গণতন্ত্রের যাত্রায় বাধা-বিপত্তি by ব্রহ্ম চেল্লানি
মালদ্বীপের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদকে এক সশস্ত্র ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করা থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করার সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি নির্বিষ তবে নির্বাচিত সরকারকে আরও দুর্বল করা পর্যন্ত ঘটনাগুলো দেখে মনে হচ্ছে,
দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা দৃশ্যত উল্টে যাচ্ছে। নেপাল ও শ্রীলংকার ঘটনার পর নাশিদকে বন্দুকের নলের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করানোর মাধ্যমে মালদ্বীপ হলো এই অঞ্চলের তৃতীয় দেশ, যেখানে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা কক্ষচ্যুত হলো। ভারত মহাসাগরের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার ঘূর্ণিপাকের মধ্যে পড়ে গেল।
এদিকে পাকিস্তানের প্রকৃত গণতান্ত্রিক উত্তরণ পর্ব শুরু হতে এখনও বাকি। এর মধ্যে গিলানির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে দিয়েছে। এটা সামরিক ক্যু করে ক্ষমতা দখলের পরিবর্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য পর্দার অন্তরালে থেকে সরকার নিয়ন্ত্রণ তথা তাদের আরও অনুগত একটি সরকার প্রতিষ্ঠার পথকে সহজ করবে।
দৃশ্যত প্রেসিডেন্ট রাজাপাকশের একনায়কতন্ত্রের অধীনে শ্রীলংকার মানবাধিকার পরিস্থিতি অব্যাহত আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করে চলেছে। সম্প্রতি দেশটির ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি সেখানে একটি সামরিকায়িত সমাজ ও আত্মবিশ্বাসী রাজাপাকশে উপহার দিয়েছে, যিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কাটছাঁট করেছেন ও বহুজাতিক শ্রীলংকাকে এক জাতির দেশ হিসেবে পরিচিত করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। নেপালে রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন সংবিধান নিয়ে বিবাদের কারণে সেখানে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে নেপাল ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার বিপদের মধ্যে রয়েছে। ভারত ও নেপালের মধ্যে পাসপোর্ট ছাড়াই আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় নয়াদিলি্লর ওপর এ ধরনের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুতর প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ব্যর্থ ক্যু প্রচেষ্টা প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারের টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টাকেই মূর্ত করে এবং এখানে গণতন্ত্র এখনও যে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে তা-ই প্রমাণ করে। স্বাধীনতার চার দশকে বাংলাদেশে ২৩টি ক্যু প্রচেষ্টা হয়, যার মধ্যে কয়েকটি সফল হয়। এই অঞ্চলের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবাধ, স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘাটতিকেই নির্দেশ করে। আবার নির্বাচন আপনাআপনি তৃণমূল পর্যায়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন অথবা যারা ক্ষমতায় রয়েছে তারা সাংবিধানিক বিধিবিধানকে গ্রাহ্য করে চলবেন তার নিশ্চয়তা দেয় না। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার এখানে-সেখানে উত্তেজনা মাঝে মধ্যেই দেখা দিচ্ছে।
অন্যদিকে এই অঞ্চলের একমাত্র ভারতেই বহুত্ববাদী গণতন্ত্র শিকড় গাড়তে সক্ষম হয়েছে। তবে ভারতের বিশাল আয়তন এবং এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের সঙ্গে তার সীমান্ত থাকার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি কমবেশি ভারতকেও প্রভাবিত করে। ভারতের অতীত নীতির ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, এমনকি পাকিস্তানে দীর্ঘ সময় ধরে স্বৈরাচারী শাসন অব্যাহত থাকার সুযোগ পেয়েছিল। গণতন্ত্রের পিছু হটাটাও এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর ভারতের প্রভাব বিস্তারের অসমর্থতাকেই প্রতিপন্ন করে।
তবে চলমান রাজনৈতিক ডামাডোল ও অনিশ্চয়তা ভারতের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতিও হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিবেশীর অস্থিতিশীলতা বাণিজ্যসহ আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ইন্টিগ্রেশন ত্বরান্বিত করার পথকে কঠিন করে দিতে পারে। যখন গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শক্তি অর্জন করে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যেমনটা দেখা যাচ্ছে, তখন উগ্রবাদীদের নড়াচড়া করার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসে।
এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের জন্য বড় শিক্ষা এই যে, পুরনো ঘাঁটি গেড়ে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে যতক্ষণ পর্যন্ত না ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যাচ্ছে এবং আইনের শাসন মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার বিপদ কাটবে না। উদাহরণ হিসেবে মালদ্বীপের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। সেখানে ২০০৮ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে দশকের পর দশক ধরে চলা একনায়কত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটলেও নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মাথায় গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার আলো নিভে যায়। ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নাশিদ নতুন করে এ বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেন, 'একনায়করা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেই যে একনায়কত্ববাদ মুছে যাবে তা সব সময়ের জন্য ঠিক নয়...।'
ব্রহ্ম চেল্লানি :নয়াদিলি্লভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক
খালিজ টাইমস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর :সুভাষ সাহা
No comments