সড়ক দুর্ঘটনা-এখনো কি মনোযোগ দেওয়ার সময় হয়নি? by হাসিব মোহাম্মদ আহ্সান
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়েছিল শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। জনগণ তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা যেমন জানাল, তেমনি আমরা দেখলাম যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।
সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের এমন দুজন কৃতী সন্তান এভাবে চলে যাবেন, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমরা সচেতনতার কথা বলি, এ ঘটনাটি যে জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছে, এটাও একটা সচেতনতা। এতে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এই সচেতনতার বিষয়টিকে আমি খুবই গুরুত্ব দিতে চাই। সচেতনতা সবার প্রয়োজন: পথচারীদের, যাত্রীদের, যানবাহনের মালিকদের, চালকদের। তবে দুই দশক ধরে পরিস্থিতি যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি যাঁদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন তা হলো দেশের নীতিনির্ধারকদের।
সারা দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় বিচ্ছিন্নভাবে কত লোক মারা যায়, তার হিসাব জনসাধারণের কাছে থাকার কথা নয়। বিশেষজ্ঞরা বা যাঁরা এ নিয়ে কাজ করেন তাঁরা হিসাব রাখেন। আর যাঁদের রাখার কথা, তাঁরা হচ্ছেন এ ক্ষেত্রে যাঁরা নীতিনির্ধারণ করেন। একটি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১ ছাত্রের মৃত্যু বা সেদিনের ঘটনায় দুজন কৃতী ব্যক্তিত্বসহ পাঁচজনের মৃত্যু খুব স্বাভাবিক কারণেই আমাদের সবাইকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু আমরা যারা এ নিয়ে কাজ করি, তারা জানি প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় কত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, কত পরিবার তাদের স্বজন হারাচ্ছে, কত লোক পঙ্গুত্ব বরণ করছে। নীতিনির্ধারকেরা যদি এসবের একটু খোঁজখবর রাখতেন, তবে নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে আমরা অন্তত কিছু উদ্যোগ দেখতে পেতাম।
আমাদের পর্যবেক্ষণের তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় যত লোক মারা যায়, তার ৫৮ শতাংশ পথচারী, ২৯ শতাংশ যাত্রী ও ১৩ শতাংশ চালক। সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী বা হেঁটে চলাচলকারীদের সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর এই তথ্য কি আমাদের নীতিনির্ধারকদের পরিষ্কারভাবে জানা আছে? যদি তাঁরা তা জেনে থাকেন, তবে তো শুধু দেশের ফুটপাত ও রাস্তা পারাপারের দিকে নজর দিলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেক কমিয়ে আনা যেত।
আবারও সচেতনতার প্রসঙ্গে আসছি। আজ জনগণ বলছে, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যু দেখতে চাই না, এর প্রতিকার চাই।’ জনগণের মধ্য থেকে সচেতন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যাঁরা সচেতন হলে কাজের কাজ কিছু হবে, সেই নীতিনির্ধারকদের তরফ থেকে তো কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যদি তা হতো, তবে তাঁরা উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানাতেন, কোনো একটি টার্গেট ঘোষণা করতেন। বলতে পারতেন যে আগামী এত বছরের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার হার আমরা এত ভাগ কমিয়ে আনব। কীভাবে তা করা যায়, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসতেন।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে দুর্ঘটনা রোধ করা হচ্ছে। আমরা এটা জোর দিয়ে বলতে পারি যে যথাযথ বৈজ্ঞানিক পথ অবলম্বন করে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখন পুরোপুরি রোধ করা না গেলেও কমানো সম্ভব, কমাতে কমাতে আমরা রোধ করার দিকে যেতে পারব। আমরা যারা এ নিয়ে কাজ করি, তাদের ভাষায় বলা হয় যে থ্রি-ই-এর (Three E) মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। এগুলো হচ্ছে Engineering (প্রকৌশলগত), Education (শিক্ষা) ও Enforcement (প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন)। প্রথমত, প্রকৌশলগতভাবে আমরা দেখতে পারি যে যানবাহন চলাচলের পুরো প্রক্রিয়ার উপাদানগুলো কী কী। রাস্তা এর একটি অন্যতম উপাদান। এর সঙ্গে আছে যানবাহন, চালক ও পথচারী। এখন অনেক গবেষক সামাজিক অবস্থাকেও একটি উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ যেকোনো কারিগরি পরিকল্পনার সময় সেখানকার আর্থসামাজিক অবস্থা, দারিদ্র্য বা শিক্ষার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হয়।
রাস্তার বিষয়টি পুরোপুরি প্রকৌশলগত। রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে শুরুতেই বিবেচনায় রাখতে হবে, রাস্তাটি যেন যান চলাচলের জন্য নিরাপদ হয়। রাস্তা কত মসৃণ বা কত গতিতে গাড়ি চলতে পারবে এর চেয়েও বড় বিবেচনা হচ্ছে রাস্তাটি যান চলাচলের জন্য নিরাপদ কি না। পাশ্চাত্য বা অন্য অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের ভূমি অনেক নিচু, রাস্তা নির্মাণ করতে হয় উঁচু করে ও কার্যত বাঁধের ওপর। যেহেতু উঁচু করে রাস্তা তৈরি করতে হয় এবং রাস্তার পাশের ভূমি নিচু ও অনেক ক্ষেত্রেই জলাভূমি, ফলে রাস্তার ঢালটি যথেষ্ট বিস্তৃত থাকতে হবে। এসব মেনে চলা হলে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রাক খাদে পড়ে ৪১ জন ছাত্রের মৃত্যুর মতো অনেক মর্মান্তিক ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত। আমি মনে করি, সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে এই নিরাপত্তার বিষয়টি হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিবেচনা। এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কীভাবে নিরাপদ সড়ক তৈরি করতে হবে তা আমাদের জানা আছে, কিন্তু বাস্তবে তা করা হচ্ছে কি না, সেটাই আসল প্রশ্ন।
সড়ক নিরাপত্তার জন্য নির্দেশিকা, মার্কিং ও স্পিড ম্যানেজমেন্টের বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানিকগঞ্জের যে স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন মারা গেলেন, ওই জায়গায় আমরা গিয়েছিলাম। সেখানে সামনে একটি বাঁক আছে, কিন্তু সে-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশিকা বা চিহ্ন আমার দেখতে পাইনি। ‘সামনে বাঁক আছে’ এমন একটি নির্দেশিকা ফলক যদি থাকত, তবে চালক বুঝতে পারতেন যে তাঁকে কী করতে হবে। সড়কের সঙ্গে চালকের সম্পর্ক বা যোগাযোগের ভাষা হচ্ছে এই নির্দেশিকাগুলো। কোনো সড়ক বা মহাসড়কে যদি এই নির্দেশিকাগুলো ঠিকমতো না থাকে, তবে চালক রাস্তার গতি-প্রকৃতি বুঝবেন কিসের মাধ্যমে? সড়কের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বিষয় অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত, একটি ঠিক না থাকা মানে বাকিগুলোও ঠিক থাকবে না। ভালো রাস্তা বানানো হলো কিন্তু তাতে যদি নির্দেশিকাগুলো ঠিকমতো না থাকে, তবে সেই রাস্তাকে নিরাপদ রাস্তা বলা যাবে না। নিরাপদ সড়ক একজন চালককে সব তথ্য দেবে, যার ওপর ভিত্তি করে চালক গাড়ি চালাবেন।
সড়ক নিরাপত্তার সঙ্গে ফুটপাতের বিষয়টিও রয়েছে। রাস্তার দুই পাশে হাঁটাপথ না থাকলে লোকজন রাস্তায় নেমে আসবেই। ঢাকার রাস্তার কয়টা ফুটপাতে আমরা হাঁটতে পারি, মহাসড়কের পাশে কতটুকু হাঁটার জায়গা আছে? আগেই বলেছি যে শুধু ফুটপাত আর হাঁটার জায়গা ঠিক করে দিতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮ শতাংশ পথচারীর মৃত্যুর হার দ্রুতই অনেক কমিয়ে ফেলা সম্ভব। সরকার যদি বিষয়টি বিবেচনায় নিত, তবে সারা দেশের ফুটপাত আর পায়ে চলার পথগুলো এভাবে বেদখল ও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ত না।
দেখা যাচ্ছে, দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে মহাসড়কে এবং তা হচ্ছে ভারী যানবাহনের জন্য। তাই বাস ও ট্রাকগুলোর দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূল নির্মাণপ্রতিষ্ঠান যে যানবাহনগুলো বানাচ্ছে, সেগুলো মডিফাই করা হচ্ছে। বাস ও ট্রাক চওড়া করা হচ্ছে, পণ্য বেশি বহন করা হচ্ছে, যাত্রীদের আসনসংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এই যানবাহনগুলো ঝুঁকি বাড়ায়। সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়ক নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় নিলে এ ধরনের যান চলাচল গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আইন থাকলেও তা যদি প্রয়োগ করা না হয়, তবে পুরো বিষয়টিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলেই লাইসেন্স ছাড়া চালকেরা গাড়ি চালাচ্ছেন, চলছে ফিটনেস ছাড়া গাড়ি। বিআরটিএর এক পরিসংখ্যানেই বলা হয়েছে যে দেশে ফিটনেস ছাড়া ৮০ হাজার গাড়ি চলছে। আর চালকদের প্রায় ৫০ শতাংশেরই কোনো লাইসেন্স নেই।
অভিজ্ঞতা ছাড়া চালকদের লাইসেন্স দেওয়া অনেকটা তাঁদের হাতে মারণাস্ত্র তুলে দেওয়ার মতো। লাইসেন্স ছাড়া যেমন আগ্নেয়াস্ত্র কাউকে দেওয়া হয় না, তেমনি লাইসেন্স ছাড়া কাউকে গাড়ি চালাতে দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি বেআইনিভাবে অস্ত্র রাখার চেয়েও মারাত্মক। একটি অস্ত্র দিয়ে হয়তো কেউ এক-দুজনকে মারতে পারবে, কিন্তু একটি দুর্ঘটনা একসঙ্গে কেড়ে নিতে পারে অনেক মানুষের প্রাণ।
আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা সড়কের নিরাপত্তা বাড়াতে ও দুর্ঘটনা কমাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষিত। দেশের অধিকাংশ মানুষ ট্রাফিক আইনের সাধারণ বিষয়গুলো জানে না। উন্নত দেশগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের রাস্তায় চলাচলের নানা নিয়মকানুন ও ট্রাফিক চিহ্ন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়। ফলে ছোট বয়স থেকেই ট্রাফিক নিয়মকানুন সম্পর্কে তাদের ধারণা গড়ে ওঠে। আমাদের দেশে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত মানসম্মত স্কুল নেই। বেসরকারি খাতেই এ কাজটি হবে, কিন্তু যোগ্য ও যথাযথ লোক লাইসেন্স পায় কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। সরকার যদি এ ক্ষেত্রে কঠোর মান বজায় রাখে, তবে ড্রাইভিং স্কুলগুলোও তাদের মান বাড়াতে বাধ্য হবে। আর অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ট্রাফিক নিয়মকানুনের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমগুলোও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। অথচ এ বিষয়টি সরকারের কাছে কেন এত উপেক্ষিত, তা সত্যিই বিস্ময়কর। সড়ক দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা যান, তাঁদের ৫০ শতাংশের বয়স ৩০-এর নিচে এবং তাঁরা সবাই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ। প্রতিবছর আমরা হারাচ্ছি শ্রমশক্তির এক বড় অংশ। সেদিনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় জনগণ এখন ক্ষুব্ধ। এখনো কি বিষয়টি মনোযোগ পাওয়ার মতো নয়? এখনো কি এদিকে নজর দেওয়ার সময় হয়নি?
হাসিব মোহাম্মদ আহ্সান: পরিচালক, দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই), বুয়েট ও অধ্যাপক পুরকৌশল বিভাগ।
No comments