রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা ও সুরের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও বিশ্ব মানবতার জয়গান গেয়েছেন by লাইসা আহমেদ লিসা
আমার জন্ম হয়েছে রাজশাহীতে। আমি বড় হয়েছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আমার বাবা সংগীতপাগল মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক। আমাদের বাড়িতে সব সময় গান হতো। আমার জন্মটা হয়েছে সাংগিতিক পরিবেশের মধ্যে। আমার বাবা বাসায় থাকলে গান গাইতেন।
তাঁর কণ্ঠ থেকে শোনা একটি গান আমি ছোট্টবেলায় গুনগুন করে গাইতাম। গানটি ছিল 'দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানেরও পাড়ে'। আমি তখনো এ গানের কোনোরূপ মর্মার্থ বুঝতাম না। কিন্তু আমি গাইতাম। আমার বাবার সহকর্মী বাংলা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম মুরশীদ। যিনি গান শেখাতেন। যদিও অনেকে তা জানেন না। আমি তাঁর কাছে গান শিখেছি। অনেকের ক্ষেত্রে যেটা হয়, গানের স্কুলে গিয়ে গান শেখে। আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। আমার জন্মটা হয়েছে সংগীতের আবহে। ফলে সংগীতটা আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জীবনবোধের গভীরে মিশে গেছে। বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা হতো। পারিবারিকভাবে ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে সহজাতভাবে এসেছেন। যখন কিশোরী হলাম তখন একবার জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতা হলো। তাতে আমি অংশ নিই। গানের জন্য প্রাণে একরকম পিপাসা অনুভব করতাম। তখনো তেমন বুঝতে শিখিনি। ক্রমশ রবীন্দ্রচর্চার মধ্যে আমার শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি মাঝেমধ্যে আমাদের রাজশাহীর বাসায় আসতেন। তাঁর সঙ্গে ওঠা-বসা, চলাফেরা। তাঁর ভেতর দিয়ে প্রকৃতি চেনা, রবীন্দ্রনাথকে জানা ও তাঁর গান শেখা। ফলে রবীন্দ্রনাথকে আমি জীবনযাপনের ভেতর থেকে গভীরভাবে পেয়েছি।
রবীন্দ্রনাথ আমাকে গানটা বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর গানের কথা আমার কাছে চেনা ছবি হয়ে ধরা দিত। রবীন্দ্রনাথের গান তো শুধু কথা ও সুর নয়, তার ভেতরে থাকে এক ছবি। যেমন_'দূর দেশী এক রাখাল ছেলে'; এর ভেতরে রয়েছে এক ছবি। যে ছবির ভেতরে রয়েছে এক সৌন্দর্য। জীবন এখানে সৌন্দর্যের গান গায়। মনের খেয়ালে মেঠোসুরে বাঁশি বাজায়। রবীন্দ্রনাথের গানে রয়েছে জীবনের অন্য রকম সুর। রবীন্দ্র গানের সুরের আবেশে আমরা নিরন্তর সত্য ও সুন্দরের চর্চা করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের গানটা সুন্দর করে গাওয়ার মধ্য দিয়ে জীবনও যেন সুন্দর হয়ে ওঠে। মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালোবাসার নানা রূপ, রং ও প্রকাশ তাঁর গানে আমরা পাই। চেতনার আয়নায় রবীন্দ্র গানের আবেশ আমাদের মানবিক ও প্রেমময় অনুভূতি জাগিয়ে দেয়। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে জীবনযাপনের গভীর থেকে অনুভব করতে পারি। এ অনুভব করাটা সহজ হয়েছে ছোট্টবেলায় রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে পাওয়ার কারণে।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, বিশেষত তাঁর কবিতা, গান, ছোটগল্প ও উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমি দেখেছি, জীবনের নানা পর্বে রবীন্দ্রনাথের কোনো লাইন যেন মানসিক অবস্থার সঙ্গে মিলে গেছে। তাঁর কথাগুলো এমন নিবেদন নিয়ে আসে, মনে হয় যেন এটা আমারই কথা। এমন অনেক সময়ই হয় যে আজ ভীষণ মন খারাপ, রবীন্দ্রনাথের কোনো বিশেষ গান সেই অবস্থা ও তার বর্ণনা এমনভাবে দেন যে শুনতে শুনতে-গাইতে গাইতে চিত্তে বেদনার হাহাকারটাও আনন্দ হয়ে ধরা দেয়।
রবীন্দ্রনাথকে না জানলে আমি আজ এই আমিটুকু হতে পারতাম না। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ মানুষের মনের অনেকটা জায়গাজুড়ে বিরাজ করেন। এই যে আজও অনেক মানুষ রবীন্দ্রনাথের গান গুনগুন করে গায়, এটা কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। এর পেছনেও রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। যেমন_আমাদের ছায়ানটকে আজকের এ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এ সংগ্রামের মূলে কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই রবীন্দ্রনাথ আমাদের দুঃখ-শোক ও আনন্দ-বেদনায় মিশে আছেন।
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়ে বিশ্বদরবারে চলে গেছে। গীতাঞ্জলির সাহিত্যমূল্য ও এর অন্তর্নিহিত আমাদের দর্শন বা চিন্তাকে বিশ্বদরবারে নিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে আমরা পরিচিত হয়েছি বিশ্বদরবারে। তাঁর মাধ্যমে আমরা আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরতে পেরেছি। রবীন্দ্র-সাহিত্যে ভাষার এমন ভাব ও প্রকাশ আমরা দেখতে পাই, যা অনেক কঠিন কোনো বিষয়কে সহজ করে আমাদের কাছে তুলে ধরে। রবীন্দ্র-সাহিত্যে কথাগুলোকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা একটা প্রচণ্ড আবেগ দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই এমন তীব্র আবেগ। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা যে যতটুকু স্পর্শ করতে পারে, নিজের করে অনুভব করতে পারে, তার গান গাওয়াটা সবচেয়ে সুন্দর হয়।
রবীন্দ্রনাথ এত দিনব্যাপী আমাদের এতটা জায়গাজুড়ে আছেন। কারণ তিনি আধুনিক। সময়ের মৌলিক সুরটা তিনি অনুভব করেছেন মর্মে মর্মে। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানই আমাকে আলোড়িত করে। বিশেষ করে একটা গান আমাকে বিমোহিত করে রাখে।
'শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু, হে প্রিয়
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও'।
আমি এ বিশেষ গানটা যখন গাই, তখন কোনো বাজনা ছাড়া গেয়ে থাকি। আমার এ গানটা গাওয়ার সময় মনে হয়, এটি এমন বাণীপ্রধান গান যে এতে বাজনার কোনো দরকার নেই। এ গানটা সুর ও প্রাণ দিয়ে গাওয়াটাকেই আমার ভালো লাগে।
রবীন্দ্রনাথের অনেক গানই ছন্দোবদ্ধ। তাঁর অনেক বর্ষার গান আছে। যেমন_'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসারে'। রবীন্দ্রনাথের ছন্দোবদ্ধ গানগুলোই আমার বেশি ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথের সহজ কথা ও সুরের গানগুলো সবার কাছে সহজে ধরা দিলেও কিছু গান আছে, যা বুঝতে শিক্ষার প্রয়োজন। অন্য সাধারণ গানের সঙ্গে ভাষাপ্রধান গানের মর্মার্থ বুঝতে শিক্ষা দরকার। একটি বিশেষ স্তরে এলে গানের মর্মার্থটা বোঝা গেলেও বাণীপ্রধান গানের সুরটা কিন্তু সবাকেই টানে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা ও সুরের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও বিশ্ব মানবতার জয়গান গেয়েছেন। এভাবে তিনি তাঁর জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে সর্বজনীন মানবে উন্নীত হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ আমাকে গানটা বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর গানের কথা আমার কাছে চেনা ছবি হয়ে ধরা দিত। রবীন্দ্রনাথের গান তো শুধু কথা ও সুর নয়, তার ভেতরে থাকে এক ছবি। যেমন_'দূর দেশী এক রাখাল ছেলে'; এর ভেতরে রয়েছে এক ছবি। যে ছবির ভেতরে রয়েছে এক সৌন্দর্য। জীবন এখানে সৌন্দর্যের গান গায়। মনের খেয়ালে মেঠোসুরে বাঁশি বাজায়। রবীন্দ্রনাথের গানে রয়েছে জীবনের অন্য রকম সুর। রবীন্দ্র গানের সুরের আবেশে আমরা নিরন্তর সত্য ও সুন্দরের চর্চা করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের গানটা সুন্দর করে গাওয়ার মধ্য দিয়ে জীবনও যেন সুন্দর হয়ে ওঠে। মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালোবাসার নানা রূপ, রং ও প্রকাশ তাঁর গানে আমরা পাই। চেতনার আয়নায় রবীন্দ্র গানের আবেশ আমাদের মানবিক ও প্রেমময় অনুভূতি জাগিয়ে দেয়। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে জীবনযাপনের গভীর থেকে অনুভব করতে পারি। এ অনুভব করাটা সহজ হয়েছে ছোট্টবেলায় রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে পাওয়ার কারণে।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, বিশেষত তাঁর কবিতা, গান, ছোটগল্প ও উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমি দেখেছি, জীবনের নানা পর্বে রবীন্দ্রনাথের কোনো লাইন যেন মানসিক অবস্থার সঙ্গে মিলে গেছে। তাঁর কথাগুলো এমন নিবেদন নিয়ে আসে, মনে হয় যেন এটা আমারই কথা। এমন অনেক সময়ই হয় যে আজ ভীষণ মন খারাপ, রবীন্দ্রনাথের কোনো বিশেষ গান সেই অবস্থা ও তার বর্ণনা এমনভাবে দেন যে শুনতে শুনতে-গাইতে গাইতে চিত্তে বেদনার হাহাকারটাও আনন্দ হয়ে ধরা দেয়।
রবীন্দ্রনাথকে না জানলে আমি আজ এই আমিটুকু হতে পারতাম না। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ মানুষের মনের অনেকটা জায়গাজুড়ে বিরাজ করেন। এই যে আজও অনেক মানুষ রবীন্দ্রনাথের গান গুনগুন করে গায়, এটা কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। এর পেছনেও রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। যেমন_আমাদের ছায়ানটকে আজকের এ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এ সংগ্রামের মূলে কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই রবীন্দ্রনাথ আমাদের দুঃখ-শোক ও আনন্দ-বেদনায় মিশে আছেন।
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়ে বিশ্বদরবারে চলে গেছে। গীতাঞ্জলির সাহিত্যমূল্য ও এর অন্তর্নিহিত আমাদের দর্শন বা চিন্তাকে বিশ্বদরবারে নিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে আমরা পরিচিত হয়েছি বিশ্বদরবারে। তাঁর মাধ্যমে আমরা আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরতে পেরেছি। রবীন্দ্র-সাহিত্যে ভাষার এমন ভাব ও প্রকাশ আমরা দেখতে পাই, যা অনেক কঠিন কোনো বিষয়কে সহজ করে আমাদের কাছে তুলে ধরে। রবীন্দ্র-সাহিত্যে কথাগুলোকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা একটা প্রচণ্ড আবেগ দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই এমন তীব্র আবেগ। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা যে যতটুকু স্পর্শ করতে পারে, নিজের করে অনুভব করতে পারে, তার গান গাওয়াটা সবচেয়ে সুন্দর হয়।
রবীন্দ্রনাথ এত দিনব্যাপী আমাদের এতটা জায়গাজুড়ে আছেন। কারণ তিনি আধুনিক। সময়ের মৌলিক সুরটা তিনি অনুভব করেছেন মর্মে মর্মে। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানই আমাকে আলোড়িত করে। বিশেষ করে একটা গান আমাকে বিমোহিত করে রাখে।
'শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু, হে প্রিয়
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও'।
আমি এ বিশেষ গানটা যখন গাই, তখন কোনো বাজনা ছাড়া গেয়ে থাকি। আমার এ গানটা গাওয়ার সময় মনে হয়, এটি এমন বাণীপ্রধান গান যে এতে বাজনার কোনো দরকার নেই। এ গানটা সুর ও প্রাণ দিয়ে গাওয়াটাকেই আমার ভালো লাগে।
রবীন্দ্রনাথের অনেক গানই ছন্দোবদ্ধ। তাঁর অনেক বর্ষার গান আছে। যেমন_'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসারে'। রবীন্দ্রনাথের ছন্দোবদ্ধ গানগুলোই আমার বেশি ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথের সহজ কথা ও সুরের গানগুলো সবার কাছে সহজে ধরা দিলেও কিছু গান আছে, যা বুঝতে শিক্ষার প্রয়োজন। অন্য সাধারণ গানের সঙ্গে ভাষাপ্রধান গানের মর্মার্থ বুঝতে শিক্ষা দরকার। একটি বিশেষ স্তরে এলে গানের মর্মার্থটা বোঝা গেলেও বাণীপ্রধান গানের সুরটা কিন্তু সবাকেই টানে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা ও সুরের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও বিশ্ব মানবতার জয়গান গেয়েছেন। এভাবে তিনি তাঁর জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে সর্বজনীন মানবে উন্নীত হয়েছেন।
No comments