই মহত্ত্ব অর্জন করা খুবই কষ্ট, খুবই শক্ত ব্যাপার। তিনি সংকীর্ণ জাতীয়তবাদে বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বমানবকে একই রকম দৃষ্টিতে দেখতেন, তার গানে আমরা দেখি, 'ও আমার দেশের মাটি তোমার তরে ঠেকাই মাথা, তোমাতে বিশ্বময়ী, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।'
দেশের মায়ের মাধ্যমে তিনি বিশ্বমাতাকে দেখিয়েছেন এই গানের মাধ্যমে।
রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, প্রবন্ধ এখানে খণ্ডিতভাবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সবাইকে অতিক্রম করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ ও ছোটগল্প বংলা সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ। মানুষের জীবনের এমন কোনো অনুভূতি নেই, যার গভীরে তিনি প্রবেশ করেননি।
রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে বলার অবকাশ নেই। তার প্রতিটি গানের মাধ্যমে আত্মার পরিতৃপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়। তার অসাধারণ সব গানের মধ্যে আমার খুবই পছন্দের গান হচ্ছে_আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ/ তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি, পেয়েছি মোর স্থান।
রবীন্দ্রনাথ সব চিন্তা-চেতনা, আধ্যাত্মিকতা-সব কিছুর মধ্যে আত্মার পরিতৃপ্তি খুঁজেছিলেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে তিনি যে একজন ক্ষুদ্র প্রাণী হয়ে জন্ম নিয়েছেন, এই বিস্ময়ে বিস্মিত হয়েছিলেন। বিশ্বের মধ্যে বিশ্বমাতাকে দেখেছেন, আত্মার মধ্যেই তিনি পরম আত্মাকে পেয়েছিলেন। তার চিন্তার স্তরে পেঁৗছানো সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন।
বর্তমান সময়ে রবীন্দ্রচর্চা হচ্ছে প্রচুর। আনাচে-কানাচে প্রচুর রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম বের হচ্ছে। যদি সঠিকভাবে রবীন্দ্রসংগীতকে উপলব্ধি করে, তাঁর আদর্শ মাহাত্ম্য, চিন্তাভাবনাকে যদি নিজের মধ্যে ধারণ করে রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম প্রকাশ করে তাহলে ভালো। কিন্তু এখন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী, রবীন্দ্রসংগীতের চাহিদা আছে_এই সুযোগে একটা অ্যালবাম করলাম, তাহলে তা ভালো নয়।
পৃথিবীর বিখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো পার্থক্য নেই। জার্মানির গ্যাটে, ইংল্যান্ডের শেঙ্পিয়ার, দার্শনিক রোমা রোলাঁ কোনো না কোনোভাবেই বিশ্বমানবতার প্রবক্তা। তাঁরা একই লক্ষ্যে তাঁদের নিজস্ব পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।
দুই বাংলায় সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে_এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনো অনুভূতি নেই। আমরা এ দেশেই জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছি অনেক জাঁকজমকভাবে। এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। ওপার বাংলা আমাদের সঙ্গে পালন করতে চায় করুক, ভালো কথা। একসঙ্গে দুই বাংলায় আরো বৃহত্তর পরিসরে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচর্চা করা হোক এবং তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে নিবিড় ভাবে পরিচিত হোক সবাই।

No comments

Powered by Blogger.