স্মরণ-এসেছিল শুধু একজন by এবিএম মূসা
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদকে প্রথম যেদিন গণভবনে দেখি, তখন তাঁর গায়ে সামরিক পোশাক ছিল না। সৌম্য চেহারা, মুখে স্মিত হাসি ব্যক্তিটিকে দেখে আমার তাৎক্ষণিক ধারণা হয়েছিল, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কোনো কলেজের অধ্যাপক। কেন জানি মনে হলো, তাঁর অধ্যাপনার বিষয়টি বাংলা।
তাঁর কামরায় ঢোকার সময় বাইরে কোনো নাম লেখা দেখিনি, তখন গণভবনে এ ধরনের দরজায় নাম টাঙানোর ব্যবস্থাও ছিল না। তাই ভাবছিলাম, বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিবিষয়ক কোনো দপ্তর খুলেছেন নাকি? কামরায় ঢুকতেই হাসিমুখে চোখ ওপরের দিকে তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। কোনো প্রশ্ন করলেন না; বুঝলাম, ভদ্রলোক কথাবার্তা কম বলেন। নিজেই পরিচয় দিলাম, দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন; তবু মুখে কথা নেই, ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে দিলেন বসার জন্য। পরে স্মিত হেসে বললেন, ‘আমি মিলিটারি সেক্রেটারি।’ তারপরই চোখ নামিয়ে ফাইল দেখতে লাগলেন। আমি গিয়েছিলাম গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে নিজস্ব একটি কাজে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দোতলায় কোনো সরকারি বৈঠক করছিলেন। এসব ক্ষেত্রে বাইরের ঘরের সোফায় অথবা সচিব রফিকউল্লাহর কামরায় অপেক্ষা করার কথা। কী মনে করে এই কামরাটিতে এসে পড়লাম। একটু অস্বস্তিকর মনে হচ্ছিল; চুপচাপ বসে আছি। তারপর একসময় ভদ্রলোক হেসে নাম বললেন, ‘আমি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ। আজ স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মনে পড়ছে, কর্নেল শব্দটি বলেননি। আমিও নিজের পরিচয় দিলাম, বাংলাদেশ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সে-ই প্রথম পরিচয়, পরে তাঁর সঙ্গে একটু একটু করে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল গণভবনে ঘন ঘন আসা-যাওয়ার সূত্রে। গেলেই তাঁর ঘরে বসে এক কাপ চা খাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। বাড়ি থেকে ফ্লাস্কে করে চা আনতেন, নিজের হাতে ঢেলে খাওয়াতেন। তার অমায়িক ব্যবহারের কারণেই বোধ হয় একদিন তাঁকে বলে বসলাম, ‘জামিল ভাই, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল না হয়ে প্রফেসর জামিল, ডক্টর জামিল হলেই আপনাকে মানাত ভালো।’ আমার এই কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল, মেজর কর্নেল বা জেনারেল বললেই আমার ধারণা হতো, বেশ ফরমাল, কেতাদুরস্ত খাকি পোশাক পরা, চটপটে বা স্মার্ট চেহারায় কাঠিন্যের ছাপ। সামরিক বাহিনীর এই বেসামরিক স্বভাবের সদস্যকে কেন বঙ্গবন্ধু তাঁর সচিবের পদে মনোনীত করেছিলেন, তা বুঝতে দেরি হয়েছিল। আমলা-সচিব রফিকউল্লাহ চৌধুরী থেকে ফরাসউদ্দিন, মাহে আলম, মশিহুর রহমান বা নূরুল ইসলাম এঁদের মতো মিশুক আপাদমস্তক ভদ্রলোকদের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছিলেন উর্দি পরা সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে চিনতেন বঙ্গবন্ধু, তাই সুন্দর একটি নিজস্ব প্রশাসনিক টিম গঠন করতে পেরেছিলেন। তবে জামিলের সামরিক ছাপ কিছুটা থাকার কারণে অথবা অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে অন্য সবার চেয়ে গণভবনে একটু আলাদা ছিলেন। খুব বেশি একটা কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আমাদের মতো কয়েকজনের সঙ্গেই শুধু তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল।
তাঁর সঙ্গে নানা আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পরিচয় পাওয়া যেত। বঙ্গবন্ধুর কোনো কোনো পদক্ষেপের ব্যাপারে আমি অসন্তোষ প্রকাশ করলে তিনি সুন্দরভাবে কয়েকটি কথায় ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিতেন। আমি কথায় না পেরে হেসে বলতাম, ‘এ জন্যই তো বলি, আপনার প্রফেসর হওয়া উচিত ছিল, দর্শনশাস্ত্রের অথবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের। এতৎসত্ত্বে, আমার মনে হতো প্রধানমন্ত্রীর কাজের সাফাই দেবেন বৈকি, হাজার হোক তাঁরই চাকরি করছেন। কিন্তু এ যে নেহাত চাকরি ছিল না, তা তিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন। তাই তো পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ঘাতকের গুলির সামনে বুক পেতে দিলেন। অনেকেরই মনে প্রশ্ন জেগেছে, সেদিন ভোরে আর কেউ ৩২ নম্বরের দিকে দৌড়ালেন না, জামিল সাহেব কেন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলেন? আমার মতো অনেকেরই তো ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচাটা’ বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথাও আত্মগোপন করাই ছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। জামিল সাহেব সামরিক বাহিনীর লোক, এ ধরনের কোনো ভাবনা হওয়ারই কথা। তাই বলে কেনো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একা দৌড়াবেন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার জন্য, যদি না কর্তব্যের বাইরেও অন্তরের কোনো টান থাকে?
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে এক সামরিক কর্মকর্তা হয়ে তাঁর অজানা থাকার কথা নয়, একা তিনি দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করতে পারতেন না। ব্যাপারটি কী ঘটছে, বাধা দিলে কী পরিণতি হবে, তাও না বোঝার কথা নয়। অন্য কেউ হলে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে ফিরে যেতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তাঁর মানে বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার্থে, আপন কর্তব্য পালনে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তবে এ শুধু নিছক কর্তব্যবোধ ছিল না, আপনজনকে রক্ষার তাগিদে তাঁর স্থান-কাল নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ বা মনের অবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর এই এক আপনজনের কথা আমরা ১৫ আগস্টে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করি না, এই সত্যটুকু সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। এত বড় আত্মত্যাগের কোনো স্বীকৃতি জাতি এখনো দেয়নি। একটি রাষ্ট্রীয় খেতাব তাঁর কপালে জোটেনি, কোনো আলোচনা সভায়, প্রবন্ধে ও স্মৃতিচারণায় তাঁর নামটি আসে না। আত্মীয়স্বজন ও আপন লোক ছাড়া কেউ তাঁর কবর জিয়ারত করেন না, ফুলের তোড়া দেন না। আমার খুব ভালো লেগেছিল শুধু কয়েক বছর আগে—ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদের কয়েকজন সাবেক সহকর্মী সেনা অফিসার তাঁর প্রতি স্মৃতি তর্পণ করে লেখালেখি করেছেন। আমরা স্লোগান দিতাম, ‘বঙ্গবন্ধু যেখানে, আমরা আছি সেখানে’। বঙ্গবন্ধু একান্ত আপনজনদের বাইরে বঙ্গবন্ধু যেখানে, সেখানে মুষ্টিমেয় যে কজন সত্যিই তাঁর সঙ্গে গিয়েছেন, তাঁদের মাঝে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ। এর কারণ বোধ হয় তিনি সত্যি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর আপনজন ছিলেন। রক্তের সম্পর্কে নয়, মনেপ্রাণে ও হূদয়ে।
সংশোধিত ও পুনর্মুদ্রিত
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
সে-ই প্রথম পরিচয়, পরে তাঁর সঙ্গে একটু একটু করে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল গণভবনে ঘন ঘন আসা-যাওয়ার সূত্রে। গেলেই তাঁর ঘরে বসে এক কাপ চা খাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। বাড়ি থেকে ফ্লাস্কে করে চা আনতেন, নিজের হাতে ঢেলে খাওয়াতেন। তার অমায়িক ব্যবহারের কারণেই বোধ হয় একদিন তাঁকে বলে বসলাম, ‘জামিল ভাই, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল না হয়ে প্রফেসর জামিল, ডক্টর জামিল হলেই আপনাকে মানাত ভালো।’ আমার এই কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল, মেজর কর্নেল বা জেনারেল বললেই আমার ধারণা হতো, বেশ ফরমাল, কেতাদুরস্ত খাকি পোশাক পরা, চটপটে বা স্মার্ট চেহারায় কাঠিন্যের ছাপ। সামরিক বাহিনীর এই বেসামরিক স্বভাবের সদস্যকে কেন বঙ্গবন্ধু তাঁর সচিবের পদে মনোনীত করেছিলেন, তা বুঝতে দেরি হয়েছিল। আমলা-সচিব রফিকউল্লাহ চৌধুরী থেকে ফরাসউদ্দিন, মাহে আলম, মশিহুর রহমান বা নূরুল ইসলাম এঁদের মতো মিশুক আপাদমস্তক ভদ্রলোকদের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছিলেন উর্দি পরা সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে চিনতেন বঙ্গবন্ধু, তাই সুন্দর একটি নিজস্ব প্রশাসনিক টিম গঠন করতে পেরেছিলেন। তবে জামিলের সামরিক ছাপ কিছুটা থাকার কারণে অথবা অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে অন্য সবার চেয়ে গণভবনে একটু আলাদা ছিলেন। খুব বেশি একটা কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আমাদের মতো কয়েকজনের সঙ্গেই শুধু তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল।
তাঁর সঙ্গে নানা আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পরিচয় পাওয়া যেত। বঙ্গবন্ধুর কোনো কোনো পদক্ষেপের ব্যাপারে আমি অসন্তোষ প্রকাশ করলে তিনি সুন্দরভাবে কয়েকটি কথায় ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিতেন। আমি কথায় না পেরে হেসে বলতাম, ‘এ জন্যই তো বলি, আপনার প্রফেসর হওয়া উচিত ছিল, দর্শনশাস্ত্রের অথবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের। এতৎসত্ত্বে, আমার মনে হতো প্রধানমন্ত্রীর কাজের সাফাই দেবেন বৈকি, হাজার হোক তাঁরই চাকরি করছেন। কিন্তু এ যে নেহাত চাকরি ছিল না, তা তিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন। তাই তো পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ঘাতকের গুলির সামনে বুক পেতে দিলেন। অনেকেরই মনে প্রশ্ন জেগেছে, সেদিন ভোরে আর কেউ ৩২ নম্বরের দিকে দৌড়ালেন না, জামিল সাহেব কেন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলেন? আমার মতো অনেকেরই তো ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচাটা’ বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথাও আত্মগোপন করাই ছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। জামিল সাহেব সামরিক বাহিনীর লোক, এ ধরনের কোনো ভাবনা হওয়ারই কথা। তাই বলে কেনো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একা দৌড়াবেন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার জন্য, যদি না কর্তব্যের বাইরেও অন্তরের কোনো টান থাকে?
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে এক সামরিক কর্মকর্তা হয়ে তাঁর অজানা থাকার কথা নয়, একা তিনি দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করতে পারতেন না। ব্যাপারটি কী ঘটছে, বাধা দিলে কী পরিণতি হবে, তাও না বোঝার কথা নয়। অন্য কেউ হলে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে ফিরে যেতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তাঁর মানে বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার্থে, আপন কর্তব্য পালনে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তবে এ শুধু নিছক কর্তব্যবোধ ছিল না, আপনজনকে রক্ষার তাগিদে তাঁর স্থান-কাল নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ বা মনের অবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর এই এক আপনজনের কথা আমরা ১৫ আগস্টে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করি না, এই সত্যটুকু সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। এত বড় আত্মত্যাগের কোনো স্বীকৃতি জাতি এখনো দেয়নি। একটি রাষ্ট্রীয় খেতাব তাঁর কপালে জোটেনি, কোনো আলোচনা সভায়, প্রবন্ধে ও স্মৃতিচারণায় তাঁর নামটি আসে না। আত্মীয়স্বজন ও আপন লোক ছাড়া কেউ তাঁর কবর জিয়ারত করেন না, ফুলের তোড়া দেন না। আমার খুব ভালো লেগেছিল শুধু কয়েক বছর আগে—ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদের কয়েকজন সাবেক সহকর্মী সেনা অফিসার তাঁর প্রতি স্মৃতি তর্পণ করে লেখালেখি করেছেন। আমরা স্লোগান দিতাম, ‘বঙ্গবন্ধু যেখানে, আমরা আছি সেখানে’। বঙ্গবন্ধু একান্ত আপনজনদের বাইরে বঙ্গবন্ধু যেখানে, সেখানে মুষ্টিমেয় যে কজন সত্যিই তাঁর সঙ্গে গিয়েছেন, তাঁদের মাঝে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ। এর কারণ বোধ হয় তিনি সত্যি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর আপনজন ছিলেন। রক্তের সম্পর্কে নয়, মনেপ্রাণে ও হূদয়ে।
সংশোধিত ও পুনর্মুদ্রিত
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments