বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসুক শহীদ ওয়াহাব by এসএম আব্রাহাম লিংকন
অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব তালুকদার তদানীন্তন অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিনহাটা মহকুমার কালমাটি গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন। ভারত বিভক্তির পর সীমান্তের এপার ভুরুঙ্গামারীর বাউসমারী গ্রামে বেড়ে ওঠেন। ১৯৬৫ সালে তিনি প্রায় বিনা বেতনে যোগ দিয়েছিলেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত কুড়িগ্রাম কলেজে।
১৯৬৯ সালে উত্তাল ছা্ত্র আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রবল ভূমিকা রাখেন তিনি। কুড়িগ্রামবাসী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১০ মার্চ কুড়িগ্রাম শহরে সর্বদলীয় সভা হয়, সভায় একটি মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন অধ্যাপক ওয়াহাব। ছাত্রদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এসব কাজে অধ্যাপক ওয়াহাব আন্তরিক সহযোগিতা দেন। তিনি কলেজের ছাত্রদেরও সামরিক প্রস্তুতিতে সহযোগিতা করেন।
পাক বাহিনী এপ্রিল মাসে কুড়িগ্রাম শহর দখল করে নিলে কৌশলগত কারণে ভুরুঙ্গামারী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে ভুরুঙ্গামারী শহরও পাক আর্মির দখলে গেলে পরিস্থিতির কারণে অধ্যাপক ওয়াহাবও পরিবার নিয়ে ভারতে যান। তিনি স্ত্রী-পুত্রকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে রেখে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বামনহাটে প্রতিষ্ঠিত যুবশিবিরের প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। সেখান থেকেই অসংখ্য যুবককে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান করে দেশের অভ্যন্তরে সম্মুখ সমরে পাঠিয়েছিলেন। এক সময় অধ্যাপক ওয়াহাব সিদ্ধান্ত নেন শিংঝাড় ও বাউসমারী অপারেশনের, যাতে পাকিস্তানি আর্মির আনাগোনা বন্ধ হয়। তথ্য সংগ্রহের জন্য রেকি করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই কাজটির দায়িত্ব নিজেই কাঁধে নেন অধ্যাপক ওয়াহাব। ৭ আগস্ট সহযোদ্ধা ডা. মজিবুর রহমান, আবুল কাশেম মাস্টার ও ফরহাদ নামে এক তরুণকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পথে বগনি ব্রিজের কাছে একদল মুক্তিযোদ্ধাকে কৌশল জানিয়ে বিকেলে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা প্রবেশ করেন শিংঝাড় গ্রামে, পরিত্যক্ত রেলপথ ধরে অনেকটা গোপনে। সাধারণ মানুষ বড় বিপদে না পড়লে এই জঙ্গলাকীর্ণ পথ ব্যবহার করত না। অধ্যাপক ওয়াহাব এই পরিত্যক্ত চেনা পথটি ধরে অগ্রসর হচ্ছেন। লক্ষ্য যেন কেউ বুঝতে না পারে তারা এলাকায় প্রবেশ করেছেন। উদ্দেশ্য শত্রুকে আড়াল করে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একই সময় একই পথ ধরে পাকিস্তানি সৈন্যরাও নিজেদের লুকিয়ে ভারতীয় সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, যা ছিল অধ্যাপক ওয়াহাবের সম্পূর্ণ অজানা। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সৈন্য উভয় দল নিজ নিজ গন্তব্যে বিপরীতমুখী অবস্থানে অগ্রসর হচ্ছিল। কিছুদূর অগ্রসর হতেই পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে পড়েন অধ্যাপক ওয়াহাব। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কিছুটা নিজেকে আড়াল করে পজিশন নিতেই নির্মম পাকিস্তানিদের বুলেটে তিনি আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এক পাক সৈন্য কাছে এসে শরীর তল্লাশি করলে তার কাছে রক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানাবিধ কাগজপত্র পায়। এতে পাক সৈন্যটি ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রাশফায়ার করে, রাগে শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বিদীর্ণ করে। তার লাশ উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা বামনহাট যুবশিবিরে এনে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীর অংশগ্রহণে জানাজা শেষে সামরিক কায়দায় বাংলাদেশ সীমান্তের পিলার ৯৫৬-এর পাশে পশ্চিমবঙ্গের কালমাটি গ্রামে বগনী নদীর তীরে সমাহিত করেন। ওইদিন পাকিস্তানিরা সেখানে অবস্থান নিলে প্রত্যাশা থাকার পরও বাংলাদেশের মাটিতে তাকে সমাহিত করা সম্ভব হয়নি।
স্বাধীনতারর পর এই বীর সেনানীর কবর ভারত থেকে নিয়ে আসার জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। কিন্তু বিষয়টির অগ্রগতি হয়নি। শহীদ ওয়াহাবের কবর এখনও ভারতেই আছে। বগনী নদীর ভাঙনে কবরটি বিলীন হওয়ার উপক্রম। আশা করি, সরকার এই বীর সেনানীর কবরটি দেশে এনে কুড়িগ্রাম কলেজে তার নামে প্রতিষ্ঠিত শহীদ ওয়াহাব ছাত্রাবাসের পাশে সমাহিত করবে। শহীদ পরিবারটি বর্তমানে কুড়িগ্রামের সরকারি খাসজমিতে বছরভিত্তিক ইজারায় বাড়ি করে কষ্টে দিনাতিপাত করছে। স্থানীয় ভূমিদস্যুরা মামলা-মোকদ্দমা করে তা দখলের পাঁয়তারা করছে। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
আজ ৭ আগস্ট শহীদ আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের শহীদ হওয়ার ৪০ বছর পূর্ণ হলো। তার নামে যে ছাত্রাবাস কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে আছে তার ছাত্ররাও জানে না এই বীর শহীদের জীবন কাহিনী, জানে না কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও। এমনকি তার মৃত্যুর দিনটিও লেখা নেই কলেজের কোথাও! প্রত্যাশা করি শহীদ ওয়াহাবের কবরটি বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসুক। তিনি পুনর্বার সমাহিত হোন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে।
lincoln_bd@yahoo.com
পাক বাহিনী এপ্রিল মাসে কুড়িগ্রাম শহর দখল করে নিলে কৌশলগত কারণে ভুরুঙ্গামারী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে ভুরুঙ্গামারী শহরও পাক আর্মির দখলে গেলে পরিস্থিতির কারণে অধ্যাপক ওয়াহাবও পরিবার নিয়ে ভারতে যান। তিনি স্ত্রী-পুত্রকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে রেখে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বামনহাটে প্রতিষ্ঠিত যুবশিবিরের প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। সেখান থেকেই অসংখ্য যুবককে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান করে দেশের অভ্যন্তরে সম্মুখ সমরে পাঠিয়েছিলেন। এক সময় অধ্যাপক ওয়াহাব সিদ্ধান্ত নেন শিংঝাড় ও বাউসমারী অপারেশনের, যাতে পাকিস্তানি আর্মির আনাগোনা বন্ধ হয়। তথ্য সংগ্রহের জন্য রেকি করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই কাজটির দায়িত্ব নিজেই কাঁধে নেন অধ্যাপক ওয়াহাব। ৭ আগস্ট সহযোদ্ধা ডা. মজিবুর রহমান, আবুল কাশেম মাস্টার ও ফরহাদ নামে এক তরুণকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পথে বগনি ব্রিজের কাছে একদল মুক্তিযোদ্ধাকে কৌশল জানিয়ে বিকেলে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা প্রবেশ করেন শিংঝাড় গ্রামে, পরিত্যক্ত রেলপথ ধরে অনেকটা গোপনে। সাধারণ মানুষ বড় বিপদে না পড়লে এই জঙ্গলাকীর্ণ পথ ব্যবহার করত না। অধ্যাপক ওয়াহাব এই পরিত্যক্ত চেনা পথটি ধরে অগ্রসর হচ্ছেন। লক্ষ্য যেন কেউ বুঝতে না পারে তারা এলাকায় প্রবেশ করেছেন। উদ্দেশ্য শত্রুকে আড়াল করে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একই সময় একই পথ ধরে পাকিস্তানি সৈন্যরাও নিজেদের লুকিয়ে ভারতীয় সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, যা ছিল অধ্যাপক ওয়াহাবের সম্পূর্ণ অজানা। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সৈন্য উভয় দল নিজ নিজ গন্তব্যে বিপরীতমুখী অবস্থানে অগ্রসর হচ্ছিল। কিছুদূর অগ্রসর হতেই পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে পড়েন অধ্যাপক ওয়াহাব। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কিছুটা নিজেকে আড়াল করে পজিশন নিতেই নির্মম পাকিস্তানিদের বুলেটে তিনি আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এক পাক সৈন্য কাছে এসে শরীর তল্লাশি করলে তার কাছে রক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানাবিধ কাগজপত্র পায়। এতে পাক সৈন্যটি ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রাশফায়ার করে, রাগে শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বিদীর্ণ করে। তার লাশ উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা বামনহাট যুবশিবিরে এনে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীর অংশগ্রহণে জানাজা শেষে সামরিক কায়দায় বাংলাদেশ সীমান্তের পিলার ৯৫৬-এর পাশে পশ্চিমবঙ্গের কালমাটি গ্রামে বগনী নদীর তীরে সমাহিত করেন। ওইদিন পাকিস্তানিরা সেখানে অবস্থান নিলে প্রত্যাশা থাকার পরও বাংলাদেশের মাটিতে তাকে সমাহিত করা সম্ভব হয়নি।
স্বাধীনতারর পর এই বীর সেনানীর কবর ভারত থেকে নিয়ে আসার জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। কিন্তু বিষয়টির অগ্রগতি হয়নি। শহীদ ওয়াহাবের কবর এখনও ভারতেই আছে। বগনী নদীর ভাঙনে কবরটি বিলীন হওয়ার উপক্রম। আশা করি, সরকার এই বীর সেনানীর কবরটি দেশে এনে কুড়িগ্রাম কলেজে তার নামে প্রতিষ্ঠিত শহীদ ওয়াহাব ছাত্রাবাসের পাশে সমাহিত করবে। শহীদ পরিবারটি বর্তমানে কুড়িগ্রামের সরকারি খাসজমিতে বছরভিত্তিক ইজারায় বাড়ি করে কষ্টে দিনাতিপাত করছে। স্থানীয় ভূমিদস্যুরা মামলা-মোকদ্দমা করে তা দখলের পাঁয়তারা করছে। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
আজ ৭ আগস্ট শহীদ আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের শহীদ হওয়ার ৪০ বছর পূর্ণ হলো। তার নামে যে ছাত্রাবাস কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে আছে তার ছাত্ররাও জানে না এই বীর শহীদের জীবন কাহিনী, জানে না কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও। এমনকি তার মৃত্যুর দিনটিও লেখা নেই কলেজের কোথাও! প্রত্যাশা করি শহীদ ওয়াহাবের কবরটি বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসুক। তিনি পুনর্বার সমাহিত হোন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে।
lincoln_bd@yahoo.com
No comments