চলতি পথে-আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল ও রবিস্মৃতি by দীপংকর চন্দ
দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা সফরে এলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল। দীর্ঘ ৬৫ বছরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জীবন আরও বিচিত্র রং-রেখায় সাজিয়ে নিতে ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি পা রাখেন ঢাকায়। বিদগ্ধ ব্যক্তিদের নিবিড় সাহচর্যে ভীষণ ব্যস্ততায় কাটল তাঁর পরের কয়েকটি দিন।
নির্ধারিত-অনির্ধারিত বিভিন্ন কর্মসূচির প্রতি কর্তব্যকর্ম যথাসম্ভব পালন শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যাহ্নে রেলগাড়িতে ওঠেন তিনি। নির্বাচিত সফরসঙ্গী পরিবেষ্টিত হয়ে অপরাহ্নে পৌঁছান ময়মনসিংহে। হ্যাঁ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনের উত্তেজনায় ময়মনসিংহের সুধীসমাজ উদ্বেলিত ছিল সেদিন। স্টেশনে কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন শহরের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। মাল্যে আর মধুভাষ্যে তাঁরা বরণ করেন কবিকে। তারপর শোভাযাত্রাসহ তাঁকে নিয়ে গেলেন আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলে।
ময়মনসিংহের খ্যাতিমান জমিদার মহারাজ শশীকান্ত চৌধুরীর আতিথেয়তায় আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল নামের ব্যতিক্রমধর্মী স্থাপনাতেই অতিবাহিত হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ময়মনসিংহ সফরের বেশ কয়েকটি দিন। মহামূল্যবান সেই দিনগুলোর স্মৃতি বহনকারী স্থাপনাটি দেখতেই এবার ময়মনসিংহ এলাম আমরা। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিলাম। তারপর অনেকটা পথ অতিক্রম করে নামলাম ময়মনসিংহ জজ কোর্টের সামনে।
জজ কোর্টের পাশেই দেয়ালঘেরা বিশাল এলাকা। গ্রিল-নির্মিত একটি প্রমিত আকারের প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে শান্ত, সুনিবিড় সেই এলাকায় প্রবেশ করলাম আমরা। ভেতরে বিভিন্ন আকৃতির বেশ কিছু আধুনিক স্থাপনা। ছোট-বড় কয়েকটি জলাশয়ও রয়েছে সেখানে। মাঝখানে পিচঢালা সরু পথ। গোধূলির আলো জড়িয়ে শুয়ে থাকা সেই পথ ধরে সামনে এগোতে এগোতেই আমাদের দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে উদ্ভাসিত হলো বিচিত্র স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল।
আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল মহারাজ শশীকান্ত চৌধুরীর বাগানবাড়ি। মনোরম এই বাগানবাড়ির নির্মাণ-কৃতিত্ব শশীকান্তের পালক পিতা মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর। সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী দত্তকসূত্রে মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর ষষ্ঠ উত্তরপুরুষ। অগণন জনকল্যাণকর কাজের পাশাপাশি ময়মনসিংহে অনিন্দ্যসুন্দর কিছু স্থাপনাও নির্মাণ করেন তিনি। সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক হিতসাধনের উদ্দেশ্যেই এসব স্থাপনার সিংহভাগ নির্মিত হলেও আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ।
ইংরেজ রাজত্ব তখন। উত্তরোত্তর জমিদারির শ্রীবৃদ্ধির স্বার্থে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন ইংরেজ তোষণ। তাই জুবিলি উৎসবকে ময়মনসিংহবাসীর জীবনের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পারে আট বিঘা জমি দান করেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। জমি দানের কিছুদিন পরেই সে স্থানে তিনি নির্মাণ করেন বাংলো আকৃতির একটি দ্বিতল ভবন। সুদৃশ্য এই ভবনে তৎকালীন ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের পত্নী আলেকজান্দ্রার তৈলচিত্র স্থাপন করেন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, তাঁর নামেই এ ভবনের নামকরণ করেন আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল।
রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে নির্মিত হলেও আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের সৌন্দর্যে মন রঙিন হলো আমাদের। কৌতূহলোদ্দীপক এ ভবনের সুউচ্চ ভিত্তিভূমি ইট-সিমেন্টে গাঁথা হলেও দৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান দ্বিতল কাঠামোটি মূলত লৌহনির্মিত। ব্যতিক্রমধর্মী নির্মাণরীতির কারণে স্থানীয় জনসাধারণ স্থাপনাটিকে শশীকান্তের লোহার কুটির নামেও অভিহিত করে থাকেন।
চারপাশে প্রশস্ত বারান্দা পরিবেষ্টিত স্থাপনার বিভিন্ন অংশে কাঠ-টিনের ব্যবহার লক্ষণীয়। প্রায় বর্গাকার আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের চারকোনায় অনুচ্চ স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত চারটি চিমনি। মূল স্থাপনার পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত ছুঁয়ে দুটি প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার দিকে। বাগানবাড়ির উপরিভাগ উঁচু শিরোধারযুক্ত টিনের ঢালু ছাদে আচ্ছাদিত। আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের দোতলার চতুর্দিকও নিচতলার মতোই বারান্দা পরিবেষ্টিত। ভবনের সামনে অবস্থিত গাড়িবারান্দার ওপরের অংশটুকু কিছুটা প্রসারিত হয়ে পরিগ্রহ করেছে ঝুলবারান্দার রূপ।
আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য দরজা রয়েছে বেশ কয়েকটি। কিন্তু সব কটি দরজাই তালাবদ্ধ বর্তমানে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ভবনটি বর্তমানে ব্যবহূত হচ্ছে শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র (পুরুষ) গ্রন্থাগার হিসেবে। সুতরাং ভবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সেই সহযোগিতা পাওয়া কি আদৌ সম্ভব চলতি পথের উৎসুক মানুষের পক্ষে? মনের ভেতর জাগ্রত হওয়া প্রশ্নটিকে ইতিবাচক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যাশায় ভবনসংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে খুঁজে বের করলাম। কথা বললাম বিনম্রস্বরে। কিন্তু হতাশাজনক ফলাফলে ক্লান্ত হলাম দ্রুত। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের সামনের সবুজ মাঠের এক প্রান্তে একটা গোড়া বাঁধানো বটগাছের নিচে বসলাম আমরা। পত্রপল্লবে বিকশিত বটগাছকে একটু যেন ভিন্ন প্রকৃতির মনে হলো আমাদের কাছে! মনে হলো বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ! কেন? কৌতূহল প্রশমনে কাছাকাছি অবস্থানরত কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ নারীর শরণাপন্ন হলাম এবার। তাঁরা জানালেন, ‘ময়মনসিংহ সফরকালে আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলে অবস্থানের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায়ই এসে বসতেন এই বটবৃক্ষতলে। স্বচ্ছজলের ব্রহ্মপুত্র তখন কাছেই ছিল। সুপ্রাচীন নদ থেকে উঠে আসা শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে নিতেন কবি—’ রবীন্দ্রনাথের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্তি ভুলে যাই আমরা। নতুন উদ্যমে আবার গ্রহণ করি আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলে প্রবেশের প্রস্তুতি।
দীপংকর চন্দ
ময়মনসিংহের খ্যাতিমান জমিদার মহারাজ শশীকান্ত চৌধুরীর আতিথেয়তায় আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল নামের ব্যতিক্রমধর্মী স্থাপনাতেই অতিবাহিত হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ময়মনসিংহ সফরের বেশ কয়েকটি দিন। মহামূল্যবান সেই দিনগুলোর স্মৃতি বহনকারী স্থাপনাটি দেখতেই এবার ময়মনসিংহ এলাম আমরা। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিলাম। তারপর অনেকটা পথ অতিক্রম করে নামলাম ময়মনসিংহ জজ কোর্টের সামনে।
জজ কোর্টের পাশেই দেয়ালঘেরা বিশাল এলাকা। গ্রিল-নির্মিত একটি প্রমিত আকারের প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে শান্ত, সুনিবিড় সেই এলাকায় প্রবেশ করলাম আমরা। ভেতরে বিভিন্ন আকৃতির বেশ কিছু আধুনিক স্থাপনা। ছোট-বড় কয়েকটি জলাশয়ও রয়েছে সেখানে। মাঝখানে পিচঢালা সরু পথ। গোধূলির আলো জড়িয়ে শুয়ে থাকা সেই পথ ধরে সামনে এগোতে এগোতেই আমাদের দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে উদ্ভাসিত হলো বিচিত্র স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল।
আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল মহারাজ শশীকান্ত চৌধুরীর বাগানবাড়ি। মনোরম এই বাগানবাড়ির নির্মাণ-কৃতিত্ব শশীকান্তের পালক পিতা মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর। সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী দত্তকসূত্রে মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর ষষ্ঠ উত্তরপুরুষ। অগণন জনকল্যাণকর কাজের পাশাপাশি ময়মনসিংহে অনিন্দ্যসুন্দর কিছু স্থাপনাও নির্মাণ করেন তিনি। সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক হিতসাধনের উদ্দেশ্যেই এসব স্থাপনার সিংহভাগ নির্মিত হলেও আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ।
ইংরেজ রাজত্ব তখন। উত্তরোত্তর জমিদারির শ্রীবৃদ্ধির স্বার্থে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন ইংরেজ তোষণ। তাই জুবিলি উৎসবকে ময়মনসিংহবাসীর জীবনের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পারে আট বিঘা জমি দান করেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। জমি দানের কিছুদিন পরেই সে স্থানে তিনি নির্মাণ করেন বাংলো আকৃতির একটি দ্বিতল ভবন। সুদৃশ্য এই ভবনে তৎকালীন ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের পত্নী আলেকজান্দ্রার তৈলচিত্র স্থাপন করেন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, তাঁর নামেই এ ভবনের নামকরণ করেন আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল।
রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে নির্মিত হলেও আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের সৌন্দর্যে মন রঙিন হলো আমাদের। কৌতূহলোদ্দীপক এ ভবনের সুউচ্চ ভিত্তিভূমি ইট-সিমেন্টে গাঁথা হলেও দৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান দ্বিতল কাঠামোটি মূলত লৌহনির্মিত। ব্যতিক্রমধর্মী নির্মাণরীতির কারণে স্থানীয় জনসাধারণ স্থাপনাটিকে শশীকান্তের লোহার কুটির নামেও অভিহিত করে থাকেন।
চারপাশে প্রশস্ত বারান্দা পরিবেষ্টিত স্থাপনার বিভিন্ন অংশে কাঠ-টিনের ব্যবহার লক্ষণীয়। প্রায় বর্গাকার আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের চারকোনায় অনুচ্চ স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত চারটি চিমনি। মূল স্থাপনার পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত ছুঁয়ে দুটি প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার দিকে। বাগানবাড়ির উপরিভাগ উঁচু শিরোধারযুক্ত টিনের ঢালু ছাদে আচ্ছাদিত। আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের দোতলার চতুর্দিকও নিচতলার মতোই বারান্দা পরিবেষ্টিত। ভবনের সামনে অবস্থিত গাড়িবারান্দার ওপরের অংশটুকু কিছুটা প্রসারিত হয়ে পরিগ্রহ করেছে ঝুলবারান্দার রূপ।
আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য দরজা রয়েছে বেশ কয়েকটি। কিন্তু সব কটি দরজাই তালাবদ্ধ বর্তমানে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ভবনটি বর্তমানে ব্যবহূত হচ্ছে শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র (পুরুষ) গ্রন্থাগার হিসেবে। সুতরাং ভবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সেই সহযোগিতা পাওয়া কি আদৌ সম্ভব চলতি পথের উৎসুক মানুষের পক্ষে? মনের ভেতর জাগ্রত হওয়া প্রশ্নটিকে ইতিবাচক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যাশায় ভবনসংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে খুঁজে বের করলাম। কথা বললাম বিনম্রস্বরে। কিন্তু হতাশাজনক ফলাফলে ক্লান্ত হলাম দ্রুত। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের সামনের সবুজ মাঠের এক প্রান্তে একটা গোড়া বাঁধানো বটগাছের নিচে বসলাম আমরা। পত্রপল্লবে বিকশিত বটগাছকে একটু যেন ভিন্ন প্রকৃতির মনে হলো আমাদের কাছে! মনে হলো বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ! কেন? কৌতূহল প্রশমনে কাছাকাছি অবস্থানরত কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ নারীর শরণাপন্ন হলাম এবার। তাঁরা জানালেন, ‘ময়মনসিংহ সফরকালে আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলে অবস্থানের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায়ই এসে বসতেন এই বটবৃক্ষতলে। স্বচ্ছজলের ব্রহ্মপুত্র তখন কাছেই ছিল। সুপ্রাচীন নদ থেকে উঠে আসা শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে নিতেন কবি—’ রবীন্দ্রনাথের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্তি ভুলে যাই আমরা। নতুন উদ্যমে আবার গ্রহণ করি আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলে প্রবেশের প্রস্তুতি।
দীপংকর চন্দ
No comments