হাসান আজিজুল হকের সাক্ষাৎকার-ছোটগল্পের আলাদা রাস্তা

হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশের সাহিত্যরুচির প্রেক্ষাপটে এক বিস্ময়কর চরিত্র। শুধু গল্পচর্চা করেও যে দেশের অন্যতম প্রধান লেখকে পরিণত হওয়া যায়, তিনি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, আগুন পাখি প্রভৃতি।


বাংলা একাডেমী, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদে অধিষ্ঠিত।

প্রশ্ন: আপনি দীর্ঘদিন গল্প লিখছেন না, অথচ গল্প আপনার লেখালেখির প্রিয়তম মাধ্যম। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাহিত্যসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ-বক্তব্য-সাক্ষাৎকার দেওয়া চলছেই। এটাকে কি এক ধরনের সমর্পণ বলব—বিশেষ কোনো প্রণোদনায়?
হাসান আজিজুল হক: সমাজে এখন যে চাঞ্চল্য জেগেছে, ভালো কিংবা মন্দ দেখি, তাতে করে আর চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। অনেক বিষয়ে কথা বলতেই হচ্ছে। অনেক নতুন নতুন সংকট দেখতে পাচ্ছি—আমাদের সাংস্কৃতিক সংকট-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট; এসব বিষয় নিয়ে লেখা অনেক সময় দায়িত্ব বলে মনে করেছি। ফলে এ জাতীয় লেখা এখন আমার সৃজনশীল লেখার চেয়ে বেড়ে গেছে। তাই বলে সৃজনশীল লেখা পেছনে পড়ে যায়নি। সামনেই আছে কিন্তু আপাতত আমি সেসব স্থগিত রেখেছি। যেমন ছোটগল্প দীর্ঘকাল লিখেছি। তা ছাড়া আরও একটা কথা আছে, যেটার চর্চা তুমি করছ, ছোটগল্পের, লেখক হিসেবে সব সময় তোমাকে সচেতন থাকতে হবে, তুমি কি পুরোনো খাবারই জাবর কাটছ, নাকি নতুন তাজা কোনো কিছু তৈরি করতে পারছ। আমার মনে হয় যেন শেষ গল্প লেখার পরে, আমার কোথায় যেন সমাপ্তি ঘটে গেছে। ছোটগল্পের জন্য আমাকে আলাদা একটা রাস্তা খুঁজতে হবে। সেটাতে আমার কোনো ক্লান্তি নেই বা তাতে আমার মনোযোগ আসবে না, তা নয়। আমি ওটা স্থগিত রেখেছি। কিন্তু ইতিমধ্যে আমার অন্যান্য লেখা, সেসব সৃজনশীল লেখাই, ওসবের এত উপলক্ষ চলে এল যে লিখেই ফেলতে হলো। মাঝখানে উপন্যাস লেখার দিকে একটু ঝুঁকে পড়লাম। তারপরে স্মৃতিকাহন নামের একটা লেখা শুরু করে দিলাম। লেখাটা আমাকে টানছে এবং আমি দেখলাম যে এটা লিখতে হবে। কাজেই আপাতত এখানেই আমার কলম চালনাটা হয়েছে আর কি।
প্রশ্ন: আপনি একবার বলেছিলেন, গল্প আমার প্রিয় মাধ্যম। কাজেই এটাকে আমি সাবধানে ব্যবহার করতে চাই...
হাসান আজিজুল হক: এই কথাটা কীভাবে আমি বলেছি এবং কীভাবে তুমি নিয়েছ জানি না। প্রিয়তম মাধ্যম মানে, যেটাকে নিয়ে যখন লিখব তখন সেটাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করাটাই আমার স্বভাব। আমি বলেও থাকি, লেখালেখিটা একদিক থেকে আনন্দের বিষয়। কিন্তু যখনই তুমি লেখালেখির কাজে নিযুক্ত হয়েছ, তখন কিন্তু খুব কষ্টদায়ক অনুভূতির ভেতর দিয়েই যেতে হয়। কাজেই লেখাটা একদিক থেকে বেশ কষ্টের এবং যন্ত্রণার বিষয়ও। এটা মাথার ওপরে ভীষণভাবে চেপেও থাকে। তার ফলটা এই দাঁড়ায়—যে মাধ্যমেই আমি কাজ করতে যাই না কেন, সেটা আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে।
প্রশ্ন: ‘শকুন’ গল্পটি লেখার আগের সমস্ত লেখা কিংবা আপনার উন্মেষকালে লেখা উপন্যাস বৃত্তায়ন; এটি যে আপনারই লেখা তা অস্বীকার করতে পারলে আপনি খুশি এবং ব্যক্তিগতভাবে আপনি তা-ই করেছেন। পরিণত এবং হিসাব মেলানোর এই প্রান্তে এসে ব্যাপারটাকে যদি ব্যাখ্যা করেন!
হাসান আজিজুল হক: আমি যা-ই বলে থাকি না কেন, শেষ পর্যন্ত আমি এক জায়গায় বলেছি, আমার সব রকম লেখা, তা পাঠকের চোখে পরিণত লেখা, কাঁচা লেখা; সব লেখাই, শেষ পর্যন্ত আমি অস্বীকার করতে পারি না। কেননা, ওই সত্যটা ঠিক স্থির দাঁড়িয়ে থাকে—এসব আমারই লেখা। কাজেই বৃত্তায়ন যে আমারই লেখা, তা আমি কোনো দিন অস্বীকার করিনি, করবও না। আমি লেখক হিসেবে যেখানে গিয়েছি, পৌঁছেছি লেখাতে, যে পথ থেকে পেছনে ফিরে এসেছি; এমনকি যে পথটা ধরে আমি বাকি পথ হাঁটিনি, সেই পথটাতে আমি ফিরতে চাইছিলাম না। সেই কারণে ওটাকে পুনরুজ্জীবিত করা, হয়তো এটাকে প্রকাশ করে আবার পাঠকের সামনে আনাটা, এটা আমার কাছে তেমন আগ্রহের বিষয় মনে হয়নি। কিন্তু যা-ই হোক পাঠকের আগ্রহ দেখা দিয়েছে এবং পাঠকের তরফ থেকে প্রকাশের আগ্রহ দেখা দিয়েছে। তাঁরা এটা বের করেছেন। সেই জন্য ও কথা আমাকে কেউ যেন না জিজ্ঞেস করেন, ওইটার পরে এটা; ওটা ভালো এটা খারাপ। এটার জবাব তো আমি দিতে পারব না। হ্যাঁ, ‘শকুন’ আগে লেখা হয়েছে, বৃত্তায়ন তার বেশ কিছু পরে লেখা হয়েছে। তবু বৃত্তায়নকে আমি স্বীকার করতে চাই না। ‘শকুন’ সম্পর্কে আমার সে রকম কোনো বক্তব্য নেই।
প্রশ্ন: আপনি একবার বলেছিলেন, ‘আমি বানিয়ে গল্প লিখতে পারি না। বাস্তবতাটা যা চোখে দেখি, সেটার বর্ণনা দিয়ে আমার গল্প বানানোর অক্ষমতাকে ভরিয়ে তুলতে চাই।’ আমাদের গল্প ভুবনের রাজপুত্র হাসান, এটা কি বিনয় করে বলছেন?
হাসান আজিজুল হক: যদি এই কথাটা বলেই থাকি, তাহলে এটা পুরোপুরি বিশ্বাস করেই ফেলো না। এটা আবার নতুন করে বলা কেন? গল্প যেটাকে তৈরি করা বলে আর কি, সেভাবে তৈরি করা কোনো গল্পই আমার নেই। আমি সেই কথাটা খুব ভালো করে বলতে চেষ্টা করেছিলাম যে আমার কোনো উদ্ভাবনী ক্ষমতা নেই। এখন এটা বিনয় না গূঢ় অর্থে সত্য, সেটার বিচার করুক পাঠক। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে আমি লেখার সময় যে বিষয়টা বুঝতে পারি—লেখাটা কেমন করে এগোচ্ছে। এবং তাতে বুঝতে পারি যে আমার নতুন নতুন উদ্ভাবন, ঘটনা এবং ঘটনার ক্রম সাজানো, একটা কৌতূহল তৈরি করা ইত্যাদি জিনিস সক্রিয়ভাবে কাজ করে না। আমার মনে হয়, আমার লেখার সময় লেখার অন্য বিষয় আছে এই গল্প তৈরি করা ছাড়াও; তাতে যদি একটা গল্প দাঁড়িয়ে যায়, যাবে। কিন্তু গল্প তৈরি করার দিকে আমি কলমটাকে চালনা করি না।
প্রশ্ন: আপনার জন্ম তো গ্রামে। সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর পরিবারেই বেড়ে ওঠা; আপনার এক চাচা কেবল বর্ধমান শহরে অফিসে কাজ করতেন। আপনি নিজেও প্রায় সারা জীবন রাজধানী থেকে দূরে থেকে গেলেন। কিন্তু খ্যাতি, সুনাম এবং সৃজনশীল প্রজ্ঞার অলৌকিক ঐশ্বর্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে গেলেন...
হাসান আজিজুল হক: বিশ্বময় ছড়িয়েছি না মদনভস্ম হয়েছি, তা আমার পক্ষে বলা কঠিন। একা একা যখন ভাবি, তখন মূলত নিজের নানা রকমের সীমাবদ্ধতার কথাই মনে হয়। এটাও ঠিক বিনয়ের কথা নয়। আমি নিজেই বুঝতে পারি যে আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমার সেই অর্থে উল্লেখযোগ্য কোনো বিশেষ ক্ষমতা কিছুমাত্র নেই। আমি এখনো জানি না, আমি কতটা পাঠকপ্রিয়। জানা নেই। আমার জানার আগ্রহও খুব কম। তবে এটা ঠিক, পাঠকেরা যখন আমাকে কোনো কিছু জানায়—এটা পড়েছে এবং ভালো লেগেছে, তখন আমার নিজের কাছে খুব ভালো লাগে। ভালো লাগে বলেই যে খুব আত্মগরিমায় ভুগতে থাকি, তা কিন্তু নয়। এটা এক ধরনের ভালো লাগা। মানুষের বহু কাজ করে ভালো লাগে, তৃপ্তি লাগে—খুব ভালো একটা খাওয়া হলে তৃপ্তি লাগে। খুব ভালো একজন প্রেমিকা জুটলে ভালো লাগে—ঠিক তেমনি আর কি। অনেকে কিন্তু এ কথাও বলেছে, হাসান আজিজুল হক ঠিক যতটা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য, তারচেয়ে অনেক বেশি প্রশংসা পান। আমার মনে হয়, এ কথা যদি কেউ বলে থাকেন, তিনি যে অশুভ সত্য বলেছেন তা মনে হয় না। হয়তো সত্যিই বলেছেন। হয়তো সেটা যুক্তিহীন, ভালোবাসা বা প্রীতি আমার কপালে জুটেছে। সেটার কারণ আমিও জানি না।
প্রশ্ন:আত্মজা ও একটি করবী গাছ গল্পের ঘটনা, ভাষা, পরিবেশ ফুলতলার। কিন্তু এর আবহ-ইঙ্গিত ১৯৪৭-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জীবনাভিজ্ঞান?
হাসান আজিজুল হক: গল্পটি লেখা হয়েছে ১৯৬৬ সালের দিকে। আর তুমি যেটা বলছ, খানিকটা ঠিক। এটা হচ্ছে ’৪৬ সালে ভারত বিভাজন এবং বঙ্গ বিভাজন হওয়ার পরের যে ব্যাপার, গল্পটা পড়লে তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। কোন সম্প্রদায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেই হিসাব আমি করব না। এখনে উন্মুল হওয়ার যে বেদনা, সেটাকে আমি ধরার চেষ্টা করেছি। এই বেদনার অর্থই হচ্ছে মানুষের নিজের কাছে নিজের মনুষ্যত্ব, নিজের মর্যাদা-অস্তিত্ব প্রায় হারিয়ে ফেলা। তার মানে চাপা একটা বিষ, সমাজের ব্যাধির একটা দুর্গন্ধ গল্পটি যখন লিখি, তখনো রয়ে গিয়েছিল। এরই প্রকাশ আত্মজা ও একটি করবী গাছ।
প্রশ্ন: আত্মজা ও একটি করবী গাছ
এই গল্পটি লেখার সময় ভাষার ব্যবহারে আপনি কি বিশেষ সচেতন বা যত্নবান ছিলেন? যেমন—অল্প বাতাসে একটা বড় কলারপাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়...
হাসান আজিজুল হক: তোমাদের জীবিত লেখকদের এসব প্রশ্ন করেছ কোনো দিন? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবিত থাকতে কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছে—আচ্ছা, গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিলুম আর আকাশের দেবতা তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন! তার মানে এই বাক্যে যে বজ্রপাত, বজ্রপাতটাকে আপনি যে এভাবে বর্ণনা করলেন, এটা কি আপনি ভেবেচিন্তে করেছেন? আমার খুব ইচ্ছে হয় জানতে, মানিক কী জবাব দিতেন। মার তুলতেন কি না কে জানে! আমি লিখতে শুরু করেছি, এক লাইন লিখলাম, তারপরের লাইন লিখলাম। আচ্ছা আমি কেমন করে বলব বলো তো, এই জিনিসের বর্ণনাটা আমার মাথায় কী করে এল? যারা লেখক তারা জানে, বাক্যের পরে পরের বাক্যটা ঠিক কী করে আসবে সে জানে না। পরের বাক্যটা যদি ঠিক করা থাকত তাহলে তো সে মুখস্থ করা জিনিস লিখত। একজন লেখক যখন প্রথম বাক্যটা লেখে, তখন সে যে কী বিচ্ছিরি একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে লেখে যে কেমন করে শুরু করা যায়—এটা তো একটা সমস্যা।
এই সমস্যাটা হতে পারে যে এক শ রকমভাবে বাক্যটা আসতে পারত, আর গল্পটা এক শ রকম হতে পারত। লেখা যখন শুরু হয়ে গেল তখন একটা কোপ পড়ে গেল তোমার ভিত্তির। পরের কোপটা কিন্তু অত কঠিন হবে না, ওটার সঙ্গে রিলেটেড হবে। প্রথম বাক্যটা আসার পরেই ওর সঙ্গে আরেকটা বাক্য আসবে। অনেক সময় সেই বাক্য আসতে গিয়ে কী কঠিন অবস্থা হয়—আর আসছে না। আমি এ রকম একটা বাক্য আসছে না বলে দুই দিন লেখা বন্ধ রেখেছি। আবার আমি কখনো ভাবিওনি যে এই বাক্যগুলো আসবে।
প্রশ্ন: পরিবেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে আপনি কি ডেফিনেট একটা উপমার প্রয়োগ করেছেন, যাতে হুবহু ছবিটা চলে আসে? কলার পাতার দুলুনিটা দেখা যায়? নাকি মনোহর বাক্য লেখার প্রয়াস?
হাসান আজিজুল হক: সাধারণভাবে আমার অভ্যাস হচ্ছে, ক্যামেরা থাকলে ফটো তুলে যে জিনিসটা দেখাতাম, ক্যামেরা না থাকার ফলে লিখতে গিয়ে জিনিসটাকে যদি অবিকল তুলতে পারি, দুই ছবি যদিও এক রকম হবে না; ক্যামেরার ছবি অবিকল এবং যান্ত্রিক লেখার ছবি তেমন নয়। ছবিই সেটা, আমি সেই ছবিটা আনতে চাই। চিন্তা করার দিকে আমি যাব না। চিন্তা করার জন্য যে ছবিটা দরকার, সেই ছবিটা তুলি। মানুষ কত কষ্টে আছে, সেটা বলার আমার দরকার নেই, কষ্টের ছবিটা দেখাই। লেখাও ছবি, কিন্তু ক্যামেরার ছবি নয়। লেখার ছবি থেকে তুমি হয়তো এক হাজার ছবির অনুভূতি পেয়ে গেলে। ক্যামেরার ছবি ঠিক ওভাবে আসে না। আমি লিখতে চাই, অবিকল ছবিটা আঁকলে আমার উদ্দেশ্য সফল হবে। সে জন্য যে উপমাটা দিই, সেটা কতটা আমার কাজে সহায়ক হচ্ছে তা বিবেচনা করি। মনোহর বাক্য লেখার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় আমার নেই।
প্রশ্ন: অথবা ‘শকুন’ গল্পে অন্ধকারের বর্ণনা দিতে গিয়ে আপনি লিখেছেন—‘অনঢ় হয়ে আছে অন্ধকারের দলাটা। লুকিয়ে যাওয়ার একটা ভাব, পারলে কোনো বহু পুরনো বটের কোটরে, কোনো পুরীষ গন্ধে বিকট আবাসে, কোনো নদীর তীরে বেনাঝোপের নিচে শেয়ালের তৈরি গর্তে লুকিয়ে যাওয়ার মতলব’...
হাসান আজিজুল হক: ছবি আসছে? এই ছবিটা কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করছে? একটা অস্বস্তিকর—কার দিক থেকে, যে শকুনটা অন্ধকারের দলার মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে, সে পাখিটারও যেন মনে হচ্ছে লুকাতে পারলে ভালো হতো। একটু পরে আমার পেছনে লাগবে সব। এই ছবিগুলো আমি ভেতর থেকে চিন্তা করি। ফলে কী হচ্ছে—একটা পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে। এখনো আমি সেভাবে বলতে পারব না যে আমি ভেবেচিন্তে লিখেছি। তুমি যখন প্রশ্নটা করলে, আমার মনে হলো, ও আচ্ছা, এটা পড়লে তো এমন মনে হতে পারে।
প্রশ্ন: আপনি আসলে কবিতার মানুষ, এটা বোঝা যায় গল্পে ব্যবহূত গদ্যের ছন্দে। কবিত্বের শক্তিই যেন অনেক গল্পকে ঈর্ষণীয় প্রশংসার স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। যেমন ‘জীবন ঘষে আগুন’ গল্পের কথা বলা যায়। এই বিবেচনাকে আপনি কীভাবে নেবেন?
হাসান আজিজুল হক: তাহলে একটা কথা বলি, আমি কবিতা লিখিনি। কারণ, আমাদের যাঁরা বড় বড় কবি আছেন, পাছে তাঁদের ভাত মারা যাবে। (অট্টহাসি) এই কথা আমি কত শুনব বলো তো!
প্রশ্ন: বিভিন্ন সময়ে আপনি বেশ কিছু কবিতা লিখেছেনও। যেগুলো নানা মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে...
হাসান আজিজুল হক: কখনো কখনো মনে হয়, একটু লিখি। ছেলেবেলায় তো সবাই কবিতার চর্চা করে। আমিও একসময় চর্চা করতাম। আজকাল কোনো কোনো ভাবনা হয়, চট করে চলে আসে কথাগুলো যেন এক্ষুনি লিখে ফেলতে হবে। হয়তো দুপুরবেলা কল্পনা করেছি—একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, হয়তো প্রেসের মালিকের হাত থেকে একটা অক্ষর ছিটকে পড়ে গেল। সেই সময় শহীদ মিনারে তাঁর সন্তান গুলিবিদ্ধ হলো। তখন টুকরো করে কবিতার আকারে লেখার চেষ্টা আর কি।
প্রশ্ন: আপনার গল্প-উপন্যাসের তুলনায় প্রবন্ধের সংখ্যা বিপুল। বিশেষ করে বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্য নিয়ে আমাদের কথাসাহিত্যের প্রধান নক্ষত্রদের নিয়ে আপনি কঠিন, নির্মোহ, রাগী এবং অসামান্য সৃজনশীল প্রবন্ধ লিখেছেন। আপনার সব মতের সঙ্গে একমত না হলেও এসব লেখার যুক্তি খণ্ডন করা কঠিন। এই কাঠিন্যময়তার আড়ালে কি গল্পকার হাসান কলকাঠি নাড়েন?
হাসান আজিজুল হক: মননের চর্চাকে আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এটাকে আমি তথাকথিত বিজ্ঞানচেতনা বলব না। মানুষ এই একটামাত্র জিনিস পেয়েছে, যেটা অসাধারণ, যার কোনো তুলনা হয় না। অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে গিয়ে নিজেকে চেনা যায়। তখন বাংলাদেশ এসে পড়ে। এই দেশটাকে নিয়ে আমি ভাবব না? এখানে আবেগ ঢুকিয়ে দিলে চলবে? কাজেই এ জন্য আমি ভীষণভাবে মননশীলতা চর্চা করতে পছন্দ করি। ফলে আমার পড়াশোনার একটা ব্যাপক অংশ সৃজনশীল সাহিত্য নয়, অসৃজনশীল সাহিত্য। যেটাকে এককথায় মনন চর্চা বলা যায়। এটাকে বলা যেতে পারে দর্শনচর্চা-ইতিহাসচর্চা-সমাজচর্চা এবং এটা আমি এক ধরনের দায় থেকেও করি। যে সমাজ ও রাষ্ট্রে আমি বসবাস করি, সেখানে বসে আমার ভেতর দায় কাজ করে। আমার ক্রোধ হয়, ক্ষোভ হয়, করুণা জাগে, তাই এগুলো করে যাই।
প্রশ্ন: আপনি এক আলোচনায় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন, সাহিত্য দিয়ে আপনারা কী করবেন? নিজের স্বপক্ষে কিছু যুক্তিও ছিল আপনার। সাহিত্য সম্পর্কে আপনার সাম্প্রতিক ভাবনা কেমন?
হাসান আজিজুল হক: আমার সাম্প্রতিক ভাবনা চিরকালের ভাবনাই। সাহিত্য থেকেই সব হয়। তুমি যদি মনে করো সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়বে, তাহলেও তোমাকে মার্কসের সাহিত্য পড়া উচিত। পড়া ছাড়া মানুষ নিজের চিন্তাটাকে প্রকাশ করবে কোথায়? এই সমস্ত কথার পেছনে কী ক্ষোভ আছে তা আগে জানতে হবে। ক্ষোভটা কেন—সাহিত্য দিয়ে কী করব? সত্যিই তো। কেন বলছি, সাহিত্য দিয়ে আসলে কেউ কিছু করে না। সাহিত্য দিয়ে আজকে বাংলাদেশে কিছু হয় না। কেউ তোয়াক্কাই করে না। তুমি যে কাগজে কাজ করো, সেখানেও দেখবে আট পাতার সাহিত্য আর ৫০ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন। আমি যে বলেছি, সাহিত্য দিয়ে আপনারা কী করবেন? আমি কি অন্যায্য প্রশ্ন করেছি? তার মানে কি এই সাহিত্য দিয়ে কিছু পাওয়া যাবে না? তা তো নয়।
প্রশ্ন: মানুষ বয়স বাড়লে বুঝতে পারে কৈশোরের দৈর্ঘ্য কতটা। কারণ, সমস্ত জীবনের একদিকে এবং কৈশোরের দৈর্ঘ্য একদিকে রাখলে পাল্লা কৈশোরের দিকেই ভারী হবে। এটি আপনারই কথা। আত্মজীবনীর দুটি খণ্ড—ফিরে যাই ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত তো বেরিয়ে গেল, কিন্তু আপনি যে দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন, তার এক-চতুর্থাংশও তাতে আসেনি...
হাসান আজিজুল হক: দুই খণ্ডে এক-ষষ্ঠাংশও আসেনি। আমি যদি ক্রমাগত লিখে যাই, কোনো বিঘ্ন যদি না ঘটে, কয় খণ্ডে শেষ হবে আমি বলতে পারি না; তবে আরও চার খণ্ড হওয়ার কথা। আমার সাধারণ কর্মজীবন আমি লিখব না। পূর্ণ তরুণ বয়স যেটা, সেখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে লেখাটা বন্ধ করে দেব। তার মানে ১৯৬০ পর্যন্তও যদি লিখি, তাহলেও আরও কয়েকটি খণ্ড লাগবে। আমি আপাতত যেটা করেছি, সেখানে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত আছে। অর্ধেক জীবনী বলো আর যা-ই বলো ভেতরের তাগিদ এটুকু।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মাসউদ আহমাদ

No comments

Powered by Blogger.