আফগানিস্তান-নেভি সিলের হামলা বন্ধ হওয়া জরুরি by আহমেদ রশিদ

তালেবান কর্তৃক একগুচ্ছ হত্যাকাণ্ড আফগানিস্তানের শাসক অভিজাতদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। জাতিগত টানাপোড়েন বাড়িয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্ব মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর কাছ থেকে আফগান বাহিনীর হাতে হস্তান্তরের আসন্ন প্রক্রিয়াটি নিয়ে শঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করেছে।


সামরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তালেবানের সঙ্গে সংলাপ প্রক্রিয়ার গতি দ্রুততর করা অত্যাবশ্যক। তবে তা ঘটতে হলে আমেরিকাকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে তালেবান লক্ষ্যবস্তুতে প্রাণঘাতী নৈশ হামলা।
গত মার্চ মাস থেকে সাতজন শীর্ষস্থানীয় আফগান নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন নিহত হয়েছেন কৌশলগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কান্দাহার প্রদেশে। নিহতদের মধ্যে আছেন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের ভাই আহমেদ ওয়ালি কারজাই এবং কাবুলের মেয়র গোলাম হাইদার হামিদি। হামিদিকে আফগানিস্তানের সবচেয়ে সৎ নেতাদের অন্যতম মনে করা হতো। দুজনকেই হত্যা করা হয় গত জুলাই মাসে।
বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা এই নতুন অস্থিরতার প্রতিক্রিয়ায় তাঁদের পরিবার-পরিজনকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন কিংবা নিজের জোরালো প্রহরাধীন বাড়িঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কাবুলের বাইরে শাসনের পরিস্থিতি সর্বকালের শোচনীয় অবস্থায় চলে গেছে, কর্মকর্তারা নিজেদের দপ্তরে নিজের সুরক্ষা ভেবে বসে থাকে। পাশাপাশি কারজাই সাহেবকে সংসদীয় সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিরোধী দল অভিসংশনের হুমকি দিচ্ছে। অন্যদিকে মন্ত্রিসভা ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া যায়নি। আর্থিক সমস্যায়ও পড়তে হচ্ছে রাষ্ট্রকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থা ও দাতারা কোনো অর্থ প্রদান কিংবা ঋণ দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চার মাস ধরে। কারণ, হিসেবে তারা কাবুল ব্যাংকের দুর্নীতির কলঙ্কের কথা বলছে। এ বিষয়টি কারজাই সাহেব ঠিকমতো তুলে ধরতে পারেননি। মার্কিন ও আফগান সরকার মতৈক্যে পৌঁছাতে পারছে না, কী ধরনের মার্কিন বাহিনী এখানে রয়ে যাবে ২০১৪ সালে বৃহৎ অংশের মার্কিন সেনা চলে যাওয়ার পর। তা ছাড়া নিরাপত্তাবিষয়ক নতুন কাঠামোগত মতৈক্যে উভয় পক্ষ সম্মত হবে কি না, সে প্রশ্নও রয়ে গেছে। আমেরিকানরা বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্র প্রদানের অঙ্গীকার করতে প্রস্তুত, তার চেয়ে আফগানরা ২০১৪ পরবর্তী সময়ের জন্য আরও অর্থ ও অস্ত্র চায়।
ফলে আফগানরা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সন্দিহান হয়ে উঠেছে, আফগান বাহিনীর হাতে পশ্চিমারা সহজে কর্তৃত্ব ছাড়বে কি না, যে বাহিনী নিজের জনগণকে সুরক্ষা দেবে। এ কারণে তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে পশ্চাৎপট কঠিন হয়ে ওঠে। গোপন আলাপের সমালোচনায় ধীরে ধীরে মুখর হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো। এতে আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে যে চূড়ান্ত ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তি হয়তো গ্রহণযোগ্য হবে না, যা গুরুতর জাতিগত বিরোধ কিংবা নতুন গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে দেশকে।
এই জায়গাতেই নৈশ হামলাগুলো খুব প্রাসঙ্গিক। বর্তমান আলাপ-আলোচনার প্রতি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের পুরোপুরি সমর্থন নেই। সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে পেন্টাগনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিবাদেও জড়িয়েছেন। পেন্টাগন এমনও মনে করে, নেভি সিলদের মতো অভিজাত বিশেষ বাহিনী কর্তৃক চালিত নৈশ হামলা হলো তালেবানকে দুর্বল করার অন্যতম প্রধান অস্ত্র। এসব হামলায় বেশ কিছু তালেবান কমান্ডারকে হত্যা করা গেলেও বিপুল জনগণ এতে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এসব হামলা বন্ধের জন্য কারজাই সাহেব উচ্চকণ্ঠে দাবি জানাচ্ছেন। পেন্টাগন তাতে কান দিচ্ছে না।
ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পরে মার্কিন কর্মকর্তারা বাস্তব সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। তাঁরা হুজুক তুলছেন যে আল-কায়েদা হয়তো ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন, আর মাত্র ২০ জন শীর্ষস্থানীয় আল-কায়েদা নেতাকে হত্যা করতে পারলেই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এ সংস্থাটি ধ্বংস করা যাবে, আর এদের হত্যাযজ্ঞও হয়তো নৈশ হামলার মাধ্যমেই সম্ভব। তবে এভাবে নৈশ হামলার যৌক্তিকতা প্রদানও অতিরঞ্জিত। দক্ষিণ এশিয়ায় আল-কায়েদার হাইকমান্ডে এখন অনেক বেশি পাকিস্তানি ও মধ্য এশীয় আছেন, যাঁরা নবসংগৃহীতদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং হামলা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। ওসামার হত্যা এক আঘাত, তবে এতেই সংস্থাটি শেষ হয়ে যায়নি।
নৈশ হামলার ব্যাপারে জনরোষ তালেবানের আক্রমণ পরিচালনার প্রধান যৌক্তিকতা প্রদানে অন্যতম ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি পূর্ববর্তী মার্কিন হামলার জবাব দেওয়া ও তালেবানের আক্রমণ চালানোর যৌক্তিকতা প্রদান করছে। নৈশ হামলা অব্যাহত থাকলে ঝুঁকি থেকে যায় যে আরও হত্যাকাণ্ড ঘটার মাধ্যমে দুর্বল আফগান সরকারে আমলাতন্ত্র ও পুলিশের নেতৃত্ব পুরোপুরি ধসে পড়বে।
এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে মার্কিন ও ন্যাটোর জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার গতি তীব্রতর করা। দ্রুততর আলাপ-আলোচনার জন্য দরকার আস্থা তৈরির পদক্ষেপ। সে জন্য আমেরিকার পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত যে আফগান কর্মকর্তাদের হত্যা অভিযান বন্ধের বিনিময়ে নৈশ হামলা বন্ধ করা হবে। তখন সহিংসতার পরিমাণ কমাতে আরও পদক্ষেপ ধীরে ধীরে নেওয়া সম্ভব হবে, কর্তৃত্ব হস্তান্তরও সহজতর হয়ে উঠবে।
তালেবানের বক্তব্য হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত আমেরিকানরা তাদের আক্রমণের লক্ষ্যস্থল না বানাবে, তারা বাছাই করা অঞ্চল থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে বাধা দেবে না। অন্যদিকে কারজাই সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কথা হলো, ট্রিগারে যে হাত রাখা সে তো আমেরিকানের হাত। আর এ ব্যাপারে নৈশ হামলা বন্ধের আহ্বান জানানো ছাড়া তাদের করার তেমন কিছুই নেই। স্থিতিশীলতার ভার এখন আমেরিকার ওপরই নির্ভর করছে। কিন্তু তারা যদি বর্তমান পথে চলা অব্যাহত রাখে, তাহলে আফগান বাহিনীর হাতে কর্তৃত্বভার হস্তান্তর দ্রুতই সমূহ বিনাশে পর্যবসিত হবে।

ব্রিটেনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. আহমেদ রশিদ: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাকিস্তানি সাংবাদিক। আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মধ্যএশিয়া বিষয়ে বেশ কয়েকটি সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের রচয়িতা।

No comments

Powered by Blogger.