মধ্য গগনে থির দাঁড়িয়ে ভানু by কনকচাঁপা
'আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে; দেখতে আমি পাইনি!' সত্যিই তো, দেখব কী করে? আঁখিনাথ যে আঁখিপল্লব দেখতে পায় না। একজন মানুষ_একজন প্রেমময় মানুষের প্রাণে_প্রাণের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ স্বপ্নবীজের খোসায় ঘুমিয়ে থাকেন। দিনে দিনে, পলে পলে, জীবনে জীবনে, সুখে-দুঃখে, সংকটে, অভিমানে, সেই রবীন্দ্রনাথ অঙ্কুুরোদ্গম হয়।
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি ছড়াতে থাকে, ডালপালা হয়। তারপর মহীরুহ হয়ে প্রাণের সঙ্গে লুকিয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ ঝিরঝিরে বাতাসের আবেশ ছড়ান। তখনই অনুভব হয়_'আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো'।
শৈশবের আগে_যে কালের নাম নেই_তখনই রবীন্দ্রনাথকে দেখি আমার দাদাবাড়িতে। বাঙ্ময় চোখ, তীক্ষ্ন নাক, কুঞ্চিত চুল ও চাদরের মতো ছেয়ে থাকা দাড়ির আড়ালে দাঁড়ানো ঋজু রবীন্দ্রনাথ_হাত দুটি পেছনে আটকানো, যেন পা পর্যন্ত জামাটাকে বিশেষ একটা খাঁজ বা বাঁক দেওয়াই উদ্দেশ্য। তাঁর পাশে ঝকঝকে তারুণ্যে কাচ টলটলে কাজী নজরুল ইসলাম। দুজনই আলাদা দুটি পঞ্জিকার পাতায় আটকে আছেন। রবীন্দ্রনাথের চোখে ঐশ্বর্য, নজরুলের চোখে প্রেম ও আগুন। দাদাবাড়ির যে ঘরে তাঁরা দুজন ঝোলানো, সেখানে একা হলেই ভয়ে দৌড় লাগাতাম। কী যে ভয় হতো! কিন্তু ওই ঘরের ছোট জানালায় দেখা বিশাল গোলাপঝাড় থেকে ভেসে আসা গন্ধে মাতাল হয়ে ভাবতাম, এ গোলাপও তাঁদেরই। ওই ঘর থেকে যার ভয়ে পালাতাম, সে যে আমার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড় লাগাত, কে জানত! ধাওয়া করতে নয়, আমার শিশুপ্রাণের ছোট্ট ঝুড়িতে গোলাপের গুচ্ছ হয়ে সুবাস ছড়াতে।
একটু করে পড়াশোনা ও গানের সঙ্গে সঙ্গে বড় হচ্ছিলাম। উচ্চাঙ্গসংগীত-নজরুলসংগীত-লালনের গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতের সুবাস ঠিকই নাকে আসছিল_কেউ না শেখানো সত্ত্বেও। নানাবাড়িতে গানের সামান্য চল ছিল। সেই 'সামান্য'তেই কানে আসত_'আমার সকল দুখের প্রদীপ'। কী প্রগাঢ় সুরধারা! চোখে পানি এসে যেত। বড় খালা গাইতেন_'দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে'। মনে হতো, গোধূলি লগ্নে পাটভাঙা শাড়ির আঁচল গলায় পেঁচিয়ে প্রেমিকা তার প্রেমাস্পদের অবহেলায় অভিমানের একমুঠো কুয়াশা ছড়িয়ে বলছে_'আমার সুরগুলি পায় চরণ/আমি পাই নে তোমারে'।
সন্ধ্যাবেলায় বই নিয়ে স্কুলের পড়া তৈরি করতে বসে দুলতে দুলতে পড়ি_'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/বাদল গেছে টুটি/...রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু...উ উ...'। ধেনু, ধেনু মানে গাভী, ধেনু মানে গাভী...। হঠাৎ দেখি, এই কবিতাটা গান হয়ে বাজছে। আহা, কী অবধারিত সুর! মনে হচ্ছে, এই সুরটা কেউ করেনি, আগে থেকেই হয়ে ছিল। এরপর পড়লাম_'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে'। ও মা! এ তো আমাদের গ্রাম। ওই বইয়ের কবিতার অক্ষরের সমান হয়ে কল্পনায় সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াই। কারণ, পড়ায় আমার মন বসে না কল্পনারই গন্ধে। এরপর পড়লাম_পড়লাম না, জানলাম_'কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা'। বাহ্, সেটাকে বানালাম_'কল্পনাতে চাঁদে যেতেও নেই মানা'। কোনো বাঁধা এলেই এটা আওড়াই। আর যে বাঁধা দেয়, তাকে মনে মনে কাঁচকলা দেখাই। দেখাব না? মনে মনে যে সবকিছুই করা যায়! সেই গোপন জীবনে কেউ বাঁধা দেয় না, কেউ হানা দেয় না, কেউ ছিনিয়ে নেয় না! বড় সুবিধা হয়ে গেল এই রবিবাবুর কারণে। তাঁর লেখা গান-কবিতার সঙ্গে বড় হতে হতে পেয়ে গেলাম তাঁর গল্পগুচ্ছ। লুকিয়ে-চুরিয়ে তা পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে বা আড়ালে গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম।
মানুষের মনে এত চোরাগলি? এত প্রকোষ্ঠ? এত খিড়কি? জীবন যেন ঋতুবতী নারীর মতোই রহস্যময়_ক্ষণে ক্ষণে মন বদলায়, রং বদলায়, তাপমাত্রা বদলায়। আর তা ওই একজন সব জেনে গেল? সবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় বুঝি! না হলে এত খুঁটিনাটি! 'পোস্টমাস্টার'-এর রতন আর বাবুর মধ্যকার রহস্য ধরতে পারি না। 'রতন যেন মুহূর্তেই বড় হয়ে গেল'_এ কথায় রতনের স্নেহশীলা রূপের বদলে প্রেমিকা হিসেবে ভাবতেই মন বেশি সায় দিচ্ছিল। ঘোর কিশোরী না!
ততদিনে রবিবাবুকে জানতে থাকলাম। তাঁর জীবনী, দর্শন, ভালোবাসা, ছবি আঁকা, উপন্যাস_এগুলো থেকে কেমন যেন বড় হয়ে যাচ্ছিলাম। মা আমাকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে তাঁর সব বইয়ের 'সমগ্র' হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। আমি তাঁর লেখা পড়ে পড়ে শেষে মনে মনে তাঁকেই চেয়ে বসলাম। সে হয়ে গেল আমার কল্পলোকের-মানসলোকের ছায়া, প্রতিচ্ছবি, মানুষ! তাঁকে নিয়ে কত ভাবনা আমার!
মাঝেমধ্যে যখন দেখি, হাতায় ফ্রিল দেওয়া অজস্র গহনায় জবরদস্ত নারী সেজে রবিবাবুর নাটকে-গল্পে অভিনয়শিল্পী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন ভাবি, তাঁর সময়ে হয়তো অমন কাপড়-গহনা-খোঁপা ব্যবহৃত হতো। কিন্তু তা কি তাঁর পছন্দ ছিল? তাঁর আঁকা ছবিতে কিন্তু ও রকম ফুলবিবি-তুলতুলে সুন্দরীদের দেখা যায় না। বরং ওই ঘোমটা-খসা চিকন কালো হরিণ চোখের নিরাবরণ তরুণীটিই তাঁর মনে বিশাল কবিতা বা সুরের জন্ম দিয়েছিল। জমিদার বংশের মানুষ হয়েও জানতেন, বেশি থাকলে মানুষ ফেলে ছড়িয়ে রাখে, আর অল্প হলে তার পুরোটার সদ্ব্যবহার করে। দুঃখই মানুষকে সুখানুভূতি জোগায়। বরং সুখই মানুষের মননে ও জীবনে চর্বি জমায়। তাঁর এই দর্শনগুলো আমি একান্ত বাধ্য ছাত্রীর মতো মেনে চলি, বিশ্বাস করি, গ্রহণ করি। স্রষ্টার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে ভাবনায় ফেলে দেয়। আমি বুঝতে পারি না, 'যাব না এই মাতাল সমীরণে আজ/জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে' বলে স্রষ্টাকে কী বোঝাতে চেয়েছেন। জীবন, সৃষ্টিকর্তা, পৃথিবী, ঋতু, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, শব্দতরঙ্গ, স্বর্গীয় ফুলের হাওয়া, অনুভব_সবকিছুকে এক সুতায় গেঁথে তাঁর কবিতায়-গানে অবলীলায় অথবা ভীষণ লীলাখেলায় রাঙিয়ে তুলে নিজে নির্বিকার মুণি-ঋষির ভাব ধরেছেন। কল্পলোকে আমি তাঁর নায়িকা। সেথায় তাঁকে আমি ভানু বলে ভাবি। সে যদি সারাক্ষণ ওই ঋজু ভঙ্গিতে ক্যালেন্ডারের পাতায় দাঁড়িয়ে থাকে তো আমার চলে? নাহ, এ আমার নিছক ভাবনা। কত শিক্ষা, কত ভাবনার খোরাক, কত সুর-কবিতা এই জীবনের নিঃসঙ্গ দুপুরগুলো জবাফুলের স্পর্ধা নিয়ে রাঙিয়ে দিল আমাকে। এ তো ভানুরই অবদান।
আমি বিশ্বাস করি, কবিদের থামিয়ে দিলে পৃথিবী বোবা হয়ে যাবে। আর ভানু সিংহ? সে তো সূর্য, রবি_রবির কিরণ নয়, আস্ত রবি। সে না থাকলে এই গান-সুর-কাব্যের পৃথিবীই আঁধার হয়ে থাকবে। মেঘেরা গোমড়ামুখে উড়ে বেড়াবে না। কারণ, আলো না থাকলে মেঘ দেখাই যায় না। তাঁর জীবদ্দশায়-মরণোত্তরকালে যেমন কিছু হিংসুটে মানুষ তাঁকে নিয়ে কিছু (হাস্যকর) সমালোচনা করায় আমি বিরক্ত, তেমনি তাঁর গান যখন কেউ মুখে সুপারি দিয়ে অহঙ্কারী ভঙ্গিতে গায়, তখন আমি খুব রেগে যাই। আরে এ যে রবিবাবুর গান! এ তো গলানো সোনার মতো প্রবহমান, উজ্জ্বল, স্পষ্ট, একরোখা, কিন্তু সরল। তাঁর সবকিছু তাঁর মতোই অনায়াস হওয়া চাই। নইলে তিনি যে রাগ করবেন।
শিশু বয়সে-কিশোরবেলায় তিনি আমাকে যেমনভাবে ভাবনার খোরাক-ছন্দ-সুর দিয়েছেন, এই পরিণত বয়সে তার চেয়ে আরো বেশি পাচ্ছি। মৃত্যুচিন্তাকে অনায়াস কামনা করার স্পর্ধা, দুঃখকে জয় করার দর্শন, জীবনকে লোভ না করার ধৈর্য শিক্ষা সবার এবং নিজের অলক্ষে পেয়ে যাচ্ছি দিনক্ষণ-দিনমান ধরে। শুধু মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার মনের কথা ভানু বাবু জানল কেমন করে? আর আমার না বলা কথা সব তাঁকেই বলতে হবে? আরেকটি প্রশ্ন অমীমাংসিতই থেকে যায়_তাঁর আলোময় জীবনের প্রতিফলন, তাঁর লেখা-সুর-ছন্দ, যা সূর্যেরই নামান্তর। তাহলে তাঁর আঁকা ছবিতে এত দুঃখ, এত কালো, এত অসামঞ্জস্যপূর্ণ সৌন্দর্য কোত্থেকে এল? নাকি ওগুলোই তাঁর জীবনীশক্তির আধার? তাঁর হৃদয়ের পাশে সোনার কৌটায় সাঁটা প্রাণ ভোমরা? কে জানে!
আমি খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট হই। রবিবাবু যদি আর কোনো কিছু না লিখে শুধু একটি কথাচিত্রই আঁকতেন, আমি তাতেও তাঁকে সমান শ্রদ্ধা করতাম। তিনি যেভাবে বলেছেন, 'আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি', এমনটা আর কে বলবে? কেউ না। তাঁর লেখা তো লেখা নয়, যমুনার জল। যা তরল-সহজ, কিন্তু বাঁক নিয়ে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে তারপর ক্ষান্ত হয়। গনগনে-টগবগে লাভা বুকে নিয়ে দীর্ঘকাল আমাদের মিঠা রোদ্দুরের আরাম দিয়ে যাচ্ছেন; নিয়ে যাচ্ছেন কাল থেকে কালান্তরে। তাঁর কথা তাঁকেই বলতে চাই_'আমার সোনার রবীন্দ্রনাথ/আমি তোমায় ভালোবাসি'। তাঁর জন্ম, জীবনশিক্ষা, বিদ্যাশিক্ষার জন্য বিলেত যাওয়া, সেখান থেকে আরো শানিত ও পরিপূর্ণ হওয়া, অনন্তর লিখে যাওয়া, নতুন নতুন তাল সুর সৃষ্টি করা, তাঁর কবিতা বিশ্বের তাবড় তাবড় অনুবাদকের হাতে পড়া, নোবেল প্রাইজ পাওয়া, ব্রিটিশদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে নাইট উপাধি বর্জন করা, তার আগের-পিছের হিংসুটে কবি লেখকদের দ্বারা সমালোচিত হওয়া, জমিদারি কাজকর্মে মনোনিবেশ করা_এগুলো তো অনেক বড় বড় গবেষক গবেষণা-পর্যালোচনা করেছেন। সেগুলো বই আকারে একবারেই হাতে পাওয়া যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমি একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে পরখ করি, চেখে দেখি, স্বাদ নিই পরম তৃপ্তিতে। আর ভাবি, ডিকশনারিতে এমন কোনো শব্দ আছে কি, যা তিনি ব্যবহার করেননি? বা এমন কারো মনের কথা কি বাকি আছে, যা তিনি ব্যক্ত করেননি? তাই আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ হলেন মহাকালের কণ্ঠ, যা হাওয়ায় ভাসিয়ে মহাপ্রলয়ের কাছে গিয়ে ঠেকবে। আমরা, আমাদের প্রজন্ম থাকবে না; কিন্তু তাঁর উপস্থিতি থাকবেই। সেটা এই ইন্টারনেটের যুগেও। বেশি ভালোবাসলে একটা অধিকারবোধ জন্মে। তেমনি অধিকারবোধ থেকেই কল্পনায় চাঁদে চলে যাই। রুপালি জালের সুতায় লিখি_
'কুসুম কুসুম ঘুম; রাত্রি নিঝুম
অনুভবে রবিবাবু দিয়ে যায় চুম
পাশাপাশি বসি; আধো লাজ হাসি
ললাটে লেপ্টে গেল লাল কুমকুম
রাতের আঁধার, নীরব সাঁতার
সাঁতরে পেঁৗছে তুলি লাল পদ্মফুল
রবিবাবু এসে, ভুলে! ভালোবেসে
কোনালে সাজিয়ে দিল এই কুন্তল।'
রবিবাবুর ঢঙে এমন নকল করে কিছু লিখলে আর এ দেশে বাস করতে হবে না বাপু! তাঁর গান গাইতে নিঃশ্বাস এদিক-ওদিক হওয়ারই জো নেই! কিন্তু অন্য কিছু যে লিখব, তার তো উপায় নেই। তিনি তো সুই থেকে ব্রহ্মাণ্ড_সবই কলমের কালিতে ডুবিয়ে নিয়েছেন। তাই মাঝেমধ্যে চিৎকার করে বলি_
আমার কথা? ওরে, কইবো কেমন ক'রে
সকল কথা কইতে আমার হৃদয় কেমন করে
কেমনে থামাই আমি ভানু সিংহরে_হাঃ হাঃ হাঃ।
থাক, আর কিছু কইব না। শুধু শেষে বলি_ভালোবাসি তোমায়, রবীন্দ্রনাথ হে।
শৈশবের আগে_যে কালের নাম নেই_তখনই রবীন্দ্রনাথকে দেখি আমার দাদাবাড়িতে। বাঙ্ময় চোখ, তীক্ষ্ন নাক, কুঞ্চিত চুল ও চাদরের মতো ছেয়ে থাকা দাড়ির আড়ালে দাঁড়ানো ঋজু রবীন্দ্রনাথ_হাত দুটি পেছনে আটকানো, যেন পা পর্যন্ত জামাটাকে বিশেষ একটা খাঁজ বা বাঁক দেওয়াই উদ্দেশ্য। তাঁর পাশে ঝকঝকে তারুণ্যে কাচ টলটলে কাজী নজরুল ইসলাম। দুজনই আলাদা দুটি পঞ্জিকার পাতায় আটকে আছেন। রবীন্দ্রনাথের চোখে ঐশ্বর্য, নজরুলের চোখে প্রেম ও আগুন। দাদাবাড়ির যে ঘরে তাঁরা দুজন ঝোলানো, সেখানে একা হলেই ভয়ে দৌড় লাগাতাম। কী যে ভয় হতো! কিন্তু ওই ঘরের ছোট জানালায় দেখা বিশাল গোলাপঝাড় থেকে ভেসে আসা গন্ধে মাতাল হয়ে ভাবতাম, এ গোলাপও তাঁদেরই। ওই ঘর থেকে যার ভয়ে পালাতাম, সে যে আমার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড় লাগাত, কে জানত! ধাওয়া করতে নয়, আমার শিশুপ্রাণের ছোট্ট ঝুড়িতে গোলাপের গুচ্ছ হয়ে সুবাস ছড়াতে।
একটু করে পড়াশোনা ও গানের সঙ্গে সঙ্গে বড় হচ্ছিলাম। উচ্চাঙ্গসংগীত-নজরুলসংগীত-লালনের গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতের সুবাস ঠিকই নাকে আসছিল_কেউ না শেখানো সত্ত্বেও। নানাবাড়িতে গানের সামান্য চল ছিল। সেই 'সামান্য'তেই কানে আসত_'আমার সকল দুখের প্রদীপ'। কী প্রগাঢ় সুরধারা! চোখে পানি এসে যেত। বড় খালা গাইতেন_'দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে'। মনে হতো, গোধূলি লগ্নে পাটভাঙা শাড়ির আঁচল গলায় পেঁচিয়ে প্রেমিকা তার প্রেমাস্পদের অবহেলায় অভিমানের একমুঠো কুয়াশা ছড়িয়ে বলছে_'আমার সুরগুলি পায় চরণ/আমি পাই নে তোমারে'।
সন্ধ্যাবেলায় বই নিয়ে স্কুলের পড়া তৈরি করতে বসে দুলতে দুলতে পড়ি_'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/বাদল গেছে টুটি/...রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু...উ উ...'। ধেনু, ধেনু মানে গাভী, ধেনু মানে গাভী...। হঠাৎ দেখি, এই কবিতাটা গান হয়ে বাজছে। আহা, কী অবধারিত সুর! মনে হচ্ছে, এই সুরটা কেউ করেনি, আগে থেকেই হয়ে ছিল। এরপর পড়লাম_'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে'। ও মা! এ তো আমাদের গ্রাম। ওই বইয়ের কবিতার অক্ষরের সমান হয়ে কল্পনায় সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াই। কারণ, পড়ায় আমার মন বসে না কল্পনারই গন্ধে। এরপর পড়লাম_পড়লাম না, জানলাম_'কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা'। বাহ্, সেটাকে বানালাম_'কল্পনাতে চাঁদে যেতেও নেই মানা'। কোনো বাঁধা এলেই এটা আওড়াই। আর যে বাঁধা দেয়, তাকে মনে মনে কাঁচকলা দেখাই। দেখাব না? মনে মনে যে সবকিছুই করা যায়! সেই গোপন জীবনে কেউ বাঁধা দেয় না, কেউ হানা দেয় না, কেউ ছিনিয়ে নেয় না! বড় সুবিধা হয়ে গেল এই রবিবাবুর কারণে। তাঁর লেখা গান-কবিতার সঙ্গে বড় হতে হতে পেয়ে গেলাম তাঁর গল্পগুচ্ছ। লুকিয়ে-চুরিয়ে তা পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে বা আড়ালে গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম।
মানুষের মনে এত চোরাগলি? এত প্রকোষ্ঠ? এত খিড়কি? জীবন যেন ঋতুবতী নারীর মতোই রহস্যময়_ক্ষণে ক্ষণে মন বদলায়, রং বদলায়, তাপমাত্রা বদলায়। আর তা ওই একজন সব জেনে গেল? সবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় বুঝি! না হলে এত খুঁটিনাটি! 'পোস্টমাস্টার'-এর রতন আর বাবুর মধ্যকার রহস্য ধরতে পারি না। 'রতন যেন মুহূর্তেই বড় হয়ে গেল'_এ কথায় রতনের স্নেহশীলা রূপের বদলে প্রেমিকা হিসেবে ভাবতেই মন বেশি সায় দিচ্ছিল। ঘোর কিশোরী না!
ততদিনে রবিবাবুকে জানতে থাকলাম। তাঁর জীবনী, দর্শন, ভালোবাসা, ছবি আঁকা, উপন্যাস_এগুলো থেকে কেমন যেন বড় হয়ে যাচ্ছিলাম। মা আমাকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে তাঁর সব বইয়ের 'সমগ্র' হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। আমি তাঁর লেখা পড়ে পড়ে শেষে মনে মনে তাঁকেই চেয়ে বসলাম। সে হয়ে গেল আমার কল্পলোকের-মানসলোকের ছায়া, প্রতিচ্ছবি, মানুষ! তাঁকে নিয়ে কত ভাবনা আমার!
মাঝেমধ্যে যখন দেখি, হাতায় ফ্রিল দেওয়া অজস্র গহনায় জবরদস্ত নারী সেজে রবিবাবুর নাটকে-গল্পে অভিনয়শিল্পী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন ভাবি, তাঁর সময়ে হয়তো অমন কাপড়-গহনা-খোঁপা ব্যবহৃত হতো। কিন্তু তা কি তাঁর পছন্দ ছিল? তাঁর আঁকা ছবিতে কিন্তু ও রকম ফুলবিবি-তুলতুলে সুন্দরীদের দেখা যায় না। বরং ওই ঘোমটা-খসা চিকন কালো হরিণ চোখের নিরাবরণ তরুণীটিই তাঁর মনে বিশাল কবিতা বা সুরের জন্ম দিয়েছিল। জমিদার বংশের মানুষ হয়েও জানতেন, বেশি থাকলে মানুষ ফেলে ছড়িয়ে রাখে, আর অল্প হলে তার পুরোটার সদ্ব্যবহার করে। দুঃখই মানুষকে সুখানুভূতি জোগায়। বরং সুখই মানুষের মননে ও জীবনে চর্বি জমায়। তাঁর এই দর্শনগুলো আমি একান্ত বাধ্য ছাত্রীর মতো মেনে চলি, বিশ্বাস করি, গ্রহণ করি। স্রষ্টার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে ভাবনায় ফেলে দেয়। আমি বুঝতে পারি না, 'যাব না এই মাতাল সমীরণে আজ/জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে' বলে স্রষ্টাকে কী বোঝাতে চেয়েছেন। জীবন, সৃষ্টিকর্তা, পৃথিবী, ঋতু, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, শব্দতরঙ্গ, স্বর্গীয় ফুলের হাওয়া, অনুভব_সবকিছুকে এক সুতায় গেঁথে তাঁর কবিতায়-গানে অবলীলায় অথবা ভীষণ লীলাখেলায় রাঙিয়ে তুলে নিজে নির্বিকার মুণি-ঋষির ভাব ধরেছেন। কল্পলোকে আমি তাঁর নায়িকা। সেথায় তাঁকে আমি ভানু বলে ভাবি। সে যদি সারাক্ষণ ওই ঋজু ভঙ্গিতে ক্যালেন্ডারের পাতায় দাঁড়িয়ে থাকে তো আমার চলে? নাহ, এ আমার নিছক ভাবনা। কত শিক্ষা, কত ভাবনার খোরাক, কত সুর-কবিতা এই জীবনের নিঃসঙ্গ দুপুরগুলো জবাফুলের স্পর্ধা নিয়ে রাঙিয়ে দিল আমাকে। এ তো ভানুরই অবদান।
আমি বিশ্বাস করি, কবিদের থামিয়ে দিলে পৃথিবী বোবা হয়ে যাবে। আর ভানু সিংহ? সে তো সূর্য, রবি_রবির কিরণ নয়, আস্ত রবি। সে না থাকলে এই গান-সুর-কাব্যের পৃথিবীই আঁধার হয়ে থাকবে। মেঘেরা গোমড়ামুখে উড়ে বেড়াবে না। কারণ, আলো না থাকলে মেঘ দেখাই যায় না। তাঁর জীবদ্দশায়-মরণোত্তরকালে যেমন কিছু হিংসুটে মানুষ তাঁকে নিয়ে কিছু (হাস্যকর) সমালোচনা করায় আমি বিরক্ত, তেমনি তাঁর গান যখন কেউ মুখে সুপারি দিয়ে অহঙ্কারী ভঙ্গিতে গায়, তখন আমি খুব রেগে যাই। আরে এ যে রবিবাবুর গান! এ তো গলানো সোনার মতো প্রবহমান, উজ্জ্বল, স্পষ্ট, একরোখা, কিন্তু সরল। তাঁর সবকিছু তাঁর মতোই অনায়াস হওয়া চাই। নইলে তিনি যে রাগ করবেন।
শিশু বয়সে-কিশোরবেলায় তিনি আমাকে যেমনভাবে ভাবনার খোরাক-ছন্দ-সুর দিয়েছেন, এই পরিণত বয়সে তার চেয়ে আরো বেশি পাচ্ছি। মৃত্যুচিন্তাকে অনায়াস কামনা করার স্পর্ধা, দুঃখকে জয় করার দর্শন, জীবনকে লোভ না করার ধৈর্য শিক্ষা সবার এবং নিজের অলক্ষে পেয়ে যাচ্ছি দিনক্ষণ-দিনমান ধরে। শুধু মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার মনের কথা ভানু বাবু জানল কেমন করে? আর আমার না বলা কথা সব তাঁকেই বলতে হবে? আরেকটি প্রশ্ন অমীমাংসিতই থেকে যায়_তাঁর আলোময় জীবনের প্রতিফলন, তাঁর লেখা-সুর-ছন্দ, যা সূর্যেরই নামান্তর। তাহলে তাঁর আঁকা ছবিতে এত দুঃখ, এত কালো, এত অসামঞ্জস্যপূর্ণ সৌন্দর্য কোত্থেকে এল? নাকি ওগুলোই তাঁর জীবনীশক্তির আধার? তাঁর হৃদয়ের পাশে সোনার কৌটায় সাঁটা প্রাণ ভোমরা? কে জানে!
আমি খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট হই। রবিবাবু যদি আর কোনো কিছু না লিখে শুধু একটি কথাচিত্রই আঁকতেন, আমি তাতেও তাঁকে সমান শ্রদ্ধা করতাম। তিনি যেভাবে বলেছেন, 'আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি', এমনটা আর কে বলবে? কেউ না। তাঁর লেখা তো লেখা নয়, যমুনার জল। যা তরল-সহজ, কিন্তু বাঁক নিয়ে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে তারপর ক্ষান্ত হয়। গনগনে-টগবগে লাভা বুকে নিয়ে দীর্ঘকাল আমাদের মিঠা রোদ্দুরের আরাম দিয়ে যাচ্ছেন; নিয়ে যাচ্ছেন কাল থেকে কালান্তরে। তাঁর কথা তাঁকেই বলতে চাই_'আমার সোনার রবীন্দ্রনাথ/আমি তোমায় ভালোবাসি'। তাঁর জন্ম, জীবনশিক্ষা, বিদ্যাশিক্ষার জন্য বিলেত যাওয়া, সেখান থেকে আরো শানিত ও পরিপূর্ণ হওয়া, অনন্তর লিখে যাওয়া, নতুন নতুন তাল সুর সৃষ্টি করা, তাঁর কবিতা বিশ্বের তাবড় তাবড় অনুবাদকের হাতে পড়া, নোবেল প্রাইজ পাওয়া, ব্রিটিশদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে নাইট উপাধি বর্জন করা, তার আগের-পিছের হিংসুটে কবি লেখকদের দ্বারা সমালোচিত হওয়া, জমিদারি কাজকর্মে মনোনিবেশ করা_এগুলো তো অনেক বড় বড় গবেষক গবেষণা-পর্যালোচনা করেছেন। সেগুলো বই আকারে একবারেই হাতে পাওয়া যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমি একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে পরখ করি, চেখে দেখি, স্বাদ নিই পরম তৃপ্তিতে। আর ভাবি, ডিকশনারিতে এমন কোনো শব্দ আছে কি, যা তিনি ব্যবহার করেননি? বা এমন কারো মনের কথা কি বাকি আছে, যা তিনি ব্যক্ত করেননি? তাই আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ হলেন মহাকালের কণ্ঠ, যা হাওয়ায় ভাসিয়ে মহাপ্রলয়ের কাছে গিয়ে ঠেকবে। আমরা, আমাদের প্রজন্ম থাকবে না; কিন্তু তাঁর উপস্থিতি থাকবেই। সেটা এই ইন্টারনেটের যুগেও। বেশি ভালোবাসলে একটা অধিকারবোধ জন্মে। তেমনি অধিকারবোধ থেকেই কল্পনায় চাঁদে চলে যাই। রুপালি জালের সুতায় লিখি_
'কুসুম কুসুম ঘুম; রাত্রি নিঝুম
অনুভবে রবিবাবু দিয়ে যায় চুম
পাশাপাশি বসি; আধো লাজ হাসি
ললাটে লেপ্টে গেল লাল কুমকুম
রাতের আঁধার, নীরব সাঁতার
সাঁতরে পেঁৗছে তুলি লাল পদ্মফুল
রবিবাবু এসে, ভুলে! ভালোবেসে
কোনালে সাজিয়ে দিল এই কুন্তল।'
রবিবাবুর ঢঙে এমন নকল করে কিছু লিখলে আর এ দেশে বাস করতে হবে না বাপু! তাঁর গান গাইতে নিঃশ্বাস এদিক-ওদিক হওয়ারই জো নেই! কিন্তু অন্য কিছু যে লিখব, তার তো উপায় নেই। তিনি তো সুই থেকে ব্রহ্মাণ্ড_সবই কলমের কালিতে ডুবিয়ে নিয়েছেন। তাই মাঝেমধ্যে চিৎকার করে বলি_
আমার কথা? ওরে, কইবো কেমন ক'রে
সকল কথা কইতে আমার হৃদয় কেমন করে
কেমনে থামাই আমি ভানু সিংহরে_হাঃ হাঃ হাঃ।
থাক, আর কিছু কইব না। শুধু শেষে বলি_ভালোবাসি তোমায়, রবীন্দ্রনাথ হে।
No comments