স্মরণ-সাংবাদিক রশিদ খোকন by গৌরাঙ্গ নন্দী
বয়সে তিনি আমার চেয়ে বেশ বড়। অথচ পরিচয় এবং সখ্যের কারণে খুবই নৈকট্য তৈরি হয়। সম্পর্কটি তুই, তুমিতে রূপ নেয়। হঠাৎ করেই একদিন শুনতে পাই তিনি ঢাকা শহরে চলে গেছেন। বন্ধুদের বলেছে বিখ্যাত না হয়ে সে ফিরবে না। আমিও যে দু-একবার সেসব কথা শুনিনি, তা নয়। তবে শৈশবে ওই সব কথার খুব একটা তাৎপর্য বুঝিনি।
মাসখানেক পরে সে আবার ফিরে আসে। পরে জেনেছিলাম, প্রকৃতপক্ষে সে ভাগ্যান্বেষণে গিয়েছিল। কিন্তু ঢাকা আপন করে নিতে পারেনি। ১৯৮০ সালের ঢাকা শহরে তার ঠাঁই হয়নি। আবারও সে ফিরে আসে আটরার আলীম জুট মিল এলাকার শ্রমিক কলোনিতে। ওই সময়ের আগে সে আলীম জুট মিলে অস্থায়ী (বদলি) শ্রমিক হিসেবে চাকরি করত। বদলি শ্রমিকদের স্থায়ী করার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করার অপরাধে (!) তার অস্থায়ী চাকরিটি চলে যায়। তারপর থেকে সে বন্ধুদের সহায়তায় চলেছে। খাবার খেত নানাজনের সহযোগিতায়। রাত কাটাত এখানে-সেখানে। তবে সুযোগ পেলেই লিখত। প্রধানত নাটক, কবিতা। আবার অভিনয়ও করত। রাজনীতিতে ছিল আকর্ষণ। সম্ভবত নিজের আর্থিক টানাপড়েন ও অনিশ্চয়তার জীবন থেকে সে আর্থিক সাম্যের সমাজের স্বপ্ন দেখত। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধনী-গরিবের বৈষম্য, কার্ল মার্ঙ্, লেনিন, শ্রেণী, শ্রেণীহীন সমাজ, সুকান্ত, কর্নেল তাহের প্রভৃতি কথাগুলো তার কাছ থেকেই আমার প্রথম শোনা। দিন না চলার অনিশ্চয়তার জীবন থেকে মুক্তি নিতে একদিন সেই চিরচেনা শ্রমিক এলাকা ছেড়ে চলে আসে দৌলতপুরে। সেখানে এক রেস্তোরাঁয় কাজ জোটে। পরে একটি ছাপাখানায়। এরই মধ্যে খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বাঞ্চলে একটু-আধটু লেখার সুযোগ পায়। ১৯৯০ সালের দিকে সে পূর্বাঞ্চলের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করে। তত দিনে আমার ও তার মধ্যে যোগাযোগটা বেশ শিথিল হয়ে পড়ে। এর মধ্যেই তার বিয়ে, সংসার এবং খুলনার অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকতা নিয়ে ব্যস্ত জীবন। আমার সঙ্গে তার আবারও যোগাযোগ হয়, আমার সাংবাদিকতা পেশার দ্বিতীয় পর্বে, ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে। তখন সে পেশাগত বিষয়ে বেশ ব্যস্ত। খুলনার অপরাধ জগৎ নিয়ে বেশ লেখালেখি করে চলেছে। অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে তার জীবন এবং জীবনবোধের। ১৯৮০ সালে আমার পরিচয়ের সময়ের হারুণ অর রশিদ ওরফে খোকন দুই দশক পর ২০০০ সালে রশিদ খোকনের আবরণে এক ভিন্ন মানুষ। রশিদ খোকন ওর লেখার নাম। ওই নামটির সঙ্গে সঙ্গে আগের নাম ও স্বত্বাও যেন তলিয়ে যায়। প্রতিদিনের মতো সেদিন সন্ধ্যায়ও আমি আমার তখনকার কর্মস্থল দৈনিক জনকণ্ঠের খুলনা অফিসে ছিলাম। পূর্বাঞ্চলের অরুণ দা'র ফোন পেলাম। বললেন, 'শুনেছেন, খোকন এক্সিডেন্ট করেছে। সম্ভবত মারা গেছে।' খোকন থাকত দৌলতপুরের দেয়ানায়। সেখান থেকে মোটরসাইকেলে আসা-যাওয়া করত। প্রতি সন্ধ্যায় দৌলতপুরে খানিকটা আড্ডা মেরে অফিসে ছুটত। সেই সন্ধ্যায়ও তাই করেছিল। ধারণা হয়েছিল সে মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করে নিহত হয়েছে। না, পরে দেখা যায়, তার পিঠ দিয়ে গুলি শরীরের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে। দিনটি ২০০২ সালের ২ মার্চ। খুলনা শহরে সেটাই সাংবাদিক খুনের প্রথম ঘটনা। খোকনের বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন ছিল; হ্যাঁ, খোকন, তুই বিখ্যাত হয়েছিস!
গৌরাঙ্গ নন্দী
গৌরাঙ্গ নন্দী
No comments